আভিজাত্যের বাহন থেকে আঃ মান্নানের জীবিকার সঙ্গী ঘোড়াগাড়ি
- আপডেট সময় : ৮২ বার পড়া হয়েছে
বাংলার ইতিহাসে ঘোড়ার গাড়ির আলাদা মর্যাদা ছিল। নবাব-জমিদারের প্রাসাদে অতিথি আনাগোনা, বিবাহযাত্রার শোভাযাত্রা কিংবা শহর-গ্রামের রাজপথে রাজকীয় ভঙ্গিতে ছুটে চলত ঘোড়ার গাড়ি। মুক্তাগাছার আটানি জমিদারবাড়ির আঙিনায়ও একসময় প্রতিদিন ভেসে আসত ঘোড়ার টগবগ শব্দ। এটি ছিল আভিজাত্যের পরিচয়, ক্ষমতার প্রকাশ।
কালের নিয়মে হারিয়ে গেছে সেই যুগ। মোটরযান, ভ্যান, ট্রাকের ভিড়ে আজ আর তেমন দেখা যায় না ঘোড়ার গাড়ি। ইতিহাস যেন মিশে গেছে কেবল বইয়ের পাতায় আর জাদুঘরের কাচের ভেতরে।
তবু মুক্তাগাছার পাহাড়ি অঞ্চল গয়েশপুরে এখনও ভোরবেলা শোনা যায় সেই টক্ টক্ শব্দ। দুই চাকার ঘোড়াগাড়ি নিয়ে ছুটে চলেন গ্রামেরই মানুষ আব্দুল মান্নান (৫২)। তিনি যেন বর্তমানের ভেতরে দাঁড়িয়ে অতীতকে টেনে আনেন জীবনের বাস্তবতায়।
মান্নানের বাবা জালাল উদ্দিন ছিলেন সাধারণ কৃষক। মাটির সঙ্গেই জীবন কেটেছে তাঁর। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর কিশোর বয়সেই সংসারের ভার কাঁধে তুলে নিতে হয় মান্নানকে। প্রথমদিকে কৃষিকাজ করলেও সংসারের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়নি।
জীবিকার খোঁজে তিনি বেছে নিলেন ঘোড়াগাড়ি চালানো। শুরুটা ছিল সাদামাটা, তবে সেটিই হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের প্রধান ভরসা। আজ প্রায় দুই দশক ধরে এই গাড়ি ঘুরছে তার সংসারের চাকা।
মান্নানের তিন ছেলে। ঘোড়াগাড়ির উপার্জনেই একজনকে বিদেশে পাঠিয়েছেন। আরেকজন পড়াশোনা করে ঢাকায় চাকরি করছে। ছোট ছেলেকে দিয়েছেন দোকান বসানোর সুযোগ। শুধু তাই নয়, গাড়ি চালিয়ে তুলেছেন ঘরবাড়ি, কিনেছেন চাষাবাদের জমি।
তিনি বলেন, “গাড়ি না থাকলে আমি কিছুই করতে পারতাম না। আমার জীবনের সব অর্জন এই গাড়ির টানেই।”
মান্নানের গাড়ি এখন মুক্তাগাছার গ্রামীন জীবনের নিত্যদিনের সঙ্গী। কখনো গাছ, আখ, আনারস বা কলা; কখনো মাটির বোঝা বা গোবর সবই তিনি পৌঁছে দেন মানুষের দরজায়। অনেকের জন্য ঘোড়ার গাড়ি আজও ভরসার বাহন।
লেখক ও লোকসংস্কৃতি গবেষক, মুক্তাগাছা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এম. ইদ্রিস আলী বলেন, এ গাড়ি ছাড়া আগের দিনে চলাই যেত না। এখনো মান্নানের মতো মানুষ না থাকলে অনেক সময় মালপত্র এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেওয়া কষ্ট হয়ে যেত।
প্রশ্ন করলে হাসিমুখে বলেন মান্নান, গাড়ি চালাতে আমার ভালো লাগে। হাতে টাকা থাকলে ভালো লাগে। সন্ধ্যায় বাড়ি গেলে বউ-ছেলে পুলাকে দুইশ, পাঁচশ টাকা দিতে পারি সেটাই আমার সবচেয়ে বড় সুখ। তিনি মনে করেন, শরীর যতদিন সায় দেবে, ততদিন এই গাড়ি চারিয়েই সংসার চালাবেন।
মানুষের জীবন যেমন সময়ের সঙ্গে পাল্টে যায়, তেমনি বদলায় জীবিকার ধরন। তবুও কিছু মানুষ থেকে যান যারা অতীতকে বাঁচিয়ে রাখেন তাদের কাজের মধ্য দিয়ে। আব্দুল মান্নান সেই মানুষদেরই একজন।
তার গাড়ির টক্ টক্ শব্দ যেন শুধু জীবিকার নয়, অতীতেরও ডাক। একসময়কার রাজজীয় বাহন আজ সাধারণ মানুষের মালবাহী গাড়ি হলেও মান্নানের মতো মানুষের কারণে ঐতিহ্য এখনো জীবিত।
মুক্তাগাছার জমিদার বাড়ির ধ্বংসপ্রায় স্থাপনা যেন অতীতের সাক্ষী, তেমনি আ. মান্নানের দুই চাকার গাড়িও আমাদের ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল। তার জীবন প্রমাণ করে ঐতিহ্য শুধু জাদুঘরে বন্দি নয়, মানুষের ঘাম ও পরিশ্রমের ভেতর দিয়েও বেঁচে থাকতে পারে।




















