রাতের মহাসড়কে ডাকাত আতঙ্ক

- আপডেট সময় : ৩২ বার পড়া হয়েছে
সারাদেশের মহাসড়কে রাতে বাসে ডাকাতির ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। যাত্রীবেশে বাসে উঠে চালক, সহকারী ও সুপারভাইজারসহ যাত্রীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে ডাকাতদল। ডাকাতি আতঙ্কে রংপুরসহ আশপাশের জেলা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেটসহ রাতে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসে যাত্রী কমছে। মহাসড়কে রাতে পুলিশের টহল জোরদার না হওয়ায় অহরহ যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি সংঘটিত হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডাকাতদলের সদস্যরা ভিন্ন ভিন্ন পেশায় জড়িত। কেউ গার্মেন্টসে খন্ডকালীন কাজ করেন। আবার কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসা করেন বা অটোরিকশা চালান। এরাই রাতের বেলা হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর। ফোন করে হুমকি দেন। নিয়মিত মাসোহারা না পেলে গাড়ি থামিয়ে লুট করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, একের পর এক ডাকাতির ঘটনায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক যাত্রী ও যানবাহনের চালকদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে। দিনে-রাতে মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহন থামিয়ে ডাকাতেরা অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের সর্বস্ব লুটে নিয়ে যাচ্ছে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও চলছে ডাকাতি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগে ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও ৫ আগস্টের পর তা বেড়েছে। বিমানবন্দর হয়ে দেশে ফেরা প্রবাসী, রাজধানীতে আসা ব্যবসায়ী, গাড়িচালক ও স্থানীয় তৈরি পোশাকশ্রমিকেরা বেশি ডাকাতি, ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ‘ঝামেলা এড়াতে’ মহাসড়কে ডাকাতির শিকার ব্যক্তিরা মামলা করতে চান না। অনেক সময় পুলিশও ডাকাতির ঘটনায় ছিনতাইয়ের মামলা কিংবা শুধু জিডি নিয়েই দায় শেষ করেন। কিছু ঘটনায় হওয়া মামলায় ডাকাত দলের সদস্যরা ধরা পড়লেও জামিনে বেরিয়ে আসামিরা আবার ডাকাতিতে জড়াচ্ছেন বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
এদিকে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে ডাকাতির সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে পাওয়া যায়নি। এই মহাসড়কে চলাচলকারী কুমিল্লা অঞ্চলের হালকা যানবাহনের চালকেরা নিজেদের ভার্চ্যুয়াল গ্রুপে শেয়ার করা তথ্যের বরাত দিয়ে বলছেন, গত ছয় মাসে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর থেকে কুমিল্লার চান্দিনা পর্যন্ত মহাসড়কে অন্তত ১০০ ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। যার বেশির ভাগের ক্ষেত্রে কোনো মামলা হয়নি। অপর দিকে শেষ ছয় মাসে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনায় অন্তত ১৯টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাস মালিক বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড, মদনপুর, কাঁচপুর, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঘোড়াশাল টোলপ্লাজা থেকে ইটাখোলা মোড় এবং রংপুর-ঢাকা রুটের কালিয়াকৈর থেকে হাঁটুভাঙা পর্যন্ত পয়েন্টে কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র ডাকাতির সঙ্গে জড়িত। এদের নিয়মিত মাসোহারা দিতে হয়। কোনো কারণে একটু কমবেশি হলেই তারা হুমকি দিয়ে টাকা দাবি করেন। নয়তো রাতে বাস থামিয়ে মালামাল লুট করে নিয়ে যান।
সম্প্রতি বাস ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় যাত্রী সংখ্যা কমছে দাবি করে ওই বাস মালিক বলেন, গত পরশু রাতে ১৩ জন যাত্রী নিয়ে নীলফামারী থেকে সিলেট গেছে তার বাস। আর গতকাল রাতে এসেছে ১৪ জন যাত্রী নিয়ে। আগের তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগ যাত্রীও মিলছে না।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, গত দেড় মাসে দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনায় ১৬টি মামলা হয়েছে। তবে সড়কে ডাকাতির প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। ডাকাত আতঙ্কে রাতে দূরপাল্লার বাসের যাত্রী কমেছে। এ পরিস্থিতির জন্য যাত্রী ও সংশ্লিষ্টরা দায়ী করছেন পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, টহল জোরদার না থাকা ও ঢিলেঢালা নিরাপত্তাকে।
