অগ্নিকাণ্ডের হিড়িক!

- আপডেট সময় : ৬২ বার পড়া হয়েছে
দেশজুড়ে হঠাৎ বেড়ে গেছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। রাজধানী মিরপুর থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম, বিমানবন্দর সবখানে যেন একের পর এক আগুনের খবর। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ঘটে যাওয়া একাধিক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানি, ধ্বংস হয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ, পুড়ে ছাই হয়েছে মানুষের জীবনের পরিশ্রমের ফল। এই ধারাবাহিক আগুন কি নিছক দুর্ঘটনা, নাকি এর পেছনে কোনো সংগঠিত নাশকতা-এই প্রশ্ন এখন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে গেছে তিনটি বড় অগ্নিকাণ্ড। ১৪ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়ির একটি রাসায়নিকের গুদামে ভয়াবহ আগুন লাগে। দাহ্য পদার্থে ভর্তি ওই গুদাম মুহূর্তেই দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিট ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও, পুড়ে ছাই হয়ে যায় পুরো ভবনটি। নিহত ও আহত হন কয়েকজন শ্রমিক। স্থানীয়দের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরেই সেখানে অনুমোদনহীনভাবে রাসায়নিক মজুদ করা হচ্ছিল।
এর দুই দিন পর, ১৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম ইপিজেড এলাকার একটি তোয়ালে তৈরির কারখানায় আগুন লাগে। দুপুরে শুরু হওয়া আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পুরো কারখানায়। টানা কয়েক ঘণ্টার প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও, কয়েক কোটি টাকার কাঁচামাল ও প্রস্তুত পণ্য পুড়ে যায়। শ্রমিকরা অভিযোগ করেছেন, ফ্যাক্টরিতে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল অপ্রতুল এবং ফায়ার এক্সিট পথও কার্যকর ছিল না।
এরপর ১৮ অক্টোবর বিকেলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ঘটে সর্বশেষ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। দুপুর সোয়া দুইটার দিকে হঠাৎ করেই আগুন লাগে আমদানির কার্গো কমপ্লেক্স ভবনে। সেখানে মূলত বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পণ্য সামগ্রী রাখা হয়। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভবনে। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা মিলে আগুন নেভাতে তৎপর হন। পাঁচ ঘণ্টা চেষ্টা চালানোর পর সন্ধ্যায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে, তবে তখনও ভেতরে ধোঁয়া আর তাপের কারণে উদ্ধার অভিযান চালানো কঠিন হয়ে পড়ে।
বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালকের মুখপাত্র মো. মাসুদুল হাসান মাসুদ জানান, আমদানিকৃত কার্গো ভবনে থাকা প্রায় সব মালামাল পুড়ে গেছে। আগুনের উৎস ও ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে তদন্ত চলছে। তিনি আরও জানান, কার্গো ভিলেজটি পোস্ট অফিস ও হ্যাঙ্গারের মাঝামাঝি স্থানে, মূলত ৮ নম্বর গেটের পাশে অবস্থিত।
অগ্নিকাণ্ডগুলোতে এখন পর্যন্ত প্রাণহানির সংখ্যা একাধিক। মিরপুরের ঘটনায় মারা যান অন্তত ১৬জন, আহত হয়েছেন অনেক শ্রমিক। চট্টগ্রাম ইপিজেডের আগুনে ব্যাপক সম্পদ নষ্ট হয়, যদিও বড় ধরনের প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি। বিমানবন্দরের আগুনে সুনির্দিষ্ট ক্ষতির পরিমাণ এখনো জানা যায়নি, তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ক্ষতির পরিমাণ কয়েকশ কোটি টাকার বেশি হতে পারে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পুড়ে গেছে গুরুত্বপূর্ণ নথি, বিদেশি পণ্য, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, কাপড়, রাসায়নিক দ্রব্যসহ নানা মালামাল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় এমন অগ্নিকাণ্ড শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, বরং নিরাপত্তার বড় সংকেতও। ঘটনাগুলোর সময় ও প্রকৃতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে সন্দেহ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন-এত কম সময়ের মধ্যে রাজধানী ও চট্টগ্রামে ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ড কি কেবলই কাকতালীয়?
নিরাপত্তা বিশ্লেষক রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের শিল্পাঞ্চল, বন্দর এলাকা ও বিমানবন্দর-সবই এখন কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। তাই এসব স্থানে ধারাবাহিক আগুনের ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত নাশকতার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুব বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা এগুলোকে দুর্ঘটনা হিসেবেই দেখছি। তদন্তের পরই নিশ্চিত করে বলা যাবে কোনো ধরনের নাশকতার উপাদান আছে কি না।
বাংলাদেশে অগ্নিকাণ্ডের অন্যতম বড় কারণ অপরিকল্পিত গুদাম, দাহ্য রাসায়নিকের অনিয়ন্ত্রিত মজুদ, এবং অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি। রাজধানীর পুরান ঢাকাসহ অনেক এলাকায় এখনো রাসায়নিক গুদাম আবাসিক ভবনের নিচে বা মাঝখানে রাখা হয়। একইভাবে শিল্পাঞ্চলগুলিতে অগ্নি প্রতিরোধক সরঞ্জাম থাকলেও সেগুলোর অধিকাংশই অকেজো।
বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু সাঈদ বলেন, আমাদের সমস্যা হলো, অগ্নিকাণ্ডের পর তদন্ত হয় কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। একই ভুল বারবার ঘটে, আর তার ফল হয় ভয়াবহ।
পরপর অগ্নিকাণ্ডে জনমনে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। সামাজিক মাধ্যমে অনেকে লিখছেন-আগুন এখন দেশজুড়ে মহামারী’ কেউ বলছেন, আগুনের পেছনে অদৃশ্য হাত আছে। সাধারণ মানুষ চাইছে, এসব ঘটনার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে উচ্চপর্যায়ের স্বাধীন তদন্ত। সরকার বলছে, প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। আগুনের পেছনে কারও গাফিলতি বা নাশকতার প্রমাণ মিললে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্তে ফায়ার সার্ভিস, সিভিল অ্যাভিয়েশন, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও বিশেষ শাখা যৌথভাবে কাজ করছে।
অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে, যা নিছক দুর্ঘটনা মনে হয় না। মিরপুরের গুদাম মালিক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, বিদ্যুৎ বন্ধ ছিল, গুদামে কেউ ছিল না, তারপরও কীভাবে আগুন লাগল বুঝতে পারছি না। এটা পরিকল্পিত না হলে কীভাবে সম্ভব? চট্টগ্রামের কারখানা মালিক সুমন দত্ত বলেন, এ যেন আমাদের অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস করে দেওয়ার একটা ষড়যন্ত্র। এত আগুন একসাথে লাগা কাকতালীয় হতে পারে না।
আরেক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী রুবেল হোসেনের ভাষায়, আমরা নিঃস্ব হয়ে গেলাম। তদন্তের নামে সময় কাটানো হচ্ছে, কিন্তু আগুনের রহস্য কেউ জানতে চাইছে না। একদিকে দুর্ঘটনার দায়, অন্যদিকে নাশকতার আশঙ্কা-এই দুইয়ের মাঝেই সাধারণ মানুষ হারাচ্ছে জীবন ও সম্পদ। ধারাবাহিক আগুনের এই প্রবণতা যদি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তাহলে শুধু আর্থিক নয়, দেশের নিরাপত্তার চিত্রও গভীর সংকটে পড়বে। এখন প্রশ্ন একটাই-এই আগুন কি কেবল ভাগ্যের নির্মম খেলা, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে আরও গভীর কোনো চক্রান্ত?