ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকি সামনে
- আপডেট সময় : ১৮ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশে গত সাড়ে ৩১ ঘণ্টায় চারবার ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে গত শনিবার সকালে একবার ও সন্ধ্যায় পরপর দুবার এবং এর অগের দিন শুক্রবার সকালে একবার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকা। চারটির মধ্যে শুক্রবারের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল সবচেয়ে বেশি। ৫ দশমিক ৭ মাত্রার তীব্র ঝাঁকুনিতে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ কেঁপে ওঠে। শিশুসহ ১০ জন নিহত ও ছয় শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। এ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সামনে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি দেখছে ভূতত্ত্ববিদ এবং বিশেষজ্ঞরা।
শনিবার সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে নরসিংদীতে ৩ দশমিক ৩ মাত্রায় মৃদু ভূমিকম্প হয়। ঠিক তার সাড়ে সাত ঘণ্টা পর সন্ধ্যায় আবারও রাজধানীতে পরপর দুটি ভূমিকম্প হয়েছে। ধারাবাহিক ভাবে ভূমিকম্পের কারণে রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে উৎকণ্ঠা ও উদাসীনতা। এদিকে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের মতে, বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে ঢাকা চট্টগ্রাম শহরতলীর মানুষ বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। এমন শঙ্কা থেকে অন্তবর্তী সরকারের শীর্ষ মহলে চলছে জরুরী একর পর এক বৈঠক। বুয়েট কর্মকর্তা, রাজউক, নগর পরিকল্পনাবিদ উপদেষ্টাদের সমন্বয়ে আলোচনা চলছে। কি প্রক্রিয়ায় ভুমিকম্পের আগ্রাসন থেকে মানুষকে প্রাণে রক্ষা করা যায়। প্রাণহানি কমিয়ে নিরাপদে রাখা যায় ।
এরই অংশ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো রাজধানীসহ সারাদেশের বিভাগীয় শহরগুলোর সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষনাকরা হতে পারে। তা ছাড়া বড় ধরনের ভুমিকম্প হলে প্রানহানি কমানো এবং উদ্ধার কাজ দ্রুত করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ত্রান ও দুযোর্গ মন্ত্রনালয়। এ সংক্রান্তে ইতোমধ্যে প্রায় ৫ হাজার ফায়ার কমীর্, ভলান্টিয়ার, রেডক্রিসেন্টসহ মানবিক এবং সামাজিক সংগঠনের নেতা কর্মীদের প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে।
এদিকে ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ভূত জরুরি পরিস্থিতিতে আগামী ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। । এরআগে সিন্ডিকেটের জরুরি সভা উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানের সভাপতিত্বে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সিন্ডিকেট সদস্যরা সংযুক্ত ছিলেন। এছাড়া চিকিৎসা অনুষদের ডিন, ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অফিসের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক, ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী সভায় অংশ নেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগ থেকে পাঠানো জানানো হয়, সভায় সাম্প্রতিক ভূমিকম্প ও তৎপরবর্তী ঝাঁকুনির কারণে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক আঘাতের বিষয়টি বিবেচনা করা হয় এবং তাদের সার্বিক নিরাপত্তার দিক সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। সভায় বুয়েটের বিশেষজ্ঞ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অফিসের পরিচালক এবং প্রধান প্রকৌশলীর মতামত বিশ্লেষণ করা হয়। তাদের মতামত ভিত্তিতে ভূমিকম্প পরবর্তী আবাসিক হলসমূহের পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সামগ্রিক ঝুঁকি মূল্যায়ন ও প্রয়োজনীয় সংস্কার দরকার। এই ঝুঁকি নিরূপণ ও সম্ভাব্য সংস্কারের স্বার্থে আবাসিক হলগুলো খালি করা প্রয়োজন। একারণে সভায় আগামী ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রাখা এবং আবাসিক হলসমূহ খালি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গতকাল রোববার বিকেল ৫টার মধ্যে আবাসিক হলসমূহ খালি করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সভায় প্রাধ্যক্ষদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসসমূহ যথারীতি খোলা থাকবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়। এর এক সেকেন্ড পর সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৫ সেকেন্ডে দ্বিতীয়বার ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে এটির মাত্রা ৪ দশমিক ৩।
ভূমিকম্প ঝুঁকি, ৪৮ ঘণ্টার জন্য গ্যাস কূপ খনন কার্যক্রম স্থগিত দেশে ভূমিকম্পজনিত সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরোশনের (পেট্রোবাংলা) আওতাধীন কোম্পানিগুলোর কূপ খনন ও সিসমিক জরিপ সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি, সংশ্লিষ্ট কর্মীদের নিরাপত্তা এবং সর্বসাধারণ তথা জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আগামী ৪৮ ঘণ্টা সব ধরনের কূপ খনন ও সিসমিক জরিপ কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। গতকাল রোববার এক বার্তায় এ তথ্য জানিয়েছে পেট্রোবাংলা।
ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, ভারত, ইউরেশিয়া ও মিয়ানমার টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থান হওয়ায় বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। প্লেটগুলো শত শত বছর ধরে শক্তি সঞ্চয় করার ফলে যেকোনো সময় হতে পারে আরও বড় মাত্রার ভূমিকম্প। ভূমিকম্প মোকাবিলায় সরকারের উল্লেখযোগ্য প্রস্তুতি নেই দাবি করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আপাতত জনসচেতনতার বিকল্প নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া বলেন, আমাদের প্লেটটি পূর্বদিকে তলিয়ে যাচ্ছে। এরফলে মাঝেমধ্যে সেকিং (ঝাঁকি) হচ্ছে। ১০০ বছরে বড় কোনো ভূমিকম্প না হওয়ায় শক্তি জমা হয়ে আছে, যেকোনো সময় হতে পারে আরও বড় মাত্রার ভূমিকম্প।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ হুমায়ুন আখতার বলেন, ২০০৩ সালে রাঙ্গামাটিতে ভারত সীমান্তের কাছাকাছি বরকল ইউনিয়নে ৫ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। এটিও অনেক শক্তিশালী ছিল। তবে ১৯১৮ সালে দেশের অভ্যন্তরে সর্বোচ্চ ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল।
তিনি বলেন, আমরা সরকারকে বারবার বলে আসছি ভূমিকম্পে মহড়ার বিকল্প নাই। সরকার ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধারকার্যের জন্য কোটি কোটি টাকার বাজেট রাখে, সেখান থেকে দুর্নীতি করতে পারে। কিন্তু যথাযথ কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। ভূমিকম্প মোকাবিলায় সরকারিভাবে গবেষণার তাগিদ দিয়ে অধ্যাপক ড. মো: আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া বলেন, পাঠ্যপুস্তকে এ সংক্রান্ত তথ্য যুক্ত করাসহ মানতে হবে, ভবন নির্মাণের নিয়ম।
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, অপরিকল্পিত বসতির কারণে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে। এই দায় কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারে না সরকার। ভূমিকম্প জনিত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে রয়েছে ঢাকাসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কিছু অংশ।
গত শুক্রবার সকালে আঘাত হানা ভূমিকম্পটির রিখটার স্কেলে তীব্রতা ছিল ৫ দশমিক ৭ যা মাঝারি মাত্রার বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ভূমিকম্পটির কেন্দ্রস্থল ছিল নরসিংদীর মাধবদী। সাধারণত ভূমিকম্পের পর ছোট ছোট কম্পন বা আফটারশকের সম্ভাবনা থাকে। তবে শুক্রবারের এ ভূমিকম্পে আফটারশকের কোনো আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। চলতি বছরের ৫ মার্চ রাজধানীতে ৫ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল। তারও আগে ২৮ মে দিবাগত রাতে ভারতের মণিপুরের মোইরাং শহরের কাছে আরেকটি ভূমিকম্পের কম্পন বাংলাদেশেও অনুভূত হয়। শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে আঘাত হানা ভূমিকম্পের প্রভাব শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানেও অনুভূত হয়। কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকা কম্পিত হয়। এনডিটিভি জানিয়েছে, একই দিনে ভোরে পাকিস্তানেও ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, যার কেন্দ্রস্থল ছিল ভূমির ১৩৫ কিলোমিটার গভীরে।
এবিষয়ে আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির গণমাধ্যমকে বলেন, এটি মধ্যম বা মডারেট মাত্রার ভূমিকম্প ছিল। শক্তি খুব বেশি নয়, তবে অনুভূতি প্রবল হয়। এ ধরনের ভূমিকম্পে কখনো কখনো আফটারশক হতে পারে, তবে এবার এমন আশঙ্কা নেই। তিনি আরও বলেন, ‘মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে কিছু ক্ষেত্রে আফটারশক দেখা গেলেও তা সব সময় তীব্র বা ঝুঁকিপূর্ণ হয় না।























