এনসিটিবিতে ফ্যাসিস্টের ভূত

- আপডেট সময় : ১৭৬ বার পড়া হয়েছে
ফ্যাসিস্ট সরকারের ভূত সড়েনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ঘাড় থেকে। পরিবর্তিত পরিস্থিতের মধ্যেও আওয়ামী লীগের সাবেক একমন্ত্রীর ভাই দেড় কোটির বেশি বই ছাপার কাজ পাচ্ছে এমন তথ্যে এনসিটিবির অভ্যন্তরে ক্ষোভ সৃস্টির পর ৬০৩ কোটি টাকার দরপত্র আটকে দিয়েছে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ (পারচেজ কমিটি)। সব কিছু মিলিয়ে এনসিটিবিতে আওয়ামীপ্রীতি ও গোপন প্রভাব নিয়ে তদন্তে নেমেছে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা।
গত মঙ্গলবার ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের জন্য পাঠ্যবই ছাপানোর তিনটি প্রস্তাব উত্থাপন হয়। যেখানে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের এক মন্ত্রীর ভাইসহ ১২ জন প্রেস মালিকের সঙ্গে সরাসরি আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠতার তথ্য আসে। তথ্য গোপন করে কাজ পাইয়ে দেয়ার ঐ চেষ্টা আটকে দেয় কমিটি।পাঠ্যবইয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ রাখা নিয়েও বিতর্কে জড়িয়েছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা। এতে সংস্থাটির ভেতরে চরম অস্থিরতা চলছে। ফলে নতুন শিক্ষাবর্ষের বই সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
সূত্রমতে, এনসিটিবিতে পতিত আওয়ামীপ্রীতি নিয়ে তদন্তে নেমেছে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের তথ্য, অতীতের কর্মকাণ্ড সংগ্রহ করা হচ্ছে। সংস্থাটির শীর্ষ ব্যক্তি ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ বহাল রাখার চেষ্টাও আটকে গেছে, যা এখন তদন্তে গড়িয়েছে। এমন তৎপরতার পর সোচ্চার হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তর। আগামী নভেম্বরে চেয়ারম্যানের চাকরি শেষ হবে, সেজন্য তাকে সরানো যাবে না মন্ত্রণালয়ের এমন যুক্তি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সাড়ে ৪ কোটি শিক্ষার্থীর জন্য কারিকুলাম প্রণয়ন, পাঠ্যবই ছাপানো মতো স্পর্শকাতর একটি দপ্তরে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের আস্থাভাজন ব্যক্তিকে রাখা নিয়ে বিতর্কের মাত্রা আরও বেড়েছে।
মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, গত ১৯ আগস্ট ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ১১ কোটি ৮৯ লাখ ৩২ হাজার ৮০২ কপি বই ছাপানোর জন্য তিনটি প্রস্তাব পারচেজ কমিটিতে উত্থাপন হয়। এর মোট ব্যয় ধরা হয় ৬০৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। প্রস্তাবে অস্পস্টতা ও প্রশ্নবিদ্ধ ইস্যুতে কমিটি অনুমোদন দেয়নি ঐ প্রস্তাবটি । চলতি বছর ৩০ কোটির বেশি বইয়ের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি কাজ যাচ্ছে আওয়ামীপন্থি প্রিন্টার্সদের কাছে এমন অভিযোগ ছিল পারচেজ কমিটির কাছে। সাবেক মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের ছোট ভাই জুলাই আন্দোলনে হত্যা মামলার আসামি রব্বানী জব্বারের মালিকানাধীন আনন্দ প্রিন্টার্স ও এপেক্স প্রিন্টার্সকে তিন শ্রেণিতে ১৬টি লটে ৭২ লাখ বইয়ের কাজ পাওয়ায় আপত্তি তোলা হয় কমিটিতে। সাবেক মন্ত্রীর ভাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে কীভাবে কাজ পায়, এমন প্রশ্ন তুলে বিষয়টি শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে জানতে চেয়েছেন কমিটির অন্য সদস্যরা। এ ছাড়া ২২৭টি লটের বিপরীতে ৯টি প্যাকেজ করায় আপত্তি তোলে টেকনিক্যাল কমিটি। একপর্যায়ে পুরো কেনাকাটা স্থগিত করা হয়।
এসআর প্রিন্টার্সসহ আরও ১২টির বেশি প্রিন্টার্সের মালিকরা বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের পদপদবিতে ছিলেন, তাদের নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। এসব আপত্তি আমলে নিয়ে ফের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। চলতি সপ্তাহে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে ফাইল নোট আকারে সেগুলো পাঠাবে মন্ত্রিসভা বিভাগের ক্রয় ও অর্থনৈতিক অধিশাখা। পারচেজ কমিটির কাছে উত্থাপিত নথি বলছে, ষষ্ঠ শ্রেণির জন্য ৯৭টি, সপ্তম শ্রেণির জন্য ৯৪টি এবং অষ্টম শ্রেণির জন্য ৮৯টিসহ মোট ২৭০টি লটের জন্য ৯টি প্যাকেজ করা হয়েছে, যা পারচেজ কমিটির মতে অনেক বেশি। তারা বলছেন, এখানে সর্বোচ্চ ৫টি প্যাকেজ করা উচিত ছিল। কিন্তু এনসিটিবির একজন সদস্য নিজের পছন্দের ছোট প্রেসকে কাজ দিতে বিগত বছরের প্যাকেজ ভেঙে এবার ৯টি করেছেন।
