বিউটি বোর্ডিং: ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী

- আপডেট সময় : ৭১০ বার পড়া হয়েছে
পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের প্যারিদাস রোডের শ্রীশদাস লেনে অবস্থিত বিউটি বোর্ডিং, এটি বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির এক ঐতিহাসিক কেন্দ্র। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে দেশের শিল্প-সাহিত্য চর্চার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ:
পঞ্চাশের দশকে নলিনী মোহন সাহা ও প্রহ্লাদ সাহা দুই ভাই মিলে বিউটি বোর্ডিং প্রতিষ্ঠা করেন। নলিনী বাবুর মেয়ের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়। ২৭টি থাকার ঘর এবং তিন বেলার খাবারের ব্যবস্থা নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। কবি শহীদ কাদরীর আহ্বানে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গাফফার চৌধুরী, ফজল শাহাবুদ্দীন, বেলাল চৌধুরীর মতো বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে এই স্থান।
সাংস্কৃতিক কেন্দ্র:
দেশভাগের পর বাংলাবাজার মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পের কেন্দ্রে পরিণত হওয়ায়, বিভিন্ন স্থান থেকে লেখক ও প্রকাশকদের আগমন ঘটে। বিউটি বোর্ডিং তাদের মিলনস্থলে পরিণত হয়। এখানে নিয়মিত আড্ডা চলত, যা থেকে বহু সৃষ্টিশীল কাজের জন্ম হয়। এই আড্ডাবাজদের ‘বিউটিয়ান’ বলা হতো।
বিখ্যাত ব্যক্তিদের আনাগোনা:
শামসুর রাহমান, আলাউদ্দীন আল আজাদ, কাইয়ুম চৌধুরী, জহির রায়হান, খান আতা, গোলাম মুস্তাফাসহ অসংখ্য শিল্পী-সাহিত্যিক এখানে আড্ডা দিতেন। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে অলি আহাদ, সাইফুদ্দিন মানিক, আব্দুল মতিন প্রমুখের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও এখানে বহু সভা করেছেন এবং স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু ও পল্লীকবি জসীম উদ্দীনও এখানে এসেছিলেন।
স্মৃতিচিহ্ন:
কবি শামসুর রাহমান এখানে প্রথম কবিতা লেখেন, সৈয়দ শামসুল হক রচনা করেন ‘অনুপম দিন’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’-এর মতো বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম। আবদুল জব্বার ‘মুখ ও মুখোশ’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা করেন এখানে। সমর দাসের কালজয়ী গানের সুর সৃষ্টি হয়েছে এই বোর্ডিংয়ে।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি:
১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর হামলায় প্রহ্লাদ সাহাসহ ১৭ জন শহীদ হন। তাদের মধ্যে প্রকাশক হেমন্ত কুমার সাহা, ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব অহিন্দ চৌধুরী শংকর, চিত্রশিল্পী হারাধন বর্মণ, অভিনেতা যোশেফ কোরোয়া, সমাজসেবক নির্মল রায় খোকাবাবু, শিক্ষক প্রভাত চন্দ্র সাহার মতো ব্যক্তিরা ছিলেন। ১৯৭২ সালে প্রহ্লাদ সাহার স্ত্রী প্রতিভা সাহা দুই ছেলে সমর ও তারককে নিয়ে বোর্ডিংটি পুনরায় চালু করেন।
বর্তমান অবস্থা:
বর্তমানে বোর্ডিংটির অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। আধুনিক সুযোগ-সুবিধার অভাব এবং নতুন প্রজন্মের আগ্রহের অভাবে ব্যবসা কিছুটা কমে এসেছে। তবে, এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বজায় রাখতে বর্তমান মালিক সমর সাহা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
খাবার ও থাকার ব্যবস্থা:
বিউটি বোর্ডিংয়ে তিন বেলার খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে ভাত, মাছ, ডাল, ভর্তা সহ বিভিন্ন বাঙালি খাবার পাওয়া যায়। এখানে ২৭টি থাকার ঘরও রয়েছে।
দর্শনার্থীদের অনুভূতি:
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রোহান বলেন, “এখানে এসে ৯০ দশকের পরিবেশ খুঁজে পাই, যা আমাদের আকৃষ্ট করে।” গাজীপুর থেকে আসা তামিম রহমান বলেন, “এখানে এসে নিজেকে ইতিহাসের অংশ মনে হয়।” বিউটি বোর্ডিং শুধু একটি স্থান নয়, এটি বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির জীবন্ত ইতিহাস। এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।
আরেক শিক্ষার্থী জনি দে বলেন, ” ঐতিহ্যের দিক দিয়ে এটি অনেক পুরোনো পুরান ঢাকার মানুষের কাছে এটি একটি আবেগের নাম। সময় পেলেই এখানে ঘুরতে আসি”।
উল্লেখ্য, বিউটি বোর্ডিং প্রথমে জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের জমিদার বাড়ি ছিল। ১৯৪৭ সালের আগে এটি জমিদার বাড়ি নামে পরিচিত ছিল।এখানে প্রথমে সোনার বাংলা পত্রিকার অফিস ছিল। দেশ ভাগের পর পত্রিকা অফিসটি কলকাতায় চলে গেলে, ১৯৪৯ সালে নলিনী মোহন সাহা ও প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা মিলে ১১ কাঠা জমির বাড়িটি ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলেন বিউটি বোর্ডিং। এখানে নিয়মিত আড্ডায় অংশ নিতে এসে বহু সাহিত্যিক, প্রকাশক ও সাংবাদিক মিলিত হয়ে কয়েকটি সাময়িক পত্রিকা প্রকাশ করেছেন।##