ঢাকা ০১:৫৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪
সংবাদ শিরোনাম ::

আপোষহীন খালেদা

বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট সময় : ০১:০৫:৩০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২২ অগাস্ট ২০২৪ ১৯৯ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

 

স্বামী জিয়াউর রহমান তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। স্বামীর চাকরির সুবাদে পাকিস্তানে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে বসবাস করতেন। ছিলেন পুরোদস্তুর একজন গৃহবধূ। রাজনীতির ‘র’ও তিনি বুঝতেন না। রাজনীতি না বোঝা সেই গৃহবধূ জীবনের এক পর্যায়ে এসে পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ হয়ে উঠলেন। ১৯৮১ সালে স্বামী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শাহাদতবরণ না করলে হয়তো তিনি এখনও গৃহবধূই থেকে যেতেন। স্বামীর মৃত্যু বেদনাবিধূর হলেও দল এবং জাতির ভবিষ্যৎ কান্ডারী হিসেবে আবির্ভূত হলেন স্বমহিমায়। স্বমহিমায় আবির্ভূত হওয়া সেই গৃহবধূ হলেন আপোষহীন নেত্রীখ্যাত বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তবাদী দল বিএনপির চেয়ারপার্সন এবং বাংলাদেশের তিনতিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী।

প্রায় ৪ দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো দেদীপ্যমান। জেল, জুলুম, নির্যাতন, অত্যাচার তাকে ভোগ করতে হয়েছে। পুরোটা সময়জুড়ে ক্ষমতায় না থাকলেও তাঁর বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, জনগণের প্রতি কমিটমেন্ট সবকিছু মিলে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও আপোষহীন নেত্রীরখ্যাতির আসনে তিনি আজ অধিষ্ঠিত। এমনিতে বার্ধক্যজনিত নানা অসুখ, তারপর সাড়ে ছয় বছর কারাভোগ করায় তিনি এখন গুরুতর অসুস্থ। শেখ হাসিনা সরকার তার বিরুদ্ধে নানা সময় সায়ত্রিশটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে। সব মামলাগুলো প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে দায়ের করে তাকে সাজা দেয়া হয়। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ৬ আগস্ট নির্বাহী আদেশে দন্ডাদেশ মওকুফ করে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। মিথ্যা মামলায় সাড়ে ছয় বছর জেল খেটেছেন কিন্তু সরকারের সঙ্গে কখনো আপোষ করেননি। অতীতে স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের আমলেও বেশ কয়েকবার জেল খেটেছেন কিন্তু আপোষ করে জেল থেকে বের হননি। জনতার আন্দোলনের চাপে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। আর এবারের প্রেক্ষপট তো একবারে ভিন্ন। শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যাওয়ায় সরকারের নির্বাহী আদেশে বেগম জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

রাজনীতিতে প্রবেশ : বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতিতে প্রবেশ করেন ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি। তিনি দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ লাভ করেন। সে সময় দলের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। তিনি অসুস্থ থাকায় তখন বেগম জিয়াকে ১৯৮৩ সালে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। ১৯৮৪ সালের ১০ মে দলীয় কাউন্সিলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারপার্সন হিসেবে নির্বাচিত হন। এখনও বেগম জিয়া চেয়ারপার্সন হিসেবে রয়েছেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্রগ্রামের সার্কিট হাউজে একদল বিপদগামী সেনাদের হাতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হন। এরপর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিচারপতি সাত্তার বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট হন, একই সঙ্গে দলের দায়িত্ব নেন। কিন্তু তিনি বেশি দিন সরকার চালাতে পারেননি। তৎকালীন সেনা প্রধান জেরারেল এরশাদ ১৯৮২-এর ২৪ মার্চ বন্দুকের নল দেখিয়ে সাত্তারের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেন। সাত্তারের মন্ত্রীসভার অনেককে ভাগিয়ে নেন নিজের মন্ত্রীসভায়। এরফলে বিএনপি অনেকটা নিস্ক্রীয় হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় বেগম খালেদা জিয়া দলের হাল ধরেন।

