সমাজসেবায় আন্দোলনের নেপথ্যে সচিব!
- আপডেট সময় : ১১:৫৪:২৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৫০ বার পড়া হয়েছে
সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পাঁচ দফা দাবিতে গত ১৪ আগস্ট থেকে আন্দোলন করছেন। আন্দোলন থামাতে সরকার সচেষ্ট হলেও তাতে খোদ সমাজ কল্যাণ সচিব খায়রুল আলম সেখ ঘি ঢালছেন বলে অভিযোগ। দুই দফায় উপদেষ্টা কথা বলতে গেলেও সরাসরি কথা বলার পরিবেশ তৈরি করতে দেননি। বরং নিজের অনুসারীদের দিয়ে বিশৃঙ্খলা করে পরিস্থিতি ভিন্নখাতে নিয়েছেন। এখনো পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে সচেষ্ট আওয়ামী সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট ওই সচিব।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সচিব চান এই আন্দোলন জিইয়ে থাকুক বা আরও বড় আকার ধারণ করুক। তাতে উপদেষ্টাকে চাপে রেখে মন্ত্রণালয়ে নিজের দাপট ধরে রাখতে পারবেন। কারণ উপদেষ্টা নতুন হওয়ায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কে তেমন জানেন না। সচিব যা বলেন সে অনুযায়ী কাজ করেন। এতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের মতো যথারীতি পদায়ন ও বদলিতেও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পথ মসৃণ হবে।
অভিযোগ রয়েছে, এই সচিব হাসিনা সরকারের আমল থেকেই বেসরকারি প্রকল্প থেকে ১০ শতাংশ উৎকোচ নিতেন। সরকারি ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নিজের বাবার নামে হাসপাতাল করারও প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব থাকাকালীন মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা নিয়ে এস আলমের বিদেশে নাগরিকত্বের ‘নথি’ অনুমোদন করেন। পিরোজপুরের ডিসি থাকাকালীনও সরকারি খাসজমি ইজারাসহ নানা খাত থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেওয়ার যে তালিকা করেছে, তার মধ্যে সচিব খায়রুল আলম সেখের নামও এসেছে।
সমাজসেবার কর্মকর্তারা বলছেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগী এই সচিবের স্বপদে থাকা নিয়েই তো আমাদের প্রশ্ন। এরই মধ্যে নিজের চেয়ার পাকাপোক্ত করতে ষড়যন্ত্র করে যাওয়ার ব্যাপারে তো আমরা হতবাক! যে জায়গায় দায়িত্বশীল জায়গা থেকে আন্দোলন থামানো হয়, সেখানে এই সচিব আন্দোলন উসকে দিচ্ছেন। যদিও জাগো নিউজের কাছে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন সচিব খাইরুল আলম সেখ।
৫ দফার আন্দোলন: সমাধান না করে উসকানি!
সমাজসেবা কর্মকর্তারা জানান, গত ১৪ আগস্ট ২০২৪ থেকে প্রেষণ বাতিল করে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তাদের পরিচালক পদে পদায়ন, বিসিএস (সমাজসেবা) ক্যাডার সৃজন, বিভিন্ন পদের স্কেল আপগ্রেডেশন, প্রতিটি ধাপে ফিডার পদের অন্তত ৫০ শতাংশ পদোন্নতিযোগ্য পদ সৃজনসহ কর্মচারী পর্যায়ে সব বৈষম্য নিরসনে পাঁচ দফা দাবিতে সরব সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
আন্দোলন থামাতে উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ দুবার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে সমাজসেবা অধিদপ্তরে যান। কিন্তু সচিব খাইরুল আলম সেখ কৌশলে আন্দোলনকারীদের উপদেষ্টার সঙ্গে একান্তে কথা বলতে দেননি। বরং গণহারে সবার সঙ্গে সমাবেশের মতো কথা বলার পরিবেশ তৈরি করেন। সেখানে নিজের অনুসারীদের দিয়ে তৈরি করেন হট্টগোল। যে কারণে বিষয়টির সুরাহা হয়নি।
এমনকি যেখানে উপদেষ্টা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী, সেখানে সচিব স্বৈরাচারী কায়দায় গণবদলির নীতি অনুসরণ করছেন। এরই মধ্যে একদিনে তিন অর্ডারসহ ২০ জন কর্মকর্তাকে হয়রানিমূলক বদলি ও কারণ দর্শানোর চিঠি দেওয়া হয়েছে। বদলির জন্য টার্গেট আরও শতাধিক কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘গণবদলি করতে গিয়ে বেলায়েত মজুমদার নামে একজন সমাজসেবা কর্মকর্তাকে বদলির বিষয়ে অধিদপ্তরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যার অস্তিত্ব কেউ খুঁজে পাচ্ছে না।’
অন্তত ডজনখানেক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে জানান, অনিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় তাদের দমন করার জন্য ফ্যাসিবাদী কায়দায় বদলি করা হচ্ছে। যারাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান করবে তাদেরই কারণ দর্শানোসহ শাস্তিমূলক বদলি করা হবে বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ফলে অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিরাজ করছে বদলি আতঙ্ক।
অন্তর্বর্তী সরকারকে বিব্রত করতে এ কাজ সচিব খায়রুল আলম সেখ করছেন বলে অভিযোগ। ফলে সমাজকল্যাণ সচিবের অপকর্মের দায় সমাজকল্যাণ উপদেষ্টার ওপর বর্তায়।
