ঢাকা ০৪:০৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম ::
Logo জয়পুরহাটে স্ত্রীকে হত্যার পর আত্মহত্যার চেষ্টা স্বামীর Logo ব্যস্ত সময় পার করছে প্রতিমা শিল্পীরা Logo ডাকসু হল সংসদে মাগুরার জয়জয়কার: ছয় কৃতি মুখে গর্বিত জনপদ Logo ইসলামপুরে মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত Logo জামালপুরে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে স্মরণসভা Logo ঘাটাইলে স্বাধীন বাংলা মিনি ফুটবল টুর্নামেন্ট ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত Logo গৌরীপুরে ৩১ দফা বাস্তবায়ন ও দলকে নির্বাচন মুখী করতে বিএনপির আলোচনা সভা Logo গোলাপগঞ্জে শিশু ধর্ষনের মিথ্যা মামলার অভিযোগে মানববন্ধন Logo ভেদরগঞ্জে জমি বিক্রির বায়না নিয়ে প্রতারণায় পাল্টা পাল্টি অভিযোগ Logo খুনিদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন

জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতাল নিজেই ক্যান্সারে আক্রান্ত

স্টাফ রিপোর্টার
  • আপডেট সময় : ৪৯ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

রাজধানী ঢাকার মহাখালী এলাকায় অবস্থিত জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, যা দেশের একমাত্র সরকারি ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র। প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্ত থেকে হাজারও রোগী চিকিৎসার আশায় ভিড় জমাচ্ছেন এখানে। কিন্তু বাস্তবে এই হাসপাতাল হয়ে উঠেছে ভোগান্তি, হতাশা আর অবহেলার প্রতীক।
একদিকে রোগীর চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত শয্যা নেই, অন্যদিকে বছরের পর বছর অকেজো চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম সব মিলিয়ে রোগীরা কেবল লড়াই-ই করছেন এখানে, চিকিৎসা পাওয়া হয়ে পড়েছে দুষ্কর। গত রোববার সকাল ১০টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত হাসপাতালটি ঘুরে চিকিৎসা সেবার নানামুখী অপ্রতুলতা দেখা যায়।
হাসপাতালের রেডিওথেরাপি ডিপার্টমেন্টে গিয়ে দেখা যায় সকাল থেকে রেডিওথেরাপির জন্য আসা দেড় থেকে দুইশ রোগী অপেক্ষা করছেন। কেউ মেঝেতে শুয়ে আছেন, কেউ ব্যথায় অস্থির হয়ে বসে আছেন। কিন্তু সেবা পাচ্ছেন না। দু-একজন কোনোরকমে ‘ম্যানেজ’ করছেন। সেবা না পেয়ে কেউ কেউ হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাসপাতালটিতে সব মিলিয়ে আটটি রেডিওথেরাপি যন্ত্র ছিল। এর মধ্যে চারটি বহুদিন ধরে অকেজো, আর দুটি যন্ত্র মেরামত-অযোগ্য। বর্তমানে মাত্র দুটি যন্ত্রে কোনোরকমে সেবা চলছে। এর মধ্যে অতিরিক্ত চাপের কারণে প্রায়ই একটি বিকল হয়ে পড়ে। ফলে চিকিৎসা নিতে আসা শত শত রোগীকে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়। অনেকে দীর্ঘ সময় বসে থেকেও সেবা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যান। সাভারের আশুলিয়া থেকে আসা অটোরিকশা চালক সোলায়মান সরদার হাসপাতালের বারান্দায় বসে তীব্র ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। মলদ্বারে দ্বিতীয়বার টিউমার ধরা পড়েছে তার। প্রথমবার দীর্ঘ চিকিৎসা ও অপারেশনের পর কিছুটা সুস্থ ছিলেন। এবার ব্যথা এমন যে কোমর থেকে পা পর্যন্ত পুরো একটি