বেগম জিয়া জীবনযাপনে অনেকখানি সৌখিন হলেও রাজনীতির ময়দানে তিনি কর্মঠ এবং অত্যন্ত পরিশ্রমী। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে স্বৈরাচারি এরশাদের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলেন। বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী ছাত্র দলকে রাজনীতির মাঠ তৈরি করতে শক্তি জোগান দেন। ছাত্র দল বিভিন্ন দাবিতে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্বি বিদ্যালয়ের বটতলায় পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সে সংঘর্ষে জয়নাল, কাঞ্চন, দিপালী সাহাসহ ৭ জন শহীদ হন। এর প্রতিবাদে ১৫ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা মিছিল বের করলে পুলিশের গুলিতে ১৫ জন শহীদ হন। এর ফলে আন্দোলন জমতে শুরু করে। আন্দোলন দমানোর জন্য জেনারেলে এরশাদ ক্ষিপ্ত হয়ে তখন বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাকে গ্রেফতার করেন। পুরো আন্দোলনে বেগম জিয়ার নেতৃত্ব ছিল চোখে পড়ার মত। তিনি নেমে আসেন রাজপথে। একই সঙ্গে তিনি সারাদেশ সফর শুরু করেন। সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ৭ দলীয় জোট গঠন করেন। একইভাবে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দলীয় জোট গঠিত হয়। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৫ দলের পরিবর্তে ৮ দলীয় জোট গঠিত হয়। উভয়জোট ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে অভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। জেনারেল এরশাদ দুই নেত্রীকে এক মাসের আটকাদেশ দিয়ে তাদের যার যার বাসায় অন্তরীণ রাখেন। এরপর ’৮৪ সালে বেগম জিয়া গ্রেফতার করা হল। এতে করে রাজপথের আন্দোলন আরো জমে ওঠে। হরতার অবরোধসহ নানা কর্মসূটি পালন করে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।

এ অবস্থার মধ্যে ১৯৮৬ সালের জেনারেল এরশাদ নির্বাচন ঘোষণা দেন। বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেন। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা আন্দোলনের সঙ্গে বেইমানি করে নির্বাচনে অংশ নেন। কিন্তু বেগম জিয়া নির্বাচনে অংশ নিলেন না। তার এ অনঢ অবস্থানের জন্য তিনি আপোষহীন নেত্রী হয়ে উঠলেন। তার দল বিএনপি এরশাদের অধীনে কোনো নির্বাচনেই অংশ নেয়নি। তার এ অনঢ অবস্থানের কারণে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতার মসনদ নড়বড়ে হয়ে যায়। তার দৃঢতার কারণে আওয়ামী লীগ, জামায়াতসহ সকল রাজনৈতিক দল এরশাদের পদত্যাগ প্রশ্নে এককাতারে শামিল হয়। অন্যদিকে এরশাদের স্বৈরাচারী নীতি দেশবাসীর সামনে আরো পরিস্কার হয়ে উঠতে থাকে। চলতে থাকে এরশাদের দমনপীড়ন। ৮৭ সালের ১১ নভেম্বর রাজধানীর পূর্বানী হোটেল থেকে বেগম জিয়াকে আবারো গ্রেফতার করে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ক্ষমতায় থাকার জন্য জেনারেল এরশাদ ফের ১৯৮৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের ঘোষণা দেন। সে নির্বাচনে জাসদের আ স ম আবদুর বর ছাড়া অন্য কোনো দল অংশ নেয়নি। একতরফা নির্বাচনে এরশাদের দল জাতীয় পার্টি বিপুল ভোটে জয়ী হয়। আ স ম রব হন গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা। অবৈধ এই সংসদ বেশি দিন টেকেনি।

