আন্দোলন কিসের ইঙ্গিত যৌক্তিকতাই বা কী
- আপডেট সময় : ৫৭ বার পড়া হয়েছে
আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের হওয়ার কথা। নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস বাকি। রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দলগুলো এবং জনগণ এখন অনেকটাই নির্বাচনমুখী। এরই মধ্যে রাজধানীর সচিবালয় ঘিরে আন্দোলন নতুন আলোচনার জন্ম দিচ্ছে। চাকরিপ্রার্থী, শ্রমজীবী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের এই সড়ক অবরোধ কর্মসূচি শুধু দাবি-দাওয়ার প্রশ্নই নয়, বরং আসন্ন নির্বাচনী রাজনীতিতেও কম-বেশী ছাপ ফেলছে। সাধারণ মানুষ ভাবছে নির্বাচনের আগে এই আন্দোলন আসলে কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে? এর যৌক্তিকতাই বা কী।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় ঘিরে আবারও আন্দোলনে উত্তাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। জুলাই শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহত ব্যক্তিরা, শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন দাবি, চাকরিপ্রার্থী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা মঙ্গলবার সকাল থেকে সচিবালয়ের চারপাশে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এতে এলাকাজুড়ে যানজটের সৃষ্টি হয়, দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ মানুষ।
জুলাই শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহত ব্যক্তিরা দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তাঁরা সচিবালয়ের ২ নম্বর ফটকের সামনের সড়ক অবরোধ করেন। তাঁরা অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের পদত্যাগ দাবি করেন। সড়ক ছেড়ে দেওয়ার সময় আন্দোলনকারীরা বলেন, জুলাই হত্যাকান্ডের আসামিরা কেন জামিন পাচ্ছেন, তা নিয়ে আইন উপদেষ্টাকে আগামী রোববারের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কাছে ব্যাখ্যা দিতে হবে। সেই ব্যাখ্যা প্রধান উপদেষ্টাকে জাতির সামনে প্রকাশ করতে হবে। আজকের কর্মসূচিতে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশি হামলা হয়েছে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে দৃশ্যমান বিচারের দাবি জানান তাঁরা।
পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করে শহীদ তায়িমের ভাই রবিউল আউয়াল বলেন, আইন উপদেষ্টা তাঁদের আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা সেটা প্রত্যাখ্যান করেছেন। আগামী রোববার পর্যন্ত তাঁরা সময় দিয়েছেন। এর মধ্যে আসামিদের জামিনের বিষয়ে আইন উপদেষ্টার ব্যাখ্যা ও পুলিশি হামলার ঘটনায় দৃশ্যমান বিচার না হলে তাঁরা আবার আন্দোলন শুরু করবেন। রবিউল আউয়াল হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, আগামী রোববারের মধ্যে দাবি আদায় না হলে আইন উপদেষ্টার পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টারও পদত্যাগ দাবি করবেন তাঁরা। সেই কর্মসূচিতে সারা দেশ থেকে জুলাই শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিরা অংশ নেবেন। সেই আন্দোলন সচিবালয়ের ২ নম্বর গেটের সামনে হবে। বেলা সোয়া ১১টার দিকে জুলাই শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহত ব্যক্তিরা প্রথমে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ করেন। পরে তাঁরা মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের ২ নম্বর ফটকের সামনে অবস্থান নেন। এতে সচিবালয়ের সামনের সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
২০১৩ সালে ঘোষণার পর ১২ বছর কেটে গেলেও এখনো জাতীয়করণের বাইরে রয়ে গেছে দেশের প্রায় ৫ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এমন পরিস্থিতিতে ‘এক দফা এক দাবি জাতীয়করণ চাই’ স্লোগান দিয়ে মানববন্ধন করেছেন শিক্ষকেরা। মঙ্গলবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশ বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে এই কর্মসূচি পালন করা হয়। কর্মসূচিতে বক্তারা অভিযোগ করেন, ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি তৎকালীন সরকার সব বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়েছিল। পরে বিভিন্ন ধাপে অনেক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হলেও ২০১৯ সালের ২৫ মে’র আগে প্রতিষ্ঠিত প্রায় ৫ হাজার বিদ্যালয় এখনো এর বাইরে রয়ে গেছে।
মানববন্ধনে বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির মহাসচিব মো. ফিরোজ উদ্দিন বলেন, জাতীয়করণের জন্য কনসালটেশন কমিটি সুপারিশ করলেও বাস্তবায়ন হয়নি। এতে হাজারো শিক্ষক-কর্মচারী বঞ্চিত হচ্ছেন। যুগ্ম সচিব সুমন কুমার চাকি বলেন, ‘২০১৮ সাল থেকে আমরা আন্দোলন করছি। গত ২৬ জুলাই আবারও সুপারিশ করা হলেও এখনো কোনো ফল নেই। সরকার দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে আমরা বৃহত্তর কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হব।
রাজনৈতিক তকমা দিয়ে ৫ হাজার বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে মানববন্ধনে এই অভিযোগ তোলেন নীলফামারীর শিক্ষক নেতা মখলেছুর রহমান। কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. মামুনুর রশিদ শিকদার। তিনি বলেন, ‘আমরা বৈষম্য চাই না। সরকারি কিংবা বেসরকারি সব প্রাথমিক বিদ্যালয়কেই জাতীয়করণের আওতায় আনতে হবে। এক দেশে দুই নীতি চলবে না।
বিশ্লেষকদের মতে, সচিবালয় ঘিরে আন্দোলনের এ ধারা শুধু দাবিদাওয়া নয়, রাজনৈতিক বার্তাও বহন করছে। সাম্প্রতিক সময়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ার প্রেক্ষাপটে এসব আন্দোলন নতুন মাত্রা পেয়েছে। বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে সমর্থন না জানালেও অনেকে মনে করছেন, আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ বাড়ানোর কৌশলও এতে নিহিত রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আনিসুর রহমান বলেন, সচিবালয় ঘিরে আন্দোলন মানে এটি আর সাধারণ প্রতিবাদ নয়, বরং সরকারের কাছে একটি সরাসরি বার্তা। সচিবালয় দেশের নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে অবরোধের মাধ্যমে দাবি উত্থাপন করলে সরকার চাপের মুখে পড়তে বাধ্য হয়। মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট মাহবুবুল হক যোগ করেন, মানুষ যখন দীর্ঘদিন ধরে ন্যায্য অধিকার পায় না, তখন তারা রাজপথে নামতে বাধ্য হয়। সরকারের দায়িত্ব হলো শান্তিপূর্ণ উপায়ে এই সংকট সমাধান করা।
সরকারি একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আন্দোলনকারীদের দাবিগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা চলছে, তবে সব দাবি তাৎক্ষণিকভাবে পূরণ সম্ভব নয়। অবরোধে ভোগান্তিতে পড়া সাধারণ মানুষ বলছেন, আন্দোলনের কারণ তারা সমর্থন করলেও পদ্ধতি নিয়ে তাদের আপত্তি রয়েছে। এক যাত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দাবি মানতে হবে এটা ঠিক। কিন্তু প্রতিবার সচিবালয় ঘিরে আন্দোলন করলে হাজারো মানুষকে কষ্ট পোহাতে হয়।