নারায়ণগঞ্জে ত্বকী হত্যা: ৩ মাসের মধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র
- আপডেট সময় : ০৩:০১:১১ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১০৩ বার পড়া হয়েছে
নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার বছর পূর্তী আগেই র্যাব জানিয়েছিলো, তারা যেকোন দিন আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেবে।
কিন্তু র্যাবের এই বয়ানের পর কেটে গেছে দীর্ঘ দশ বছর। আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া তো দূরের কথা, ত্বকী হত্যা নিয়ে কোন আলোচনাও হয়নি দীর্ঘ সময়ে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে পালিয়ে যাবার পর, চাঞ্চল্যকর বহু মামলা, গুমসহ নানা অপরাধের বিষয়ে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন।
এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে ত্বকী হত্যা জড়িত থাকার অভিযোগে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মামলাটির তদন্ত দ্রুত শেষ করে তিন মাসের মধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন র্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা।
র্যাবের এই তৎপরতায় আশা দেখছেন সন্তান হত্যার ন্যায়বিচার পেতে সাড়ে ১১ বছর ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসা ত্বকীর বাবা, সাংস্কৃতিক সংগঠক রফিউর রাব্বি।
ত্বকীর পরিবারের সদস্যদের বরাবরই অভিযোগ ছিল, এ হত্যা মামলায় নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের সম্পৃক্ততা থাকায় তাদের বাঁচাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এই তদন্ত আটকে ছিল।
ত্বকী হত্যায় প্রয়াত সংসদ সদস্য একেএম নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমান সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে সেসময় গণমাধ্যমে ফাঁস হওয়া র্যাবের খসড়া তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল।
আজমেরী আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানের ভাতিজা। সম্প্রতি এ মামলায় গ্রেপ্তার চারজনও আজমেরী ওসমানের ঘনিষ্ঠ।
রফিউর রাব্বি বলেন, এক বছরের মাথায় ২০১৪ সালের ৫ মার্চ র্যাবের তদন্তে সব বেরিয়ে এসেছিল। ওসমান পরিবারের টর্চার সেলে ত্বকীকে কীভাবে হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যায় ফেলা হয়, তার সবই সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিল র্যাব।
কিন্তু যখনই শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে ওসমান পরিবারের পাশে থাকার ঘোষণা দিলেন, তখনই এই মামলার সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
রাব্বি বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পেরিয়েছে মাত্র একমাস। এই সময়ের মধ্যেই র্যাবের তৎপরতায় আমাদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে।
এখন যে চারজন গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাদের নাম অপর এক আসামির জবানবন্দিতে এসেছিল, কিন্তু তারা আগে গ্রেপ্তার হননি। আজকের পরিস্থিতিতে তদন্ত কার্যক্রম আবার শুরু করেছে।
তদন্তকারী সংস্থা সঠিকভাবে এগোচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। আমরা চাই, এই হত্যাকান্ডে জড়িতদের সকলেই যেন আইনের আওতায় আসে। নিরীহ ও নিরাপরাধী কেউ যেন হয়রানির শিকার না হয়।
২০১৩ সালের ৬ মার্চ বিকাল ৪টার দিকে নারায়ণগঞ্জের শায়েস্তা খান রোডের বাসা থেকে বেরিয়ে স্থানীয় সুধীজন পাঠাগারে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয় ১৭ বছর বয়সী ত্বকী।
পরদিন তার ‘এ’ লেভেল পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয়, যেখানে দেখা যায় ত্বকী পদার্থবিজ্ঞানে সর্বোচ্চ ৩০০ নম্বরের মধ্যে ২৯৭ পেয়েছিলেন।
৮ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদীর কুমুদিনী খাল থেকে ত্বকীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশ উদ্ধারের পর রফিউর রাব্বি বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
পরে ১৮ মার্চ শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান, জেলা যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা জহিরুল ইসলাম পারভেজ ওরফে ক্যাঙারু পারভেজ, জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি রাজীব দাস, সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সুজন, সালেহ রহমান সীমান্ত ও রিফাত বিন ওসমানসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৮-১০ জনের বিরুদ্ধে পুলিশ সুপারের কাছে সম্পূরক অভিযোগ জমা দেন রফিউর রাব্বি।
