ঢাকা ১০:২৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম ::

অর্ন্তকোন্দলে পুড়ছে বাম দলগুলো

বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট সময় : ১২:২৬:০৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ৭৫ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি
  • অস্তিত্ব সঙ্কটে দেশের ১৪ দল : ১০টি বিলুপ্ত
    * জাতীয় পার্টি ন্যাপ ৫ ওয়ার্কার্স জাসদ ৩ ধারা
    * গণফোরাম বিকল্পধারা এলডিপিতে ভাঙ্গনের সূর

অস্তিত্ব সঙ্কটে দেশের ছোট ছোট ভুঁই ফোড় রাজনৈতিক দলগুলো। ক্রমান্বয়ে এসব দলের ভোট কমছে। কমছে গ্রহণযোগ্যতা। নীতিতে অটল থাকতে না পারায় সাংগঠনিক শক্তি কমেছে। এরফলে সংসদেও এ সকল দলের একক প্রতিনিধিত্ব কমছে। টিকে থাকার প্রয়োজনে বড় দলগুলোর তুরুপের তাসে পরিণত হয়েছ্রে দলগুলো। বেশিরভাগ সময় দেখা গেছে ছোট দল বড়দলের নেতৃত্বাধীন জোটে নিজেদের যুক্ত করেছে। পাওয়া না পাওয়ার হিসাবে ােভ থাকলেও এসব দল প্রধান শরিকের প্রতি অনুগত। তাছাড়া কোন্দলের আগুনে পুড়ে খ- বিখ- বাম দলগুলোর রাজনীতি। গত প্রায় এক দশকে বিরোধী রাজনীতি কার্যত শিকেয় উঠেছে। শুধু তাই নয়, ১৫ বছরে ২০টি রাজনৈতিক দল এলেও সবকটি জনসমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে। ফ্যাসিষ্ট হাসিনা সরকারের পতন ও শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়া পর পট পরিবর্তন হয়। আর এই প্রোপটে দেশের রাজনীতিতে শক্তিশালী দল বা জোট আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছোট দলগুলোর গুরুত্ব বাড়ছে। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি নিজেদের জোটের পরিধি বাড়াতে ছোট দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে। হাসিনা সরকার পতনের আন্দোলনে অংশ নেওয়া দলগুলোর পাশাপাশি ডান, বাম ও মধ্যপন্থি বিভিন্ন সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনী কৌশল প্রণয়নে তৎপর বিএনপি। বিশেষ করে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে নজর দিয়েছে দলটি।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীও নির্বাচনী কৌশল প্রণয়নে ব্যস্ত। ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে তাদের নিয়ে বৃহত্তর নির্বাচনী ঐক্য গঠনের চেষ্টা করছে দলটি। গতকাল জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান বরিশালের চরমোনাইয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীমের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এটিই প্রথমবারের মতো জামায়াত নেতৃত্ব সরাসরি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠক করলেন।

বিএনপিও ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে তৎপর। সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর খেলাফত মজলিশের আমির মাওলানা আবদুল বাসিত আজাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এছাড়াও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতা মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীমের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন তিনি। বিএনপির প থেকে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য গঠন এবং আসন বণ্টনের বিষয়েও আলোচনা চলছে।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকার বিদায়ের আন্দোলনে যেসব দল রাজপথে ছিল, আমরা সবাইকে নিয়ে আগামী নির্বাচন এবং পরবর্তীতে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় সরকার গঠন করতে চাই।
জামায়াতে ইসলামী আনুষ্ঠানিকভাবে জোট গঠনের ঘোষণা না দিলেও ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছে। দলটির নেতারা বলছেন, ৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে কাজ করতে হবে। এ ল্েয ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, হেফাজতে ইসলাম, জাকের পার্টিসহ বিভিন্ন ইসলামি দল ও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মতবিনিময় চলছে। খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল জলিল বলেন, জুলাই বিপ্লবের ঐক্য ধরে রাখতে আমরা বিএনপিসহ সবার সঙ্গেই আলোচনা করছি। নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে কথা হচ্ছে।

