ঢাকা ০৩:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম ::
Logo ইসলামপুরে মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত Logo জামালপুরে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে স্মরণসভা Logo ঘাটাইলে স্বাধীন বাংলা মিনি ফুটবল টুর্নামেন্ট ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত Logo গৌরীপুরে ৩১ দফা বাস্তবায়ন ও দলকে নির্বাচন মুখী করতে বিএনপির আলোচনা সভা Logo গোলাপগঞ্জে শিশু ধর্ষনের মিথ্যা মামলার অভিযোগে মানববন্ধন Logo ভেদরগঞ্জে জমি বিক্রির বায়না নিয়ে প্রতারণায় পাল্টা পাল্টি অভিযোগ Logo খুনিদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন Logo বাগেরহাটে আসন পুনর্বহালের আন্দোলনে সকলকে শরিক হওয়ার আহ্বান Logo শেরপুরে নিখোঁজের দুদিন পর শিশুর মরদেহ উদ্ধার Logo বাগেরহাটের চারটি আসন বহালের দাবিতে সর্বাত্মক হরতাল পালিত

বাজারে আছে, কপালে নেই

হালিম মোহাম্মদ
  • আপডেট সময় : ৫৯ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

চট্টগ্রামে সাগর উপকূল থেকে মাছের আড়ত, পাইকারি থেকে খুচরা হাঁট-বাজার পর্যন্ত এখন ইলিশ মাছে সয়লাব । কিন্তু আকাশচুম্বী দামের কারণে মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠির ভাগ্যে নেই ইলিশ। ইলিশ যেন তাদের স্বপ্ন, ইলিশের স্বাদ এখন ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতি।
ষাটের উর্ধে¦ প্রবীণ মাছ ব্যবসায়িরা বলছেন, বাজারে এক সময় ৮-১০ টাকা কেজিতে পাওয়া যেতো বড় বড় ইলিশ। এরপরও বিক্রি না হওয়া ইলিশ পচে গেলে তা ওজন করা ছাড়ায় ৪-৫ টাকায় দিয়ে দিতো পুরোটা। এই পচা ইলিশ ভাজাও যে কত স্বাদের তা বলে বোঝাতে পারব না।
অপরদিকে গত মঙ্গলবার মৎস সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্টানে ক্ষোভের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস বলেন, আমরা প্রকৃতির প্রতি নির্মম আচরণ করছি। এভাবে চললে একদিন মাছ কপাল থেকে উঠে যাবে। তিনি বলেন, মৎস্য খাতের উন্নয়নের জন্য প্রকৃতি ও পানির প্রতি সদয় হওয়ার আহবান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, মাছ প্রকৃতির উপহার, আল্লাহর দান। কিন্তু আমরা প্রকৃতির প্রতি নির্মম। এভাবে চললে একদিন মাছ কপাল থেকে উঠে যাবে। আমরা নদী শাসনের কথা বলি, কিন্তু নদী পালনের কথা ভাবি না। এতে ক্ষতি বাড়ছে।
অপরদিকে মধ্যবিত্ত এবং নিম্ম বিত্তরা ইলিশ মাছ সর্ম্পকে বলছেন, সেই দিন এখন আর নেই। দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের অতীতের স্মৃতি রোমন্থনের এই সময়ে ইলিশের মজা লুটছেন কালো টাকার মালিক লুটেরা-ঘুষখোরেরা। নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের ভাষ্য, নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সহজ ছিল গরিবের ইলিশ খাওয়া। তখন সাগরে মাছ ধরায় সরকারি কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রতি বছর শুরু হয় সাগরে মাছের উৎপাদন বাড়ানোর নামে মাছ ধরায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা। এতে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু সেই ইলিশ ক্রমেই পাতে ওঠা কমছে গরিব মধ্যবিত্ত মানুষের। বর্তমানে সেই ইলিশ হয়ে উঠেছে ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী অথবা লুটেরা দুর্নীতিবাজ শিল্পপতি, মন্ত্রী-এমপি ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের খাবার।
নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের ভাষ্যমতে, ভোট দিয়ে সরকার বানায় যারা তাদের কপালে জুটে শোষণ, বঞ্চনা আর দুর্গতি। কেউ কেউ রাতেও ভোট করেছে। কিন্তু এবার হবে ভোট বিরতির মহড়া। কারণ সরকারের কারণেই নিষ্পেষিত সাধারণ মানুষ। সরকার গরিবের মুখ থেকে ইলিশ কেড়ে নিয়ে বিদেশে রফতানি করে ডলার আনছে। আর সেই ডলার চোরাই পথে পাচার হচ্ছে বিদেশে। তাতে জনগণের লাভ কী হচ্ছে?