বেগম জিয়ার নেতৃত্বে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকলে এরশাদ ক্ষমতায় থাকতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। ১৯৯০ সালে নভেম্বর মাসে শুরু হয় এরশাদ পতনের দুর্বার আন্দোলন। তখন বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোট, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৮ দল, বামদের নিয়ে গঠিত ৫ দল ১৯ নভেম্বর আলাদা আলাদাভাবে তিন জোটের অভিন্ন রুপরেখা ঘোষণা করে। জামায়াতে ইসলামও দলীয়ভাবে অভিন্ন রুপরেখা ঘোষণা করে। রুপরেখা ঘোষণার পর এরশাদের মসনদ কেপে ওঠে। এক পর্যায়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে গণ আন্দোলনের মুখে ৬ ডিসেম্বর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। পতন ঘটলো দীর্ঘ স্বৈরশাসন ব্যবস্থার। এরপর ৩ দলীয় জোটের রুপরেখার ভিত্তিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবউদ্দীন আহমেদ হন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। এরশাদের ঠিকানা হয় নাজিমুদ্দীন রোডের কারাগারে।

গণতন্ত্রে উত্তরণ : স্বৈরশাসনের পতনের পর ১৯৯১ সালের ১৯ মার্চ দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এটি ছিল পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বেগম জিয়া জীবনে প্রথম নির্বাচনে অংশ নিয়ে চমক দেখালেন। ৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব আসনেই তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হন। নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হলে বেগম জিয়া সরকার গঠন করেন। তিনি হন সরকারের প্রধানমন্ত্রী। তিনি ৫ বছর সফলভাবে সরকার পরিচালনা করেন। এরপর ফের ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দেশে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনেও বিএনপি জয়ী হলে বেগম জিয়া দ্বিতীয়বারের মত প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু বিএনপির প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে আন্দোলন করে। সহনশীল বেগম জিয়া বিরোধী দলগুলোর দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করেন। এরপর তিনি পদত্যাগ করেন।

তার পদত্যাগের পর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বেগম খালেদা জিয়া আবারও ৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবগুলো আসনে জয়ী হন। কিন্তু নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলে বিএনপি জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসে। বেগম জিয়া হন বিরোধী দলীয় নেত্রী। এরপর ২০০১ সালের ১ অক্টোবর ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। এ নির্বাচনেও বেগম জিয়া ৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবগুলোতে জয়ী হন।

এরপর সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ সমমনা দলগুলো কতিপয় দাবিতে দেশে আন্দোলন শুরু করে। তাদের অরাজক পরিস্থিতির কারণে দেশ অনেকটা অচল হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনা শাসিত সরকার আসতে বাধ্য হয়। ওই সরকারের নামকরণ হয় ‘ওয়ান ইলেভেন সরকার’। এই সরকার মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বেগম জিয়াকে গ্রেফতার করে। এক বছরের বেশি সময় কারাভোগের পর ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মুক্তি পান। এরপর দেশে ২০০৮ সালে ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে এবার বেগম জিয়া ৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবকটিতেই জয়ী হন। তবে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে বেগম জিয়া জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা হন।

কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে বিনা কারণে হয়রানি করতে শুরু করে। দেওয়া হয় একের পর এক মিথ্যা মামলা। একই সঙ্গে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দেয়। আজীবন ক্ষমতায় থাকার মানসে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। হয়েছেও তাই। দশম, একাদশ এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের অংশ গ্রহণ ছাড়া বামদের নিয়ে গঠিত ১৪ দল নিয়ে নির্বাচন করেছে। এর সঙ্গে ছিল পতিত স্বৈরাচার এরশাদের জাতীয় পার্টি।

অবৈধভাবে ক্ষমতায় থেকে গত ১৬ বছর ধরে বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মীর নামে মিথ্যা মামলা নিয়েছেন শেখ হাসিনা। স্বস্তিতে থাকতে দেননি। পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে। এই লাঠিয়াল বাহিনী অসংখ্য মামলা দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের এতটি বছর ধরে হয়রানি নির্যাতন করেছে। বেগম জিয়াকে শায়েস্তা করতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মিথ্যা দুর্নীতির মামলায় সাজা দেওয়া হয়। ৭৯ বছর বয়সী খালেদা জিয়া আর্থ্রাইটিস, হƒদরোগ, ফুসফুস, লিভার, কিডনি, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন। উন্নত চিকিৎসা করাতে বিদেশে দেওয়ার জন্য অনেকবার পরিবার এবং দলের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে আবেদন করা হয়। কিন্তু সরকার আইনী জটিলতা দেখিয়ে আবেদন গ্রহণ করেনি। এ ছাড়া দলটি শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সকল নেতা একাধিকবার জেলে গেছেন বিনা কারণে। সকলে অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা সফল আন্দোলনের মাধ্যমে।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা : জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট এই দুই মামলা বেগম জিয়ার সাজা হয়েছিল। এ দুটি মামলা ছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধে মোট মামলা ৩৫টি। ২০০৮ সালে ৩ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা দায়ের করে। এ মামলায় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি বেগম জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করলে আবেদনের প্রেক্ষিতে তাঁর সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট।