বিধি লঙ্ঘন করে পদায়ন
সমাজসেবায় প্রায় ১৩ হাজার লোক কাজ করেন। সংস্থাটির কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সর্বোচ্চ পদ একজন মহাপরিচালক ও ১২ জন পরিচালক। দীর্ঘদিন চাকরির পর কর্মকর্তাদের স্বপ্ন থাকে পরিচালক-মহাপরিচালক হবেন। আইনও সেভাবেই তৈরি। কিন্তু সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিয়োগ বিধি লঙ্ঘন করে এসব পদে প্রেষণে পদায়ন করা হয়। দীর্ঘদিনেও দেওয়া হয়নি পদোন্নতি। অথচ ‘সমাজসেবা অধিদফতর (গেজেটেড কর্মকর্তা এবং নন-গেজেটেড কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা, ২০১৩-তে উল্লেখ আছে, ‘মহাপরিচালক ও পরিচালক হবেন পদোন্নতির মাধ্যমে। পদোন্নতিযোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে প্রেষণে বদলির মাধ্যমে পদায়ন করা হবে।’
কিন্তু কাজটি সে আলোকে হচ্ছে না। বরং পদোন্নতি আটকে রেখে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হয়। সে আলোকে গত ১৫ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে ১৪ জন অতিরিক্ত পরিচালককে পরিচালক হিসেবে পদোন্নতির প্রস্তাব পাঠিয়েছেন মহাপরিচালক। বছর হতে চললেও সব শর্ত পূরণ করা সেই প্রস্তাবের আলোকে পদোন্নতি দেয়নি মন্ত্রণালয়।
নিয়ম অনুযায়ী সব ঠিক থাকলেও গত এক বছরেও সেই পদোন্নতি সভা ডাকেননি সচিব খাইরুল আলম সেখ। বরং এই পদোন্নতি আটকে রেখে বিধিবহির্ভূতভাবে প্রেষণে নিয়োগ দিয়ে নিজের বলয় শক্ত করছেন তিনি। ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য দিয়ে বদলি, পদায়ন ও তাদের দিয়ে অপকর্ম করার প্রতিবাদ করায় বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এরই মধ্যে সচিবের রোষানলেও পড়েছেন।
দুই ডিসিকে ডাম্পিং পোস্টিং
কর্মকর্তারা জানান, গত ১৮ আগস্ট ২০২৪ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাঁচ দফা সংস্কার প্রস্তাব বিষয়ে একটি স্মারকলিপি দেন কর্মকর্তারা। তিনি প্রস্তাবিত দাবিগুলো বিধি মোতাবেক বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন। পরবর্তীসময়ে সেটি বাস্তবায়ন না করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ এবং ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ প্রেষণে তিনজন পরিচালক পদায়ন করা হয়। এদের মধ্যে দুজন আওয়ামী সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট জেলা প্রশাসক ছিলেন। এরা হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নেত্রকোনার সাবেক ডিসি শাহেদ পারভেজ ও মো. হাবিবুর রহমান। সচিব তার নিয়ন্ত্রণ সুরক্ষিত করতে বিধিভঙ্গ করে তাদের পদায়ন করেন।
বিষয়টি নিয়ে অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বর্তমানে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও কেন প্রেষণে পরিচালক পদে পদায়ন করা হচ্ছে, তা সুরাহা করার জন্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নিজে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করলে দ্রুত পদোন্নতির বিষয়টি নিষ্পত্তির আশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করা হয় এবং সুকৌশলে নিয়োগবিধিতে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে মতামত চেয়ে কালক্ষেপণ করা হয়। পরে মতামত এলেও সে আলোকে পদোন্নতি দিচ্ছে না। বর্তমানে সংস্থাটির সব পরিচালকই প্রেষণে আসা। পদোন্নতি থেকে কেউ নেই।
নিজস্ব এজেন্ট দিয়ে অধিদফতর নিয়ন্ত্রণ করেন সচিব
মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা সচিবের এজেন্ট হিসেবে বিভিন্ন প্রকল্প থেকে অবৈধ অর্থ সংগ্রহ, টেন্ডারসহ প্রকল্পের সার্বিক বিষয়াদি বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব পালন করেন। সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. হেলাল উদ্দিন ভূঞা তাদের মধ্যে অন্যতম বলে অভিযোগ। প্রকল্প বাস্তবায়নে অদক্ষতা ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বারবার সচিবকে উৎকোচ দিয়ে অভিযোগ থেকে নিষ্পত্তির মাধ্যমে একাধিক প্রকল্পে পিডির দায়িত্ব পালন করছেন। তার বিরুদ্ধে কেনা-কাটায় গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ আছে ঢাকা শিশু হাসপাতালের অ্যাডভান্স শিশু স্টেম সেল থেরাপি ইউনিট স্থাপন প্রকল্পে। যদিও সচিবকে বড় অংকের অর্থের মাধ্যমে এ অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে মর্মে গুঞ্জন আছে। পুনরায় তাকে মোটা অংকের অর্থ দিয়ে ‘কিশোরগঞ্জ জেলার বেকার ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে আত্মকর্মসংস্থানমূলক কাজের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন’ প্রকল্প নামে নতুন আরেকটি প্রকল্পের পিডির দায়িত্ব নিয়েছেন বলে জানা যায়।