ঢাকা ০২:৫৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম ::
Logo দাগনভূঞায় রাজাপুর ইউনিয়ন তাঁতীদলের কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত Logo রামুতে প্রায় সাতাশ হাজার পিস ইয়াবাসহ আটক ১ Logo ভালুকায় কোটি টাকা মূল্যের জমি জবর দখলের চেষ্টার অভিযোগ Logo কিশোরগঞ্জ যুবদল নেতাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটির পদ থেকে পদত্যাগের নির্দেশ Logo ৩০ মৃত শ্রমিকের পরিবারকে ১৪ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা এককালীন অনুদান প্রদান Logo ফরিদপুরে গৃহবধূর ওপর হামলার পর বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার অভিযোগ Logo পীরগঞ্জে ডাক্তার কামাল হোসেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে বদলি হওয়ায় উপজেলাবাসীর ক্ষোভ Logo বসুরহাট বস্ত্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির শপথ গ্রহণ Logo দেওয়ানগঞ্জ সাত পুলিশ কর্মকর্তা পেলেন সনম্মনা Logo ইসলামপুরে আগুনে পুড়ে ২টি ঘর ভস্মীভূত

প্রাথমিকে কমে যাচ্ছে শিক্ষার্থী

হালিম মোহাম্মদ
  • আপডেট সময় : ৮৫ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

রাজধানীসহ সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সঙ্কট দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থী কমতে কমতে শূন্যের কোটায় নেমেছে। ছাত্র-ছাত্রী না থাকলেও শিক্ষকের কোনো সংকট নেই। অনেক স্কুলে পদের চেয়ে বেশি শিক্ষক। কিছু স্কুলে প্রেষণে শিক্ষক পদায়নও করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মানহীন শিক্ষা ও শিক্ষকদের অবহেলাই শিক্ষার্থী সংকটের মুল কারণ বলে দাবি করা হচ্ছে।
এক জরিপে দেখা যায়, শহুরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী সংকটে চরম আকার ধারন করেছে। শিক্ষার্থী কমতে কমতে শূন্যের কোটায় নেমেছে। ছাত্র-ছাত্রী না থাকলেও শিক্ষকের কোনো সংকট নেই। অনেক স্কুলে পদের চেয়ে বেশি শিক্ষক কর্মরত। কিছু স্কুলে প্রেষণে শিক্ষক পদায়নও করা হয়েছে। জরিপ করা অধিকাংশ স্কুলেই তিনজন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক কর্মরত। অর্থাৎ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩।
জরিপের তথ্যমতে, ঢাকা সিটি করপোরেশনে ৩৪২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ঢাকায় বঙ্গবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়াও অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংকট চরমে। তালিকায় সবার ওপর মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। দুই শিফটে চলে এ বিদ্যালয়। সবমিলিয়ে স্কুলটির শিক্ষার্থী সংখ্যা ২১ জন। অথচ এ বিদ্যালয়ে শিক্ষকের পদ আছে পাঁচজন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩। সংশ্লিষ্ট স্কুলটির প্রাক-প্রাথমিকে রয়েছে মাত্র দুজন শিক্ষার্থী। প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি পাঁচজন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে চারজন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতেও শিক্ষার্থী সংখ্যা চারজন করে। পঞ্চম শ্রেণিতে শিক্ষার্থী মাত্র দুজন।
রাজধানীর বঙ্গবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নয়, ঢাকাসহ সারাদেশের অধিকাংশ সিটি করপোরেশন এলাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একই অবস্থা। শিক্ষকে ঠাসা থাকলেও নেই শিক্ষার্থী। সন্তানকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির চেয়ে অভিভাবকরা ঝুঁকছেন কিন্ডারগার্টেনে। বিশেষ করে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে সন্তানকে পড়াতে বেশি আগ্রহী তারা। অনেকে আবার নুরানি ও হাফেজি মাদরাসায় পড়তে পাঠাচ্ছেন সন্তানকে।
অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষা উপবৃত্তি, মিড ডে মিল, বৃত্তি পরীক্ষার ব্যবস্থাসহ নানান ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়েও শিক্ষার্থী ধরে রাখতে পারছে না প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। তবে শিক্ষক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এর কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। অভিভাবকদের অবশ্য সোজাসাপ্টা জবাব, ‘প্রাইমারি স্কুলে পড়ালেখা হয় না। স্যার-ম্যাডামরা গল্প-গুজব করে চলে যায়। ক্লাস নেয় না। তাদের অহমিকা বেড়েছে। এই অহমিকার কারনে শিক্ষার্থীরাও অনত্র চলে যাচ্ছে।
উদাহরন স্বরুপ বলা যায়, ঢাকার নবাবপুরের মদনপাল লেনে অবস্থিত বঙ্গবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ৫৩ বছর বয়সী বিদ্যালয়টির আশপাশে ব্যাপক ঘনবসতি। সেই হিসেবে শ্রেণিকক্ষগুলো শিক্ষার্থীতে ঠাসা থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মাত্র ১৭ জন শিক্ষার্থী এ বিদ্যালয়ে। শ্রেণিপ্রতি শিক্ষার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে—প্রথম শ্রেণিতে মাত্র একজন, দ্বিতীয়তে তিনজন, তৃতীয়তে দুজন, চতুর্থতে ছয়জন ও পঞ্চমে পাঁচজন। অথচ স্কুলটিতে কর্মরত আটজন শিক্ষক-কর্মচারী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিটি করপোরেশন এলাকায় অবস্থিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী, শিক্ষকের সংখ্যা এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনুপাত জানতে গত এপ্রিল-মে মাসে অভ্যন্তরীণ জরিপ করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। সম্প্রতি সেই জরিপের প্রতিবেদন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে অধিদপ্তর। তাতে দেশের ১০টি সিটি করপোরেশন তথা মহানগর এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংকটের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। সিটি করপোরেশনগুলো হলো হচ্ছে, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, সিলেট, গাজীপুর ও রাজশাহী।
ওই জরিপে বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকার ১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই চরম শিক্ষার্থী সংকট। বরিশাল সিটির হরিজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ১৪ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকের একজন, প্রথম শ্রেণিতে দুজন, দ্বিতীয়তে দুজন, তৃতীয়তে মাত্র একজন, চতুর্থতে পাঁচজন ও পঞ্চমে মাত্র তিনজন। পাশাপাশি বরিশাল সিটির চরজাগুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থাও আরও নাজুক। বিদ্যালয়টিতে মাত্র ১৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকের আটজন, প্রথমে একজন, দ্বিতীয়তে তিনজন, তৃতীয়তে দুইজন, চতুর্থ ও পঞ্চমে মাত্র একজন করে। দুই শিফটে এই শিক্ষার্থীদের পড়ানোর জন্য কর্মরত চারজন শিক্ষক। অর্থাৎ প্রতি দুজন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৬৭টি। এসব স্কুলে কর্মরত শিক্ষক ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৬২৪ জন। বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত ১:২৮। সেই হিসাবে সিটি করপোরেশনে শিক্ষক বেশি, শিক্ষার্থী কম।
এবিষয়ে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, শিক্ষার পরিবেশ, মানহীনতা, পুরোনো পদ্ধতি আঁকড়ে থাকায় অভিভাবকরা সন্তানদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন না। ফলে দিন দিন শিক্ষার্থী কমছে। সরকারি চাকরি হওয়া শিক্ষকরা মাস গেলেই বেতন তুলছেন। কোনো জবাবদিহিতা নেই।
অপরদিকে জরিপের তথ্য মতে, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের অধীন ৮৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর মধ্যে অন্তত ১০টি সরকারি প্রাথমিকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৫ থেকে ১:৯-এর মধ্যে। গাজীপুর, চট্টগ্রাম, খুলনার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩ থেকে ১:৭ এবং কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, সিলেট ও রাজশাহীর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৬ থেকে ১:৯-এর মধ্যে।
বরিশালের একটি উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখন গ্রামের অভিভাবকরাও সন্তানকে পড়াতে চাইছেন না। যারা একটু সচেতন তারা সন্তানকে কিন্ডারগার্টেন অথবা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াচ্ছেন। এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সন্তানদের প্রাথমিকে পড়তে দিচ্ছেন না। এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষার্থী কমতেই থাকবে।