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের মামলাটি ২০১১ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন। এ মামলায় ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর রায় ঘোষণা করা হয়। এ রায়ে ৭ বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর তেজগাঁও থানায় নাইকো দুর্নীতি মামলা দায়ের করে দুদক। ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা দায়ের করে। তার ছোট ছেলে আরাফাত রহ মান কোকোসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় এ মামলা হয়। ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থানায় বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলা দায়ের করা হয়। গাবতলী বালুর মাঠ ও মিরপুর মাজার রোড সংলগ্ন এলাকায় ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত নাশকতার অভিযোগে দারুস সালাম থানায় ১১টি মামলা হয়। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে পেট্রোল বোমা দিয়ে চারজনকে হত্যার ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় মোট চারটি মামলা দায়ের করা হয়।

২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চৌদ্দগ্রামের হায়দারপুল এলাকায় কাভার্ড ভ্যানে অগ্নিসংযোগ ঘটনায় চৌদ্দগ্রাম থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি, বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে একটি এবং একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। ২০১৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে যাত্রীবাহী নৈশকোচে পেট্রোল বোমায় ৮ যাত্রী পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির অভিযোগ এনে ২০১৬ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়।

২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড়ের বোমা হামলা ও নাশকতা মামলা দায়ের করা হয়। ২০১৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মিছিলে হামলার ঘটনায় গুলশান থানায় মামলা দায়ের করা হয়। ২০ দলীয় জোটের আন্দোলনে ৪২ জনকে হত্যার অভিযোগে ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মামলা দায়ের করা হয়। ২০১৫ সালের ২১ ডিসেম্বর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন জজ কোর্টে মামলা দায়ের করা হয়।

শ্রমিক দিবসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভায় বক্তব্য দেয়ার সময় শেখ হাসিনার ছেলে জয়কে নিয়ে বক্তব্য দেয়ার অভিযোগে মানহানি মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়া জয়ের অ্যাকাউন্টে ৩০ কোটি ডলার রয়েছে বলে বক্তব্য দেয়ার অভিযোগে ২০১৬ সালের ৩ মে মানহানির মামলা দায়ের করা হয়। ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এবং ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে নড়াইলে মানহানির মামলা হয়।

২০১৪ সালের ১০ অক্টোবর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও জাতিগত বিভেদ সৃষ্টির অভিযোগে দুই মামলা করা হয়। ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালনকে ‘ভুয়া’ অভিযোগ করে ২০১৬ সালের ৩০ আগস্ট ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। বাংলাদেশের মানচিত্র, জাতীয় পতাকা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগ এনে ২০১৬ সালের নভেম্বর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আরেকটি মামলা দায়ের করা হয় এবং ২০১৩ সালের ২ অক্টোবর ঋণ খেলাপির অভিযোগ তুলে ঢাকার অর্থঋণ আদালতে মামলা করা হয়। এ সকল ভুয়া মামলা দিয়ে বেগম জিয়াকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়। কিন্তু তিনি কখনো ভেঙ্গে পড়েননি। দলের নেতাকর্মীরা অনৈক সময় ভেঙ্গে পড়লেও তিনি ধৈর্যের সঙ্গে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সকলকে সাহস যুগিয়েছেন। এ কারণেই তিনি বাংলাদেশে আপোষহীন নেত্রী হিসেবে স্বীকৃত হয়ে থাকবেন আজীবন।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