বাম দলগুলোও নির্বাচনী ঐক্য গঠনে তৎপর। তারা মুক্তিযুদ্ধের পরে বৃহত্তর নির্বাচনী জোটের দিকে ঝুঁকতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মুস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে নানা তৎপরতা চলবে এটাই স্বাভাবিক। তবে আমরা যারা স্বৈরাচার হাসিনা সরকার পতনের আন্দোলনে ছিলাম, তারা সম্মিলিতভাবে রাষ্ট্র সংস্কারে ৩১ দফা প্রস্তাব দিয়েছি।
গত ১১ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল হিসাব করে দেখা গেছে, ১৯৭৩-২০১৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী ১০টির বেশি রাজনৈতিক দলের এখন আর কোন অস্তিত্ব নেই। ১৯৯১ সালের পর সিপিবি ও ন্যাপ মোজাফফর দলের পে থেকে সরাসরি ভোটে কেউ পাস করতে পারেনি। ২৭ বছরে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোমের প থেকে একাদশ সংসদে প্রথম ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে দুইজন নির্বাচিত হয়েছেন। এরমধ্যে ১৯৯৬ সাল থেকে প্রায় ২৫ বছর সংসদে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মাত্র ১৪টি দল প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। এরমধ্যে সাত দলের প্রার্থীরা কমবেশি সবকটি নির্বাচনেই সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে। আবার কোনটি এক থেকে দুইবার। কোনটি একবার। বর্তমানে নিবন্ধিত ৪৫টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে নাম সর্বস্ব দলের সংখ্যা বাড়ছে। যাদের ভোটের রাজনীতিতে কত ভাগ অংশীদারিত্ব তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের শক্তি না বাড়িয়ে বারবার পড়ছে ভাঙ্গনের মুখে। নেতৃত্বের কোন্দল, রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে আদর্শিক দলগুলো ভেঙে চুরমার হয়েছে। যোগ্য নেতৃত্বের অভাবেও তৃতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠছে না। সেইসঙ্গে বড় দলগুলোর মধ্যেও এ নিয়ে রয়েছে সঙ্কীর্ণতা। গত ১৫ বছরে ২০টির বেশি রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব দেখা গেলেও কোনটিই মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারেনি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছেন, তৃতীয় শক্তিধর রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি এখন পাঁচটি ধারায় বিভক্ত, এক সময়ের ন্যাপও এখন পাঁচ ধারায় চলছে। ওয়ার্কার্স ও জাসদেও রয়েছে তিনটি ধারা। ভাঙনের মুখে গণফোরাম। বিকল্পধারা ও এলডিপি, তরিকত ফেডারেশনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে ভাঙন রয়েছে।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন রাজনৈতিক দলগুলো কেন শক্তিশালী হতে পারছে না। কেনই বা এসব দল ‘জোট নির্ভর’ রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তাছাড়া পুরনো ছোট দলগুলোও দিন দিন ছোট হয়ে আসছে। প্রবীণ রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে দেশের বিশিষ্টজনরা বলছেন, নতুন দলগুলো সাধারণ মানুষের জন্য ব্যতিক্রম চিন্তা বা জনমুখী কর্মসূচী নিয়ে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। বাস্তবতা বিবর্জিত রাজনৈতিক দর্শনের কারণেও অনেক দল মানুষের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেনি। ফলে জনসমর্থন না বেড়ে বরং কমেছে। এজন্য সাধারণ মানুষ পুরনো বড় দলগুলোর বৃত্তেই বন্দি রয়েছে। পাশাপাশি পুরনো ছোট দলগুলো আস্তে আস্তে সাংগঠনিক শক্তি হারিয়ে বড় দলগুলোতে বিলীন হচ্ছে। তৃতীয় প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় পার্টি দিন দিন শক্তি হারাচ্ছে। সেইসঙ্গে বড় দলগুলোর কঠোর নীতির কারণে তৃতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক দল বা জোট তৈরি হচ্ছে না। প্রবীণ একাধিক রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব বলেছেন, বড় রাজনৈতিক দলগুলো কখনই চায় না নতুন কোন রাজনৈতিক শক্তি দেশে বেড়ে উঠুক। অন্য দেশের মতো আমাদের দেশের বড় বড় দলগুলো ছোট দলগুলোকে এক হতে দিচ্ছে না। বড় রাজনৈতিক শক্তিগুলো সব সময় মনে করে নতুন কোন দল বা জোট শক্তিশালী হলে নিজেদের রাজনীতি শেষ হয়ে যাবে। এই জায়গা থেকে আমরা রাজনীতিতে নতুন কিছু পাচ্ছি না। ছোট ছোট দলগুলোতে মতপার্থক্য ও নেতৃত্বের লোভে টুকরো টুকরো উল্লেখ করে তিনি বলেন, এমন অনেক দল আছে সেগুলো কত ভাগে বিভক্ত কেউ জানে না।

