ফেলানি হত্যার কিনারা হয়নি ১৪ বছরেও

- আপডেট সময় : ১৪৩ বার পড়া হয়েছে
কুড়িগ্রাম সীমান্তে বিএএসএফ এর গুলিতে নির্মম ভাবে নিহত ফেলানী হত্যার বিচার গত ১৪ বছরে কুল কিনারা হয়নি। নিহতাবস্থায় তার লাশ সীমান্তে কাঁটা তারের বেড়ায় ঝুলে থাকে প্রায় একদিন। দিনটি ছিল ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি, এ নির্মম হত্যার ঘটনার ১৫ বছরে পর্দাপন করেছে। এমন সব ক্ষত নিয়ে ঢাকায় আজ মঙ্গলবার শুরু হচ্ছে বিজিবি-বিএসএফ সীমান্ত সম্মেলন। বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভারতীয় বিএসএফকে পুরানো ধাচ ও পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এসে সম্মেলনে তাদের অবস্থান পরিস্কার করতে হবে।
কুড়িগ্রাম সীমান্তে বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ গুলি চালিয়ে, হত্যা করে ফেলানীকে। শুধু ফেলানী নয়, পনেরো বছরে সীমান্তে ৬ শতাধিক নিরীহ লোকদের হত্যা করা হয়। এসকল হত্যার একটিরও বিচার হয়নি। অথচ প্রতিবছর ভারত বাংলাদেশের মহাপরিচালক পর্যায়ে একাধিক সমঝোতা সম্মেলন করা হচ্ছে। সেখানে সীমান্ত হত্য বন্ধ বা শূন্যেও কোটায় নিয়ে আসা, মাদক অস্ত্র, স্বর্ন চোরাচালান বন্ধ নিয়ে চুড়ান্ত আলোচনা হয়। দু দেশের মধ্যে সমাঝোতা স্বাক্ষর হয়। কিন্তু সেটি কাগজে কলমেই সীমাবন্ধ থাকে। কে শুনে কার কথা। বর্তমান সময়ে ২৫ আগষ্ট থেকে ২৮ আগষ্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত সম্মেলন চলমান রয়েছে। মহাপরিচালকের নেতৃত্বে দুদেশের প্রতিনিধি দল পিলখানা বিজিবি প্রধান কার্যালয়ে এ সম্মেলন চলছে। বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা এ সম্মেলনে সীমান্ত হত্যা বন্ধের সক্রিয় ভুমিকা পালন করবে বিজিবি ও বিএসএ্ফ।
এদিকে গত পাঁচ বছরে সীমান্তে বিএসএফের হাতে ১৫৮ জনের মৃত্যু ঘটে। যা এ দেশের জন্য অনঅভিপ্রেত। এবিষয়ে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে এবং শারীরিক নির্যাতনে নিহত হয়েছেন ১৫৮ জন বাংলাদেশি। গুরুতর আহত হয়েছেন ১২৭ জন। এ ছাড়াও অপহরণের শিকার হয়েছেন ৪৮ জন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এসব হত্যাকান্ড ঠেকাতে সীমান্তবর্তী এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জোরদার আরও বাড়াতে হবে। এছাড়াও সীমান্তে চোরাচালানের সঙ্গে যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ জড়িত থাকে তাহলে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
আসকের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০২০ সালে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন অন্তত ৪৯ জন বাংলাদেশি। এ বছর আহত হন ২৬ জন এবং অপহরণের শিকার হয়েছেন ২২ জন বাংলাদেশি। ২০২১ সালে হত্যা কিছুটা কমে আসে। ওই বছর নিহত হয় ১৬ জন। আহত হন ৮ জন এবং অপহরণ হন ৩ জন।
২০২২ সালে ১৮ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়াও আহত হয়েছেন ১৩ জন এবং অপহরণ হয় ৮ জন। ২০২৩ সালে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন ২৩ জন এবং আহত হন ২৩ জন। ২০২৪ সালে নিহত হন ৩০ জন। আহত হন ২৫ এবং অপহরণ ৩ জন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ২২। আহত হয়েছেন ৩২ এবং অপহরণ হয়েছেন ১২ জন।
এদিকে ফেলানী হত্যার বিষয়ে সর্ব শেষ জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মহলের চাপে ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট ভারতের কোচবিহারের জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টে ফেলানী হত্যার বিচার শুরু হয়। তবে সাজানো বিচারে মাত্র এক মাসের মধ্যে বেকসুর খালাস দেওয়া হয় আসামি বিএসএফ জওয়ান অমিয় ঘোষকে। বাদীপক্ষের না রাজিতে ২০১৪ সালে ফের শুরু হয় পুনঃবিচার। তাতেও সাজা হয়নি আসামির। ২০১৫ সালে ফেলানীর পরিবারের পক্ষে সেদেশের সুপ্রিম কোর্টে রিট করে মানবাধিকার সংস্থা-সুরক্ষা মঞ্চ। এরপর দফায় দফায় পেছাতে থাকে শুনানির তারিখ। ৯ বছর ধরে বিচারের নামে চলছে প্রহসন।