মাছ আহরণকারী জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আহরণকারীর নৌকা থেকে এক কেজি বা তার বেশি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ এখন পাইকারি বিক্রয় হচ্ছে ১৩৭৫ টাকায়। ৬০০-৮০০ গ্রাম ওজনের ১১০০ টাকায়, ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৯০০ টাকায়, ৩০০-৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৭০০-৭৫০ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে।
আড়তে বরফ দিয়ে সংরক্ষণের পর এক কেজি বা তার বেশি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ মাছ বিক্রয় হচ্ছে ১৪০০-১৪৫০ টাকায়, ৬০০-৮০০ গ্রাম ওজনের ১১৫০ টাকায়, ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৯৫০-১০০০ টাকায়, ৩০০-৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৮০০-৯৫০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
আড়ত থেকে পাইকারি বাজারে পৌঁছার পর এক কেজি ওজনের ইলিশ মাছ ২ হাজার টাকা, দেড়-দুই কেজি ওজনের ইলিশ ৩ হাজার টাকা এবং ৫০০ গ্রাম বা তার কিছু কম-বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকায়।
নগরীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে এবং ভ্রাম্যমাণ দোকানে ইলিশের দর যাচাই করে দেখা গেছে, এক-দেড় কেজি ওজনের ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ২০০০-২২০০ টাকায়, কোথাও কোথাও আবার তার চেয়েও বেশি। তবে খুচরায় বেশি মিলছে ৫০০-৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ, যেগুলোর দাম চাওয়া হচ্ছে ১৩০০-১৫০০ টাকা। এক কেজির কিছু কম ওজনের ইলিশ ১৮০০ টাকা দাম চাওয়া হচ্ছে। দুই-আড়াই কেজি ওজনের বড় ইলিশ মাছ প্রতিকেজি তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে নগরীর কাজির দেউড়ি বাজারে।
মৎস্য বিভাগের কমকর্তারা বলছেন, সাগরে যে হারে ইলিশ ধরা পড়ছে, তাতে বাজারে এত চড়া দাম কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ইলিশের দামে আমরাও বিস্মিত। বছর কয়েক আগেও সাগর তীরে সদ্য ধরে আনা ইলিশ গড়পরতা প্রতিকেজি ১০০-১৫০ টাকায় পাওয়া যেত। এখন সাগরতীরেই ৫০০-৭০০ টাকার নিচে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। আবার খুচরায় ১৩০০ টাকার নিচে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। ইলিশের চড়া দামের জন্য সরবরাহ সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছেন তারা।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, নৌকা থেকে আড়ত হয়ে খুচরা বাজার পর্যন্ত পৌঁছাতে চারবার হাতবদল হয় ইলিশের। এই চার হাত চক্রের সিন্ডিকেটবাজির কারণে দাম সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসছে না। এছাড়া, সংরক্ষণ ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ার প্রভাবও পড়েছে। তবে ভাদ্র-আশ্বিনে আরও বেশি ইলিশ আহরণ হবে এবং এতে দাম কমবে বলে আশা পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের।
ব্যবসায়িরা বলছেন, ইলিশ মাছের জোগান ও সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু ইলিশের ব্যবসায় বিনিয়োগকারী, মৎস্যজীবী, আড়তদার এবং পাইকারি ব্যবসায়ীদের গড়ে তোলা অদৃশ্য সিন্ডিকেটের কারণে দাম কমছে না। প্রতি বছর ইলিশের বাজার এই চার হাতের চক্রের মধ্যে ঘুরতে থাকে।
চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ বরাত দিয়ে আমাদের প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গত দশ দিনে ইলিশ মাছ আহরণের পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়েছে। গত মাসে একেকটি নৌকা মাত্র ১৫-২০ কেজি ইলিশ মাছ নিয়ে তীরে এসেছিল। গত তিনদিন ধরে একেকটি নৌকা একশ কেজিরও বেশি ইলিশ নিয়ে আসছে। এতে বোঝা যাচ্ছে সাগরে ইলিশের বিচরণ বেড়েছে। মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা নিয়ে নিয়মনীতি মানার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। আশা করছি, এবার গত বছরের চেয়ে ইলিশ আহরণের পরিমাণ বেশি হবে।
মৎস্যজীবী জাহেদুল ইসলাম জানান, গত সপ্তাহে একেকটি নৌকায় ৭০-১০০ কেজি করে ইলিশ ধরা পড়েছে। দেশে সবচেয়ে বেশি ইলিশ আহরণ হয় চট্টগ্রাম বিভাগের সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলাগুলোয়। অবশ্য মাছ ধরার সমুদ্রগ্রামী বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর হিসেব ওঠে চট্টগ্রামের তালিকায়। এর বাইরে পদ্মা-মেঘনার অববাহিকায় ভোলা, খুলনা, বরিশাল ও চাঁদপুর জেলায় প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে।
সরকার গরিবের মুখ থেকে ইলিশ কেড়ে নিয়ে বিদেশে রফতানি করে ডলার আনছে। আর সেই ডলার চোরাই পথে পাচার হচ্ছে বিদেশে।
এদিকে মৎস্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছরে দেশে ইলিশ আহরণের পরিমাণ আগের বছরের চেয়ে কমে গিয়েছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ৫ লাখ ২৯ হাজার মেট্রিকটন। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৭১ হাজার ৩৪২ টন। এর আগে ২০২১-২২ সালে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৫৮৩ টন। ২০২০-২১ সালে ৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৮৩ টন, ২০১৯-২০ সালে ৫ লাখ ৫০ হাজার ৪২৮ মেট্রিকটন, ২০১৮-১৯ সালে ৫ লাখ ৩২ হাজার ৭৯৫ মেট্রিকটন, ২০১৭-১৮ সালে ৫ লাখ ১৭ হাজার ১৯৮ টন এবং ২০১৬-১৭ সালে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৪১৭ মেট্রিকটন ইলিশ আহরণ হয়েছিল।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০০৪-০৫ অর্থবছরে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিকটন। এ হিসেবে গত দেড় যুগে ইলিশের আহরণ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। এর মধ্যে গত সাত বছরে ইলিশ আহরণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে, শুধু ২০২৩-২৪ অর্থবছর ছাড়া।
এতকিছুর পরও ইলিশের দাম ক্রেতাসাধারণের নাগালের মধ্যে থাকে না। গত আট বছরের রফতানির চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মোট আহরণের এক শতাংশেরও কম ইলিশ মাছ রফতানি হয়। বাকি ৯৯ শতাংশ ইলিশ মাছ দেশের বাজারেই বিক্রি হয়। এর পরও প্রতিবছর ইলিশের দাম ৩০ থেকে ৩৩ শতাংশ হারে বাড়ছে বলে কৃষি বিপণন অধিদফতরের তথ্যে জানা গেছে।
সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আট বছরে ইলিশের দাম গড়ে কেজিতে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বেড়েছে। আর ১৮ বছরের ব্যবধানে দেশে ইলিশের দাম বেড়েছে প্রায় ১০০ শতাংশ। এ বছরও ভরা মৌসুমে ইলিশের দাম ক্রেতার নাগালের মধ্যে নেই।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্যাহ বলেন, বাজারে ইলিশ মাছের অতিরিক্ত দাম নেওয়ার অভিযোগ আমরা পেয়েছি। আমরা আড়তদার, পাইকারি এবং খুচরা বাজারে যাব। কে কত দামে ইলিশ কিনছে আর কত দামে বিক্রি করছে, ক্রয়-বিক্রয়ের ভাউচার আছে কি না এবং ক্রয়মূল্য আর বিক্রয়মূল্যের মধ্যে সামঞ্জস্য আছে কি না, সেটা আমরা তদারক করব।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

বাজারে আছে, কপালে নেই

আপডেট সময় :

চট্টগ্রামে সাগর উপকূল থেকে মাছের আড়ত, পাইকারি থেকে খুচরা হাঁট-বাজার পর্যন্ত এখন ইলিশ মাছে সয়লাব । কিন্তু আকাশচুম্বী দামের কারণে মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠির ভাগ্যে নেই ইলিশ। ইলিশ যেন তাদের স্বপ্ন, ইলিশের স্বাদ এখন ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতি।
ষাটের উর্ধে¦ প্রবীণ মাছ ব্যবসায়িরা বলছেন, বাজারে এক সময় ৮-১০ টাকা কেজিতে পাওয়া যেতো বড় বড় ইলিশ। এরপরও বিক্রি না হওয়া ইলিশ পচে গেলে তা ওজন করা ছাড়ায় ৪-৫ টাকায় দিয়ে দিতো পুরোটা। এই পচা ইলিশ ভাজাও যে কত স্বাদের তা বলে বোঝাতে পারব না।
অপরদিকে গত মঙ্গলবার মৎস সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্টানে ক্ষোভের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস বলেন, আমরা প্রকৃতির প্রতি নির্মম আচরণ করছি। এভাবে চললে একদিন মাছ কপাল থেকে উঠে যাবে। তিনি বলেন, মৎস্য খাতের উন্নয়নের জন্য প্রকৃতি ও পানির প্রতি সদয় হওয়ার আহবান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, মাছ প্রকৃতির উপহার, আল্লাহর দান। কিন্তু আমরা প্রকৃতির প্রতি নির্মম। এভাবে চললে একদিন মাছ কপাল থেকে উঠে যাবে। আমরা নদী শাসনের কথা বলি, কিন্তু নদী পালনের কথা ভাবি না। এতে ক্ষতি বাড়ছে।
অপরদিকে মধ্যবিত্ত এবং নিম্ম বিত্তরা ইলিশ মাছ সর্ম্পকে বলছেন, সেই দিন এখন আর নেই। দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের অতীতের স্মৃতি রোমন্থনের এই সময়ে ইলিশের মজা লুটছেন কালো টাকার মালিক লুটেরা-ঘুষখোরেরা। নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের ভাষ্য, নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সহজ ছিল গরিবের ইলিশ খাওয়া। তখন সাগরে মাছ ধরায় সরকারি কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রতি বছর শুরু হয় সাগরে মাছের উৎপাদন বাড়ানোর নামে মাছ ধরায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা। এতে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু সেই ইলিশ ক্রমেই পাতে ওঠা কমছে গরিব মধ্যবিত্ত মানুষের। বর্তমানে সেই ইলিশ হয়ে উঠেছে ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী অথবা লুটেরা দুর্নীতিবাজ শিল্পপতি, মন্ত্রী-এমপি ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের খাবার।
নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের ভাষ্যমতে, ভোট দিয়ে সরকার বানায় যারা তাদের কপালে জুটে শোষণ, বঞ্চনা আর দুর্গতি। কেউ কেউ রাতেও ভোট করেছে। কিন্তু এবার হবে ভোট বিরতির মহড়া। কারণ সরকারের কারণেই নিষ্পেষিত সাধারণ মানুষ। সরকার গরিবের মুখ থেকে ইলিশ কেড়ে নিয়ে বিদেশে রফতানি করে ডলার আনছে। আর সেই ডলার চোরাই পথে পাচার হচ্ছে বিদেশে। তাতে জনগণের লাভ কী হচ্ছে?
