ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় বিএনপি

- আপডেট সময় : ৫৩ বার পড়া হয়েছে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু উচ্চশিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান নয়, এটি বাংলাদেশের ইতিহাস, রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রতীক। এই বিশ্ববিদ্যালয় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে, ছেষট্টির ছয় দফা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান স্বাধীনতা আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামে পথপ্রদর্শক ভূমিকা রেখেছে। এখানে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা জাতীয় জীবনে প্রতিফলিত হয়।
ডাকসু এবং জাকসু নির্বাচন এর পর সবকিছুই গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে বিএনপি সহ সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে। বিশেষ করে গত বছরের ৫ আগস্টের পর এক বছরে বিএনপি রাজনীতিতে বিপর্যয়ের সংকেত বহন করেছে ডাকসু এবং জাকসু নির্বাচন। দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি, আভ্যন্তরীণ কোন্দল, গ্রুপিং, আর নব ৭১ এর ঠিকাদারির অভিযোগ বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। দলের ইমেজ ক্ষুন্ন হয়ে তলানিতে পড়েছে। ভাভিয়ে তুলেছে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের।
প্রবীন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মতে, আওয়ামী দুঃশাসনের ১৫ বছর বিএনপির প্রতি বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সহানুভূতি ছিলো অন্য সব দলগুলোর চেয়ে শতগুণ। কিন্তু গত বছর ৫ আগস্টের পর বিএনপি ওয়ার্ড পর্যায় থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে খাল-বিল, হাট-বাজার, ফুটপাত-বাস টার্মিনাল ও বিভিন্ন দপ্তরে ঠিকাদারি দখলের। দলে জায়গা পায় হাইব্রীড এবং সন্ত্রাস-চাঁদাবাজরা। দখল বাণিজ্য এবং মারামারিতে দল টির দেশব্যাপী বদনাম ছড়িয়ে পড়ে।
শুধু তাই নয়, ক্ষমতার লড়াইয়ে গ্রুপিং এবং কোন্দল বেড়েই চলেছে। আসন্ন নির্বাচনে এমপি পদে নির্বাচনী গ্রুপিংয়ের শেষ নেই। একেকটি আসনে ১০/১৫ জন করে প্রার্থী নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। যেখানে জামায়াত একটি আসনে একজন স্বার্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। রাজধানী সহ সারাদেশে নিজেদের মধ্যে প্রায়ই ঘটছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। যা এখনো চলছে পুরোদমে। অভিযোগ আছে, দলের হাইকমান্ডের নেতারা শুধু মাত্র টাকার জন্য এদেরকে দিচ্ছেন শেল্টার। তারেক রহমান লন্ডন থেকে বার বার অনুরোধ করেছেন এসব না করার জন্য। কিন্তু কেউ বিষয়টি আমলে নেয়নি। মিডিয়া সেলে নেয়া হয়েছে একদল জান্তা। যারা শুধু অহংকার আর নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। নিজেদের নাম ফুটানোর জন্য মাঝ-মধ্যে ফেইসবুকে পোস্ট দেন যাতে তারেক রহমান দেখে তাদের সুবিধা দেন। রাজনীতিবিদরা বলেন, বিএনপির সামনে আরো খারাপ সময় আসছে। ডাকসু এবং জাকসু নির্বাচনে লাভ হয়েছে চাঁদাবাজদের। হেরেছে ছাত্রদলের প্রার্থীরা। রাজনৈতিক ভাবে ক্ষতি হয়েছে বিএনপি। দীর্ঘদিন পর ডাকসু এবং জাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল জয়ের ধার প্রান্তে গিয়েও কেন ভরাডুবি হয়েছে তা বিএনপি হারে হারে টের পাচ্ছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনুরোধ বা আহ্বান শুনলে দল ঘুরে দাঁড়াবে। নচেৎ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর খেসারত দিতে হবে। যে রকম মাশুল দিতে হয়েছে ডাকসু এবং জাকসু নির্বাচনে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে আসেন এমন একজন, যিনি জামায়াত-শিবির সমর্থিত বলে পরিচিত। নতুন উপাচার্যের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই তাঁকে ঘিরে নানা বিতর্ক শুরু হয়।ডাকসু নির্বাচন এ বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে। দীর্ঘ বিরতির পর আয়োজিত এই নির্বাচন ছিল ঐতিহাসিক। প্রায় ৮০ শতাংশ ভোটার অংশ নেন যা একদিকে ছাত্রদের আগ্রহ ও অংশগ্রহণের ইতিবাচক দিক দেখায়। কিন্তু অন্যদিকে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ এতটাই প্রবল যে পুরো প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