এদিকে রাজধানীর রামপুরা এলাকায় পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এরপরও এ এলাকায় কয়েকশ কিন্ডারগার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা তুলনামূলক কম। রামপুরার উলন রোডে অবস্থিত মাতৃছায়া শিশু নিকেতনে প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে সিদরাতুল মুনতাহা। রামপুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খুব কাছেই পরিবারের সঙ্গে বসবাস করে সে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি না করিয়ে কিন্ডারগার্টেনে ভর্তির কারণ জানতে চাইলে মুনতাহার মা আম্বিয়া সুলতানা বলেন, প্রাইমারি স্কুলে পড়ালেখা তেমন হয় না বলে শুনেছি। আমাদের সামনের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা তার ছেলেকে প্রাইমারিতে দিয়েছেন, কিন্তু সেখানে ঠিকমতো ক্লাস হয় না। সেজন্য আমি আর ওর বাবা সিদ্ধান্ত নিয়ে কিন্ডারগার্টেনে দিয়েছি। সামনের বছর আইডিয়াল স্কুলের বনশ্রী শাখায় ভর্তির চেষ্টা করবো।
ওই এলাকার সপ্তবর্ণ বিদ্যানিকেতনে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে নুসাইবা মিম। তার মা হেনা আক্তার বলেন, প্রাইমারিতে পড়ালেখাও নেই, পরীক্ষাও নেই। বাচ্চারা পড়ে না। সেজন্য মেয়েকে কিন্ডারগার্টেনে দিয়েছি। এখানে বেতন বেশি দিতে হলেও প্রতিদিনের পড়াটা স্কুলেই শেষ করে ফেলে। নিয়মিত পরীক্ষা হয়, বাচ্চারা কেমন করলো তা জানা-বোঝা যায়। সরকারি প্রাইমারিতে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত তো পরীক্ষাই হয় না। সেজন্য পড়ালেখাও হয় না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সিটি করপোরেশন এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে যত শিক্ষার্থী, সে অনুযায়ী যথেষ্ট অবকাঠামো রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্কুলের শ্রেণিকক্ষগুলো ফাঁকা পড়ে থাকে। সামনের কয়েকটি বেঞ্চে শিক্ষার্থী দেখা যায়। অনেক স্কুলে সামনের কয়েকটি বেঞ্চ পরিষ্কার রেখে পেছনের বেঞ্চগুলো উল্টে রাখা হয়। অথচ শিক্ষার্থী সংকট দূর করতে পদক্ষেপ না নিয়ে দৃষ্টিনন্দন ভবনের বায়না করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক অধ্যাপক ড. মনজুর আহমদ বলেন, গত জুলাইয়ে দেশের ১০টি সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় সিটি করপোরেশন এলাকায় থাকা ৫৩৪টি বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
এবিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, শিক্ষার ভিত্তিই হলো প্রাথমিক স্তর। এটি নড়বড়ে হলে আমরা আর এগোতে পারবো না। প্রাথমিক শেষ করে কেউ ন্যূনতম কোনো কাজে যোগ দিতে পারছে না। আবার যারা মাধ্যমিকে যাচ্ছে, সেখানে গিয়ে তারা ফেল করছে; ঝরে যাচ্ছে। তার মানে শিক্ষার মানটা মোটেও ভালো নয়।
তিনি আরও বলেন, প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়োগ উপজেলাভিত্তিক। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব, আর্থিক শক্তির কারণে অনেকেই পদ না থাকার পরও মহানগর এলাকায় পোস্টিং নিচ্ছেন। তারা এসেই কোচিং বাণিজ্যে জড়াচ্ছেন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

প্রাথমিকে কমে যাচ্ছে শিক্ষার্থী

আপডেট সময় :

রাজধানীসহ সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সঙ্কট দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থী কমতে কমতে শূন্যের কোটায় নেমেছে। ছাত্র-ছাত্রী না থাকলেও শিক্ষকের কোনো সংকট নেই। অনেক স্কুলে পদের চেয়ে বেশি শিক্ষক। কিছু স্কুলে প্রেষণে শিক্ষক পদায়নও করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মানহীন শিক্ষা ও শিক্ষকদের অবহেলাই শিক্ষার্থী সংকটের মুল কারণ বলে দাবি করা হচ্ছে।
এক জরিপে দেখা যায়, শহুরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী সংকটে চরম আকার ধারন করেছে। শিক্ষার্থী কমতে কমতে শূন্যের কোটায় নেমেছে। ছাত্র-ছাত্রী না থাকলেও শিক্ষকের কোনো সংকট নেই। অনেক স্কুলে পদের চেয়ে বেশি শিক্ষক কর্মরত। কিছু স্কুলে প্রেষণে শিক্ষক পদায়নও করা হয়েছে। জরিপ করা অধিকাংশ স্কুলেই তিনজন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক কর্মরত। অর্থাৎ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩।
জরিপের তথ্যমতে, ঢাকা সিটি করপোরেশনে ৩৪২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ঢাকায় বঙ্গবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়াও অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংকট চরমে। তালিকায় সবার ওপর মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। দুই শিফটে চলে এ বিদ্যালয়। সবমিলিয়ে স্কুলটির শিক্ষার্থী সংখ্যা ২১ জন। অথচ এ বিদ্যালয়ে শিক্ষকের পদ আছে পাঁচজন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩। সংশ্লিষ্ট স্কুলটির প্রাক-প্রাথমিকে রয়েছে মাত্র দুজন শিক্ষার্থী। প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি পাঁচজন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে চারজন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতেও শিক্ষার্থী সংখ্যা চারজন করে। পঞ্চম শ্রেণিতে শিক্ষার্থী মাত্র দুজন।
