বরেন্দ্র অধ্যুষিত নওগাঁ জেলাঃ গড়ে উঠতে পারে পর্যটন শিল্প এলাকা ॥ হাসান শাহরিয়ার পল্লব ॥
রাজা যায় রাজা আসে কিন্তু থেকে যায় তার গড়া স্মৃতিচিহ্ন, পরের সময়কালে যা হয়ে যায় ইতিহাস! দীঘির মধ্যখানে দেখা যাচ্ছে যে, বিশালাকার স্মৃতিস্তম্ভ তা সেই স্বাক্ষই প্রমান দেয়। এই বিশালাকার দীঘির ঠিক মধ্যখানে একটি স্তম্ভ। অনেকের জানা-অনেকের অজানা। অজানাদের জানাতে আজকের আমাদের এই প্রতিবেদন ।
ঐতিহাসিক দিবরদীঘির পটভূমি এক নজরে দেখা যাক:- নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলায় দিবর ইউনিয়নে এই ঐতিহাসিক নিদর্শন অবস্থিত। নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলা হতে ১৬ কিলোমিটার পশ্চিমে সাপাহার উপজেলা যাত্রাপথে সড়ক হতে উত্তর দিকে অগ্রসর হলেই দেখা মিলবে এই ঐতিহাসিক দিবরদীঘি। ইতিহাস থেকে জানা যায়, দিবরদীঘি নামের এই বিশালাকার জলাশয় এবং জলাশয়ের মাঝখানে স্তম্ভটি একাদশ শতাব্দীর কৈবত্য রাজার দিব্যক তার ভ্রাতা রুদ্রক পুত্র প্রখ্যাত নিপ্রতিভ ভিমের কৃর্তি হিসেবে পরিচিত। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, পাল শাসণামলে দ্বিতীয় মহি পালের ১০১৭-১০৭০ খৃষ্টাব্দে তার আমলের শাসকদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে বরেন্দ্রভূমির অধিকাংশ আমত্য বরেন্দ্রভূমির বংশভূত সন্তানদের নিয়ে দিব্যক পাল রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং দ্বিতীয় মহি পাল কে হত্যা করে এবং দিব্যক সর্বসাধারনের সর্বসম্মতি ভাবে বরেন্দ্র অধিপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। স্বল্প সময়ে শাসণকার্য পরিচালনা করলেও দিব্যক মৃত্যুবরণ করলে প্রথমে রুদ্রক ও পরে রুদ্রক পুত্র ভিম সিংহাসন আহোরণ করেন। এই কৈবত্য বংশীয় রাজা তিন বংশীয় ২৫ থেকে ৩০ বছর শাসণ করেন বলে জানা যায়। দিব্যক রাজা তার ঐতিহাসিক মুহূর্ত ধরে রাখার জন্য সর্বসাধারনকে নিয়ে এই বিজয় স্তম্ভ নির্মাণ করে, যা কৈবত্য রাজাদের এবং পাল রাজাদের অত্যাচারের অবসান হয় বলেই বিবেচিত হয় ইতিহাসে। ১৮৭৯ সালে স্যার আলেকজান্ডার কনিকহাম এই দীঘি পরিদর্শন করেন। দিবরদীঘির জলাশয়ের জমির পরিমাণ ছিল ৫৫০ বিঘা বলে জানা গেছে। কালের সময় গড়িয়ে এবং পুন: খনন এর অভাবে জলাশয়ের পরিমাণ এসে দাড়িয়েছে বর্তমানে ১৯ একর ২৪ শতাংশ যা প্রায় ৬০ বিঘা। ( ১৯৮৫ সালে সরকার একবার এ দীঘির সংষ্কার কাজ করেন)। দিবরদীঘির এই জয় স্তম্ভ হাজার বছরের বাংলা ও বাঙ্গালীর শৌর্যবিত্তের প্রতীক হিসেবে আজও দণ্ডায়মান। এটি একটি অখণ্ড গ্রানাইড পাথর কেটে দিয়ে তৈরি করা হয়। স্তম্ভের চারটি কোণ থাকা অবস্থায় উপরিভাগে তিন তিনটি রেখা রয়েছে যা স্তম্ভটির সৌন্দর্য অনেকখানি বৃদ্ধি করেছে। স্তম্ভটিতে নানা কারুকার্য স্তম্ভের উপরিভাগে খাঁচকাটা অলংকরন দ্বারা সজ্জিত করা। এ রকম গ্রানাইড পাথরের তৈরি স্তম্ভটি বাংলাদেশের আর কোথাও দেখা যায় না। স্তম্ভটির নানা কারুকার্য এই জয় স্তম্ভটিকে পুরোপুরি জয়ের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে তা বোঝাই যায়। এই