ছাত্রদল-সমর্থিত প্রার্থীরা অভিযোগ করেন, তাঁদের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তাঁদের প্রচারণায় বাধা দেয়া হয়েছে। শিবির-সমর্থিত প্রার্থীদের বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। এমনকি ভোটের আগে থেকেই সিল মারা ব্যালট বিতরণের মতো অভিযোগও এসেছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে নিরপেক্ষ তদন্ত ছাড়া এই অভিযোগ চাপা দেয়া সম্ভব নয়।একইসঙ্গে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা যেমন কেন্দ্রের আশপাশে প্যানেল তালিকা বিতরণ, প্রার্থীদের ভেতরে প্রবেশের অনিয়ম এসব প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে যায়নি। বরং অনেকে মনে করছেন, প্রশাসন ইচ্ছাকৃতভাবে এদের প্রশ্রয় দিয়েছে।
অপরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বারবার প্রমাণ করেছে, তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন। একুশে, ঊনসত্তর, একাত্তর, নব্বই প্রতিটি আন্দোলনে ছাত্ররা নেতৃত্ব দিয়েছে। বর্তমানে ছাত্রসমাজও অনিয়ম সহ্য করবে না। ডাকসুর নির্বাচনে অংশ নেওয়া ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর ৮০ শতাংশের উপস্থিতি প্রমাণ করে, তারা গণতন্ত্র ও অংশগ্রহণে বিশ্বাসী। প্রশাসন যদি তাদের কণ্ঠরোধ করে থাকে, তবে এর ফল শিগগিরই ভয়ংকর আকারে দেখা দেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও প্রগতির প্রতীক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন যদি অনিয়মে কলুষিত হয়, তবে তা কেবল ছাত্রদের নয়, পুরো জাতির জন্য লজ্জার। ঢাবির সাবেক ভিসি আরেফিন সিদ্দিকের লাশের জানাজা বিশ্ববিদ্যালয়ে না হওয়া যেমন মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখিয়েছে, বর্তমান অনিয়মও দেখাচ্ছে গণতান্ত্রিক চেতনার অবক্ষয়। তবে অনিয়মের অভিযোগ টি কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করেছেন। তারা বলেছেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে।
জামায়াতের প্রবীণ রাজনীতিবিদরা বলছেন, ৪০ বছর ধরে শিবির শিক্ষাখাতে অনেক বিনিয়োগ করেছে, শ্রম দিয়ে আসছে। গাইড বই, কোচিং সেন্টার চালানোর পাশাপাশি স্কুল-কলেজ থেকেই শিক্ষার্থীদের তাদের মতাদর্শে আনার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে শিবির। নিজেদের পক্ষে সমর্থন বাড়াতে শিক্ষার্থীদের নার্সিং করার উপর গুরুত্ব দিয়েছে।শিবির গত এক বছর হলগুলোতে পানির ফিল্টার এবং শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করেছে। গরীব অসহায় শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। শান্ত, ধৈর্য ও বিনয়ী আচরণ শিক্ষার্থীদের মন জয় করতে সহজ হয়েছে শিবিরের পথচলা।
শুধু তাই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার আশপাশে নিজস্ব খরচে ম্যাস ভাড়া করে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে বলেও জানা গেছে। অন্য কোন দল তা করেনি। মিবিরের দুঃস্থ ও অসুস্থ নেতাকর্মীদের আর্থিক সহায়তা থেকে শুরু করে সকল ধরনের সহযোগিতা কওে আসছে শিবির। যা অন্য রাজনৈতিক দলকে দেখা যায় না। তার জ্বলন্ত উদাহরন হচ্ছে, ডাকসু নির্বাচনের লাইভ দেয়ার সময় হার্ট এ্যাটাকে মারা যান তরিকুল শিবলী। তার পরিবারকে শিবির নেতারা বাসায় গিয়ে তার স্ত্রী সন্তানদেও খোঝ খবর নেন। পাশাপাশি ২ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন। শিবলীর পরিবারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতিও দেন শিবির নেতারা।
বিপরীতে ছাত্রদল, ছাত্রলীগ বরং নিজেদের সরকারের সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে জনসমর্থন আরও হারিয়েছে। তাছাড়া, সে আমলের তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ, জাতির জন্ম ইতিহাসের আবেদন কমে গেছে। সারাদেশে স্কুল-কলেজের তুলনায় মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার সিলেবাস মুখস্থ বিদ্যা প্রাধান্য পাচ্ছে, যেখানে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা এগিয়ে থাকছে। এসবের ফল ডাকসু এবং জাকসু নির্বাচনে স্পষ্ট হয়েছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনেও একই ধরণের ফলাফল পাওয়া যাবে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এদিকে দীর্ঘদিন পর শান্ত, ধৈর্য ও বিনয়ী আচরণ শিক্ষার্থীদের মন জয় করতে সহজ হয়েছে শিবিরের। ডাকসু নির্বাচনে শিবির বিজয়ের পর বিজয় মিছিল না করে তারা মসজিদে গিয়ে নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছেন। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ প্রকাশ্যে উপাচার্যের সঙ্গে তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। তার এই বেয়াদবির ভিডিও মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়। তার বিরুদ্ধে বিএনপি বা ছাত্রদল কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় সমালোচনা হচ্ছে সর্বত্র।
ডাকসুর নির্বাচন প্রেক্ষাপট নিয়ে ড. মোহাম্মদ ফয়েজ উদ্দিন এমবিই বলেন, ডাকসুর নির্বাচন-পরবর্তী প্রেক্ষাপট আমাদের কাছে শুধু একটি ক্যাম্পাসভিত্তিক ঘটনা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকনির্দেশনা ও প্রতিফলন। ছাত্রসমাজের নির্বাচনে যে বৈষম্য, অনিয়ম ও পক্ষপাতিত্ব দেখা গেছে, তা গোটা জাতির রাজনৈতিক সংকট ও গণতান্ত্রিক অবক্ষয়েরই প্রতিচ্ছবি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, সংগঠনিক দুর্বলতা স্পষ্ট হয়েছে বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো বিশেষত ছাত্রদল সাংগঠনিক শক্তি প্রদর্শনে সক্ষম হয়নি। দীর্ঘদিনের দমন-পীড়ন, মামলা-হামলা, গ্রেপ্তার এবং রাজনৈতিক অবরোধের ফলে মাঠের শক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত। তবে এটিই নতুন করে দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। তরুণ প্রজন্মের আস্থার সংকট আজকের তরুণ প্রজন্ম বিকল্প নেতৃত্ব খুঁজছে। কিন্তু বিএনপি তাদের কাছে সুস্পষ্ট ভিশন বা পরিকল্পনা যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারেনি। ফলে শূন্যতার সুযোগ অন্যরা গ্রহণ করেছে। ক্ষমতাসীনদের প্রভাব সুস্পষ্ট ডাকসু নির্বাচন আবারও প্রমাণ করেছে যে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখলে ভোটের মাধ্যমে প্রকৃত নেতৃত্ব কখনও উঠে আসে না। এটি গোটা জাতির জন্য এক সতর্ক সংকেত। বিএনপির করণীয় সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, গ্রাম, উপজেলা, জেলা থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত নতুন ও যোগ্য নেতৃত্বকে সামনে আনতে হবে। ত্যাগী, পরীক্ষিত ও মেধাবী নেতাকর্মীর যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। ছাত্র-যুবসমাজের সাথে সংযোগ: শিক্ষা, কর্মসংস্থান, প্রযুক্তি ও গবেষণা বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা দিতে হবে। তরুণরা যাতে বিএনপিকে ভবিষ্যতের ভরসা ও বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করতে পারে, সে ধরনের আস্থা তৈরি করতে হবে। টাকার বিনিময়ে পদবী নয়, বরং সততা, যোগ্যতা, এবং ত্যাগের ভিত্তিতে নেতৃত্ব বাছাই করতে হবে। তাদের মতে, বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন যেমন ছাত্রদল, যুবদল, কৃষকদল, স্বেচ্ছাসেবক দল এদের কার্যক্রম মনিটরিং ও নীতি নির্ধারণের জন্য একটি তদারকি প্যানেল গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। এই কমিটি নিয়মিতভাবে তাদের কার্যক্রম মূল্যায়ন করবে, সংগঠনগুলো যাতে সঠিক নীতি মেনে চলে এবং নেতাকর্মীরা দায়িত্বশীল ভাবে কাজ করে তা নিশ্চিত করবে। এতে সংগঠনের শৃঙ্খলা ও দায়বদ্ধতা বাড়বে এবং নেতৃত্বের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পাবে।