পরে তার আবেদনে হাই কোর্টের নির্দেশে সে বছরের ২০ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মামলাটি র্যাবের কাছে হস্তান্তর করে।
ছিল প্রচ্ছন্ন চাপ
বর্তমানে ত্বকী হত্যা মামলাটি তদন্ত করছে র্যাব-১১। সম্প্রতি মামলাটির অগ্রগতি নিয়ে র্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা দাবি করেন, এক বছর কাজ করে ত্বকী হত্যা মামলার তদন্তের প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছিল র্যাব। সরাসরি অফিসিয়াল নির্দেশনা না থাকলেও প্রচ্ছন্ন চাপে ত্বকী হত্যা মামলার তদন্ত আর এগোনো সম্ভব হয়নি।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানভীর বলেন, ২০১৩ সালেই তৎকালীন অধিনায়কের অধীনে ত্বকী হত্যা মামলার তদন্ত মোটামুটি ক্লোজ করার পর্যায়ে চলে এসেছিল, তখনই ওই অফিসার বদলি হন। এই ব্রেকের পর তদন্ত কাজটা একেবারে থেমে যায়নি, কিন্তু গতিটা মন্থর হয়ে যায়।
কাদের চাপ ছিল জানতে চাইলে র্যাব কর্মকর্তা তানভীর বলেন, তদন্ত বন্ধ করে রাখা বা কাউকে ধরা যাবে না, এমন অফিসিয়াল কোনো নির্দেশনা আমাদের ওপর ছিল না। কিন্তু প্রচ্ছন্ন একটা চাপ তো কাজ করেছেই। শতভাগ দিয়ে আমরা কাজ করতে পারিনি, এটা আমাদের ব্যর্থতা অবশ্যই।
কেননা আমাদের কাজ করার আরও অনেক সুযোগ ছিল। আমি যদি বলি, কেউ আমাকে নিষেধ করেছে সেটা ভুল বলা হবে, কিন্তু সময়টা তখন সঠিক ছিল না। বরং একটা নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য এখনকার সময়টা বেটার।
তিনি বলেন, আমাদের ইনটেনশন কখনোই খারাপ ছিল না। রাদার উই হ্যাড ডেফিনিট অনেস্ট ইনটেনশন ফ্রম দ্য বিগিনিং। আমরা চাইলে খুব সহজভাবে কারও ইচ্ছা অনুযায়ী তদন্ত করতে পারতাম, সেইটা আমরা করিনি।
বিষয়টা আজ থেকে ৫ থেকে ৭ বছর আগেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু তাতে বাদী বা সাধারণ মানুষ খুশি হত কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে
জবানবন্দিতে পাওয়া তথ্যে ৪ গ্রেপ্তার
দীর্ঘ সময় পর ত্বকী হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে গত ৮ থেকে ১১ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় অভিযান চালিয়ে শাফায়েত হোসেন শিপন, মামুন মিয়া, কাজল হাওলাদার ও জামশেদ শেখ নামে চারজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
এর আগে ত্বকী হত্যার কয়েক মাসের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ইউসুফ হোসেন লিটন, সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর, তায়েবউদ্দিন জ্যাকি, রিফাত বিন ওসমান ও সালেহ রহমান সীমান্ত। তবে সবাই পরে জামিনে বেরিয়ে আসেন।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর সে বছরের জুলাই এবং নভেম্বর মাসে যথাক্রমে লিটন এবং ভ্রমর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যার পরিকল্পনা থেকে হত্যা পর্যন্ত সব ঘটনার বিবরণ দিয়েছিলেন।
ভ্রমরের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দেওয়া তথ্য ও পূর্ববর্তী তদন্তের সূত্র ধরে শিপন, মামুন, কাজল ও জামশেদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানভীর জানান।
এ মামলায় গ্রেপ্তার এক আসামির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আজমেরী ওসমানের সম্পৃক্ততার বিষয়টি এলেও তাকে কখনও আইনের আওতায় আনা হয়নি। বরং এই দীর্ঘ সময়ে শহরে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন আজমেরী ওসমান।
ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বির অভিযোগ, শামীম ওসমানের নির্দেশে তার ছেলে ইমতিনান ওসমান অয়ন, ভাতিজা আজমেরী ওসমান ও তাদের সহযোগীরা মিলে ত্বকীকে অপহরণের পর নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করেছে।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ওসমান পরিবারের সদস্যরা সবাই পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ বলছে, তারা দেশ ছেড়ে পালাতেও সক্ষম হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না কেউ।
র্যাব কর্মকর্তা তানভীর বলেন, আসামি পলাতক থাকলেও বিচার কিন্তু চলতে থাকবে। তদন্ত করে আমরা একটা রিপোর্ট দেব, বাকিটা আদালতে নির্ধারণ হবে। সেক্ষেত্রে বাদী, বিবাদী উভয়ের আপত্তি জানানোর সুযোগ আছে। এমনকি বিচারকাজ চলাকালে নতুন কারো নামও আসতে পারে।