ঢাকা ০৮:০৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ডাকসু নির্বাচন : ক্যাম্পাসে নেতৃত্বের বিবর্তন

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১২ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি ছিল একেবারেই ভিন্ন, শিক্ষণীয় এবং আদর্শমুখী। তখন নেতৃত্বের মূল ভিত্তি ছিল মেধা, অধ্যবসায়, সততা এবং ন্যায়পরায়ণতা। দেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি সচেতনতা সৃষ্টির এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করত। হলে হলে নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার সময় প্রথমে খোঁজা হতো—কে ভালো ছাত্র, কে ভদ্র, কে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় বা কে নেতৃত্বের যোগ্য। সাধারণ ছাত্ররা তখন মেধাবী ও আলোকিত ছাত্রদের আস্থা রাখত এবং তাদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করত।
সেই সময়কার ছাত্রনেতাদের অনেকেই কেবল শিক্ষাঙ্গনে অবদান রাখেননি; তাঁরা বড় বড় সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতেও সফল হয়েছেন। প্রশাসন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ক্ষেত্র এবং রাষ্ট্রীয় সেবায় তারা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এমনকি দেশের জাতীয় রাজনীতিতেও অনেক সাবেক ছাত্রনেতা গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বলা যায়, সেই সময়ের ছাত্র রাজনীতি ছিল ভবিষ্যতের নেতৃত্ব গঠনের এক গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যালয়, যা শুধু ক্যাম্পাসের জন্য নয়, দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্যও মেধাবী ও দায়িত্বশীল নেতা তৈরিতে সহায়ক।
কিন্তু আশির দশকে ধীরে ধীরে চরিত্রে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। নব্বইয়ের দশকে ছাত্র রাজনীতি রূপ নেয় একধরনের হিরোইজমে। তখন মেধা নয়, বরং কে কতটা দাপট দেখাতে পারে, কে কতটা প্রভাবশালী বা ভয় সৃষ্টি করতে পারে—এটাই হয়ে ওঠে নেতৃত্বের মানদণ্ড। ক্যাম্পাসে তখন এমন কিছু ছাত্রনেতা উঠে আসে, যাদের জনপ্রিয়তা কেবল পড়াশোনার কৃতিত্বের কারণে নয়, বরং প্রভাব প্রদর্শনের কারণে বৃদ্ধি পায়। জনপ্রিয় সাময়িকীগুলোতেও সেই সময় এই নেতাদের “হিরো” হিসেবে প্রচার করা হতো। ছাত্রদের আড্ডার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়—কে কতটা প্রভাবশালী বা ভয়ংকর।
ধীরে ধীরে এই প্রবণতা শিক্ষাঙ্গনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে শুরু করে। পড়াশোনার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেধাবী ও ভদ্র ছাত্ররা নেতৃত্ব থেকে দূরে সরে যায়। সাধারণ ছাত্ররা রাজনীতির ভীতিকর ধারা নিয়ে ভয় পেতে শুরু করে। হলে হলে সিট বণ্টন, গণরুম, গেস্টরুম—এসব হয়ে ওঠে সাধারণ ছাত্রদের জন্য আতঙ্কের স্থান। এভাবে ছাত্র রাজনীতি তার ইতিবাচক চরিত্র হারাতে থাকে।
তবে সময় বদলেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে, সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে নতুন সচেতনতা, উদ্যম এবং দায়িত্ববোধ তৈরি হয়েছে। এখন তারা আর অন্ধভাবে কাউকে হিরো মানতে রাজি নয়। বরং তারা প্রশ্ন করছে, প্রতিবাদ করছে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াচ্ছে। যারা একসময় ভয় দেখিয়ে নেতৃত্ব দখল করত, সেই প্রবণতাকে ছাত্ররাই প্রকাশ্যে প্রতিহত করছে।
এর পেছনে বড় কারণ হলো ডিজিটাল যুগের উন্মুক্ত তথ্যপ্রবাহ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সাধারণ ছাত্রদের হাতে এনে দিয়েছে নতুন শক্তি। তারা এখন ক্যাম্পাসের যেকোনো অন্যায় মুহূর্তে প্রকাশ্যে আনতে পারছে। ফলে ভয় দেখিয়ে নেতৃত্ব দখলের সুযোগ অনেকটাই কমে গেছে। এতে ছাত্র রাজনীতির প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় থাকে এবং যোগ্য নেতৃত্বের সুযোগ বৃদ্ধি পায়।