এদিকে বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী বলেন, দেশপ্রেম ও প্রকৃত রাজনৈতিক দর্শন বা আদর্শ না থাকায় দেশের রাজনৈতিক বিকাশ হচ্ছে না। তিনি বলেন, দেশের সবকটি দলেই প্রকৃত অর্থে রাজনৈতিক দর্শনের অভাব রয়েছে। মূলধারার রাজনীতি যেখানে দুর্বল, অনেকটা ল্যহীন সেখানে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি সৃষ্টির কোন সম্ভাবনা নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো রাজনীতির দ্বিতীয় ধারা হিসেবে বিএনপিও গুছিয়ে উঠতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, ২০১৩ সালে হেফাজতের সাম্প্রদায়িক ইস্যুর পর বড় দলগুলোর সমর্থকরা অর্ধেক অর্ধেক সাম্প্রদায়িক চেতনার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে ফেলেছেন। বাস্তবে তাদের মধ্যে কোন চেতনা নেই। তবে মুখে মুখে অনেকেই অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলছেন। এখন দলগুলো প্রকৃত রাজনৈতিক চর্চার মধ্যে নেই। এটা দেশের রাজনীতিতে বড় সঙ্কট। তিনি বলেন, বাম ধারার দলগুলো যদি বাস্তববোধের রাজনীতি করত তাহলে সমাজের একটি সচেতন অংশ তাদের সঙ্গে থাকত। বাম নেতারা শিতি ও জানাশোনা হলেও মানুষ তাদের গ্রহণ করে না। ছোট দলগুলো আরও ছোট হয়ে বড় দলে বিলীন হচ্ছে। যোগ্য নেতৃত্ব ও সঠিক দর্শন নিয়ে নতুন ধারার রাজনীতি দেখছি না। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব দল সামনে এসেছে সবই কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ। তাছাড়া বড় সমস্যা হলো দেশের সব মানুষ রাজনীতি করে কিন্তু রাজনৈতিকভাবে কেউই সচেতন নয়।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

অর্ন্তকোন্দলে পুড়ছে বাম দলগুলো

আপডেট সময় : ১২:২৬:০৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • অস্তিত্ব সঙ্কটে দেশের ১৪ দল : ১০টি বিলুপ্ত
    * জাতীয় পার্টি ন্যাপ ৫ ওয়ার্কার্স জাসদ ৩ ধারা
    * গণফোরাম বিকল্পধারা এলডিপিতে ভাঙ্গনের সূর

অস্তিত্ব সঙ্কটে দেশের ছোট ছোট ভুঁই ফোড় রাজনৈতিক দলগুলো। ক্রমান্বয়ে এসব দলের ভোট কমছে। কমছে গ্রহণযোগ্যতা। নীতিতে অটল থাকতে না পারায় সাংগঠনিক শক্তি কমেছে। এরফলে সংসদেও এ সকল দলের একক প্রতিনিধিত্ব কমছে। টিকে থাকার প্রয়োজনে বড় দলগুলোর তুরুপের তাসে পরিণত হয়েছ্রে দলগুলো। বেশিরভাগ সময় দেখা গেছে ছোট দল বড়দলের নেতৃত্বাধীন জোটে নিজেদের যুক্ত করেছে। পাওয়া না পাওয়ার হিসাবে ােভ থাকলেও এসব দল প্রধান শরিকের প্রতি অনুগত। তাছাড়া কোন্দলের আগুনে পুড়ে খ- বিখ- বাম দলগুলোর রাজনীতি। গত প্রায় এক দশকে বিরোধী রাজনীতি কার্যত শিকেয় উঠেছে। শুধু তাই নয়, ১৫ বছরে ২০টি রাজনৈতিক দল এলেও সবকটি জনসমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে। ফ্যাসিষ্ট হাসিনা সরকারের পতন ও শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়া পর পট পরিবর্তন হয়। আর এই প্রোপটে দেশের রাজনীতিতে শক্তিশালী দল বা জোট আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছোট দলগুলোর গুরুত্ব বাড়ছে। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি নিজেদের জোটের পরিধি বাড়াতে ছোট দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে। হাসিনা সরকার পতনের আন্দোলনে অংশ নেওয়া দলগুলোর পাশাপাশি ডান, বাম ও মধ্যপন্থি বিভিন্ন সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনী কৌশল প্রণয়নে তৎপর বিএনপি। বিশেষ করে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে নজর দিয়েছে দলটি।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীও নির্বাচনী কৌশল প্রণয়নে ব্যস্ত। ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে তাদের নিয়ে বৃহত্তর নির্বাচনী ঐক্য গঠনের চেষ্টা করছে দলটি। গতকাল জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান বরিশালের চরমোনাইয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীমের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এটিই প্রথমবারের মতো জামায়াত নেতৃত্ব সরাসরি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠক করলেন।

