আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে সমালোচনায় সরকার

- আপডেট সময় : ৯৩ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের পর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছরের মূল্যায়নে প্রশংসার তুলনায় সমালোচনার দিকগুলোই বেশি সামনে এসেছে। সরকারের এক বছরের সফলতা-ব্যর্থতার আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে অর্থনীতি, বিচার সংস্কার এবং মব ভায়োলেন্সের মতো ইস্যুগুলো। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সবচেয়ে বড় সফলতা কী এই প্রশ্নে অর্থনীতিতে ব্যাংক, বাজার, রিজার্ভসহ সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সরকার কৃতিত্ব পাচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির, মব ভায়োলেন্স, মৌলিক সংস্কার এমনকি বিচার প্রক্রিয়ার কিছু বিষয়ে সরকারের ভূমিকার নানা সমালোচনা করছেন পর্যবেক্ষক এবং বিশ্লেষকরা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকেই একের পর এক দাবি দাওয়ার আন্দোলন আর বেহাল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন দাবিদাওয়ার আন্দোলনগুলো সবচেয়ে ভুগিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। এক বছরে প্রায় দুইশো আন্দোলন মোকাবিলা করতে গিয়ে রীতিমতো খাবি খেয়েছে ড. ইউনূসের প্রশাসন। আর, জনজীবনের নিরাপত্তা ইস্যুও প্রশ্নবিদ্ধ দারুণভাবে করেছে তাদের।
রিকশাচালক থেকে শিক্ষক-চিকিৎসক, বিসিএস থেকে আনসার-বিডিআর। রাজপথে প্রায় প্রতিদিনই দাবি-দাওয়ার আন্দোলন নাকাল করে তোলে সরকারকে। কখনও কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর, কখনও আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন। বিচিত্র সব আন্দোলন সামলাতে ঘাম ছুটে যায় ইউনূস সরকারের। একটি সমাধান করে কোমর সোজা করতে না করতেই, হাজির হয় আরেকটি।
গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটা নাগাদ চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় ৩৮ বছর বয়সি সাংবাদিক মো. আসাদুজ্জামান তুহিনকে কুপিয়ে খুন করা হয়। একই দিনে গাজীপুর মহানগরের সাহাপাড়া এলাকায় দুর্বৃত্তদের হামলায় এক সাংবাদিক গুরুতর আহত হয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, দুর্বৃত্তরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনেই বেধড়ক মারধর করলেও তা প্রতিরোধে পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ঐ ঘটনার একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সৌরভকে অন্তত সাত-আটজন যুবক ঘিরে ধরে মারধর করছেন। এক পর্যায়ে তার মুখ ও মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করা হয়। থেঁতলে দেওয়া হয় তার পা। এরপর টেনেহিঁচড়ে কিছু দূর নিয়ে যাওয়ার পর আবারও তাকে মারধর করা হয়। রাস্তার ওপর রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকেন সৌরভ। এই ঘটনার পর থেকেই সারাদেশে বর্তমান সরকারের আইনশৃঙ্খলা অবনতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, আগে তো এ আন্দোলন করারও অধিকার ছিল না, আপনি আসলেন আন্দোলন করলেন আপনার ওপর গুলি চালিয়ে দিল। সে জায়গায় তো আমরা নেই, আমরা প্রত্যেকটা জায়গায় নিশ্চিত করেছি সবাইর যেন সমাবেশ করার স্বাধীনতা থাকে, সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা থাকে।
এক বছরে পৌনে দু’শো আন্দোলন সামাল দিয়ে কিছুটা বাহবা কুড়ালেও আইনশৃঙ্খলার অবনতি সমালোচনার মুখে ফেলে সরকারকে। একের পর এক ছিনতাই-ডাকাতিতে অনেকটাই অনিরাপদ হয়ে ওঠে ঢাকা শহর। পুলিশের তথ্য বলছে, গত এক বছরে শুধু ডাকাতেই খুনের মামলা হয়েছে ৩৯৭টি, ছিতনাই ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৭৩৩টি। তবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তুলনামূলক পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখার পরামর্শ সরকারের। তিনি আরও বলেন, আমরা মনে করি ‘ল এন্ড অর্ডার’ পরিস্থিতি এখন অনেক ভালো। বাংলাদেশে এখন পিস এন্ড স্ট্যাবিলিটি আছে। আপনারা আগের পরিসংখ্যান দেখেন গতবছর বা আগের বছর তার তুলনায় আমরা অনেক ভালো আছি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশের ভেঙে পড়া মনোবল ও ফ্যাসিবাদের রেখে যাওয়া আমলা কাঠামো ভুগিয়েছে সরকারকে। সেইসাথে, শুরুতেই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পরিবর্তন ও বর্তমান উপদেষ্টার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্নও কম নয়। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটামুটি। প্রথমদিকে যেটা ছিল সেটা খারাপ ছিল। ফ্যাসিস্ট সরকারের যে লোকগুলো ছিল তারা অনেক জায়গায় এখনো আছে। তারা যদি সেখানে বসে থাকে তাহলে তো পরিবর্তন আসবে না।
অন্যদিকে দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, মব ভায়োলেন্সের ভয়েই আমাকে কাবু থাকতে হচ্ছে। সে কারণে কোনো সংবাদ কর্মী সাহস করছে না আর আমি একজন সম্পাদক হিসেবে আমি নিজেও এটাকে উৎসাহ দিচ্ছি না। ফলে একধরনের আপোষের মধ্যেই চলছে। শিক্ষক ও গবেষক আসিফ বিন আলী বলছেন, সরকার আরও কিছু জায়গায় কাজ করতে পারতো। তার মধ্যে একটা হচ্ছে জননিরাপত্তা। জননিরাপত্তার ক্ষেত্রে এ সরকার যথেষ্ট পিছিয়ে আছে। এছাড়া, দুর্ঘটনা মোকাবিলার সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্নের মুখে পড়ে সরকার। বিশেষ করে, মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনায় সমন্বয়হীনতা ও স্বাস্থ্য উপদেষ্টার নিলিপ্ততায় সমালোচনার কুড়াতে হয় ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে।
গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার মানুষের প্রত্যাশা পূরণে হতাশ করেছে বলে মন্তব্য করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। মানবাধিকার সংস্থাটি বলেছে, এখনো নির্বিচার গ্রেপ্তার চলছে, হেফাজতে মৃত্যু ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে, যা আগের সরকারের দমনমূলক আচরণের পুনরাবৃত্তির মতোই মনে হচ্ছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির কারণে নাগরিকের নিরাপত্তাবিষয়ক উৎকণ্ঠা রয়েছে। তারা বলছে, ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশ একটি যুগান্তকারী গণজাগরণের সাক্ষী হয়। স্বৈরাচারী দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এক ঐতিহাসিক আন্দোলন। এই আন্দোলন কেবল একটি রাজনৈতিক পালাবদল নয়, বরং এটি ছিল একটি নতুন যুগের সূচনা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আন্দোলনের পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার মানুষের প্রত্যাশা পূরণে হতাশ করেছে।