এক ভুক্তভোগী জানান, চট্টগ্রাম থেকে রংপুর আসার পথে কয়েকদিন আগে কালিয়াকৈর ব্রিজের কাছে ডাকাতির কবলে পড়ে মাসুদ পরিবহনের একটি বাস। ওই বাসের সুপারভাইজার সাদ্দাম হোসেন বলেন, চান্দুরায় চারজন যাত্রীবেশে উঠেছিল। কালিয়াকৈর ব্রিজের কাছে এসে সামনে একটি প্রাইভেটকার গতিরোধ করে। এরপর যাত্রী বেশে থাকা ডাকাতদলের সদস্যরা টাকা ও বিভিন্ন মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এসময় ডাকাত সদস্যরা তাকে বেধড়ক মারধর করে। হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন এক সপ্তাহ।
রংপুর থেকে ঢাকা নিয়মিত যাওয়া আসা করেন শহরের কসমেটিকস ব্যবসায়ী আবুল কালাম। সম্প্রতি রাতে বাস ডাকাতির আতঙ্কে যাতায়াত কমিয়ে দিয়েছেন। কালাম বলেন, আমি রাতে রংপুর থেকে ঢাকায় গিয়ে দিনের বেলা প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে আবার রাতের গাড়িতে ফিরে আসতাম। নিরাপত্তাহীনতায় এখন রাতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।
অপরদিকে সম্প্রতি পাবনার সাঁথিয়ায় মধ্যরাতে সড়কে গাছ ফেলে বাস-ট্রাকসহ বেশ কয়েকটি গাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। রাত দেড়টার দিকে পাবনা-সাঁথিয়া সড়কের ছেচানিয়া ব্রিজের পাশে ঘটে এ ঘটনা। সাঁথিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইদুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, রাত দেড়টার দিকে ছেচানিয়া ব্রিজের পাশে সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে প্রথমে একটি পণ্যবাহী ট্রাক আটকে রাখে ডাকাতরা। এতে কিছু সময়ের মধ্যেই বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার ও মাইক্রোসহ প্রায় অনেকগুলো গাড়ি আটকে পড়ে। এসময় ১০-১৫ জন সশস্ত্র ডাকাত হাসুয়া, রামদা, ছুরি, চাকুসহ বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে পর্যায়ক্রমে গাড়িগুলোতে ডাকাতি চালায়। গাড়ির গেট খুলতে দেরি করায় কিছু গাড়ি ভাঙচুরও করে। এসময় পরিবহন শ্রমিক ও যাত্রীদের মারধর করে তাদের সঙ্গে থাকা মোবাইল, টাকা ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী লুট করে নিয়ে যায়। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী চলে এ তান্ডব।
কুড়িগ্রাম-সিলেট রুটের ইউনাইটেড পরিবহনের সুপারভাইজার বাবুল বলেন, মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ক্যাম্প না থাকা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের স্বল্পতার কারণেই বেশিরভাগ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এসব কারণে রাতে বাসে যাত্রী কমছে।
গেল সপ্তাহে মধ্যরাতে ডাকাতের কবলে পড়ে ঢাকা থেকে রংপুরের গঙ্গাচড়াগামী সৈকত পরিবহন। বাসমালিক আমিনুল ইসলাম জানান, রাত দেড়টার দিকে কালিয়াকৈর ব্রিজ এলাকায় যাত্রীবেশে ওঠা আটজনের একটি দল অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে টাকা-পয়সা, মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এ কারণে এখন রাতে বাস চলাচল ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। পর্যাপ্ত যাত্রী পাওয়া যায় না। রংপুর-চট্টগ্রাম রুটের বাসমালিক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, পর্যাপ্ত যাত্রী না থাকায় আমরা বাসমালিকরা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছি। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাস বন্ধ করে দিতে হবে।
এবিষয়ে হাইওয়ে পুলিশ কুমিল্লা অঞ্চলের পুলিশ সুপারের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক খায়রুল আলম বলেন, আমরা মহাসড়কে ছিনতাই-ডাকাতি প্রতিরোধে কাজ করছি। এরই মধ্যে হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি জেলা পুলিশের সংশ্লিষ্ট থানাগুলোকেও বলা হয়েছে, রাতে মহাসড়কে টহল বৃদ্ধি করার জন্য। হাইওয়ে পুলিশের সদস্যরা দিনরাতে কাজ করছেন, কোথাও তথ্য পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছে।