প্রজননকালীন ইলিশ আমাদের অতিথি, এদের রক্ষায় সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে
- আপডেট সময় : ০৪:৫৭:৪৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ অক্টোবর ২০২৪ ১৮৪ বার পড়া হয়েছে
প্রজনন মৌসুমে ইলিশ মাছ মিঠা পানিতে ডিম ছাড়তে আসে। তখন তারা আমাদের অতিথি। এসময় তাদের না ধরে রক্ষায় এগিয়ে আসুন। তাতে করে অধিক পরিমাণে ইলিশের প্রাপ্তির পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও আমরা লাভবান হবো। তখন ইলিশ মাছ সস্তায় মিলবে। আর সস্তায় যখন মাছ প্রাপ্তির নিয়শ্চয়তা হবে, তখন আমজনতার পাতে ইলিশ ওঠবে
আমিনুল হক ভূইয়া
জাতীয় মাছ ইলিশ রক্ষায় আমাদের সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রজনন মৌসুমে মিঠা পানিতে ডিম ছাড়তে আসা মা ইলিশকে করা করলেই আগামীতে সবার পাতে ইলিশ ওঠবে। আমাদের দুর্ভাগ্য অতিরিক্ত দামের কারণে আমরা সবাই ইলিশ খেতে পারছি না। আমরা যদি ইলিশ ধরা থেকে বিরত থাকি, তাহলে জাতীয় মাছটির উৎপাদন বহুগুণ বেড়ে যাবে। তখন সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের ইলিশের স্বাদ নেওয়া সম্ভব হবে। ইলিশ রক্ষায় যে কর্মসূচিই নেয়া হোক না কেন, এই নড়িয়া উপজেলায় বিশেষ কর্মসূচি নিতে হবে। কারণ এই এলাকার জেলেদের বিকল্প কোনো কাজের ব্যবস্থা নেই। শুধু তাই নয়, এই এলাকার জেলেদের জন্য সরকারের সহায়তা দেয়া চালের পরিমাণও বাড়িয়ে দেওয়া হবে।
শনিবার পদ্মাবিদৌত শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার সুরেশ্বর লঞ্চঘাটে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান-২০২৪ উপলক্ষে আয়োজিত সচেতনতা সভা মঞ্চ থেকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা মিজ ফরিদা আখতার যখন এই ঘোষণা দেন, তখন প্যান্ডেল ভর্তি জেলে ও স্টেকহোল্ডারগণ মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে উপদেষ্টাকে অভিননন্দন জানান। এসময় অনেককে বলতে শোনা গিয়েছে, এমন ভাবে অতীতে কেউ তাদের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে কথা বলেনি। আজ তিনি মাতৃসুলভ ভাষায় যে আহ্বান জানালেন, তাতে তারা খুশি এবং ইলিশ ধরা নিষিদ্ধকালীন মা ইলিশ আহরণ থেকে বিরত থাকবেন তারা।
উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত দেশজুড়ে ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ করেছে সরকার। নিষিদ্ধকালীন ২২ দিন ইলিশ পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, মজুদ ও বিনিময় নিষিদ্ধ থাকবে। আপনারা দয়া করে এ সময় ইলিশ ধরা থেকে বিরত থাকবেন। তাহলে ইলিশের উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। ইলিশ রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। উপদেষ্টা আরও বলেন, ইলিশ আমাদের জাতীয় সম্পদ।
কয়েকদিন যাবত আবহাওয়া অনুকূল ছিলো না। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাতের খবর আসছিলো। বুধবার সন্ধ্যায় একঘন্টার বৃষ্টিতে নগরজুড়ে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। দুর্ভোগকে সঙ্গী করে মধ্যরাতে ঘরে ফেরেন কর্মজীবী মানুষ। বৃহস্পতি-শুক্রবারও বৃষ্টি হয়েছে। এমনকি শনিবার ভোররাত থেকে ঝুম বৃষ্টি ঝরেছে ঢাকার নগরে। এমন পরিস্থিতিতেই সকাল সাতটা নাগাদ মাওয়াঘাটের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়েন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা, মন্ত্রণালয়ের সচিব, মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, অধিদপ্তরের ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক, একই বিভাগের উর্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ। সৌভাগ্য নড়িয়ায় অনুষ্ঠান চলাকালীন বৃষ্টি হয়নি।
শরীয়তপুর জেলার নড়িয়ায় মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান-২০২৪ উপলক্ষ্যে সচেতনতা সভার পূর্ব ঘোষিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাবার সময়ও হাল্কা বৃষ্টি সঙ্গী হয়েছে। মাওয়া রিসোর্টে পৌছানোর পর ইলিশগুড়ি বৃষ্টি আমাদের স্বাগত জানায়। এখানে নাস্তা সেরে বেশ কয়েকটি স্পিড বোর্ডে নাড়িয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হয়। স্পিড বোর্ডগুলো দিগন্ত প্রসারিত পদ্মার জলরাশির বুক চিড়ে দূরন্ত গতিতে এগিয়ে চলে। বেশকিছু পথ অতিক্রম করার পর ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্যাহ উপদেষ্টাকে ইলিশের অভয়াশ্রম দেখার আমন্ত্রণ জানান।
জেলেদের সহায়তা বাড়লো
ইলিশ ধরা নিষিদ্ধকালীন বরাবরের সহায়তা থেকে বেড়িয়ে আসলো অন্তর্বর্তী সরকার। শনিবার নড়িয়ায় সচেতনতা সভা মঞ্চ থেকে মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আকতার ঘোষণা দিলেন, জেলে ভাইদের কথা বিবেচনায় নিয়ে ২৫ কেজি চাল সহায়তার পরিবর্তে ৩০ কেজি চাল সহায়তা দেয়া হবে। দীর্ঘ দিনের প্রচলিত ধারা ভেঙ্গে নিষিদ্ধকালীন সময়ে জেলেদের বরাদ্দ ঘোষণার পর পরই করতালি দিয়ে সভাস্থল মুখরিত করে তোলেন সচেতনতা সভায় অংশ নেওয়া জেলেরা।
এসময় উপদেষ্টা বলেন, জাতীয় মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশেরই প্রথম। তারপরও দাম বেশি হওয়ায় সাধারণ মানুষ ইলিশ কিনে খেতে পারেন না। তবে দাম কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, সে লক্ষে আমরা কাজ করছি। মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানের সময় ভোক্তাদের ইলিশ খাওয়া বন্ধ রাখতে হবে, তাহলে উৎপাদন বাড়বে। ইলিশের প্রজনন মৌসুমে সবার এ সচেতনতা না থাকলে ইলিশের উৎপাদন বাড়ানো যাবে না।
এসময় উপদেষ্টা বলেন, এই এলাকার পদ্মা ও মেঘনা নদী ছাড়া মাছ ধরার বিকল্প নদী নেই। জেলেদেরও বিকল্প কিছু করার থাকে না। তাই দেশের বিভিন্ন স্থানে যে কর্মসূচি মন্ত্রণালয় নিয়ে থাকে, তার চেয়ে বেশি কিছু কর্মসূচি এখানে নিতে হবে। জেলেদের সহায়তার জন্য স্বল্প সুদে ঋণের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। আমরা বাংলাদেশের মানুষ। ইলিশ আমাদের সম্পদ। এটার দাম বেশি হওয়ায় সাধারণ মানুষ খেতে পারে না। এটা বড় ধরনের অন্যায়। এটা হতে দেওয়া যাবে না। আমরা যদি এ সময়টা মেনে চলি, তাহলে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। বাজারে দাম কমবে। সাধারণ মানুষ কিনে খেতে পারবেন।
প্রজননকালে প্রয়োজনে সেনাবাহিনী চাই
ইলিশের প্রজননকালে শরীয়তপুর জেলার পদ্মার অংশে বাইরে থেকে বহু সংখ্যক জেলে এসে মাছ ধরে নিয়ে যায়। এর পেছনে সিন্ডিকেট কাজ করে। এ বছর ইলিশ শিকার নিষিদ্ধকালীন সময়ে প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চাইলেন, ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক মোল্লাে এমদাদুল্যাহ। তিনি বলেন, আমরা কোন জেলেকে গ্রেপ্তারের আওতায় আনতে চাই না। বা কারো বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থাও নিতে চাই না। উপস্থিত জেলেদের উদ্দেশ্য করে প্রকল্প পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্যাহ বলেন, প্রজননকালে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ, এটি আমাদের কঠোরভাবে মানতে হবে। আমরা জেলে ভাইদের সহায় সব সময় পাশে থাকবো।
বিকল্প কর্মসংস্থান, সভামঞ্চের পাশে চমৎকাল গরু
মাছ আহরণ বন্ধ থাকাকালীন জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প। প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত বহু সংখ্যক জেদেকে বিকল্প কর্মসংস্থানের আওতায় বকনা বাছুর প্রদান করা হয়। যে সব বাছুরের মধ্যে এক একটি বর্তমানে এক থেকে দুই লাখ টাকার সম্পদে পরিণত হয়েছে। প্রকল্পের সুবিধ ভোগীর সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার। সভামঞ্চের পাশেই চমৎকার একটি গরু নিয়ে দাড়িয়ে ছিলেন একজন জেলে। তিনি বিকল্প কর্মসংস্থান হিসাবে এই বকনা বাছুরটি পেয়েছেন। সেই ছোট্ট বাছুরটি এখন পূর্ণবয়স্ক গরু। যার বর্তমান বাজার দর প্রায় দেড় লাখ টাকা। সভামঞ্চ থেকে নেমে আসতেই দৃষ্টি নন্দন গরুটির দিকে এগিয়ে গেলেন উপদেষ্টা। জেলে মো. আলী আক্কাস মালত-স্ত্রী তানিয়া শেখ দম্পতি গরুটি জড়িয়ে ধরে ছিলেন। তানিয়া শেখ পরম মমতায় গুরুটির গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। এসময় শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন মৃধা উপদেষ্টাকে জানালেন, নড়িয়ার হালইসার ইউনিয়ন ঘড়িষার গ্রামের আলী আক্কাস মালত দম্পতিকে ২০২২-২৩ অর্থিক বছরে একটি বকনা বাছুর প্রদান করা হয়েছিলো। আজ এটি পূর্ণ গরুতে পরিণত হয়েছে।
শরীয়তপুরের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক সাদিয়া জেরিনের সভাপতিত্বে সচেতনতা সভায় বক্তব্য দেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর, মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. অনুরাধা ভদ্র, শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম ও জেলা মৎস্য কর্মকর্তা হাবীউজ্জামান প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চলনায় ছিলেন তাপসী মরিয়ম। সভায় জানানো হয়, শরীয়তপুর জেলায় ২৯ হাজার ৩৬৭ জন জেলে রয়েছেন। ২৫ হাজার ৮৪৬ জন জেলেকে বিভিন্ন সময় খাদ্যসহায়তা দেওয়া হয়। এ মৌসুমে ইলিশ মাছের সঙ্গে যুক্ত ২০ হাজার জেলেকে ৫০০ মেট্রিক টন চাল দেওয়া হবে।