ঢাকা ০২:৫৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫

অবসর ভাতা মিলবে তো মৃত্যুর আগে…

বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট সময় : ১২:২৬:০৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ মার্চ ২০২৫ ১৩৩ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

 

কেউ কাগজপত্র নিয়ে ফটোকপি করছেন। কেউ কাগজপত্র নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। কেউবা পরিশ্রান্ত হয়ে বসে আছেন। সকলেই প্রবীণ এবং বয়সের ভারে নূইয়ে পড়েছেন। এ লোকগুলো শিক্ষক, মানুষ গড়ার কারিগর। হতাশার, কষ্টের এবং চরম ভোগান্তির এ দৃশ্য রাজধানীর ব্যানবেইস ভবনের সামনে নিত্যদিনের

 

কেউ কাগজপত্র নিয়ে ফটোকপি করছেন। কেউ কাগজপত্র নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। কেউবা পরিশ্রান্ত হয়ে বসে আছেন। সকলেই প্রবীণ এবং বয়সের ভারে নূইয়ে পড়েছেন। এটা এখানকার নিত্যদিনের দৃশ্য। এ দৃশ্য হতাশার, কষ্টের এবং চরম ভোগান্তির। রাজধানীর নীলক্ষেত-পলাশীর মধ্যে অবস্থিত ব্যানবেইস ভবনের সামনে এমন অমানবিক, বেদনাবিধুঁর দৃশ্য এই প্রতিবেদকের চোখে পড়ে।
জানা গেছে, এ ভবনটি হচ্ছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরের অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যালয়। পেনশনে যাওয়া ষিক্ষকরা অবসর ভাতা ও কল্যান ট্রাষ্টের টাকার জন্য এখানে এসে ধর্না দিতে হচ্ছে। এখানে প্রতিদিনই দেশের ৬৪টি জেলা থেকে আগত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরা নিজেদের অবসর ভাতার জন্য ভিড় করেন। এ ক্ষেত্রে তাদের অনেকের এখানে এসে ঘুরতে ঘুরতে জুতার তলা ক্ষয় হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে। তবু মেলে না নিজেদের কাক্সিক্ষত অবসরের টাকা। একাধিক প্রবীন শিক্ষক দুঃথ এবং ক্ষোভে বলেছেন, জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে টাকা না পেয়ে চিকিৎসা করাতে পারছি না। টাকা না পাওয়াতে বিনা চিকিৎসায় মরে যেতে হবে।
ভূক্তভোগী শিক্ষকরা বলেন, বিগত দিনে এ নিয়ে গণমাধ্যমেও অনেক লেখালেখি হয়েছে। সরেজমিন প্রতিবেদনও করা হয়েছে। কিন্তু তাতে পরিবর্তন আসেনি। ব্যানবেইস কার্যালয়ের নিচতলায় গিয়ে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সঙ্গে কথা তাদের নানা ভোগান্তির বিষয়ে জানা গেল। জাতির মেরুদ- গড়ার এই কারিগররা জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এখানে অমানবিক ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।

২০০২ সালের ২৭ নম্বর আইনের মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড গঠন করা হয়। আর ১৯৯০ সালে কল্যাণ ট্রাস্ট গঠিত হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর, মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতর এবং কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের অধীন এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের অবসর সুবিধা প্রদান কার্যক্রম এ দুই বোর্ডের আওতাভুক্ত। এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের এমপিও থেকে ৬ শতাংশ টাকা সঞ্চয় করে অবসর সুবিধাদি প্রদান করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া ৪ শতাংশ সঞ্চয় করে কল্যাণ ট্রাস্ট সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে।
অনলাইনকেন্দ্রিক শিক্ষকদের অবসরের এই টাকা দেওয়ার সিস্টেম চালু থাকলেও অনেক শিক্ষকের আবেদনে নানা সমস্যা থাকে বলে বোর্ড থেকে জানানো হয়। ফলে তাদের অনেককেই ঢাকায় আসতে হয়। আর এখানে এসে তারা বিড়ম্বনার শিকার হোন। শিক্ষকরা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, তাদের মধ্যে যাদের কাগজপত্রে একটু খুঁত পাওয়া যায়, এখানে এলে তাদের বলা হয়-এটা নেই, সেটা নেই।
কাগজপত্র অস্পষ্টসহ আরও কত কী! তবে এ ক্ষেত্রে এখানের কিছু কর্মচারী আছেন, যাদের কিছু টাকা দিয়ে অনেকে ভোগান্তি থেকে পার পেয়েছেন। যারা এ পথে হাঁটেননি, তাদের কাজ হতে দেরি হয়েছে।
গরেজমিনে দেখা গেছে, ব্যানবেইস ভবনের নিচতলায় প্রবেশ করে হাতের বামদিকে মোড় নিলে কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যালয়। প্রবেশ ফটক থেকে একটু সামনে গেলে ওপরে ওঠার যে সিঁড়ি, তার পাশ ঘেঁষে আছে অবসর বোর্ডের কার্যালয়। দুপাশে আছে তথ্যকেন্দ্র। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরা যার যেদিকে প্রয়োজন, সেদিকে লাইনের আওতায় জড়ো হন। এরপর নিজের ইনডেক্স নাম্বারসহ প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে নিজের অবসরের টাকার খোঁজখবর নেন। তবে তথ্যকেন্দ্র থেকে তথ্য পেয়ে তাদের অধিকাংশকে আবার বিষন্ন হতে দেখা যায়। এর কারণ, অবসর ভাতা পেতে বিলম্ব কিংবা কর্তৃপক্ষের আশ্বাস তাদের মনঃপূত না হওয়া।

অবসর বোর্ডের কার্যালয়ের দেয়াল ঘেঁষে শিক্ষকদের সহায়তামূলক নানা ধরনের তথ্যও সংযুক্ত করা আছে। কোথাও অবসর ভাতার জন্য আবেদনের ওয়েবসাইটের নাম, আবার কোথাও তথ্যকেন্দ্রের নাম্বার সংযুক্ত করা আছে। একদিকে এটিও লেখা থাকতে দেখা গেছে, ‘অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা মধ্যস্বত্বভোগী দালাল থেকে দূরে থাকুন। এটি সম্পূর্ণ আই ওয়াস।
এখানে যে দালাল আছে, সে বিষয়ে হয়তো কর্তৃপক্ষও অবগত ছিলেন। তবে শিক্ষকরা একাধিকবার গণমাধ্যমের কাছে বলছেন, নানা সহায়তার বাণী । এখানে ভোগান্তির শেষ নেই। এ যেন বাণীতে সীমাবদ্ধ কথা। শুধু তা-ই নয়, হেল্প নাম্বার চালু থাকলেও তাদের ফোনে পাওয়া এ যেন রাজ্য জয় করার সমান। সামান্য একটি তথ্যের জন্য শিক্ষকদের দূরদূরান্ত থেকে আসতে হয়েছে ভোগান্তি সহ্য করতে।
কখনো কখনো কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা পেলেও অবসরেরটা পেতে অপেক্ষা করতে হয় কয়েক বছর। তিন মাস পর পাওয়া যাবে বললেও বছর লেগে যেতে পারে। অবসরের পর শিক্ষকদের এভাবে দ্বারে দ্বারে ঘোরা কোনোভাবেই শোভা পায় না। এটা আমাদের জন্য লজ্জারও বটে। অনেকেই ২০১৯ সালে অবসরে গিয়ে ২০২৩ সাল পার হলেও টাকা পাওয়ার খবর ছিল না। কাগজপত্র সব ওকে করে ব্যাংকে পাঠানো হলেও ব্যাংক থেকে পাঠানো হচ্ছে না। ফান্ডিংয়ের অভাবে পাঠানো হচ্ছে না বলেও জানানো হয়।

দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবন পার করে ৬০ বছর বয়সে অবসরে যান তারা। অনেক স্বপ্ন দেখেন এই টাকা নিয়ে। অনেকেই ভেবে রাখেন, অবসরের টাকা পেলে নিজের ছেলেকে ব্যবসায়ের পুঁজি দেবেন। কেউ নতুন ঘর করার স্বপ্ন দেখেন। কিংবা মুসলিম হলে পবিত্র হজ পালন করবেন। এই স্বপ্ন তাদের কাছে দুঃস্বপ্ন মনে হয়, যখন তাদের একবার বলা হয়-তথ্যে ভুল আছে।
আবার বলা হয়, কাগজপত্রের ঘাটতি আছে। এভাবে কয়েকবার এসে নানা কাগজপত্রও দিতে হয়েছে। তারপরও কাজ হয়নি। কাউকে না কাউকে দিয়ে এখান থেকে খবর নিতে হয়েছে। অনেক শিক্ষক খবরও নিতে পারেননি। অনেকে কষ্ট হলেও গেছেন খবর নিতে। তবুও তারা জানেন না, কর্তৃপক্ষের কথামতো যথাসময়ে টাকাটা পাবেন কি না? সময়মতো না পেলে এভাবে আসতেই হবে, ভোগান্তি সহ্য করতে হবে।
কেউ কেউ সঙ্গে করে সন্তান বা নাতিকেও নিয়ে আসেন। কেউ কেউ পাঁচবার-দশবার করে এখানে আসেন। কিন্তু একেকবার একেকরকম কথা বলা হয়। অনেক দূর থেকে এসে আবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হয়েছে। অনেকেই অবসরে যাওয়ার পর অনলাইনে আবেদন করেছেন সাড়ে ৩ বছর আগে। এদিকে অনলাইনে বলা হচ্ছে, আর কাগজপত্রের প্রয়োজন নেই। কিন্তু এরপরও আপডেট না হওয়ায় ব্যানবেইসে এলে বলা হয়, আরও কাগজপত্র লাগবে। ফলে আবার কাগজপত্র জমা দিতে হয়। তখন বলা হয়, খুব তাড়াতাড়ি আপডেট হয়ে যাবে। কিন্তু এই শিক্ষকরা জানেন না, কবে আপডেট হবে। প্রক্রিয়া শেষ হয়ে কবে টাকাটা পাবেন। গণঅভ্যুত্থানের পর নিশ্চয়ই পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষকদের হয়তো আর ভোগান্তি পোহাতে হবে না। তারা দ্রুতই টাকা পেয়ে যাবে। এটাই প্রত্যাশা।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

অবসর ভাতা মিলবে তো মৃত্যুর আগে…

আপডেট সময় : ১২:২৬:০৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ মার্চ ২০২৫

 

কেউ কাগজপত্র নিয়ে ফটোকপি করছেন। কেউ কাগজপত্র নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। কেউবা পরিশ্রান্ত হয়ে বসে আছেন। সকলেই প্রবীণ এবং বয়সের ভারে নূইয়ে পড়েছেন। এ লোকগুলো শিক্ষক, মানুষ গড়ার কারিগর। হতাশার, কষ্টের এবং চরম ভোগান্তির এ দৃশ্য রাজধানীর ব্যানবেইস ভবনের সামনে নিত্যদিনের

 

কেউ কাগজপত্র নিয়ে ফটোকপি করছেন। কেউ কাগজপত্র নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। কেউবা পরিশ্রান্ত হয়ে বসে আছেন। সকলেই প্রবীণ এবং বয়সের ভারে নূইয়ে পড়েছেন। এটা এখানকার নিত্যদিনের দৃশ্য। এ দৃশ্য হতাশার, কষ্টের এবং চরম ভোগান্তির। রাজধানীর নীলক্ষেত-পলাশীর মধ্যে অবস্থিত ব্যানবেইস ভবনের সামনে এমন অমানবিক, বেদনাবিধুঁর দৃশ্য এই প্রতিবেদকের চোখে পড়ে।
জানা গেছে, এ ভবনটি হচ্ছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরের অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যালয়। পেনশনে যাওয়া ষিক্ষকরা অবসর ভাতা ও কল্যান ট্রাষ্টের টাকার জন্য এখানে এসে ধর্না দিতে হচ্ছে। এখানে প্রতিদিনই দেশের ৬৪টি জেলা থেকে আগত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরা নিজেদের অবসর ভাতার জন্য ভিড় করেন। এ ক্ষেত্রে তাদের অনেকের এখানে এসে ঘুরতে ঘুরতে জুতার তলা ক্ষয় হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে। তবু মেলে না নিজেদের কাক্সিক্ষত অবসরের টাকা। একাধিক প্রবীন শিক্ষক দুঃথ এবং ক্ষোভে বলেছেন, জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে টাকা না পেয়ে চিকিৎসা করাতে পারছি না। টাকা না পাওয়াতে বিনা চিকিৎসায় মরে যেতে হবে।
ভূক্তভোগী শিক্ষকরা বলেন, বিগত দিনে এ নিয়ে গণমাধ্যমেও অনেক লেখালেখি হয়েছে। সরেজমিন প্রতিবেদনও করা হয়েছে। কিন্তু তাতে পরিবর্তন আসেনি। ব্যানবেইস কার্যালয়ের নিচতলায় গিয়ে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সঙ্গে কথা তাদের নানা ভোগান্তির বিষয়ে জানা গেল। জাতির মেরুদ- গড়ার এই কারিগররা জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এখানে অমানবিক ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।

২০০২ সালের ২৭ নম্বর আইনের মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড গঠন করা হয়। আর ১৯৯০ সালে কল্যাণ ট্রাস্ট গঠিত হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর, মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতর এবং কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের অধীন এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের অবসর সুবিধা প্রদান কার্যক্রম এ দুই বোর্ডের আওতাভুক্ত। এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের এমপিও থেকে ৬ শতাংশ টাকা সঞ্চয় করে অবসর সুবিধাদি প্রদান করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া ৪ শতাংশ সঞ্চয় করে কল্যাণ ট্রাস্ট সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে।
অনলাইনকেন্দ্রিক শিক্ষকদের অবসরের এই টাকা দেওয়ার সিস্টেম চালু থাকলেও অনেক শিক্ষকের আবেদনে নানা সমস্যা থাকে বলে বোর্ড থেকে জানানো হয়। ফলে তাদের অনেককেই ঢাকায় আসতে হয়। আর এখানে এসে তারা বিড়ম্বনার শিকার হোন। শিক্ষকরা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, তাদের মধ্যে যাদের কাগজপত্রে একটু খুঁত পাওয়া যায়, এখানে এলে তাদের বলা হয়-এটা নেই, সেটা নেই।
কাগজপত্র অস্পষ্টসহ আরও কত কী! তবে এ ক্ষেত্রে এখানের কিছু কর্মচারী আছেন, যাদের কিছু টাকা দিয়ে অনেকে ভোগান্তি থেকে পার পেয়েছেন। যারা এ পথে হাঁটেননি, তাদের কাজ হতে দেরি হয়েছে।
গরেজমিনে দেখা গেছে, ব্যানবেইস ভবনের নিচতলায় প্রবেশ করে হাতের বামদিকে মোড় নিলে কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যালয়। প্রবেশ ফটক থেকে একটু সামনে গেলে ওপরে ওঠার যে সিঁড়ি, তার পাশ ঘেঁষে আছে অবসর বোর্ডের কার্যালয়। দুপাশে আছে তথ্যকেন্দ্র। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরা যার যেদিকে প্রয়োজন, সেদিকে লাইনের আওতায় জড়ো হন। এরপর নিজের ইনডেক্স নাম্বারসহ প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে নিজের অবসরের টাকার খোঁজখবর নেন। তবে তথ্যকেন্দ্র থেকে তথ্য পেয়ে তাদের অধিকাংশকে আবার বিষন্ন হতে দেখা যায়। এর কারণ, অবসর ভাতা পেতে বিলম্ব কিংবা কর্তৃপক্ষের আশ্বাস তাদের মনঃপূত না হওয়া।

অবসর বোর্ডের কার্যালয়ের দেয়াল ঘেঁষে শিক্ষকদের সহায়তামূলক নানা ধরনের তথ্যও সংযুক্ত করা আছে। কোথাও অবসর ভাতার জন্য আবেদনের ওয়েবসাইটের নাম, আবার কোথাও তথ্যকেন্দ্রের নাম্বার সংযুক্ত করা আছে। একদিকে এটিও লেখা থাকতে দেখা গেছে, ‘অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা মধ্যস্বত্বভোগী দালাল থেকে দূরে থাকুন। এটি সম্পূর্ণ আই ওয়াস।
এখানে যে দালাল আছে, সে বিষয়ে হয়তো কর্তৃপক্ষও অবগত ছিলেন। তবে শিক্ষকরা একাধিকবার গণমাধ্যমের কাছে বলছেন, নানা সহায়তার বাণী । এখানে ভোগান্তির শেষ নেই। এ যেন বাণীতে সীমাবদ্ধ কথা। শুধু তা-ই নয়, হেল্প নাম্বার চালু থাকলেও তাদের ফোনে পাওয়া এ যেন রাজ্য জয় করার সমান। সামান্য একটি তথ্যের জন্য শিক্ষকদের দূরদূরান্ত থেকে আসতে হয়েছে ভোগান্তি সহ্য করতে।
কখনো কখনো কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা পেলেও অবসরেরটা পেতে অপেক্ষা করতে হয় কয়েক বছর। তিন মাস পর পাওয়া যাবে বললেও বছর লেগে যেতে পারে। অবসরের পর শিক্ষকদের এভাবে দ্বারে দ্বারে ঘোরা কোনোভাবেই শোভা পায় না। এটা আমাদের জন্য লজ্জারও বটে। অনেকেই ২০১৯ সালে অবসরে গিয়ে ২০২৩ সাল পার হলেও টাকা পাওয়ার খবর ছিল না। কাগজপত্র সব ওকে করে ব্যাংকে পাঠানো হলেও ব্যাংক থেকে পাঠানো হচ্ছে না। ফান্ডিংয়ের অভাবে পাঠানো হচ্ছে না বলেও জানানো হয়।

দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবন পার করে ৬০ বছর বয়সে অবসরে যান তারা। অনেক স্বপ্ন দেখেন এই টাকা নিয়ে। অনেকেই ভেবে রাখেন, অবসরের টাকা পেলে নিজের ছেলেকে ব্যবসায়ের পুঁজি দেবেন। কেউ নতুন ঘর করার স্বপ্ন দেখেন। কিংবা মুসলিম হলে পবিত্র হজ পালন করবেন। এই স্বপ্ন তাদের কাছে দুঃস্বপ্ন মনে হয়, যখন তাদের একবার বলা হয়-তথ্যে ভুল আছে।
আবার বলা হয়, কাগজপত্রের ঘাটতি আছে। এভাবে কয়েকবার এসে নানা কাগজপত্রও দিতে হয়েছে। তারপরও কাজ হয়নি। কাউকে না কাউকে দিয়ে এখান থেকে খবর নিতে হয়েছে। অনেক শিক্ষক খবরও নিতে পারেননি। অনেকে কষ্ট হলেও গেছেন খবর নিতে। তবুও তারা জানেন না, কর্তৃপক্ষের কথামতো যথাসময়ে টাকাটা পাবেন কি না? সময়মতো না পেলে এভাবে আসতেই হবে, ভোগান্তি সহ্য করতে হবে।
কেউ কেউ সঙ্গে করে সন্তান বা নাতিকেও নিয়ে আসেন। কেউ কেউ পাঁচবার-দশবার করে এখানে আসেন। কিন্তু একেকবার একেকরকম কথা বলা হয়। অনেক দূর থেকে এসে আবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হয়েছে। অনেকেই অবসরে যাওয়ার পর অনলাইনে আবেদন করেছেন সাড়ে ৩ বছর আগে। এদিকে অনলাইনে বলা হচ্ছে, আর কাগজপত্রের প্রয়োজন নেই। কিন্তু এরপরও আপডেট না হওয়ায় ব্যানবেইসে এলে বলা হয়, আরও কাগজপত্র লাগবে। ফলে আবার কাগজপত্র জমা দিতে হয়। তখন বলা হয়, খুব তাড়াতাড়ি আপডেট হয়ে যাবে। কিন্তু এই শিক্ষকরা জানেন না, কবে আপডেট হবে। প্রক্রিয়া শেষ হয়ে কবে টাকাটা পাবেন। গণঅভ্যুত্থানের পর নিশ্চয়ই পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষকদের হয়তো আর ভোগান্তি পোহাতে হবে না। তারা দ্রুতই টাকা পেয়ে যাবে। এটাই প্রত্যাশা।