আপোষহীন খালেদা

আপডেট সময় : ০১:০৫:৩০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২২ অগাস্ট ২০২৪

 

স্বামী জিয়াউর রহমান তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। স্বামীর চাকরির সুবাদে পাকিস্তানে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে বসবাস করতেন। ছিলেন পুরোদস্তুর একজন গৃহবধূ। রাজনীতির ‘র’ও তিনি বুঝতেন না। রাজনীতি না বোঝা সেই গৃহবধূ জীবনের এক পর্যায়ে এসে পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ হয়ে উঠলেন। ১৯৮১ সালে স্বামী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শাহাদতবরণ না করলে হয়তো তিনি এখনও গৃহবধূই থেকে যেতেন। স্বামীর মৃত্যু বেদনাবিধূর হলেও দল এবং জাতির ভবিষ্যৎ কান্ডারী হিসেবে আবির্ভূত হলেন স্বমহিমায়। স্বমহিমায় আবির্ভূত হওয়া সেই গৃহবধূ হলেন আপোষহীন নেত্রীখ্যাত বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তবাদী দল বিএনপির চেয়ারপার্সন এবং বাংলাদেশের তিনতিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী।

প্রায় ৪ দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো দেদীপ্যমান। জেল, জুলুম, নির্যাতন, অত্যাচার তাকে ভোগ করতে হয়েছে। পুরোটা সময়জুড়ে ক্ষমতায় না থাকলেও তাঁর বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, জনগণের প্রতি কমিটমেন্ট সবকিছু মিলে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও আপোষহীন নেত্রীরখ্যাতির আসনে তিনি আজ অধিষ্ঠিত। এমনিতে বার্ধক্যজনিত নানা অসুখ, তারপর সাড়ে ছয় বছর কারাভোগ করায় তিনি এখন গুরুতর অসুস্থ। শেখ হাসিনা সরকার তার বিরুদ্ধে নানা সময় সায়ত্রিশটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে। সব মামলাগুলো প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে দায়ের করে তাকে সাজা দেয়া হয়। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ৬ আগস্ট নির্বাহী আদেশে দন্ডাদেশ মওকুফ করে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। মিথ্যা মামলায় সাড়ে ছয় বছর জেল খেটেছেন কিন্তু সরকারের সঙ্গে কখনো আপোষ করেননি। অতীতে স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের আমলেও বেশ কয়েকবার জেল খেটেছেন কিন্তু আপোষ করে জেল থেকে বের হননি। জনতার আন্দোলনের চাপে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। আর এবারের প্রেক্ষপট তো একবারে ভিন্ন। শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যাওয়ায় সরকারের নির্বাহী আদেশে বেগম জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

রাজনীতিতে প্রবেশ : বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতিতে প্রবেশ করেন ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি। তিনি দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ লাভ করেন। সে সময় দলের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। তিনি অসুস্থ থাকায় তখন বেগম জিয়াকে ১৯৮৩ সালে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। ১৯৮৪ সালের ১০ মে দলীয় কাউন্সিলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারপার্সন হিসেবে নির্বাচিত হন। এখনও বেগম জিয়া চেয়ারপার্সন হিসেবে রয়েছেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্রগ্রামের সার্কিট হাউজে একদল বিপদগামী সেনাদের হাতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হন। এরপর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিচারপতি সাত্তার বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট হন, একই সঙ্গে দলের দায়িত্ব নেন। কিন্তু তিনি বেশি দিন সরকার চালাতে পারেননি। তৎকালীন সেনা প্রধান জেরারেল এরশাদ ১৯৮২-এর ২৪ মার্চ বন্দুকের নল দেখিয়ে সাত্তারের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেন। সাত্তারের মন্ত্রীসভার অনেককে ভাগিয়ে নেন নিজের মন্ত্রীসভায়। এরফলে বিএনপি অনেকটা নিস্ক্রীয় হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় বেগম খালেদা জিয়া দলের হাল ধরেন।