পাশ অবশ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ডাক্তার বলেছেন আমাকে ১৪ দিন পরপর কেমোথেরাপি দিতে হবে। কিন্তু এই হাসপাতালে ভর্তি হতেই নাকি এক মাস লাগে। যদি ভর্তিতেই এত সময় লাগে, তাহলে কীভাবে সময়মতো চিকিৎসা পাব? হতাশ সোলায়মান আরও বলেন, শুরুতে ৮টি কেমোথেরাপি, ২৫টি রেডিওথেরাপি দিয়েছিলাম। পরে আবার ৯টি কেমো দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি কেমোতে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত লেগেছে। তারপর অপারেশন। সব মিলিয়ে টাকা-পয়সা যা ছিল, শেষ। জীবনটাই শেষ হয়ে যাচ্ছে।
হাসপাতালটির দ্বিতীয় তলায় সার্জিক্যাল অনকোলোজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুস সালামের রুমের সামনে বসেছিলেন ষাটোর্ধ্ব রোকেয়া বেগম। স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত তিনি। চাঁদপুর থেকে নিয়মিত ঢাকায় আসেন চিকিৎসার জন্য। চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “এতদূর থেকে নিয়মিত আসা-যাওয়াটা আমাদের জন্য খুব কঠিন। ঢাকায় কোনো আত্মীয়-স্বজনও নেই যে সেখানে থেকে চিকিৎসা নেব। এদিকে এখানে ভর্তি হওয়ার জন্য লাগে লম্বা সময়। মাসখানেক ধরে শয্যা খালি না থাকা, খরচ জোগাড় করা—সব মিলিয়ে আমার ভোগান্তি আরও বেড়ে গেছে। বাড়ি থেকে টাকা আনা, প্রতিদিনের খাবার খরচ ও চিকিৎসার খরচ মেলানো দুঃসহ হয়ে পড়েছে। রোকেয়ার অভিযোগ, ক্যান্সারের মতো গুরুতর রোগ নিয়েও রোগীদের মাসের পর মাস অপেক্ষায় রাখা হয়। এর ফলে তাদের শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ার পাশাপাশি মানসিক চাপও বেড়ে যায়। ক্যান্সার হাসপাতালে এই দুর্ভোগ-ভোগান্তির চিত্র শুধু সোলাইমান সরদার এবং রোকেয়া বেগমেরই নয়। হাসপাতালটিতে সেবা নিতে আসা হাজারো রোগীকে এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় নিত্যদিন।
কর্তৃপক্ষ বলছে, ক্যান্সার হাসপাতালের বহির্বিভাগে দৈনিক গড়ে প্রায় ১ হাজারের বেশি রোগী চিকিৎসা নেন। তাদের মধ্যে অন্তত ৫০০ রোগী ভর্তি হওয়ার মতো থাকে। কিন্তু এ ধরনের একজন রোগী হাসপাতালে ভর্তি করা হলে অন্তত এক মাস রেখে চিকিৎসা দিতে হয়। এতে প্রতিদিনই রোগীর চাপ বেড়ে যাচ্ছে। দেশের একমাত্র বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতাল হওয়ায় সারা দেশের প্রায় ১৩ থেকে ১৫ লাখ ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর একমাত্র আশ্রয়স্থল এই হাসপাতাল। মরণঘাতী এই রোগ থেকে বেঁচে থাকার তীব্র আশায় প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার রোগী ভিড় জমাচ্ছেন এখানে। অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে যথারীতি চিকিৎসক-নার্সরা হিমশিম খাচ্ছেন, এমনকি এই চাপে প্রায় সময়ই বিকল হয়ে পড়ছে রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপির বিভিন্ন যন্ত্রপাতি।
জানা গেছে, ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকায় রেডিওথেরাপির কোর্স সম্পন্ন করা হয়, যা প্রাইভেট হাসপাতালে শেষ করতে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা লাগে। সাধারণত সার্ভিক্যাল ক্যান্সারে ২৫টি রেডিওথেরাপি, ব্রেস্ট ক্যান্সারে ১৫টি এবং মস্তিষ্কের ক্যান্সারের জন্য প্রয়োজন হয় ২৫টি রেডিওথেরাপির।