এনসিটিবির একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, বছরের শুরুতেই রব্বানী জব্বারকে বই ছাপার কাজ না দেয়ার জন্য পরামর্শ দেয় এনসিটিবি ও দুটি গোয়েন্দা সংস্থা। সেই সুপারিশকে পাশ কাটিয়ে চেয়ারম্যান ও একজন সদস্য গোপনে তার (রব্বানী) সঙ্গে বৈঠক করে দরপত্র দিতে বলেন। এর পর চেয়ারম্যানকে ডেকে পাঠান শিক্ষা উপদেষ্টা। ‘প্রেস বড়, তাকে কাজ না দিলে ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া অসম্ভব হবে- এমন তথ্য দেন চেয়ারম্যান। এরই মধ্যে তথ্য গোপন করে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের তিনটি করে মোট ছয় লটের কাজ পেয়েছে আনন্দ ও এপ্রেক্স প্রিন্টার্স। গত ২১ আগস্ট তাকে কাজ পাওয়ার সম্মতিপত্র দেওয়া হয়েছে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে চারটি লটের সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছেন, সেগুলো এখন মূল্যায়ন পর্যায়ে রয়েছে। আগামী মঙ্গলবার পারচেজ কমিটিতে যাওয়ার কথা রয়েছে। অর্থাৎ প্রাথমিক স্তরেই তিনি প্রায় ২০ লাখ বইয়ের কাজ পাচ্ছেন। অন্যদিকে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে ১৬ লটের রেসপনসেবল (যোগ্য) হয়েছে। প্রতিটি লটে সাড়ে ৪ লাখ বই ধরলে শুধু তিনটি শ্রেণিতে ৫০ লাখের বেশি বইয়ের কাজ পেয়েছেন রব্বানী জব্বার।
এনসিটিবির তথ্য বলছে, গত বছরের ৫ আগস্টের পর রব্বানী জব্বার প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মোট ১ কোটি ৩৩ লাখ বই ছাপার কাজ করেছেন। এর মধ্যে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণিতে ১৯টি লটে ১ কোটি ৩০ হাজার বই, বাকিগুলো প্রাথমিকের। পতিত সরকারের মন্ত্রীর ভাইয়ের এত সংখ্যক বই ছাপার কাজ পাওয়া নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন এ কাজের সঙ্গে যুক্তরা। বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে দুটি গোয়েন্দা সংস্থা।
আওয়ামী লীগ ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন করছেন এনসিটিবির শীর্ষ ব্যক্তিরা। সংস্থাটিতে নিয়মিত চেয়ারম্যান নেই গত মার্চ থেকে। চেয়ারম্যানের চলতি দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরীর মূল দায়িত্ব সদস্য (কারিকুলাম)। ২০২৪ সালে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল তার আস্থাভাজন লোক হিসেবে এনসিটিবিতে নিয়ে আসেন দীপু মনির লোক মশিউরকে সরিয়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ করা এই কর্মকর্তার হাত ধরে আওয়ামীপন্থি প্রিন্টার্সদের কাজ দেয়া হচ্ছে। বিগত সরকারের সুবিধাভোগী অন্তত ২০ জন কর্মকর্তা এখনো বহাল তবিয়তে। তাদের বদলির ফাইল উঠলে বাধা দেন চেয়ারম্যান। এসব কর্মকর্তাকে সরালে দপ্তরটি অচল হয়ে যাবে, এমন অজুহাত দাঁড় করান রবিউল চৌধুরী। তার এসব কাজের সহায়তা করছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতার আত্মীয় ড. রিয়াদ চৌধুরী। তার চাকরি জীবনে প্রায় পুরোটাই কেটেছে নায়েম, মাদ্রাসা বোর্ডসহ লোভনীয় দপ্তরগুলোতে। এনসিটিবির একাধিক সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
রব্বানী জব্বারকে কাজ দেয়া প্রসঙ্গে রবিউল কবীর চৌধুরী বলেন, সরকারি বিধিবিধান অনুযায়ী, দরপত্রদাতা সব শর্ত পূরণ করলে তাকেই কাজ দিতে হয়। এনসিটিবি সেভাবেই কাজ করছে এবং কারও কাজ বাতিল করার এখতিয়ার তাদের নেই।
অপরদিকে এনসিটিবির একজন সদস্যের পছন্দের দুটি প্রেস নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ না করা সত্ত্বেও কাজ পেয়েছে। প্রেস দুটি হলো মিরাজ ও রাব্বিল প্রিন্টিং প্রেস। সম্প্রতি টাইমস মিডিয়ার সিনিয়র মার্কেটিং অফিসার শ্রীবাস পাল তন্ময় শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে এমন অভিযোগ করেছেন। অভিযোগে তিনি লেখেন, ‘ই-জিপিতে ভুলবশত বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি রিপোর্ট আপলোড না দেওয়ায় তাদের কাজ বাতিল করা হয়েছে। অথচ মিরাজ ও রাব্বিল প্রিন্টিং নবম শ্রেণির বাংলা-ইংরেজি ভার্সন, দাখিল ও ভোকেশনাল স্তরের মোট ১১টি লটের ই-জিপি দরপত্রে স্টাফের তালিকা, মেশিনারিজ, প্রশিক্ষিত কম্পিউটার অপারেটর এবং সিসিটিভির বিবরণ জমা দেয়নি। তবুও তাদের কাজ দেয়া হয়েছে।