এছাড়া দেখা গেছে, কিছু বিকল্প প্যানেল ও গোপন শিবির ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছে। তারা নির্যাতিত ছাত্রদের জন্য মেসের ব্যবস্থা করছে, টিউশনের ব্যবস্থা করছে, আর্থিক সহায়তা দিয়েছে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। এতে সাধারণ ছাত্রদের জীবন সহজ হচ্ছে এবং তারা আরও সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারছে।
এবারের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্ররা ছাত্রদলকে ছাত্রলীগের প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখেছে। তারা ভেবেছে, ছাত্রদল জিতলে আবার সেই গণরুম, জোর করে মিছিলে নেওয়া এবং ভয় প্রদর্শনের রাজনীতি ফিরে আসবে। অন্যদিকে নির্দলীয় বা বিকল্প প্যানেলগুলোকে তারা দুর্বল মনে করেছে—যারা হয়তো তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না। ফলে ছাত্ররা স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে: এখন ছাত্র রাজনীতি করতে হলে ভালো ছাত্র হতে হবে, নরম ভাষায় কথা বলতে হবে, এবং ছাত্রদের প্রয়োজনের সময় পাশে দাঁড়াতে হবে। সময়ের চাহিদা বুঝতে হবে—অথবা নতুন চাহিদা তৈরি করতে হবে। জড়তা ভাঙতে হবে। টিকে থাকতে হলে নতুন ধারণা দিতে হবে।
১৯৫২ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত জাতির সংকটময় মুহূর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাদের সংগ্রামই স্বাধীনতা, ন্যায় ও গণতন্ত্রের পথকে দৃঢ় করেছে। আজকের ছাত্ররা আর হিরো বানানো নেতার অন্ধ অনুসারী হতে চায় না। তারা বরং নিজের অধিকার, স্বাধীন চিন্তা এবং ন্যায়বিচারের প্রশ্নে সরব হচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক পরিবর্তন। ছাত্র রাজনীতি যদি এই ধারা ধরে রাখতে পারে, তবে হয়তো আবারও মেধাবী, ভদ্র, সৎ এবং আলোকিত ছাত্রদের নেতৃত্বে আসার সুযোগ তৈরি হবে।
বাংলাদেশের ইতিহাস প্রমাণ দেয় যে, ছাত্র আন্দোলনই জাতিকে স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের পথে এগিয়ে দিয়েছে। তাই ছাত্র রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হবে। তবে সেটা হতে হবে ইতিবাচক, সৃজনশীল এবং গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে। হিরোইজমের জায়গা নিতে হবে মেধা, সততা ও মানবিকতার।
মোটকথা, ছাত্র রাজনীতি এখন আর কোনো দলের লেজুবৃত্তি নয়। এটি হতে হবে সত্যিকার অর্থেই ছাত্রদের কল্যাণ ও স্বার্থে। সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে, নতুন চাহিদার আলোকে, ছাত্র রাজনীতি কেবল ক্যাম্পাসের জন্য নয়, দেশের ভবিষ্যতের জন্যও দায়বদ্ধ হতে হবে। আগের মতো ভয়, প্রভাব বা আর্থিক সুবিধার রাজনীতি আর চলবে না। এখন নেতৃত্বের মাপকাঠি হবে সততা, ন্যায্যতা, সহানুভূতি এবং সাধারণ ছাত্রদের পাশে দাঁড়ানো।
এক্ষেত্রে ডারউইনের “Survival of the fittest” মতবাদ প্রাসঙ্গিক। শিক্ষাঙ্গনের ছাত্ররাজনীতিতে যারা যোগ্য, সততা ও ন্যায়ের পথে নেতৃত্ব দেয়, তারা টিকে থাকে। যারা অদক্ষ বা অন্যায়ের পথে নেতৃত্বের চেষ্টা করে, তারা স্বাভাবিকভাবে পিছিয়ে যায়। অর্থাৎ, ছাত্র রাজনীতি এখন একধরনের প্রাকৃতিক নির্বাচন – যেখানে যোগ্য এবং ন্যায়পরায়ণ নেতৃত্বই টিকে থাকতে পারে।
নতুন প্রজন্ম চাইছে এমন নেতৃত্ব যা প্রেরণা দেয়, উদ্যম জাগায়, এবং সত্যিকার অর্থে সবাইকে উন্নতির পথে নিয়ে যায়। আমরা চাই না, ছাত্রছাত্রীরা টেন্ডারবাজি বা তদবিরের বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকুক। তাই ছাত্রদের প্রতি আহ্বান—নিজের অধিকার জানুন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসী হোন, এবং সদা ন্যায় ও মেধার পথে নেতৃত্ব দিন। এই পথই আগামী দিনের শক্তিশালী, দায়িত্বশীল ও মানবিক নেতৃত্বের ভিত্তি স্থাপন করবে।
মো. মাহবুবুর রহমান
সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ
ফরিদপুর সিটি কলেজ, ফরিদপুর।