হাসপাতালটির সার্জিক্যাল অনকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুস সালাম বলেন, ‘রোগীদের এই চিত্র আমাদের প্রতিদিনই দেখতে হয়। আমরা অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে যতটা পারছি সেবা দিচ্ছি। তবে অনেক সময় আমাদের যন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়। আমরা সেবা দিতে চাইলেও এত রোগীর চাপ মেশিনগুলো নিতে পারে না। তিনি বলেন, আমাদের বর্তমানে দুটি রেডিওথেরাপি মেশিন চলছে। ৫ আগস্টের আগে এগুলোও ছিল না। বর্তমান পরিচালক এসে দৌড়াদৌড়ি করে দুটি যন্ত্র ম্যানেজ করেছেন বলেই এখন দৈনিক দুইশর মতো রোগী রেডিওথেরাপি পাচ্ছে। কোনো রোগী যদি চিকিৎসা সেবা নিতে এসে ফিরে যান, আমাদের কষ্ট লাগে। রোগীদের ঠিকমতো চিকিৎসা দিতে না পারাটা একটি মেডিকেল টিমের জন্য অত্যন্ত হতাশাজনক।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন এই হাসপাতালের ছয়টি রেডিওথেরাপি মেশিনের মধ্যে চারটি গত কয়েক বছরে নষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে। এতদিন অবশিষ্ট দুটি মেশিন দিয়ে দৈনিক ২০০ থেকে ২২০ জন রোগীকে সেবা দেওয়া হচ্ছিল। যদিও চাহিদা অনেক বেশি। গত ২১ ডিসেম্বর এক রোগীকে থেরাপি দেওয়ার সময় একটি মেশিন নষ্ট হয়ে যায়। পরদিন নষ্ট হয়ে যায় সচল থাকা বাকি মেশিনটিও। তারপর দেড় মাস সম্পূর্ণ বন্ধ থাকার পর গত ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে দুটি নতুন রেডিওথেরাপি মেশিন চালু করা হয়।
নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা বাকি ৪টি রেডিওথেরাপি মেশিন কবে নাগাদ বা আদৌ মেরামত সম্ভব কি না সে ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে পারেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে খুব শিগগিরই নতুন একটি রেডিওথেরাপি মেশিন বসানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন তারা। চট্টগ্রাম থেকে ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য স্ত্রীকে এনেছেন দেলোয়ার হোসেন। হাসপাতালের শয্যা না থাকায় তারা বাইরে ডরমিটরিতে উঠেছেন। দেলোয়ার জানান, ‘আমার স্ত্রী কেমোথেরাপি নেবেন। কিন্তু শয্যা না থাকায় বাইরে থাকতে হচ্ছে। প্রতিদিন খরচ হচ্ছে ৮০০–১,০০০ টাকা, ওষুধের খরচ আলাদা। সাধারণ মানুষের জন্য এখানে চিকিৎসা মানেই ঋণ, কষ্ট আর হতাশা। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ তার স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। পরিবারের কাছে এখানকার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ থাকলেও হাসপাতালের সীমিত শয্যা ও দীর্ঘ ভর্তি প্রক্রিয়া এবং চিকিৎসা প্রক্রিয়া পুরো পরিবারকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এসব প্রসঙ্গে হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর কবিরের সঙ্গে বক্তব্য নিতে তার দপ্তরে গেলে জানা যায় তিনি অপারেশন থিয়েটারে আছেন। হাসপাতালটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা এক চিকিৎসক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, ক্যান্সার হাসপাতালে রোগীদের এই দুর্ভোগ প্রায় নিত্যদিনের চিত্র। আমরা নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আন্তরিকতার সঙ্গে সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে যাচ্ছি। ৫ আগস্টের পর নতুন পরিচালক আসার পর সেবার মান আগের চেয়ে উন্নত করতে পেরেছি।