বিএনপিও ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে তৎপর। সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর খেলাফত মজলিশের আমির মাওলানা আবদুল বাসিত আজাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এছাড়াও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতা মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীমের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন তিনি। বিএনপির প থেকে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য গঠন এবং আসন বণ্টনের বিষয়েও আলোচনা চলছে।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকার বিদায়ের আন্দোলনে যেসব দল রাজপথে ছিল, আমরা সবাইকে নিয়ে আগামী নির্বাচন এবং পরবর্তীতে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় সরকার গঠন করতে চাই।
জামায়াতে ইসলামী আনুষ্ঠানিকভাবে জোট গঠনের ঘোষণা না দিলেও ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছে। দলটির নেতারা বলছেন, ৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে কাজ করতে হবে। এ ল্েয ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, হেফাজতে ইসলাম, জাকের পার্টিসহ বিভিন্ন ইসলামি দল ও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মতবিনিময় চলছে। খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল জলিল বলেন, জুলাই বিপ্লবের ঐক্য ধরে রাখতে আমরা বিএনপিসহ সবার সঙ্গেই আলোচনা করছি। নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে কথা হচ্ছে।

বাম দলগুলোও নির্বাচনী ঐক্য গঠনে তৎপর। তারা মুক্তিযুদ্ধের পরে বৃহত্তর নির্বাচনী জোটের দিকে ঝুঁকতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মুস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে নানা তৎপরতা চলবে এটাই স্বাভাবিক। তবে আমরা যারা স্বৈরাচার হাসিনা সরকার পতনের আন্দোলনে ছিলাম, তারা সম্মিলিতভাবে রাষ্ট্র সংস্কারে ৩১ দফা প্রস্তাব দিয়েছি।
গত ১১ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল হিসাব করে দেখা গেছে, ১৯৭৩-২০১৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী ১০টির বেশি রাজনৈতিক দলের এখন আর কোন অস্তিত্ব নেই। ১৯৯১ সালের পর সিপিবি ও ন্যাপ মোজাফফর দলের পে থেকে সরাসরি ভোটে কেউ পাস করতে পারেনি। ২৭ বছরে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোমের প থেকে একাদশ সংসদে প্রথম ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে দুইজন নির্বাচিত হয়েছেন। এরমধ্যে ১৯৯৬ সাল থেকে প্রায় ২৫ বছর সংসদে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মাত্র ১৪টি দল প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। এরমধ্যে সাত দলের প্রার্থীরা কমবেশি সবকটি নির্বাচনেই সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে। আবার কোনটি এক থেকে দুইবার। কোনটি একবার। বর্তমানে নিবন্ধিত ৪৫টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে নাম সর্বস্ব দলের সংখ্যা বাড়ছে। যাদের ভোটের রাজনীতিতে কত ভাগ অংশীদারিত্ব তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের শক্তি না বাড়িয়ে বারবার পড়ছে ভাঙ্গনের মুখে। নেতৃত্বের কোন্দল, রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে আদর্শিক দলগুলো ভেঙে চুরমার হয়েছে। যোগ্য নেতৃত্বের অভাবেও তৃতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠছে না। সেইসঙ্গে বড় দলগুলোর মধ্যেও এ নিয়ে রয়েছে সঙ্কীর্ণতা। গত ১৫ বছরে ২০টির বেশি রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব দেখা গেলেও কোনটিই মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারেনি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছেন, তৃতীয় শক্তিধর রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি এখন পাঁচটি ধারায় বিভক্ত, এক সময়ের ন্যাপও এখন পাঁচ ধারায় চলছে। ওয়ার্কার্স ও জাসদেও রয়েছে তিনটি ধারা। ভাঙনের মুখে গণফোরাম। বিকল্পধারা ও এলডিপি, তরিকত ফেডারেশনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে ভাঙন রয়েছে।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন রাজনৈতিক দলগুলো কেন শক্তিশালী হতে পারছে না। কেনই বা এসব দল ‘জোট নির্ভর’ রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তাছাড়া পুরনো ছোট দলগুলোও দিন দিন ছোট হয়ে আসছে। প্রবীণ রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে দেশের বিশিষ্টজনরা বলছেন, নতুন দলগুলো সাধারণ মানুষের জন্য ব্যতিক্রম চিন্তা বা জনমুখী কর্মসূচী নিয়ে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। বাস্তবতা বিবর্জিত রাজনৈতিক দর্শনের কারণেও অনেক দল মানুষের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেনি। ফলে জনসমর্থন না বেড়ে বরং কমেছে। এজন্য সাধারণ মানুষ পুরনো বড় দলগুলোর বৃত্তেই বন্দি রয়েছে। পাশাপাশি পুরনো ছোট দলগুলো আস্তে আস্তে সাংগঠনিক শক্তি হারিয়ে বড় দলগুলোতে বিলীন হচ্ছে। তৃতীয় প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় পার্টি দিন দিন শক্তি হারাচ্ছে। সেইসঙ্গে বড় দলগুলোর কঠোর নীতির কারণে তৃতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক দল বা জোট তৈরি হচ্ছে না। প্রবীণ একাধিক রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব বলেছেন, বড় রাজনৈতিক দলগুলো কখনই চায় না নতুন কোন রাজনৈতিক শক্তি দেশে বেড়ে উঠুক। অন্য দেশের মতো আমাদের দেশের বড় বড় দলগুলো ছোট দলগুলোকে এক হতে দিচ্ছে না। বড় রাজনৈতিক শক্তিগুলো সব সময় মনে করে নতুন কোন দল বা জোট শক্তিশালী হলে নিজেদের রাজনীতি শেষ হয়ে যাবে। এই জায়গা থেকে আমরা রাজনীতিতে নতুন কিছু পাচ্ছি না। ছোট ছোট দলগুলোতে মতপার্থক্য ও নেতৃত্বের লোভে টুকরো টুকরো উল্লেখ করে তিনি বলেন, এমন অনেক দল আছে সেগুলো কত ভাগে বিভক্ত কেউ জানে না।