বেগম জিয়া জীবনযাপনে অনেকখানি সৌখিন হলেও রাজনীতির ময়দানে তিনি কর্মঠ এবং অত্যন্ত পরিশ্রমী। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে স্বৈরাচারি এরশাদের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলেন। বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী ছাত্র দলকে রাজনীতির মাঠ তৈরি করতে শক্তি জোগান দেন। ছাত্র দল বিভিন্ন দাবিতে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্বি বিদ্যালয়ের বটতলায় পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সে সংঘর্ষে জয়নাল, কাঞ্চন, দিপালী সাহাসহ ৭ জন শহীদ হন। এর প্রতিবাদে ১৫ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা মিছিল বের করলে পুলিশের গুলিতে ১৫ জন শহীদ হন। এর ফলে আন্দোলন জমতে শুরু করে। আন্দোলন দমানোর জন্য জেনারেলে এরশাদ ক্ষিপ্ত হয়ে তখন বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাকে গ্রেফতার করেন। পুরো আন্দোলনে বেগম জিয়ার নেতৃত্ব ছিল চোখে পড়ার মত। তিনি নেমে আসেন রাজপথে। একই সঙ্গে তিনি সারাদেশ সফর শুরু করেন। সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ৭ দলীয় জোট গঠন করেন। একইভাবে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দলীয় জোট গঠিত হয়। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৫ দলের পরিবর্তে ৮ দলীয় জোট গঠিত হয়। উভয়জোট ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে অভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। জেনারেল এরশাদ দুই নেত্রীকে এক মাসের আটকাদেশ দিয়ে তাদের যার যার বাসায় অন্তরীণ রাখেন। এরপর ’৮৪ সালে বেগম জিয়া গ্রেফতার করা হল। এতে করে রাজপথের আন্দোলন আরো জমে ওঠে। হরতার অবরোধসহ নানা কর্মসূটি পালন করে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।

এ অবস্থার মধ্যে ১৯৮৬ সালের জেনারেল এরশাদ নির্বাচন ঘোষণা দেন। বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেন। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা আন্দোলনের সঙ্গে বেইমানি করে নির্বাচনে অংশ নেন। কিন্তু বেগম জিয়া নির্বাচনে অংশ নিলেন না। তার এ অনঢ অবস্থানের জন্য তিনি আপোষহীন নেত্রী হয়ে উঠলেন। তার দল বিএনপি এরশাদের অধীনে কোনো নির্বাচনেই অংশ নেয়নি। তার এ অনঢ অবস্থানের কারণে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতার মসনদ নড়বড়ে হয়ে যায়। তার দৃঢতার কারণে আওয়ামী লীগ, জামায়াতসহ সকল রাজনৈতিক দল এরশাদের পদত্যাগ প্রশ্নে এককাতারে শামিল হয়। অন্যদিকে এরশাদের স্বৈরাচারী নীতি দেশবাসীর সামনে আরো পরিস্কার হয়ে উঠতে থাকে। চলতে থাকে এরশাদের দমনপীড়ন। ৮৭ সালের ১১ নভেম্বর রাজধানীর পূর্বানী হোটেল থেকে বেগম জিয়াকে আবারো গ্রেফতার করে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ক্ষমতায় থাকার জন্য জেনারেল এরশাদ ফের ১৯৮৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের ঘোষণা দেন। সে নির্বাচনে জাসদের আ স ম আবদুর বর ছাড়া অন্য কোনো দল অংশ নেয়নি। একতরফা নির্বাচনে এরশাদের দল জাতীয় পার্টি বিপুল ভোটে জয়ী হয়। আ স ম রব হন গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা। অবৈধ এই সংসদ বেশি দিন টেকেনি।