রোগী ভর্তিতে এক মাস লাগার বিষয়ে জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনি যদি পাশের বক্ষব্যাধী হাসপাতালে একটি সার্জারি রোগী ভর্তি করাতে চান, তাহলে আপনাকে মিনিমাম ছয় মাস অপেক্ষা করতে হবে। ক্যান্সার হাসপাতাল তো গোটা বাংলাদেশে একটা। সারা বাংলাদেশে কত পরিমাণ ক্যান্সার রোগী রয়েছে? তাদের জন্য বাংলাদেশের একমাত্র স্পেশালাইজড ক্যান্সার হাসপাতাল এটি। বাংলাদেশের একমাত্র হাসপাতাল এটি, যেখানে একসময় প্রতিদিন ৬০০ রোগী রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়েছে। আপনি খোঁজ করে দেখতে পারেন, এমনটা সারা পৃথিবীর কোনো হাসপাতালে নেই। যন্ত্রপাতির স্বল্পতার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমাদের সবশেষ ৬টি রেডিওথেরাপি মেশিন ছিল, যেগুলো দিয়ে দৈনিক ৬০০ রোগীকে থেরাপি দেওয়া হতো। শেষ যে মেশিনটি নষ্ট হয়েছে, সেটি ২০০৯ সালের। সেটিও ২০২৪ সালের শেষের দিকে নষ্ট হয়েছে। এরপর দীর্ঘদিন রেডিওথেরাপি বন্ধ ছিল। কিন্তু ৫ আগস্টের পর নতুন ডিরেক্টর দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি মন্ত্রণালয়ে দৌড়াদৌড়ি করে দুটি মেশিন চালু করার ব্যবস্থা করেছেন এবং আরেকটি মেশিন ক্রয়ের অনুমোদন এনেছেন। সেটি সিএমএসডি থেকে আমাদের হাতে আসবে। অর্থাৎ, বর্তমানে দুটি মেশিন চলছে এবং আরেকটি কেনার প্রক্রিয়ায় আছে। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর দেশে প্রায় দুই লাখ মানুষের শরীরে নতুন করে ক্যান্সার শনাক্ত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগী প্রায় দ্বিগুণ হবে। সেই হিসেবে রেডিওথেরাপি চিকিৎসার জন্য সারাদেশে অন্তত ১৮০টি সেন্টার থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে সেন্টার আছে ২৪টি, এর মধ্যে সরকারি মাত্র ১২টি। সরকারি সেন্টারগুলোর মধ্যে পাঁচটিতে দীর্ঘদিন ধরে রেডিওথেরাপি মেশিন অচল হয়ে আছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতাল নিজেই ক্যান্সারে আক্রান্ত

আপডেট সময় :

রাজধানী ঢাকার মহাখালী এলাকায় অবস্থিত জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, যা দেশের একমাত্র সরকারি ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র। প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্ত থেকে হাজারও রোগী চিকিৎসার আশায় ভিড় জমাচ্ছেন এখানে। কিন্তু বাস্তবে এই হাসপাতাল হয়ে উঠেছে ভোগান্তি, হতাশা আর অবহেলার প্রতীক।
একদিকে রোগীর চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত শয্যা নেই, অন্যদিকে বছরের পর বছর অকেজো চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম সব মিলিয়ে রোগীরা কেবল লড়াই-ই করছেন এখানে, চিকিৎসা পাওয়া হয়ে পড়েছে দুষ্কর। গত রোববার সকাল ১০টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত হাসপাতালটি ঘুরে চিকিৎসা সেবার নানামুখী অপ্রতুলতা দেখা যায়।
