ঢাকা ০৩:৪১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫

ইসরাইল-ইরান যুদ্ধে লাভ ক্ষতি, সুবিধাভোগী কারা

মহিউদ্দিন তুষার
  • আপডেট সময় : ১০:২৬:৫৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫ ১০ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি
মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত মঞ্চে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নতুন কিছু নয়। ইসরাইল দীর্ঘদিন ধরেই সংঘাত করে আসছে। তবে সর্বশেষ দফার সংঘাত শুধু এই দুই দেশের সীমান্তেই নয়, ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবেশী কয়েকটি দেশে। আর সেই টানাপোড়েনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে বরাবরই ইসরাইলকে ছায়া দিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাধর এই দেশটি।
তেহরান পারমাণবিক বোমা তৈরির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে এমন অভিযোগে গত ১৩ জুন ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনা লক্ষ্য করে প্রথমে বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল। সেই অভিযোগ দৃঢভাবে অস্বীকার করে ইরান। এরপর ইসরায়েল ভূখণ্ডে তেহরানের প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা শুরু হয়। চলমান দুই দেশের যুদ্ধের মধ্যেই তিনটি ইরানি পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রও সংঘাতে যোগ দেয়। এই হামলার পর বিশ্বে এক প্রকার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রতিবাদ হিসেবে সোমবার রাতে কাতারে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালান ইরান।
১২ দিনের সংঘাতের পর গত মঙ্গলবার সকালে উভয় পক্ষের সম্মতিতে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত মঙ্গলবার যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পরেও গোলাবর্ষণ, ড্রোন ও সাইবার হামলার অভিযোগ চলছে। দুই পক্ষই একে অপরকে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করছে। আর এরই ফাঁকে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা চূড়ান্ত কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। এই সংঘাতে কে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত? আর এর ছত্রছায়ায় আদতে ফায়দা লুটেছে কারা? টানা ১২ দিনের সংঘাতে ইসরায়েলজুড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কতটা ভয়াবহ তা তেমনভাবে সামনে আসেনি। কারণ, ইসরায়েল সরকার ক্ষয়ক্ষতির তথ্য প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছিল। তবে দখলদার দেশটিতে যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটি অনেকটাই অনুধাবন করা যায় সম্প্রতি সামনে আশা ইসরায়েলিদের ক্ষতিপূরণ চাওয়ার তথ্যের ভিত্তিতে।
এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংঘাত শুরুর পর থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর পর্যন্ত ১২ দিনে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির জন্য জনগণের কাছ থেকে ৩৯ হাজার ক্ষতিপূরণের আবেদন পেয়েছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের পত্রিকা ইয়েদিয়থ আহারোনোথের মতে, ১৩ জুন ইসরায়েল-ইরান সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলি কর কর্তৃপক্ষের প্রায় ৩৮ হাজার ৭০০টি ক্ষতিপূরণের দাবি পেয়েছে। এই দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ভবনের ক্ষতির জন্য ৩০ হাজার ৮০৯টি, যানবাহনের ক্ষতির জন্য ৩ হাজার ৭১৩টি এবং সরঞ্জাম ও অন্যান্য জিনিসপত্রের ক্ষতির জন্য ৪ হাজার ৮৫টি। অন্যদিকে, আঞ্চলিক শক্তি ইরানও এক অর্থে বড় ক্ষতির শিকার হয়েছে। দেশটির সামরিক স্থাপনা, ড্রোন ঘাঁটি, পারমাণবিক কর্মসূচির স্থাপনা লক্ষ্য করে ভয়াবহ হামলা, দেশের ভেতরেই বিস্ফোরণ, গুপ্তচরবৃত্তি, অভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ উসকে তোলার প্রচেষ্টা সব মিলে ইরানের অর্থনীতি ও অভ্যন্তরীণ স্থিতি চাপে পড়েছে।
ইসরায়েলের ক্ষেত্রেও ক্ষতি কম নয়। হাজারো রকেট হামলা, সীমান্ত অঞ্চলে অচলাবস্থা, বড় অঙ্কের সামরিক ব্যয় ও বৈশ্বিক জনমতের ক্ষতি- এগুলোই দেশটিকে চাপে রেখেছে। এছাড়া ইসরায়েল ইরানে আক্রমণের সময় কমপক্ষে ১৪ জন ইরানি বিজ্ঞানীকে লক্ষ্যবস্তু করে হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে। এদের মধ্যে রসায়নবিদ, পদার্থবিদ এবং প্রকৌশলীও ছিলেন। তবে সামগ্রিকভাবে বললে, মানবিক দিক থেকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিয়েছে গাজা ও লেবাননের সীমান্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ। বিশ্লেষকরা সবার আগে যে নামটি বলছেন, তা হলো ফিলিস্তিনি জনগণ। গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি হামলায় হাজারো বেসামরিক মানুষের মৃত্যু, লাখো মানুষের গৃহহীনতা, ধ্বংসস্তূপে পরিণত জনপদ-এটাই এই সংঘাতের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়।
কারা সবচেয়ে বেশি লাভবান: বিশ্লেষকদের বড় অংশ একমত, এই সংঘাতের সরাসরি সুবিধাভোগী মূলত আঞ্চলিক অস্ত্র ব্যবসায়ীরা এবং বৃহৎ সামরিক শিল্পের পৃষ্ঠপোষক দেশগুলো, বিশেষত দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। যুদ্ধবিরতির নামে মধ্যস্থতার কৃতিত্ব নিয়ে ট্রাম্প নিজের হারিয়ে যাওয়া ইমেজ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছেন। ইসরায়েলের কাছে আরও নতুন অস্ত্র সহায়তা ও প্রযুক্তি বিক্রির সুযোগ পেয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে নিজের অপরিহার্য অবস্থান আবারও জোরালোভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে। অন্যদিকে, ইরানের পাশে অবস্থান নিয়ে নিজেদের প্রভাব বলয়কে আরও পাকাপোক্ত করছে রাশিয়া ও চীন। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ভেঙ্গে বিকল্প বাজার ও সামরিক সহযোগিতা নিশ্চিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে এককভাবে শান্তির রক্ষাকর্তা হিসেবে দাঁড়াতে দিচ্ছে না।
এ সংঘাতের মূল খেসারত দিয়েছে সাধারণ মানুষ- বিশেষত গাজা ও সীমান্ত অঞ্চলের নিরপরাধ নারী-শিশুরা। আর বৈশ্বিক কূটনৈতিক মঞ্চে লাভবান হয়েছে বড় শক্তিধর সামরিক ক্ষমতাধর দেশগুলো এবং তাদের অস্ত্র নির্মাতা করপোরেশনগুলো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এই যুদ্ধবিরতি আর কতদিন টিকে থাকবে? এবং এ লড়াই শেষ পর্যন্ত কার কৌশলগত লাভ নিশ্চিত করবে? সময়ই সেই জবাব দেবে।
গাজা উপত্যকায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা মঙ্গলবার ৫৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। (২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির আগ পর্যন্ত)। এতে আহত হয়েছেন এক লাখ ৩০ হাজারের বেশি বাসিন্দা। গৃহহীন প্রায় ১২ লাখ মানুষ। গাজায়  ৭৫ শতাংশ ভবনই ধ্বংসপ্রাপ্ত। গাজা সংঘাতে ইসরায়েলের নিহত হয়েছে আনুমানিক দেড় হাজার মানুষ। রকেট হামলা, হামাসের আক্রমণ, পাল্টা হামলায় আঞ্চলিক অস্ত্র বাণিজ্য: ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪-২৫ সালে ইসরায়েলের অস্ত্র আমদানি প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন অস্ত্র রপ্তানি গত এক বছরে ১৪ শতাংশ বেড়েছে। গাজার স্কুলশিক্ষক থেকে আহমাদ সাইদ বলেন, আমার স্কুল আর নেই। আমাদের পুরো পাড়াটাই ধুলোয় মিশে গেছে। যুদ্ধবিরতি বলছে, কিন্তু আমরা এখনও আতঙ্কে বেঁচে আছি। ইসরায়েলের সীমান্ত শহর আশকেলনের বাসিন্দা লিয়োর বার-জোহর বলেন, ‘রকেট হামলা বন্ধ হয়নি পুরোপুরি। আমরা চাই স্থায়ী শান্তি, শুধু বোমা আর ক্ষেপণাস্ত্র নয়।
ইরানের বিশ্লেষক মাসুদ হাকিমি বলেন, ইরান সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে খরচ করেছে প্রচুর। কিন্তু আঞ্চলিক প্রভাব ধরে রাখতে এ ছাড়া উপায় ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা, ইরানের ভেতরকার অর্থনৈতিক ক্ষতি এবার চোখে পড়ার মতো।  মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. লিনা খালিদ বলেন, এই সংঘাত মূলত একটি দুঃসহ মানবিক ট্র্যাজেডি। বেনিফিশিয়ারি রাষ্ট্রগুলো সামরিক চুক্তি আর মধ্যস্থতার নামে রাজনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে- আর বেসামরিক মানুষের দুঃখ বেচে আসল ফায়দা লুটছে অস্ত্র উৎপাদকরা। ওয়াশিংটনের থিঙ্কট্যাংক ‘মিডল ইস্ট পলিসি ইনিশিয়েটিভ-এর গবেষক স্যাম পার্কার বলেন, ‘ট্রাম্প এই যুদ্ধবিরতিকে নিজের জয়ে রূপ দিতে চাইছেন। তবে ভেতরে ভেতরে মার্কিন প্রতিরক্ষা শিল্পের বিক্রি যে হারে বেড়েছে, সেটাই আসল ফায়দা।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ইসরাইল-ইরান যুদ্ধে লাভ ক্ষতি, সুবিধাভোগী কারা