রাজধানীর বঙ্গবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নয়, ঢাকাসহ সারাদেশের অধিকাংশ সিটি করপোরেশন এলাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একই অবস্থা। শিক্ষকে ঠাসা থাকলেও নেই শিক্ষার্থী। সন্তানকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির চেয়ে অভিভাবকরা ঝুঁকছেন কিন্ডারগার্টেনে। বিশেষ করে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে সন্তানকে পড়াতে বেশি আগ্রহী তারা। অনেকে আবার নুরানি ও হাফেজি মাদরাসায় পড়তে পাঠাচ্ছেন সন্তানকে।
অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষা উপবৃত্তি, মিড ডে মিল, বৃত্তি পরীক্ষার ব্যবস্থাসহ নানান ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়েও শিক্ষার্থী ধরে রাখতে পারছে না প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। তবে শিক্ষক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এর কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। অভিভাবকদের অবশ্য সোজাসাপ্টা জবাব, ‘প্রাইমারি স্কুলে পড়ালেখা হয় না। স্যার-ম্যাডামরা গল্প-গুজব করে চলে যায়। ক্লাস নেয় না। তাদের অহমিকা বেড়েছে। এই অহমিকার কারনে শিক্ষার্থীরাও অনত্র চলে যাচ্ছে।
উদাহরন স্বরুপ বলা যায়, ঢাকার নবাবপুরের মদনপাল লেনে অবস্থিত বঙ্গবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ৫৩ বছর বয়সী বিদ্যালয়টির আশপাশে ব্যাপক ঘনবসতি। সেই হিসেবে শ্রেণিকক্ষগুলো শিক্ষার্থীতে ঠাসা থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মাত্র ১৭ জন শিক্ষার্থী এ বিদ্যালয়ে। শ্রেণিপ্রতি শিক্ষার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে—প্রথম শ্রেণিতে মাত্র একজন, দ্বিতীয়তে তিনজন, তৃতীয়তে দুজন, চতুর্থতে ছয়জন ও পঞ্চমে পাঁচজন। অথচ স্কুলটিতে কর্মরত আটজন শিক্ষক-কর্মচারী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিটি করপোরেশন এলাকায় অবস্থিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী, শিক্ষকের সংখ্যা এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনুপাত জানতে গত এপ্রিল-মে মাসে অভ্যন্তরীণ জরিপ করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। সম্প্রতি সেই জরিপের প্রতিবেদন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে অধিদপ্তর। তাতে দেশের ১০টি সিটি করপোরেশন তথা মহানগর এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংকটের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। সিটি করপোরেশনগুলো হলো হচ্ছে, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, সিলেট, গাজীপুর ও রাজশাহী।
ওই জরিপে বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকার ১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই চরম শিক্ষার্থী সংকট। বরিশাল সিটির হরিজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ১৪ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকের একজন, প্রথম শ্রেণিতে দুজন, দ্বিতীয়তে দুজন, তৃতীয়তে মাত্র একজন, চতুর্থতে পাঁচজন ও পঞ্চমে মাত্র তিনজন। পাশাপাশি বরিশাল সিটির চরজাগুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থাও আরও নাজুক। বিদ্যালয়টিতে মাত্র ১৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকের আটজন, প্রথমে একজন, দ্বিতীয়তে তিনজন, তৃতীয়তে দুইজন, চতুর্থ ও পঞ্চমে মাত্র একজন করে। দুই শিফটে এই শিক্ষার্থীদের পড়ানোর জন্য কর্মরত চারজন শিক্ষক। অর্থাৎ প্রতি দুজন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৬৭টি। এসব স্কুলে কর্মরত শিক্ষক ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৬২৪ জন। বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত ১:২৮। সেই হিসাবে সিটি করপোরেশনে শিক্ষক বেশি, শিক্ষার্থী কম।
