ইফতার কেন্দ্রীক রাজনীতি…

- আপডেট সময় : ১১:৫৮:০৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ মার্চ ২০২৫ ২৪ বার পড়া হয়েছে
সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রতিটি দলই ইফতার পার্টিকে কেন্দ্র করে নির্বাচনের প্রস্তুতিও জোরদার করছে। রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় পর্যায়ে ইফতার পার্টি আয়োজনের পাশাপাশি প্রতিদিনই বিভিন্ন সংগঠনের ইফতারে নেতারা নিজ নিজ দলের অবস্থান নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন, সংগঠনকে গুছিয়ে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করছেন, কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়াচ্ছেন, করছেন জোটের আলোচনা
ইফতারে রাজনীতি কালচার দীর্ঘদিনের। এরশাদ সরকারের আমল থেকেই বাংলাদেশে এই ইফতারি অনুষ্ঠানে ভোটের রাজনীতি চলে আসছে। একই ভাবে চলমান রমজান মাসে সারাদেশে চলছে রাজনৈতিক দলগুলোর জমজমাট ইফতার পার্টি। আর ইফতার পার্টিকে কেন্দ্র করে রাজনীতিও এখন জমজমাট। সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রতিটি দলই ইফতার পার্টিকে কেন্দ্র করে নির্বাচনের প্রস্তুতিও জোরদার করছে। এ ছাড়া সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন করা হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় পর্যায়ে ইফতার পার্টি আয়োজনের পাশাপাশি প্রতিদিনই বিভিন্ন সংগঠনের ইফতারে নেতারা নিজ নিজ দলের অবস্থান নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন, সংগঠনকে গুছিয়ে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করছেন, কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়াচ্ছেন, জোটের আলোচনা করছেন। বভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছেন। প্রচারনা বা আলোচনায় পিছিয়ে আছে ফ্যাসিষ্ট দল আওয়ামী লীগ। তাদের নেই কোনো আলোচনা এবং কর্মসূচী।
বিএনপি চাচ্ছে নেতাকর্মীদের গুছিয়ে ঈদের পরই জোরে সোরে নির্বাচনী প্রচারণায় মাঠে নামতে। প্রচারনা, আলোচনা ও বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করতে চায় তারা। আর এই দুই দলই নির্বাচনের আগে বৃহত্তর জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। জোট গঠন নিয়ে বিভিন্নভাবে কাজ করছেন তারা। এ নিয়ে জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে অলিখিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। কোন দল বেশি বড় জোট করে ভোট ব্যাংক বাড়াতে পারে সেটাই জোট গঠনের প্রধান কৌশল। এ নিয়ে চলছে দুই দলের সিনিয়র নেতাদের বিরামহীন দৌড়ঝাঁপ। এবার রোজা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা থেকে শুরু করে জেলা ও মহানগর পর্যায়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিদিনই ইফতার পার্টির আয়োজন করছে। আর এই ইফতার পার্টিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে কুশল বিনিময়সহ দলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনার পাশাপাশি ভোটের বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে।
এদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করে রাজনৈতিক দলগুলো কর্ম তৎপরতা বাড়িয়েছে। বড় রাজনৈতিক দলগুলো রোজা শুরুর প্রথম দিন থেকে শুরু করে শেষ দিন পর্যন্ত ইফতার পার্টির অজুহাতে ভোটের রাজনীতি করবে। ভোট চাওয়ার কৌশল হিসেবে রোজা শুরুর পর থেকেই দলের বিভিন্ন পর্যায়ে ইফতার পার্টি করছে। রাজনৈতিক দলের নেতা, বিদেশী কূটনীতিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের লোকদের নিয়ে পৃথক ইফতার পার্টি করছে।
এদিকে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল রোজার শেষ দিন পর্যন্ত ইফতার পার্টি চালানো ঘোষনা দিয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিনই কোন না কোন ইফতার অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন বিএনপি জামায়াত, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দলের সর্বস্তরের নেতারা। বড় দল থেকে শুরু করে নাম সর্বস্ব ছোট দলও ইফতার পার্টির আয়োজন করছে। বিশেষ করে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এমপি মনোনয়ন প্রত্যাশীরা ছুটছেন নিজ নিজ এলাকার পাড়া-মহল্লার ইফতার অনুষ্ঠানে। রমজান মাসের শেষদিন পর্যন্ত চলবে এভাবেই। আর এ কারণে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনেক কেন্দ্রীয় নেতা এখন নিজ নিজ সংসদীয় এলাকায় অবস্থান করছেন। ইফতার পার্টিকে কেন্দ্র করে নিজ দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি এলাকার সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে জনসংযোগ করছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। এভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি এগিয়ে রাখতে চাচ্ছেন তারা।
এদিকে রমজান মাসে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিদিন ইফতার পার্টি আয়োজনের পাশাপাশি গরিব-দুখীদের মধ্যে ইফতারসামগ্রী বিতরণ, খাদ্য সহায়তা প্রদান, ওষুধসামগ্রী বিতরণ, জামাকাপড় ও জাকাত বিতরণের মাধ্যমে মানুষের ভালবাসা আদায়ের চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে যারা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান তারা ইফতার ও গরিব-দুখীদের সহায়তার বিষয়ে বেশি সক্রিয়।