হাসপাতালের রেডিওথেরাপি ডিপার্টমেন্টে গিয়ে দেখা যায় সকাল থেকে রেডিওথেরাপির জন্য আসা দেড় থেকে দুইশ রোগী অপেক্ষা করছেন। কেউ মেঝেতে শুয়ে আছেন, কেউ ব্যথায় অস্থির হয়ে বসে আছেন। কিন্তু সেবা পাচ্ছেন না। দু-একজন কোনোরকমে ‘ম্যানেজ’ করছেন। সেবা না পেয়ে কেউ কেউ হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাসপাতালটিতে সব মিলিয়ে আটটি রেডিওথেরাপি যন্ত্র ছিল। এর মধ্যে চারটি বহুদিন ধরে অকেজো, আর দুটি যন্ত্র মেরামত-অযোগ্য। বর্তমানে মাত্র দুটি যন্ত্রে কোনোরকমে সেবা চলছে। এর মধ্যে অতিরিক্ত চাপের কারণে প্রায়ই একটি বিকল হয়ে পড়ে। ফলে চিকিৎসা নিতে আসা শত শত রোগীকে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়। অনেকে দীর্ঘ সময় বসে থেকেও সেবা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যান। সাভারের আশুলিয়া থেকে আসা অটোরিকশা চালক সোলায়মান সরদার হাসপাতালের বারান্দায় বসে তীব্র ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। মলদ্বারে দ্বিতীয়বার টিউমার ধরা পড়েছে তার। প্রথমবার দীর্ঘ চিকিৎসা ও অপারেশনের পর কিছুটা সুস্থ ছিলেন। এবার ব্যথা এমন যে কোমর থেকে পা পর্যন্ত পুরো একটি পাশ অবশ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ডাক্তার বলেছেন আমাকে ১৪ দিন পরপর কেমোথেরাপি দিতে হবে। কিন্তু এই হাসপাতালে ভর্তি হতেই নাকি এক মাস লাগে। যদি ভর্তিতেই এত সময় লাগে, তাহলে কীভাবে সময়মতো চিকিৎসা পাব? হতাশ সোলায়মান আরও বলেন, শুরুতে ৮টি কেমোথেরাপি, ২৫টি রেডিওথেরাপি দিয়েছিলাম। পরে আবার ৯টি কেমো দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি কেমোতে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত লেগেছে। তারপর অপারেশন। সব মিলিয়ে টাকা-পয়সা যা ছিল, শেষ। জীবনটাই শেষ হয়ে যাচ্ছে।
হাসপাতালটির দ্বিতীয় তলায় সার্জিক্যাল অনকোলোজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুস সালামের রুমের সামনে বসেছিলেন ষাটোর্ধ্ব রোকেয়া বেগম। স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত তিনি। চাঁদপুর থেকে নিয়মিত ঢাকায় আসেন চিকিৎসার জন্য। চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “এতদূর থেকে নিয়মিত আসা-যাওয়াটা আমাদের জন্য খুব কঠিন। ঢাকায় কোনো আত্মীয়-স্বজনও নেই যে সেখানে থেকে চিকিৎসা নেব। এদিকে এখানে ভর্তি হওয়ার জন্য লাগে লম্বা সময়। মাসখানেক ধরে শয্যা খালি না থাকা, খরচ জোগাড় করা—সব মিলিয়ে আমার ভোগান্তি আরও বেড়ে গেছে। বাড়ি থেকে টাকা আনা, প্রতিদিনের খাবার খরচ ও চিকিৎসার খরচ মেলানো দুঃসহ হয়ে পড়েছে। রোকেয়ার অভিযোগ, ক্যান্সারের মতো গুরুতর রোগ নিয়েও রোগীদের মাসের পর মাস অপেক্ষায় রাখা হয়। এর ফলে তাদের শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ার পাশাপাশি মানসিক চাপও বেড়ে যায়। ক্যান্সার হাসপাতালে এই দুর্ভোগ-ভোগান্তির চিত্র শুধু সোলাইমান সরদার এবং রোকেয়া বেগমেরই নয়। হাসপাতালটিতে সেবা নিতে আসা হাজারো রোগীকে এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় নিত্যদিন।
