চীনের দু:খ হোয়াংহো, শরীয়তপুরের দু:খ ২৭ কিলোমিটার সড়ক
- আপডেট সময় : ০৩:৩৫:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪ ১১০ বার পড়া হয়েছে
চীনের দু:খ যেমন হোয়াংহো নদী, ঠিক তেমনি শরীয়তপুর জেলা বাসীর দু:খ ২৭ কিলোমিটার নির্মাণাধীন সড়কে বললে ভুল বলা হবে না। কারন আলোচিত-সমালোচিত পদ্মা সেতু-শরীয়তপুর চার লেন সংযোগ সড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ চলছে অতি ধীর গতিতে। চার বছর পেরিয়ে গেলেও এ পর্যন্ত ৬০ শতাংশ কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। কাজ শেষ না করে সড়ক খুঁড়ে রাখায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন এপথে চলাচলকারীরা। লাগছে বাড়তি সময়, বেড়েছে জ্বালানি খরচ, নষ্ট হচ্ছে যানবাহনের যন্ত্রাংশ। এমন পরিস্থিতির জন্য চরম ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা। তবে আগামী বর্ষা মৌসুম আসার আগেই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করা হবে বলে জানিয়েছে সড়ক বিভাগ।
পদ্মাসেতুর স্বাগতিক জেলা শরীয়তপুরবাসীর জন্য ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা ব্যায়ে শরীয়তপুর-জাজিরা-নাওডোবা (পদ্মা সেতু অ্যাপ্রোচ) সড়ক উন্নয়ন’ প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০২০ সালে। কথা ছিল ২০২২ সালের জুন মাসে যখন পদ্মাসেতু চালু করা হবে তখন থেকেই শরীয়তপুরবাসী সড়কটি দিয়ে পদ্মাসেতু পার হয়ে রাজধানী ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবে।
পদ্মাসেতু আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হয়েছে ২০২২ সালের ২৫ জুন। এরপর কেটে গেছে দুই বছরের বেশি সময়। এরমধ্যে তিন দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তারপরেও ঠিকাদারের চরম গাফিলতি আর সড়ক বিভাগের দায়সারা তদারকির কারণে এ পর্যন্ত কাজ হয়েছে ৬০ শতাংশ।
এ দিকে পদ্মাসেতু চালু হওয়ার পর থেকে সড়কটিতে গাড়ির চাপ বেড়েছে কয়েকগুণ। প্রতিদিন যাত্রীবাহী বাস সহ ছোট-বড় কয়েক হাজার গাড়ি চলছে এই সড়ক দিয়ে। অথচ নির্মানাধীন সড়কটির বর্তমান পরিস্থিতি ভয়াবহ। ভাঙ্গাচোরা খানাখন্দে ভরা সড়কটি দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে শরীয়তপুরবাসীকে। সড়কটি দিয়ে চলাচলের সময় প্রায়ই ঘটছে দূর্ঘটনা, বিকল হচ্ছে যানবাহন। ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে পরিবহন খাত। এ নিয়ে শরীয়তপুরবাসীর মনে দুঃখ কষ্ট আর ক্ষোভের যেন শেষ নেই।
তবে সড়ক বিভাগ বলছে, জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন না হওয়া এবং বর্ষা মৌসুমের কারণে কাজে গতি আনা যাচ্ছে না।
শরীয়তপুর সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি একনেক সভায় ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকার ব্যয়ে শরীয়তপুর-জাজিরা-নাওডোবা (পদ্মা সেতু অ্যাপ্রোচ) সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। এরপর তিনটি প্যাকেজে পৃথক ঠিকাদার নিয়োগের পর ওই বছরের জুলাই মাস থেকে সড়ক উন্নয়নের কাজ শুরু হয়।
পদ্মা সেতুর ল্যান্ডিং পয়েন্ট জাজিরার নাওডোবা থেকে শরীয়তপুর জেলা সদর পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার সড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে অধিগ্রহণকৃত ভূমির পরিমান ধরা হয় ১০৫ দশমিক ৫ হেক্টর। যার ব্যায় ধরা হয়েছে ১ হাজার ২শ’ ১৮ কোটি টাকা। আর ব্রিজ কালভার্ট সহ দুই লেন সড়ক নির্মাণে ধরা হয় ৪৫০ কোটি টাকা।
সড়কটি শরীয়তপুর সদর থেকে জাজিরা উপজেলার কাজিরহাট পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটারের প্রস্থ ১৮ ফুট এবং কাজীর হাট থেকে নাওডোবাবা গোলচক্কর পর্যন্ত প্রস্থ ১২ ফুট। সড়কটি চার লেনে উন্নীত করার লক্ষ্যে জমি অধিগ্রহণ করা হলেও বর্তমানে সড়কটি ৩৪ ফুট প্রসস্থ করে দুই লেনে উন্নীত করণ কাজ চলমান রয়েছে। কাজের সুবিধার্থে প্রকল্পটি তিনটি প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছে।
