এখনও ভাঙ্গেনি চাল সিন্ডিকেট
- আপডেট সময় : ০৩:৩৪:২৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ অক্টোবর ২০২৪ ১০৪ বার পড়া হয়েছে
এক মাসের ব্যবধানে কেজিতে বাড়ে ৫-৭ টাকা
বস্তার গায়ের মূল্য থেকে দাম নেয়া হচ্ছে বেশি
দাম বৃদ্ধিতে একটি মহলের সিন্ডিকেট গড়ে তোলার অভিযোগ
সংকট মোকাবিলায় বিপণন নীতিমালা চায় সাধারণ ব্যবসায়ীরা
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর সাধারণ মানুষ ধরেই নিয়েছিল এবার বুঝি সকল সেক্টরের সিন্ডিকেটগুলোর দৌরাত্ম্য কমবে এবং নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের সেই আশা পূরণ তো হচ্ছেই না উল্টো নিত্যপণ্যের দাম কমার পরিবর্তে কোন কারণ ছাড়াই আরও বাড়ছে। বিশেষ করে মোটা-সরু চালের দাম বেড়েছে অসহনীয় পর্যায়ে। চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষ পড়েছে চরম দুর্ভোগে। সাধারণ মানুষ বলছে সরকারের পরিবর্তন হলেও এখনও ভাঙ্গেনি চালের সিন্ডিকেট। আর চালের বাজার অস্থির হওয়ার পেছনে মিল মালিক ও করপোরেট সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, আগের কয়েক সপ্তাহে যে মোটা চালের কেজি ছিল ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা ছিল বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। এরমধ্যে আবার অধিকাংশ দোকানেই মিলছে না মোটা জাতের চাল। যে কারণে অনেক ক্রেতাকে বাধ্য হয়ে মাঝারি মানের চাল কিনতে হচ্ছে। এদিকে, মাঝারি চাল বিআর-২৮ ও পাইজাম বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা কেজি দরে। পাশাপাশি মানভেদে সরু চালের কেজি ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। মাস দেড়েক আগেও মোটা চাল ৫০ থেকে ৫২ ও মাঝারি চালের কেজি ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। আর সরু চাল বিক্রি হতো কেজিপ্রতি ৬৫ থেকে ৭৬ টাকায়। অর্থাৎ, চালের দাম গত এক মাসের ব্যবধানে কেজিতে ৫ থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ক্রেতারা বলছেন, বর্তমানে বাজারে চালের সরবরাহ পর্যাপ্ত।
অনেক আড়তে বস্তা রাখার জায়গা হচ্ছে না। অথচ এমন ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ছে। ৬০ টাকা ছাড়িয়েছে মোটা চালের দর। মিনিকেটেও একই দশা। নাজিরশাইল কিনতে পারছেন গুটি কয়েক মানুষ। এছাড়া বস্তার গায়ে যে মূল্য রয়েছে তার থেকে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। কেন বেশি দাম নিচ্ছে ক্রেতারা জানতে চাইলে উত্তরে জানান বেশি দামে ক্রয় তাই বেশি দামে বিক্রি। ক্রেতারা বলছেন চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনা এখন সময়ের দাবি। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে এ অজুহাতে ৫০ কেজির প্রতিবস্তা চালে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। একইসঙ্গে দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মোকামগুলোতে ধান ও চালের মজুত গড়ে তুলে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে দাম বাড়াচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়া বিশ্ববাজারে চালের দাম দেশের বাজারের চেয়ে বেশি। ফলে আমদানির সম্ভাবনাও কম। অক্টোবর মাস পর্যন্ত চালের বাজারে অস্থিরতা থাকতে পারে। তবে নভেম্বরে আমন কাটা শুরু হলে চালের দাম কমতে পারে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশ চাহিদার তুলনায় কম চাল উৎপাদন করে। এ অবস্থায় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ধানের মজুদ করে একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ তৈরি করতে পারে। এর ফলে বাজারে স্বাভাবিক সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে গিয়ে চালের বাজার আরও নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। গ্রামগঞ্জে মিল ও চাতাল মালিকদের ধান সংগ্রহকালে অর্থাৎ মৌসুমের শুরুতে চালের দাম বেড়ে যায়। বড় কোম্পানিগুলো ধান সংগ্রহ কার্যক্রম বাড়ালে সরকারই চাহিদা অনুযায়ী ধান-চাল সংগ্রহ করতে পারবে না। ফলে দেশের বাজারে চালের দাম আরও অনেক বেশি বাড়বে। এসব সংকট মোকাবিলায় বড় কোম্পানিগুলোর চাল বিপণন কার্যক্রমের জন্য সরকারি নীতিমালা চাইছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা।