অপরদিকে ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি চোখের সামনে ছটফট করে মেয়েকে মরতে দেখেছেন মা। ফেলানীর সেই মৃত্যুযন্ত্রণা আজও তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে। ফেলানীর মা জাহানারা বেগম আক্ষেপ করে জানান, ৩ ঘণ্টা পানির জন্য চিৎকার করেছিল ফেলানী। তিনি মা হয়ে তার মেয়ের পাশে যেতে পারেননি।
ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম নতুন সরকার অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকারকে এই মামলাটি দেখভাল করে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বছরওয়ারি হিসাব অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে সীমান্তে ৬ শতাধিক মানুষ হত্যা করেছে বিএসএফ। আহত ও পঙ্গু হয়েছে সাড়ে সাতশ মানুষ। এসব ঘটনার একটিরও বিচার হয়নি।
এবিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. সৈয়দ আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী জানান, দীর্ঘদীন ধরে বিএসএফের দেখা মাত্রই গুলি করার যে বিষয়টি যা আসলে তাদের করার কথা নয় এ কারণেই এসব ঘটনা ঘটছে।
কুড়িগ্রামের সাবেক পিপি এস এম আব্রাহাম লিংকন জানান, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে যে আবেদন করা হয়েছে সেটির নিষ্পত্তি হলে শুধু ন্যায় বিচারই নয় বরং ভবিষ্যতে সীমান্ত হত্যা কমে আসবে। নিরস্ত্র নাগরিকদের সুরক্ষা ও সীমান্ত হত্যা বন্ধে বাংলাদেশ-ভারত স্বাক্ষরিত যৌথ প্রটোকল পুনর্মূল্যায়ন ও পূর্ণ প্রয়োগের পরামর্শও দেন তিনি।
অন্যদিকে বাংলাদেশ যদি ঘুরে দাঁড়ায় তাহলে বিএসএফ বাংলাদেশিদের ওপর হত্যাকা- চালাতে পারবে না বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. নেহাল করিম। তিনি বলেন, যারা ভৌগলিকভাবে বড় তারা সাধারণত ছোটদের অবহেলা করে। বাংলাদেশ তার সার্বভৌমত্ব ও অস্তিত্বে ছাড় দিতে পারবে না বলেই ভারত আমাদের দুর্বলতার সুযোগ পেয়েছে। যেমন- নেপালকে ভারত আগের মতো শোষণ করতে পারে না, মালদ্বীপকে পারে না। তেমনি বাংলাদেশও যদি ঘুরে দাঁড়ায় তাহলে আর পারবে না।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের ওপর ভারতের যে আধিপত্য ছিল সেটা ২০২৪ সালের গত ৫ আগস্টের পর একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সরকারের উচিত ভারতের এই সহিংস আচরণের প্রতিবাদ করা। কারণ, প্রতিবাদ না করলে তারা প্রশ্রয় পেয়ে যাবে। এর আগে প্রতিবাদ করেনি বলে তারা এখনও এটা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত এটার প্রতিবাদ করা।
এছাড়া সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে আরও টহল বৃদ্ধি করা উচিত বলে মনে করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান মো. সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য আমাদের যারা নিরাপত্তারক্ষী আছে যেমন- বিজিবি, পুলিশ, নৌবাহিনী বা বিভিন্ন ধরনের রেঞ্জ পুলিশ আছে তারা দায়িত্ব পালন করে তাদের টহল বৃদ্ধি করতে হবে। সীমান্তে অনিয়মের সঙ্গে যদি কোনও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য জড়িত থাকে তাদেরকে চিহ্নিত করে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। যারা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকে এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে লিয়াজু করে অপরাধ করে তাদের খুঁজে বের করতে হবে, তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সীমান্তবর্তী এলাকায় যারা বসবাস করে তাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বসা উচিত। বসে তারা কী কী ধরনের সেবা চায়, নিরাপত্তা বাহিনীর কাছ থেকে কী কী সাপোর্ট চাচ্ছে, সেটা তাদের কাছ থেকে শোনার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে পুলিশিংটা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে বর্ডার এলাকায় অপরাধ, অন্যায়, অনিয়ম ধীরে ধীরে প্রতিহত করা সম্ভব হবে।