এবিষয়ে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, শিক্ষার পরিবেশ, মানহীনতা, পুরোনো পদ্ধতি আঁকড়ে থাকায় অভিভাবকরা সন্তানদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন না। ফলে দিন দিন শিক্ষার্থী কমছে। সরকারি চাকরি হওয়া শিক্ষকরা মাস গেলেই বেতন তুলছেন। কোনো জবাবদিহিতা নেই।
অপরদিকে জরিপের তথ্য মতে, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের অধীন ৮৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর মধ্যে অন্তত ১০টি সরকারি প্রাথমিকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৫ থেকে ১:৯-এর মধ্যে। গাজীপুর, চট্টগ্রাম, খুলনার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩ থেকে ১:৭ এবং কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, সিলেট ও রাজশাহীর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৬ থেকে ১:৯-এর মধ্যে।
বরিশালের একটি উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখন গ্রামের অভিভাবকরাও সন্তানকে পড়াতে চাইছেন না। যারা একটু সচেতন তারা সন্তানকে কিন্ডারগার্টেন অথবা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াচ্ছেন। এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সন্তানদের প্রাথমিকে পড়তে দিচ্ছেন না। এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষার্থী কমতেই থাকবে।
এদিকে রাজধানীর রামপুরা এলাকায় পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এরপরও এ এলাকায় কয়েকশ কিন্ডারগার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা তুলনামূলক কম। রামপুরার উলন রোডে অবস্থিত মাতৃছায়া শিশু নিকেতনে প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে সিদরাতুল মুনতাহা। রামপুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খুব কাছেই পরিবারের সঙ্গে বসবাস করে সে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি না করিয়ে কিন্ডারগার্টেনে ভর্তির কারণ জানতে চাইলে মুনতাহার মা আম্বিয়া সুলতানা বলেন, প্রাইমারি স্কুলে পড়ালেখা তেমন হয় না বলে শুনেছি। আমাদের সামনের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা তার ছেলেকে প্রাইমারিতে দিয়েছেন, কিন্তু সেখানে ঠিকমতো ক্লাস হয় না। সেজন্য আমি আর ওর বাবা সিদ্ধান্ত নিয়ে কিন্ডারগার্টেনে দিয়েছি। সামনের বছর আইডিয়াল স্কুলের বনশ্রী শাখায় ভর্তির চেষ্টা করবো।
ওই এলাকার সপ্তবর্ণ বিদ্যানিকেতনে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে নুসাইবা মিম। তার মা হেনা আক্তার বলেন, প্রাইমারিতে পড়ালেখাও নেই, পরীক্ষাও নেই। বাচ্চারা পড়ে না। সেজন্য মেয়েকে কিন্ডারগার্টেনে দিয়েছি। এখানে বেতন বেশি দিতে হলেও প্রতিদিনের পড়াটা স্কুলেই শেষ করে ফেলে। নিয়মিত পরীক্ষা হয়, বাচ্চারা কেমন করলো তা জানা-বোঝা যায়। সরকারি প্রাইমারিতে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত তো পরীক্ষাই হয় না। সেজন্য পড়ালেখাও হয় না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সিটি করপোরেশন এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে যত শিক্ষার্থী, সে অনুযায়ী যথেষ্ট অবকাঠামো রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্কুলের শ্রেণিকক্ষগুলো ফাঁকা পড়ে থাকে। সামনের কয়েকটি বেঞ্চে শিক্ষার্থী দেখা যায়। অনেক স্কুলে সামনের কয়েকটি বেঞ্চ পরিষ্কার রেখে পেছনের বেঞ্চগুলো উল্টে রাখা হয়। অথচ শিক্ষার্থী সংকট দূর করতে পদক্ষেপ না নিয়ে দৃষ্টিনন্দন ভবনের বায়না করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক অধ্যাপক ড. মনজুর আহমদ বলেন, গত জুলাইয়ে দেশের ১০টি সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় সিটি করপোরেশন এলাকায় থাকা ৫৩৪টি বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
এবিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, শিক্ষার ভিত্তিই হলো প্রাথমিক স্তর। এটি নড়বড়ে হলে আমরা আর এগোতে পারবো না। প্রাথমিক শেষ করে কেউ ন্যূনতম কোনো কাজে যোগ দিতে পারছে না। আবার যারা মাধ্যমিকে যাচ্ছে, সেখানে গিয়ে তারা ফেল করছে; ঝরে যাচ্ছে। তার মানে শিক্ষার মানটা মোটেও ভালো নয়।
তিনি আরও বলেন, প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়োগ উপজেলাভিত্তিক। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব, আর্থিক শক্তির কারণে অনেকেই পদ না থাকার পরও মহানগর এলাকায় পোস্টিং নিচ্ছেন। তারা এসেই কোচিং বাণিজ্যে জড়াচ্ছেন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।