মাছ আহরণকারী জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আহরণকারীর নৌকা থেকে এক কেজি বা তার বেশি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ এখন পাইকারি বিক্রয় হচ্ছে ১৩৭৫ টাকায়। ৬০০-৮০০ গ্রাম ওজনের ১১০০ টাকায়, ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৯০০ টাকায়, ৩০০-৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৭০০-৭৫০ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে।
আড়তে বরফ দিয়ে সংরক্ষণের পর এক কেজি বা তার বেশি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ মাছ বিক্রয় হচ্ছে ১৪০০-১৪৫০ টাকায়, ৬০০-৮০০ গ্রাম ওজনের ১১৫০ টাকায়, ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৯৫০-১০০০ টাকায়, ৩০০-৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৮০০-৯৫০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
আড়ত থেকে পাইকারি বাজারে পৌঁছার পর এক কেজি ওজনের ইলিশ মাছ ২ হাজার টাকা, দেড়-দুই কেজি ওজনের ইলিশ ৩ হাজার টাকা এবং ৫০০ গ্রাম বা তার কিছু কম-বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকায়।
নগরীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে এবং ভ্রাম্যমাণ দোকানে ইলিশের দর যাচাই করে দেখা গেছে, এক-দেড় কেজি ওজনের ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ২০০০-২২০০ টাকায়, কোথাও কোথাও আবার তার চেয়েও বেশি। তবে খুচরায় বেশি মিলছে ৫০০-৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ, যেগুলোর দাম চাওয়া হচ্ছে ১৩০০-১৫০০ টাকা। এক কেজির কিছু কম ওজনের ইলিশ ১৮০০ টাকা দাম চাওয়া হচ্ছে। দুই-আড়াই কেজি ওজনের বড় ইলিশ মাছ প্রতিকেজি তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে নগরীর কাজির দেউড়ি বাজারে।
মৎস্য বিভাগের কমকর্তারা বলছেন, সাগরে যে হারে ইলিশ ধরা পড়ছে, তাতে বাজারে এত চড়া দাম কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ইলিশের দামে আমরাও বিস্মিত। বছর কয়েক আগেও সাগর তীরে সদ্য ধরে আনা ইলিশ গড়পরতা প্রতিকেজি ১০০-১৫০ টাকায় পাওয়া যেত। এখন সাগরতীরেই ৫০০-৭০০ টাকার নিচে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। আবার খুচরায় ১৩০০ টাকার নিচে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। ইলিশের চড়া দামের জন্য সরবরাহ সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছেন তারা।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, নৌকা থেকে আড়ত হয়ে খুচরা বাজার পর্যন্ত পৌঁছাতে চারবার হাতবদল হয় ইলিশের। এই চার হাত চক্রের সিন্ডিকেটবাজির কারণে দাম সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসছে না। এছাড়া, সংরক্ষণ ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ার প্রভাবও পড়েছে। তবে ভাদ্র-আশ্বিনে আরও বেশি ইলিশ আহরণ হবে এবং এতে দাম কমবে বলে আশা পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের।
ব্যবসায়িরা বলছেন, ইলিশ মাছের জোগান ও সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু ইলিশের ব্যবসায় বিনিয়োগকারী, মৎস্যজীবী, আড়তদার এবং পাইকারি ব্যবসায়ীদের গড়ে তোলা অদৃশ্য সিন্ডিকেটের কারণে দাম কমছে না। প্রতি বছর ইলিশের বাজার এই চার হাতের চক্রের মধ্যে ঘুরতে থাকে।
চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ বরাত দিয়ে আমাদের প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গত দশ দিনে ইলিশ মাছ আহরণের পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়েছে। গত মাসে একেকটি নৌকা মাত্র ১৫-২০ কেজি ইলিশ মাছ নিয়ে তীরে এসেছিল। গত তিনদিন ধরে একেকটি নৌকা একশ কেজিরও বেশি ইলিশ নিয়ে আসছে। এতে বোঝা যাচ্ছে সাগরে ইলিশের বিচরণ বেড়েছে। মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা নিয়ে নিয়মনীতি মানার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। আশা করছি, এবার গত বছরের চেয়ে ইলিশ আহরণের পরিমাণ বেশি হবে।
মৎস্যজীবী জাহেদুল ইসলাম জানান, গত সপ্তাহে একেকটি নৌকায় ৭০-১০০ কেজি করে ইলিশ ধরা পড়েছে। দেশে সবচেয়ে বেশি ইলিশ আহরণ হয় চট্টগ্রাম বিভাগের সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলাগুলোয়। অবশ্য মাছ ধরার সমুদ্রগ্রামী বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর হিসেব ওঠে চট্টগ্রামের তালিকায়। এর বাইরে পদ্মা-মেঘনার অববাহিকায় ভোলা, খুলনা, বরিশাল ও চাঁদপুর জেলায় প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে।
সরকার গরিবের মুখ থেকে ইলিশ কেড়ে নিয়ে বিদেশে রফতানি করে ডলার আনছে। আর সেই ডলার চোরাই পথে পাচার হচ্ছে বিদেশে।
এদিকে মৎস্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছরে দেশে ইলিশ আহরণের পরিমাণ আগের বছরের চেয়ে কমে গিয়েছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ৫ লাখ ২৯ হাজার মেট্রিকটন। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৭১ হাজার ৩৪২ টন। এর আগে ২০২১-২২ সালে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৫৮৩ টন। ২০২০-২১ সালে ৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৮৩ টন, ২০১৯-২০ সালে ৫ লাখ ৫০ হাজার ৪২৮ মেট্রিকটন, ২০১৮-১৯ সালে ৫ লাখ ৩২ হাজার ৭৯৫ মেট্রিকটন, ২০১৭-১৮ সালে ৫ লাখ ১৭ হাজার ১৯৮ টন এবং ২০১৬-১৭ সালে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৪১৭ মেট্রিকটন ইলিশ আহরণ হয়েছিল।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০০৪-০৫ অর্থবছরে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিকটন। এ হিসেবে গত দেড় যুগে ইলিশের আহরণ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। এর মধ্যে গত সাত বছরে ইলিশ আহরণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে, শুধু ২০২৩-২৪ অর্থবছর ছাড়া।
এতকিছুর পরও ইলিশের দাম ক্রেতাসাধারণের নাগালের মধ্যে থাকে না। গত আট বছরের রফতানির চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মোট আহরণের এক শতাংশেরও কম ইলিশ মাছ রফতানি হয়। বাকি ৯৯ শতাংশ ইলিশ মাছ দেশের বাজারেই বিক্রি হয়। এর পরও প্রতিবছর ইলিশের দাম ৩০ থেকে ৩৩ শতাংশ হারে বাড়ছে বলে কৃষি বিপণন অধিদফতরের তথ্যে জানা গেছে।
সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আট বছরে ইলিশের দাম গড়ে কেজিতে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বেড়েছে। আর ১৮ বছরের ব্যবধানে দেশে ইলিশের দাম বেড়েছে প্রায় ১০০ শতাংশ। এ বছরও ভরা মৌসুমে ইলিশের দাম ক্রেতার নাগালের মধ্যে নেই।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্যাহ বলেন, বাজারে ইলিশ মাছের অতিরিক্ত দাম নেওয়ার অভিযোগ আমরা পেয়েছি। আমরা আড়তদার, পাইকারি এবং খুচরা বাজারে যাব। কে কত দামে ইলিশ কিনছে আর কত দামে বিক্রি করছে, ক্রয়-বিক্রয়ের ভাউচার আছে কি না এবং ক্রয়মূল্য আর বিক্রয়মূল্যের মধ্যে সামঞ্জস্য আছে কি না, সেটা আমরা তদারক করব।