কর্তৃপক্ষ বলছে, ক্যান্সার হাসপাতালের বহির্বিভাগে দৈনিক গড়ে প্রায় ১ হাজারের বেশি রোগী চিকিৎসা নেন। তাদের মধ্যে অন্তত ৫০০ রোগী ভর্তি হওয়ার মতো থাকে। কিন্তু এ ধরনের একজন রোগী হাসপাতালে ভর্তি করা হলে অন্তত এক মাস রেখে চিকিৎসা দিতে হয়। এতে প্রতিদিনই রোগীর চাপ বেড়ে যাচ্ছে। দেশের একমাত্র বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতাল হওয়ায় সারা দেশের প্রায় ১৩ থেকে ১৫ লাখ ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর একমাত্র আশ্রয়স্থল এই হাসপাতাল। মরণঘাতী এই রোগ থেকে বেঁচে থাকার তীব্র আশায় প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার রোগী ভিড় জমাচ্ছেন এখানে। অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে যথারীতি চিকিৎসক-নার্সরা হিমশিম খাচ্ছেন, এমনকি এই চাপে প্রায় সময়ই বিকল হয়ে পড়ছে রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপির বিভিন্ন যন্ত্রপাতি।
জানা গেছে, ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকায় রেডিওথেরাপির কোর্স সম্পন্ন করা হয়, যা প্রাইভেট হাসপাতালে শেষ করতে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা লাগে। সাধারণত সার্ভিক্যাল ক্যান্সারে ২৫টি রেডিওথেরাপি, ব্রেস্ট ক্যান্সারে ১৫টি এবং মস্তিষ্কের ক্যান্সারের জন্য প্রয়োজন হয় ২৫টি রেডিওথেরাপির।
হাসপাতালটির সার্জিক্যাল অনকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুস সালাম বলেন, ‘রোগীদের এই চিত্র আমাদের প্রতিদিনই দেখতে হয়। আমরা অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে যতটা পারছি সেবা দিচ্ছি। তবে অনেক সময় আমাদের যন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়। আমরা সেবা দিতে চাইলেও এত রোগীর চাপ মেশিনগুলো নিতে পারে না। তিনি বলেন, আমাদের বর্তমানে দুটি রেডিওথেরাপি মেশিন চলছে। ৫ আগস্টের আগে এগুলোও ছিল না। বর্তমান পরিচালক এসে দৌড়াদৌড়ি করে দুটি যন্ত্র ম্যানেজ করেছেন বলেই এখন দৈনিক দুইশর মতো রোগী রেডিওথেরাপি পাচ্ছে। কোনো রোগী যদি চিকিৎসা সেবা নিতে এসে ফিরে যান, আমাদের কষ্ট লাগে। রোগীদের ঠিকমতো চিকিৎসা দিতে না পারাটা একটি মেডিকেল টিমের জন্য অত্যন্ত হতাশাজনক।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন এই হাসপাতালের ছয়টি রেডিওথেরাপি মেশিনের মধ্যে চারটি গত কয়েক বছরে নষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে। এতদিন অবশিষ্ট দুটি মেশিন দিয়ে দৈনিক ২০০ থেকে ২২০ জন রোগীকে সেবা দেওয়া হচ্ছিল। যদিও চাহিদা অনেক বেশি। গত ২১ ডিসেম্বর এক রোগীকে থেরাপি দেওয়ার সময় একটি মেশিন নষ্ট হয়ে যায়। পরদিন নষ্ট হয়ে যায় সচল থাকা বাকি মেশিনটিও। তারপর দেড় মাস সম্পূর্ণ বন্ধ থাকার পর গত ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে দুটি নতুন রেডিওথেরাপি মেশিন চালু করা হয়।
নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা বাকি ৪টি রেডিওথেরাপি মেশিন কবে নাগাদ বা আদৌ মেরামত সম্ভব কি না সে ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে পারেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে খুব শিগগিরই নতুন একটি রেডিওথেরাপি মেশিন বসানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন তারা। চট্টগ্রাম থেকে ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য স্ত্রীকে এনেছেন দেলোয়ার হোসেন। হাসপাতালের শয্যা না থাকায় তারা বাইরে ডরমিটরিতে উঠেছেন। দেলোয়ার জানান, ‘আমার স্ত্রী কেমোথেরাপি নেবেন। কিন্তু শয্যা না থাকায় বাইরে থাকতে হচ্ছে। প্রতিদিন খরচ হচ্ছে ৮০০–১,০০০ টাকা, ওষুধের খরচ আলাদা। সাধারণ মানুষের জন্য এখানে চিকিৎসা মানেই ঋণ, কষ্ট আর হতাশা। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ তার স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। পরিবারের কাছে এখানকার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ থাকলেও হাসপাতালের সীমিত শয্যা ও দীর্ঘ ভর্তি প্রক্রিয়া এবং চিকিৎসা প্রক্রিয়া পুরো পরিবারকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এসব প্রসঙ্গে হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর কবিরের সঙ্গে বক্তব্য নিতে তার দপ্তরে গেলে জানা যায় তিনি অপারেশন থিয়েটারে আছেন। হাসপাতালটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা এক চিকিৎসক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, ক্যান্সার হাসপাতালে রোগীদের এই দুর্ভোগ প্রায় নিত্যদিনের চিত্র। আমরা নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আন্তরিকতার সঙ্গে সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে যাচ্ছি। ৫ আগস্টের পর নতুন পরিচালক আসার পর সেবার মান আগের চেয়ে উন্নত করতে পেরেছি।
রোগী ভর্তিতে এক মাস লাগার বিষয়ে জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনি যদি পাশের বক্ষব্যাধী হাসপাতালে একটি সার্জারি রোগী ভর্তি করাতে চান, তাহলে আপনাকে মিনিমাম ছয় মাস অপেক্ষা করতে হবে। ক্যান্সার হাসপাতাল তো গোটা বাংলাদেশে একটা। সারা বাংলাদেশে কত পরিমাণ ক্যান্সার রোগী রয়েছে? তাদের জন্য বাংলাদেশের একমাত্র স্পেশালাইজড ক্যান্সার হাসপাতাল এটি। বাংলাদেশের একমাত্র হাসপাতাল এটি, যেখানে একসময় প্রতিদিন ৬০০ রোগী রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়েছে। আপনি খোঁজ করে দেখতে পারেন, এমনটা সারা পৃথিবীর কোনো হাসপাতালে নেই। যন্ত্রপাতির স্বল্পতার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমাদের সবশেষ ৬টি রেডিওথেরাপি মেশিন ছিল, যেগুলো দিয়ে দৈনিক ৬০০ রোগীকে থেরাপি দেওয়া হতো। শেষ যে মেশিনটি নষ্ট হয়েছে, সেটি ২০০৯ সালের। সেটিও ২০২৪ সালের শেষের দিকে নষ্ট হয়েছে। এরপর দীর্ঘদিন রেডিওথেরাপি বন্ধ ছিল। কিন্তু ৫ আগস্টের পর নতুন ডিরেক্টর দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি মন্ত্রণালয়ে দৌড়াদৌড়ি করে দুটি মেশিন চালু করার ব্যবস্থা করেছেন এবং আরেকটি মেশিন ক্রয়ের অনুমোদন এনেছেন। সেটি সিএমএসডি থেকে আমাদের হাতে আসবে। অর্থাৎ, বর্তমানে দুটি মেশিন চলছে এবং আরেকটি কেনার প্রক্রিয়ায় আছে। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর দেশে প্রায় দুই লাখ মানুষের শরীরে নতুন করে ক্যান্সার শনাক্ত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগী প্রায় দ্বিগুণ হবে। সেই হিসেবে রেডিওথেরাপি চিকিৎসার জন্য সারাদেশে অন্তত ১৮০টি সেন্টার থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে সেন্টার আছে ২৪টি, এর মধ্যে সরকারি মাত্র ১২টি। সরকারি সেন্টারগুলোর মধ্যে পাঁচটিতে দীর্ঘদিন ধরে রেডিওথেরাপি মেশিন অচল হয়ে আছে।