বিজয় স্তম্ভটির অখণ্ড পথরের নয়টি কোণ আছে এর এক কোণ থেকে অন্য কোণের দূরত্ব ৯’’। এর শীর্ষ দেশে আছে নানা কারুকার্য যা ব্যহত মুকুট আকারে নির্মিত। বর্ণনামতে, পানির উপরে স্তম্ভটির উচ্চতা ১০ ফুট, পানির ভিতরে ১২ ফুট এবং মাটির নিচে সম্ভবত আর ১০/১২ ফুট কথিত আছে। ঐতিহাসিক দিবরদীঘি এলাকার সৌন্দর্য আপনাকে স্বাগত জানাবে। দিবর যাবার রাস্তার দু ধারে দেবদারু গাছ আপনার মনকে করবে শীতল। বরেন্দ্রভূমিরুপ তথা বরেন্দ্র এলাকার প্রধান আকর্ষণ উঁচু- নিচু টিলা এলাকার সৌন্দর্য আপনাকে বিমোহিত করবে। অন্য দিকে আছে আম, কাঁঠালের বাগান, সামাজিক বনায়নও আছে। বরেন্দ্র অবস্থিত নওগাঁর পত্নীতলায় দিবরদীঘির মাঝখানে স্থাপিত এক ঐতিহাসিক কীর্তি যা কালের স্বাক্ষী হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে নওগাঁ জেলা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের এক অন্যতম জেলা হিসেবে বিবেচিত। “ঐতিহাসিক অনুসন্ধান” যদি একটি বিষয় হয় তাহলে নওগাঁ জেলার পূর্বে বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকে আরম্ভ করে দিব্যক রাজার বিজয় স্তম্ভ পর্যন্ত ৯০ কিলোমিটারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক স্থান আটটি। এই ঐতিহাসিক স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম, দিবরদীঘি, পালযুগে আমাইর দীঘিকে আম্বাজ শহর যা সোনাভান পুঁথিতে এ শহর ও দীঘির নাম পাওয়া যায়। বাঁকি গুলো হলো, মাহিসন্তোস (তাকিশা-টাকশাল), আলতা দীঘি, ভীমের পান্টি, জগদল বিহার, দুবলহাটি রাজবাড়ি, জবাই বিল, ও প্রখ্যাত পাহাড়পুর। “কাঞ্চনদীঘি” নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার নওগাঁ-নজিপুর পাকা রাস্তার পার্শ্বে এবং আত্রাই নদীর তীরে অবস্থিত, এখানে রয়েছে পীর জহর উদ্দিনের মাজার। এছাড়া আরও অনেক দীঘি ও প্রত্যেক মৌজায় শতশত পুকুর বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাচীন প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্যতায় একটি নিদর্শন বহন করে, যা দেখতে নয়নাভিরাম। জ্ঞান পিপাসু ও ভ্রমণ পিপাসুগন যে কোন সময় এই বিজয় স্তম্ভ ও এ দীঘির অমায়িক সৌন্দর্য দেখার জন্য চলে আসতে পারেন তবে, সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে এখনও গড়ে ওঠেনি পর্যটন বান্ধব পরিবেশ। পরিস্কার পরিচ্ছনতা, এই ঐতিহাসিক স্থান সম্পর্কিত তথ্যবহুল তথ্যবোর্ড, নিরাপত্তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা, দীঘিকে ভালভাবে উপভোগ করার জন্য নৌকার ব্যবস্থা, বনায়ন কে আরও শক্তিশালি করা, সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেয়া ইত্যাদির মাধ্যমে এই ঐতিহাসিক সমৃদ্ধ স্থানটিকে পর্যটন শিল্প হিসেবে খুব সহজেই একটি মাত্রায় নিয়ে যাওয়া যায় এবং ইতিহাসের বাঙ্গালীর বিজয়ের একটি অধ্যায় সম্যক জ্ঞান পাবেন ইতিহাস প্রেমীরা। বর্তমানে পর্যটন বান্ধব ও উন্নয়ন বান্ধব সরকার সেদিকেই মনোযোগী হচ্ছেন বলেই জানা যায়।
হাসান শাহরিয়ার পল্লব নওগাঁ ব্যুরো, “দৈনিক গণমুক্তি” ফার্মাসিষ্ট ও মানবাধিকারকর্মী।
|