বেগম জিয়ার নেতৃত্বে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকলে এরশাদ ক্ষমতায় থাকতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। ১৯৯০ সালে নভেম্বর মাসে শুরু হয় এরশাদ পতনের দুর্বার আন্দোলন। তখন বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোট, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৮ দল, বামদের নিয়ে গঠিত ৫ দল ১৯ নভেম্বর আলাদা আলাদাভাবে তিন জোটের অভিন্ন রুপরেখা ঘোষণা করে। জামায়াতে ইসলামও দলীয়ভাবে অভিন্ন রুপরেখা ঘোষণা করে। রুপরেখা ঘোষণার পর এরশাদের মসনদ কেপে ওঠে। এক পর্যায়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে গণ আন্দোলনের মুখে ৬ ডিসেম্বর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। পতন ঘটলো দীর্ঘ স্বৈরশাসন ব্যবস্থার। এরপর ৩ দলীয় জোটের রুপরেখার ভিত্তিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবউদ্দীন আহমেদ হন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। এরশাদের ঠিকানা হয় নাজিমুদ্দীন রোডের কারাগারে।

গণতন্ত্রে উত্তরণ : স্বৈরশাসনের পতনের পর ১৯৯১ সালের ১৯ মার্চ দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এটি ছিল পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বেগম জিয়া জীবনে প্রথম নির্বাচনে অংশ নিয়ে চমক দেখালেন। ৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব আসনেই তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হন। নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হলে বেগম জিয়া সরকার গঠন করেন। তিনি হন সরকারের প্রধানমন্ত্রী। তিনি ৫ বছর সফলভাবে সরকার পরিচালনা করেন। এরপর ফের ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দেশে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনেও বিএনপি জয়ী হলে বেগম জিয়া দ্বিতীয়বারের মত প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু বিএনপির প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে আন্দোলন করে। সহনশীল বেগম জিয়া বিরোধী দলগুলোর দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করেন। এরপর তিনি পদত্যাগ করেন।

তার পদত্যাগের পর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বেগম খালেদা জিয়া আবারও ৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবগুলো আসনে জয়ী হন। কিন্তু নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলে বিএনপি জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসে। বেগম জিয়া হন বিরোধী দলীয় নেত্রী। এরপর ২০০১ সালের ১ অক্টোবর ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। এ নির্বাচনেও বেগম জিয়া ৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবগুলোতে জয়ী হন।

এরপর সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ সমমনা দলগুলো কতিপয় দাবিতে দেশে আন্দোলন শুরু করে। তাদের অরাজক পরিস্থিতির কারণে দেশ অনেকটা অচল হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনা শাসিত সরকার আসতে বাধ্য হয়। ওই সরকারের নামকরণ হয় ‘ওয়ান ইলেভেন সরকার’। এই সরকার মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বেগম জিয়াকে গ্রেফতার করে। এক বছরের বেশি সময় কারাভোগের পর ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মুক্তি পান। এরপর দেশে ২০০৮ সালে ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে এবার বেগম জিয়া ৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবকটিতেই জয়ী হন। তবে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে বেগম জিয়া জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা হন।

কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে বিনা কারণে হয়রানি করতে শুরু করে। দেওয়া হয় একের পর এক মিথ্যা মামলা। একই সঙ্গে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দেয়। আজীবন ক্ষমতায় থাকার মানসে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। হয়েছেও তাই। দশম, একাদশ এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের অংশ গ্রহণ ছাড়া বামদের নিয়ে গঠিত ১৪ দল নিয়ে নির্বাচন করেছে। এর সঙ্গে ছিল পতিত স্বৈরাচার এরশাদের জাতীয় পার্টি।

অবৈধভাবে ক্ষমতায় থেকে গত ১৬ বছর ধরে বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মীর নামে মিথ্যা মামলা নিয়েছেন শেখ হাসিনা। স্বস্তিতে থাকতে দেননি। পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে। এই লাঠিয়াল বাহিনী অসংখ্য মামলা দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের এতটি বছর ধরে হয়রানি নির্যাতন করেছে। বেগম জিয়াকে শায়েস্তা করতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মিথ্যা দুর্নীতির মামলায় সাজা দেওয়া হয়। ৭৯ বছর বয়সী খালেদা জিয়া আর্থ্রাইটিস, হƒদরোগ, ফুসফুস, লিভার, কিডনি, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন। উন্নত চিকিৎসা করাতে বিদেশে দেওয়ার জন্য অনেকবার পরিবার এবং দলের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে আবেদন করা হয়। কিন্তু সরকার আইনী জটিলতা দেখিয়ে আবেদন গ্রহণ করেনি। এ ছাড়া দলটি শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সকল নেতা একাধিকবার জেলে গেছেন বিনা কারণে। সকলে অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা সফল আন্দোলনের মাধ্যমে।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা : জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট এই দুই মামলা বেগম জিয়ার সাজা হয়েছিল। এ দুটি মামলা ছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধে মোট মামলা ৩৫টি। ২০০৮ সালে ৩ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা দায়ের করে। এ মামলায় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি বেগম জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করলে আবেদনের প্রেক্ষিতে তাঁর সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট।