এদিকে বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী বলেন, দেশপ্রেম ও প্রকৃত রাজনৈতিক দর্শন বা আদর্শ না থাকায় দেশের রাজনৈতিক বিকাশ হচ্ছে না। তিনি বলেন, দেশের সবকটি দলেই প্রকৃত অর্থে রাজনৈতিক দর্শনের অভাব রয়েছে। মূলধারার রাজনীতি যেখানে দুর্বল, অনেকটা ল্যহীন সেখানে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি সৃষ্টির কোন সম্ভাবনা নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো রাজনীতির দ্বিতীয় ধারা হিসেবে বিএনপিও গুছিয়ে উঠতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, ২০১৩ সালে হেফাজতের সাম্প্রদায়িক ইস্যুর পর বড় দলগুলোর সমর্থকরা অর্ধেক অর্ধেক সাম্প্রদায়িক চেতনার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে ফেলেছেন। বাস্তবে তাদের মধ্যে কোন চেতনা নেই। তবে মুখে মুখে অনেকেই অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলছেন। এখন দলগুলো প্রকৃত রাজনৈতিক চর্চার মধ্যে নেই। এটা দেশের রাজনীতিতে বড় সঙ্কট। তিনি বলেন, বাম ধারার দলগুলো যদি বাস্তববোধের রাজনীতি করত তাহলে সমাজের একটি সচেতন অংশ তাদের সঙ্গে থাকত। বাম নেতারা শিতি ও জানাশোনা হলেও মানুষ তাদের গ্রহণ করে না। ছোট দলগুলো আরও ছোট হয়ে বড় দলে বিলীন হচ্ছে। যোগ্য নেতৃত্ব ও সঠিক দর্শন নিয়ে নতুন ধারার রাজনীতি দেখছি না। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব দল সামনে এসেছে সবই কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ। তাছাড়া বড় সমস্যা হলো দেশের সব মানুষ রাজনীতি করে কিন্তু রাজনৈতিকভাবে কেউই সচেতন নয়।