ইমেইল :mmrrajbari71@gmail.com

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ডাকসু নির্বাচন : ক্যাম্পাসে নেতৃত্বের বিবর্তন

আপডেট সময় :

স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি ছিল একেবারেই ভিন্ন, শিক্ষণীয় এবং আদর্শমুখী। তখন নেতৃত্বের মূল ভিত্তি ছিল মেধা, অধ্যবসায়, সততা এবং ন্যায়পরায়ণতা। দেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি সচেতনতা সৃষ্টির এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করত। হলে হলে নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার সময় প্রথমে খোঁজা হতো—কে ভালো ছাত্র, কে ভদ্র, কে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় বা কে নেতৃত্বের যোগ্য। সাধারণ ছাত্ররা তখন মেধাবী ও আলোকিত ছাত্রদের আস্থা রাখত এবং তাদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করত।
সেই সময়কার ছাত্রনেতাদের অনেকেই কেবল শিক্ষাঙ্গনে অবদান রাখেননি; তাঁরা বড় বড় সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতেও সফল হয়েছেন। প্রশাসন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ক্ষেত্র এবং রাষ্ট্রীয় সেবায় তারা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এমনকি দেশের জাতীয় রাজনীতিতেও অনেক সাবেক ছাত্রনেতা গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বলা যায়, সেই সময়ের ছাত্র রাজনীতি ছিল ভবিষ্যতের নেতৃত্ব গঠনের এক গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যালয়, যা শুধু ক্যাম্পাসের জন্য নয়, দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্যও মেধাবী ও দায়িত্বশীল নেতা তৈরিতে সহায়ক।
কিন্তু আশির দশকে ধীরে ধীরে চরিত্রে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। নব্বইয়ের দশকে ছাত্র রাজনীতি রূপ নেয় একধরনের হিরোইজমে। তখন মেধা নয়, বরং কে কতটা দাপট দেখাতে পারে, কে কতটা প্রভাবশালী বা ভয় সৃষ্টি করতে পারে—এটাই হয়ে ওঠে নেতৃত্বের মানদণ্ড। ক্যাম্পাসে তখন এমন কিছু ছাত্রনেতা উঠে আসে, যাদের জনপ্রিয়তা কেবল পড়াশোনার কৃতিত্বের কারণে নয়, বরং প্রভাব প্রদর্শনের কারণে বৃদ্ধি পায়। জনপ্রিয় সাময়িকীগুলোতেও সেই সময় এই নেতাদের “হিরো” হিসেবে প্রচার করা হতো। ছাত্রদের আড্ডার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়—কে কতটা প্রভাবশালী বা ভয়ংকর।
ধীরে ধীরে এই প্রবণতা শিক্ষাঙ্গনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে শুরু করে। পড়াশোনার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেধাবী ও ভদ্র ছাত্ররা নেতৃত্ব থেকে দূরে সরে যায়। সাধারণ ছাত্ররা রাজনীতির ভীতিকর ধারা নিয়ে ভয় পেতে শুরু করে। হলে হলে সিট বণ্টন, গণরুম, গেস্টরুম—এসব হয়ে ওঠে সাধারণ ছাত্রদের জন্য আতঙ্কের স্থান। এভাবে ছাত্র রাজনীতি তার ইতিবাচক চরিত্র হারাতে থাকে।
তবে সময় বদলেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে, সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে নতুন সচেতনতা, উদ্যম এবং দায়িত্ববোধ তৈরি হয়েছে। এখন তারা আর অন্ধভাবে কাউকে হিরো মানতে রাজি নয়। বরং তারা প্রশ্ন করছে, প্রতিবাদ করছে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াচ্ছে। যারা একসময় ভয় দেখিয়ে নেতৃত্ব দখল করত, সেই প্রবণতাকে ছাত্ররাই প্রকাশ্যে প্রতিহত করছে।
এর পেছনে বড় কারণ হলো ডিজিটাল যুগের উন্মুক্ত তথ্যপ্রবাহ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সাধারণ ছাত্রদের হাতে এনে দিয়েছে নতুন শক্তি। তারা এখন ক্যাম্পাসের যেকোনো অন্যায় মুহূর্তে প্রকাশ্যে আনতে পারছে। ফলে ভয় দেখিয়ে নেতৃত্ব দখলের সুযোগ অনেকটাই কমে গেছে। এতে ছাত্র রাজনীতির প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় থাকে এবং যোগ্য নেতৃত্বের সুযোগ বৃদ্ধি পায়।