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের মামলাটি ২০১১ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন। এ মামলায় ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর রায় ঘোষণা করা হয়। এ রায়ে ৭ বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর তেজগাঁও থানায় নাইকো দুর্নীতি মামলা দায়ের করে দুদক। ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা দায়ের করে। তার ছোট ছেলে আরাফাত রহ মান কোকোসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় এ মামলা হয়। ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থানায় বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলা দায়ের করা হয়। গাবতলী বালুর মাঠ ও মিরপুর মাজার রোড সংলগ্ন এলাকায় ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত নাশকতার অভিযোগে দারুস সালাম থানায় ১১টি মামলা হয়। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে পেট্রোল বোমা দিয়ে চারজনকে হত্যার ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় মোট চারটি মামলা দায়ের করা হয়।

২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চৌদ্দগ্রামের হায়দারপুল এলাকায় কাভার্ড ভ্যানে অগ্নিসংযোগ ঘটনায় চৌদ্দগ্রাম থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি, বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে একটি এবং একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। ২০১৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে যাত্রীবাহী নৈশকোচে পেট্রোল বোমায় ৮ যাত্রী পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির অভিযোগ এনে ২০১৬ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়।

২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড়ের বোমা হামলা ও নাশকতা মামলা দায়ের করা হয়। ২০১৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মিছিলে হামলার ঘটনায় গুলশান থানায় মামলা দায়ের করা হয়। ২০ দলীয় জোটের আন্দোলনে ৪২ জনকে হত্যার অভিযোগে ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মামলা দায়ের করা হয়। ২০১৫ সালের ২১ ডিসেম্বর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন জজ কোর্টে মামলা দায়ের করা হয়।

শ্রমিক দিবসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভায় বক্তব্য দেয়ার সময় শেখ হাসিনার ছেলে জয়কে নিয়ে বক্তব্য দেয়ার অভিযোগে মানহানি মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়া জয়ের অ্যাকাউন্টে ৩০ কোটি ডলার রয়েছে বলে বক্তব্য দেয়ার অভিযোগে ২০১৬ সালের ৩ মে মানহানির মামলা দায়ের করা হয়। ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এবং ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে নড়াইলে মানহানির মামলা হয়।

২০১৪ সালের ১০ অক্টোবর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও জাতিগত বিভেদ সৃষ্টির অভিযোগে দুই মামলা করা হয়। ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালনকে ‘ভুয়া’ অভিযোগ করে ২০১৬ সালের ৩০ আগস্ট ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। বাংলাদেশের মানচিত্র, জাতীয় পতাকা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগ এনে ২০১৬ সালের নভেম্বর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আরেকটি মামলা দায়ের করা হয় এবং ২০১৩ সালের ২ অক্টোবর ঋণ খেলাপির অভিযোগ তুলে ঢাকার অর্থঋণ আদালতে মামলা করা হয়। এ সকল ভুয়া মামলা দিয়ে বেগম জিয়াকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়। কিন্তু তিনি কখনো ভেঙ্গে পড়েননি। দলের নেতাকর্মীরা অনৈক সময় ভেঙ্গে পড়লেও তিনি ধৈর্যের সঙ্গে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সকলকে সাহস যুগিয়েছেন। এ কারণেই তিনি বাংলাদেশে আপোষহীন নেত্রী হিসেবে স্বীকৃত হয়ে থাকবেন আজীবন।