প্রথমে প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। এই মেয়াদ শেষ হলে সড়ক বিভাগ থেকে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। দ্বিতীয় দফা মেয়াদ বাড়িয়েও প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পেরে ২০২৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আবার তৃতীয় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়। দফায় দফায় মেয়াদ বাড়িয়েও সড়কটি চলাচলের উপযোগী করতে না পারায় যাত্রী সাধারণের মধ্যে দেখা দিয়েছে তীব্র ক্ষোভ।
স্থানীয় হাসান আলী নামের একজন বলেন, পদ্মা সেতুর সুফল দক্ষিণাঞ্চলের সব জেলার মানুষ পেলেও শরীয়তপুরের মানুষ এখনও পায়নি। সড়কের নির্মাণ কাজ শুরু হলেও কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। সংস্কার কাজের কারণে ভাঙা ও খানা-খন্দ সৃষ্টি হয়েছে। ভাঙা ও খানা-খন্দ বৃষ্টির পানিতে মরণ ফাঁদ তৈরি করে রেখেছে। এ রাস্তাটি এখন শরীয়তপুরের মানুষের জন্য বড় দুঃখের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। শহর থেকে নাওডোবা পর্যন্ত সড়কে চলাচল করলে সুস্থ্য মানুষও অসুস্থ হয়ে যায়।
লাল মিয়া হাওলাদার নামে একজন বলেন, এ সড়কে বৃদ্ধ ও অসুস্থ মানুষের চলাচলের কোনো উপায় নেই। জায়গা জাগায় খানা-খন্দের কারণে সুস্থ মানুষের হৃদপিণ্ড কেঁপে ওঠে আর অসুস্থ মানুষ নিয়ে সড়কে চলাচল করলে মৃত্যু ঝুঁকি থাকে। দ্রুত সড়কটির সংস্কার কাজ সমাপ্ত করার দাবি জানাই।
জয়নাল আবেদীন ( ৪০) একজন বাস চালক বলেন, গাড়ি চালাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। যাত্রীদের নিরাপত্তা ও নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই গাড়ি চলে সড়কটিতে। প্রায়ই গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। সরু সড়কের কারণে দুইটি গাড়ি পাশাপাশি চলতে পারে না। সড়কের বেহাল দশার কারনে কয়েক দিন পর পর গাড়ির পার্সপাট্টা নষ্ট হয়ে যায়, গাড়ি থেকে লাভের মুখ দেখা সম্ভব হয়ে উঠে না। দ্রুত সংস্কার কাজ শেষ করার দাবি জানাই।
তিন নম্বর প্যাকেজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মীর হাবিবুল আলমের ম্যানেজার বকুল প্রামানিক বলেন, আমরা কাজ শুরু করেছি ২০২৩ সালের জুলাই থেকে। অনেক জায়গায় জমি বুঝে না পাওয়ার কারণে এবং বর্ষার কারণে কাজে কিছুটা ধীরগতি হচ্ছে। বর্ষা মৌসুম শেষ হলে কাজের গতি বাড়িয়ে দেওয়া হবে।
শরীয়তপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ নাবিল হোসেনের বলেন, সড়ক নির্মাণ কাজে জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় কাজের অনেক ক্ষতি হয়েছে। তবে মোট কাজের অগ্রগতি প্রায় ৫৫ ভাগের বেশি। যদিও ২০২৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত সময় নেওয়া। তবে আগামি বর্ষা মৌসুমের আগেই সড়কটির কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করছি।
প্রকল্পের পিডি সড়ক ও জনপদ বিভাগের গোপালগঞ্জ জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. সাদেকুল ইসলাম বলেন, প্রথমত করোনা মহামারীর কারণে প্রকল্পের কাজ শুরু করতে প্রায় এক বছর সময় লেট হয়ে যায়। এরপর জমি অধিগ্রহণে সময় বেশি লাগার কারণে কাজের গতি কমে যায়। ২২টি এলএ কেইসের মধ্যে এখনো ৮টি এলএ কেইসের জমি আমরা বুঝে পাইনি। এছাড়া তিন নম্বর প্যাকেজের ওয়ার্কঅর্ডার দেয়া হয়েছে ২০২৩ সালের জুলাই মাসে।
তিন নম্বর প্যাকেজের কাজ লেট করে শুরু করার কারণ হচ্ছে এই প্যাকেজের কাজীরহাট থেকে নাওডোবা গোলচক্কর পর্যন্ত পূর্বের সড়কটি বেশি খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণে ২০২১ সালে মেজর মেইনটেনেন্সের কাজ করা হয়। নিয়ম হচ্ছে মেইনটেনেন্সের পরে তিন বছর সময় অতিবাহিত না হলে সেখানে নতুন করে কাজ করা যায়না। এ কারণে তিন নম্বর প্যাকেজের কাজ লেট করে শুরু করা হয়েছে।
শরীয়তপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. সাইফুদ্দিন গিয়াস বলেন, প্রায় জমি অধিগ্রহণ হয়ে গেছে। ২২টি এলএ কেইসের মধ্যে মাত্র ১৫ নাম্বার এলএ কেইসের সাত ধারার নোটিশ দেয়া হয়নি। এছাড়া সবকয়টি এলএ কেইসের সাত এবং আট ধারা দেয়া হয়েছে। অধিকাংশ এলএ কেইসের জমি আমরা সড়ক বিভাগকে বুঝিয়ে দিয়েছি। মূলত চার ধারার নোটিশের পরেই কাজ করা যায়। জমি অধিগ্রহণ কোন সমস্যা না। ঠিকাদার অন্য কোন কারণে হয়তো কাজে গাফিলতি করতেছে। আর জমি অধিগ্রহণ হচ্ছে না বলে অজুহাত দিচ্ছে।