এ ছাড়া তারা তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব গোছানোর চেষ্টা করছেন। এ জন্য নিজ নিজ এলাকায় ইফতার পার্টিসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করছেন নিয়মিত। আগের মতো সব রাজনৈতিক দলই একে অন্যকে ইফতারের আমন্ত্রণ জানিয়ে রাজনীতি করার চেষ্টা করলেও এখন কেউ কারও ইফতার পার্টিতে অংশ নেয় না। তবে বড় রাজনৈতিক দলগুলো নিজ দলের নেতৃত্বে জোটের পরিধি ও ভোট ব্যাংক বাড়ানোর লক্ষ্যে সমমনা দলগুলোর নেতাদের জন্য ইফতার আয়োজন করে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ইফতার পার্টি আয়োজনের মধ্য দিয়ে সেই চেষ্টা আরও বেগবান হচ্ছে। এবার ইফতার পার্টি নিয়ে যেসব রাজনেতিক দল বেশি সক্রিয় রয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বিকল্পধারা, এলডিপি, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিশ, জাসদ, কল্যাণ পার্টি, এনডিপি, এনপিপি, মুসলিম লীগ, ইসলামিক পার্টি, লেবার পার্টি, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, গণফোরাম।
এই দলগুলো ইতোমধ্যেই কেন্দ্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে ইফতার পার্টি আয়োজন করেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এবারও বিএনপি ও জাতীয় পার্টি ছাড়াও দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই ভোটের প্রচারণায় ইফতার পার্টিকে বেছে নিয়েছে। এই মিলনমেলা নির্বাচনের প্রস্তুতি কাজে লাগাচ্ছে। কারণ, যে দল নেতিবাচক বিষয়গুলোকে মোকাবেলা করে ইতিবাচক দিকগুলোকে ইফতার রাজনীতির মধ্য দিয়ে এগিয়ে রাখতে পারবে, সেই দল ভোটের লড়াইয়ে স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে থাকবে। আর এ জন্যই রাজনৈতিক দলগুলো এতো বেশি গুরুত্ব দিয়ে ইফতার পার্টি আয়োজন করছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, দেশে ইফতার রাজনীতি দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি হলেও মূলত এরশাদ সরকারের পতনের পর থেকে তা জোরদার হয়।
বড় রাজনৈতিক দলগুলো ইফতার পার্টিকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্তরের শোডাউনের চেষ্টা করেন। রোজা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ইফতার পার্টিকে কেন্দ্র করে রাজনীতিও জমে উঠে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মাঠ এগিয়ে রাখতে চায়। তাই এবারের রমজান মাসকে রাজনৈতিক দলগুলো অধিক গুরুত্ব দিয়ে নিজেদের প্রস্তুতি জোরদার করার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে দেশে চলমান দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াত এ বিষয়ে বেশি সক্রিয়। তবে এবার ইফতার পার্টির আয়োজন আগে শুরু করেছে বিএনপি। রমজানের প্রথম থেকে বিএনপি এতিম ও আলেম-ওলামাদের সঙ্গে ইফতার পার্টির মধ্য দিয়ে ইফতার এবং ভোটের রাজনীতি শুরু করে। পরে রাজনৈতিক দলের নেতা ও কূটনীতিকসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষকে নিয়ে বেশ কটি ইফতার পার্টি সম্পন্ন করে। কূটনীতিক ও বিভিন্ন স্তরের মানুষের জন্য ইফতার পার্টি আয়োজন করে বিএনপি। এ ছাড়া জাতীয় পার্টিও এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইফতার পার্টি করছে। বিএনপি এবার নিজেদের দলের ইফতার পার্টির পাশাপাশি ২০ দলীয় জোটের শরিক দল ও অন্যান্য সমমনা দলের ইফতার পার্টিগুলোতে অংশ নিচ্ছে গুরুত্বসহকারে। এর মাধ্যমে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি জোটের পরিধি বাড়াতে চাচ্ছে। তবে জামায়াত যতদিন বিএনপির সঙ্গে আছে ততদিন বামদলগুলো তাদের সঙ্গে নির্বাচনী জোটে আসবে না জেনেও বিএনপি বিভিন্ন কৌশলে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। এ কারণে বিএনপি বিভিন্নভাবে বামদলের নেতাদেরও ইফতার পার্টিতে দাওয়াত দিচ্ছে। কূটনীতিকদের সম্মানে ইফতার পার্টিতে সবসময়ই অধিক সংখ্যক বিদেশী কূটনীতিক অংশ নিয়ে থাকে।
তবে এবার বিএনপির ইফতার পার্টিতেও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, পাকিস্তান ও ভারতসহ প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কূটনীতিক অংশ নিচ্ছেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই ইফতার পার্টিকে বিদেশী কূটনীতিকরাও গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। ক্ষমতা হারানোর ১৬ বছর পর্যন্ত বিএনপি রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় ছিল। বিএনপি এখন নতুন উদ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন কর্মকৌশল হাতে নিয়ে বাস্তবায়ন করছে। বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে ইফতার পার্টিগুলোতেও দলের পক্ষ থেকে তা তুলে ধরা হচ্ছে।
সূত্রমতে, কেন্দ্রীয়ভাবে বিএনপি এবার বেশি ইফতার পার্টি করলেও তৃণমূল পর্যায়ে তুলনামূল কম ইফতার পার্টি আয়োজন করেছে। আর জামায়াত ইফতার পার্টির আয়োজন করলেও তৃণমূল পর্যায়ে বেশি করছে। তবে বিএনপি দলীয়ভাবে করা ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নামে এবার অনেক ইফতার পার্টির আয়োজন করেছে বলে জানা যায়। আর এ সকল ইফতার পার্টিকে পুঁজি করে সম্ভাব্য প্রার্থীরা জনসাধারনের সঙ্গে ভোটের জন্য আবেদন, সাহায্য সহায়তা প্রদান করছেন।