এছাড়া দেখা গেছে, কিছু বিকল্প প্যানেল ও গোপন শিবির ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছে। তারা নির্যাতিত ছাত্রদের জন্য মেসের ব্যবস্থা করছে, টিউশনের ব্যবস্থা করছে, আর্থিক সহায়তা দিয়েছে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। এতে সাধারণ ছাত্রদের জীবন সহজ হচ্ছে এবং তারা আরও সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারছে।
এবারের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্ররা ছাত্রদলকে ছাত্রলীগের প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখেছে। তারা ভেবেছে, ছাত্রদল জিতলে আবার সেই গণরুম, জোর করে মিছিলে নেওয়া এবং ভয় প্রদর্শনের রাজনীতি ফিরে আসবে। অন্যদিকে নির্দলীয় বা বিকল্প প্যানেলগুলোকে তারা দুর্বল মনে করেছে—যারা হয়তো তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না। ফলে ছাত্ররা স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে: এখন ছাত্র রাজনীতি করতে হলে ভালো ছাত্র হতে হবে, নরম ভাষায় কথা বলতে হবে, এবং ছাত্রদের প্রয়োজনের সময় পাশে দাঁড়াতে হবে। সময়ের চাহিদা বুঝতে হবে—অথবা নতুন চাহিদা তৈরি করতে হবে। জড়তা ভাঙতে হবে। টিকে থাকতে হলে নতুন ধারণা দিতে হবে।
১৯৫২ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত জাতির সংকটময় মুহূর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাদের সংগ্রামই স্বাধীনতা, ন্যায় ও গণতন্ত্রের পথকে দৃঢ় করেছে। আজকের ছাত্ররা আর হিরো বানানো নেতার অন্ধ অনুসারী হতে চায় না। তারা বরং নিজের অধিকার, স্বাধীন চিন্তা এবং ন্যায়বিচারের প্রশ্নে সরব হচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক পরিবর্তন। ছাত্র রাজনীতি যদি এই ধারা ধরে রাখতে পারে, তবে হয়তো আবারও মেধাবী, ভদ্র, সৎ এবং আলোকিত ছাত্রদের নেতৃত্বে আসার সুযোগ তৈরি হবে।
বাংলাদেশের ইতিহাস প্রমাণ দেয় যে, ছাত্র আন্দোলনই জাতিকে স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের পথে এগিয়ে দিয়েছে। তাই ছাত্র রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হবে। তবে সেটা হতে হবে ইতিবাচক, সৃজনশীল এবং গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে। হিরোইজমের জায়গা নিতে হবে মেধা, সততা ও মানবিকতার।
মোটকথা, ছাত্র রাজনীতি এখন আর কোনো দলের লেজুবৃত্তি নয়। এটি হতে হবে সত্যিকার অর্থেই ছাত্রদের কল্যাণ ও স্বার্থে। সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে, নতুন চাহিদার আলোকে, ছাত্র রাজনীতি কেবল ক্যাম্পাসের জন্য নয়, দেশের ভবিষ্যতের জন্যও দায়বদ্ধ হতে হবে। আগের মতো ভয়, প্রভাব বা আর্থিক সুবিধার রাজনীতি আর চলবে না। এখন নেতৃত্বের মাপকাঠি হবে সততা, ন্যায্যতা, সহানুভূতি এবং সাধারণ ছাত্রদের পাশে দাঁড়ানো।
এক্ষেত্রে ডারউইনের “Survival of the fittest” মতবাদ প্রাসঙ্গিক। শিক্ষাঙ্গনের ছাত্ররাজনীতিতে যারা যোগ্য, সততা ও ন্যায়ের পথে নেতৃত্ব দেয়, তারা টিকে থাকে। যারা অদক্ষ বা অন্যায়ের পথে নেতৃত্বের চেষ্টা করে, তারা স্বাভাবিকভাবে পিছিয়ে যায়। অর্থাৎ, ছাত্র রাজনীতি এখন একধরনের প্রাকৃতিক নির্বাচন – যেখানে যোগ্য এবং ন্যায়পরায়ণ নেতৃত্বই টিকে থাকতে পারে।
নতুন প্রজন্ম চাইছে এমন নেতৃত্ব যা প্রেরণা দেয়, উদ্যম জাগায়, এবং সত্যিকার অর্থে সবাইকে উন্নতির পথে নিয়ে যায়। আমরা চাই না, ছাত্রছাত্রীরা টেন্ডারবাজি বা তদবিরের বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকুক। তাই ছাত্রদের প্রতি আহ্বান—নিজের অধিকার জানুন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসী হোন, এবং সদা ন্যায় ও মেধার পথে নেতৃত্ব দিন। এই পথই আগামী দিনের শক্তিশালী, দায়িত্বশীল ও মানবিক নেতৃত্বের ভিত্তি স্থাপন করবে।
মো. মাহবুবুর রহমান
সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ
ফরিদপুর সিটি কলেজ, ফরিদপুর।
ইমেইল :mmrrajbari71@gmail.com