সাধারণ ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত মজুত থাকার পাশাপাশি সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র বন্যা, ত্রাণ ও আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাতে চালের দাম বাড়াচ্ছে একটি মহল। একইসঙ্গে মোকামগুলোতে ধান ও চালের মজুত গড়ে তুলে সিন্ডিকেট গড়ে তোলার মতো অভিযোগও করেছেন। বিশেষ করে ধান উৎপাদন এলাকা হিসেবে পরিচিত রাজশাহী, নওগাঁ, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, পাবনা ও বগুড়ার মোকামে ধান-চাল মজুত রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এক্ষেত্রে সিন্ডিকেট প্রথা ভাঙতে চাল আমদানির এলসি উন্মুক্ত করার দাবি ব্যবসায়ীদের। চালকল মালিকরা বলছেন, বন্যাকে কেন্দ্র করে নওগাঁয় চাল উৎপাদনে কোনো প্রভাব পড়েনি।
তবে কৃষকরা এসময় হাটবাজারে ধানের আমদানি কম করায় মোটা ধানেরই প্রতিমনে দাম বেড়েছে ৫০-১০০ টাকা। বর্তমানে প্রতিমণ মোটা স্বর্ণা ধান বিক্রি হচ্ছে ১৩০০-১৫০০ টাকায়। বর্তমানে জেলার খুচরা বাজারে প্রতিকেজিতে চার টাকা বেড়ে প্রতিকেজি স্বর্ণা ৫০-৫৫ টাকা ও হাইব্রিড ৪৫-৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, বেশিরভাগ অটোরাইস মিল মালিকরা উত্তরাঞ্চলে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে অটোরাইস মিলের সংখ্যা এখন পাঁচ শতাধিক। এছাড়াও সেমি অটো হাস্কিং মিলের সংখ্যা কমবেশি ৪০ হাজার। এসব মিলের উৎপাদিত চালের একটা অংশ অগ্রিম পেমেন্টে কিনে নেয় ২-৩টি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ।
ফলে চালের বাজার স্বাভাবিক সরবরাহের কমবেশির ওপর মূল্য নির্ধারণ হয় না। চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করেন এই সিন্ডিকেট সদস্যরা। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় প্রতিবছর আমন, আউশ ও বোরো মৌসুমে উৎপাদন হয় সোয়া ১ কোটি মেট্রিক টন চাল। এই অঞ্চলের চাহিদার মিটিয়েও আরও প্রায় ৮০ লাখ মেট্রিন চাল উদ্বৃত্ত থাকে। কিন্তুু এই উদ্বৃত্ত ধান কোথায় কীভাবে বিক্রি হয় সেই তথ্য মিলাররা কখনো প্রকাশ করেন না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের সোয়া ২ কোটি মেট্রিক টন চালের চাহিদার বিপরীতে যে পরিমাণে ধান উৎপাদন হয়, তাতে অল্প পরিমাণ চাল ঘাটতি থাকে। এই ঘাটতিকে পুঁজি করেই সিন্ডিকেট সদস্যরা চালের বাজারকে অস্থিতিশীল করেন কোনো ইস্যু পেলেই। যার ভোগান্তি পোহাতে হয় সাধারণ মানুষকে। প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াস মৃধা গণমাধ্যমকে বলেন, যে বাজারে চাল বিক্রি করে, সে একাই কিন্তু পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করে না।
এটা এক-দুইজন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, এটা কোনো প্যাটেন্ট করা পণ্য না, চাল সবাই উৎপাদন করতে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, চালের উৎপাদন ও চাহিদার তথ্য নিয়ে গড়মিল আছে। যার দায় পড়ছে ব্যবসায়ীদের ঘাড়ে। কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ছোট-মাঝারি-বড় ব্যবসায়ী সবার মাঝে একটা প্রতিযোগিতা তৈরি করা। এখন সেই প্রতিযোগিতা নেই। দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবাই এখন সহযোগিতা করছে এবং মুনাফা লুটছে।