অদৃশ্য জলবায়ু বিপর্যয়ে গ্র্রামীণ জনপদ

- আপডেট সময় : ৯৮ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অনেক সময় অপ্রকাশিত থেকে যায়। বন্যা, খরা ও জোয়ারের পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির কারনে এসব সমস্যা গড়ে তোলে যা মানুষের জীবনযাত্রায় নীরব সংকট তৈরি করে। যার ফলে কৃষকরা ফসলের ক্ষতি, পানির সংকট এবং জীবিকার ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন। দেখা যায়, অনেক পরিবার বাধ্য হয়ে শহরে স্থানান্তরিত হচ্ছে, যার ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট বেড়ে যাচ্ছে। স্থানীয় সরকার ও এনজিওগুলোকে এ সংকট মোকাবিলায় দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে এবং টেকসই জীবিকা নিশ্চিত করতে পরিবেশবান্ধন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।
বন্যা ও জলাবদ্ধতা : নদীর তীরবর্তী গ্রামের কৃষক মনু মিয়া। বন্যার পানিতে তার জমির ফসল প্রায় প্রতি বছরই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্ষার সময় নদীর পানি বেড়ে গেলে তার প্রায় ১০ একর চাউলের জমি পুরোপুরি তলিয়ে যায়। প্রতি বছর বন্যার কারনে মনু মিয়া আর আগের মত ভালো ফসল উৎপাদন করতে পারছে না। যার ফলে তার পরিবারের আয় অনেক কমে গেছে।
লবণাক্ততা ও মাটির অবনতি: যে সকল অঞ্চলের পানিতে লবণাক্ততা রয়েছে সেসব এলাকায় জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। কৃষকরা জানান, আগে দুইবার ধাণ ফলাতে পারতেন আর এখন এক বারই ঠিকমতো হয় না। লবণাক্ত পানি নিচু এলাকার জমি সংক্রমণ ঘটায়, যা ফসল নষ্ট করে দেয় বলে জানান তারা। খাদ্য নিরাপক্তা ও জীবিকা: এমনসব গ্রামীণ এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও মৎসজীবীরা যখন নিজেদের জীবিকা হারাচ্ছেন, তখন দেশের খদ্য নিরাপত্তাও সঙ্কটে পড়ছে। এদের মধ্যে অনেকেই শহরে অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, যার ফলে পরিবারে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও সমস্যাও বাড়ছে।
সমাধান ও প্রস্তাবনা: প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় স্থানীয় প্রস্তুতি নিতে হবে। জলাবদ্ধতা কমানোর জন্য গ্রামে ছোট ছোট খাল খনন, বাঁধ নির্মাণ ও পানি নিঙ্কাশন ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া লবণ প্রতিরোধ ধানের জাত এবং সাশ্রয়ী চাষাবাদের পদ্ধতি প্রচার করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা বৃদ্ধি করা উচিত। এনজিও ও সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে স্থায়ী পরিকল্পনা প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের নীরব এই সংকট মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি সাংবাদিক ও সচেতন নাগরিকদের ভূমিকা অপরিহার্য। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কষ্ট ও চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে টেকসই উন্নয়নের পথে অগ্রসর কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
ক্লাইমেট বিশেষজ্ঞ ড: আফসারি বেগম বলেন, বন্যা ও ঘূণিঝড় বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়, তবে এর তীব্রতা ও প্রভাব আগের থেকে অনেক বেশি বেড়েছে। গ্রামীণ জনগণ এখন আরও বেশি ঝুঁকির মুখোমুখি। প্রস্তুতি গ্রহণ ও টেকসই অভিযোজন পদ্ধতি ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। গ্রামীণ মানুষদের মধ্যে আবহাওয়ার পরিবর্তনের বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো এবং স্থানীয় পরিবেশ বাদ্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করাই এখন অগ্রাধিকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. খুরশিদ আলম জানান, বাংলাদেশের নিম্নভূমি এলাকা বিশেষত নদী তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে লবণাক্ততার বৃদ্ধি এবং বন্যার পুনরাবৃত্তি গ্রামীণ কৃষি ও জীবিকার জন্য মারাত্মক হুমকি। এই সমস্যা শুধু কৃষিকাজে নয় বরং সামাজিক অবকাঠামো ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও বড় প্রভাব ফেলছে।
সরকারকে এখন দ্রুত জলবায়ু অভিযোজন নীতি শক্তিশালী করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদশে কৃষি গবষেণা কাউন্সলিরে চেয়ারম্যানড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বন্যা, খরা ও লবণাক্ততার মতো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব গ্রামীণ কৃষকদের জীবনে অপ্রত্যাশিত ধাক্কা দিয়েছে। আমরা লবণ প্রতিরোধী ধান চাষ এবং জৈব সার ব্যবহারে ভালো অগ্রগতি দেখেছি। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে প্রযুক্তগত সহায়তার মাধ্যমে কৃষকদেরকে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে চাষাবাদে উৎসাহিত করা।
এনজিও কর্মী ও সমাজসেবিকা শামসুন নাহার বলেন, গ্রামীণ পরিবারগুলো খুবই দুর্বল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাদের জীবিকা নষ্ট হচ্ছে এবং তারা শহরে অভিবাসনের জন্য বাধ্য হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি তাদেরকে আর্থিক সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে টেকসই জীবিকা গড়ে তুলতে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা উন্নয়ন চাই, তবে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে নয়। জলাশয় ভরাট, পাহাড় কাটা কিংবা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অবহেলা চলতে পারে না। প্রকৃতিকে সম্মান জানিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে হবে। তবে শুধু সরকারের নয়, সকলের পরিবেশ রক্ষা করার দায়িত্ব। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় তরুণদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
এমটি/ এএটি