আপডেট সময় : ১০:২৬:৫৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫
মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত মঞ্চে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নতুন কিছু নয়। ইসরাইল দীর্ঘদিন ধরেই সংঘাত করে আসছে। তবে সর্বশেষ দফার সংঘাত শুধু এই দুই দেশের সীমান্তেই নয়, ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবেশী কয়েকটি দেশে। আর সেই টানাপোড়েনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে বরাবরই ইসরাইলকে ছায়া দিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাধর এই দেশটি।
তেহরান পারমাণবিক বোমা তৈরির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে এমন অভিযোগে গত ১৩ জুন ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনা লক্ষ্য করে প্রথমে বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল। সেই অভিযোগ দৃঢভাবে অস্বীকার করে ইরান। এরপর ইসরায়েল ভূখণ্ডে তেহরানের প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা শুরু হয়। চলমান দুই দেশের যুদ্ধের মধ্যেই তিনটি ইরানি পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রও সংঘাতে যোগ দেয়। এই হামলার পর বিশ্বে এক প্রকার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রতিবাদ হিসেবে সোমবার রাতে কাতারে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালান ইরান।
১২ দিনের সংঘাতের পর গত মঙ্গলবার সকালে উভয় পক্ষের সম্মতিতে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত মঙ্গলবার যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পরেও গোলাবর্ষণ, ড্রোন ও সাইবার হামলার অভিযোগ চলছে। দুই পক্ষই একে অপরকে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করছে। আর এরই ফাঁকে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা চূড়ান্ত কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। এই সংঘাতে কে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত? আর এর ছত্রছায়ায় আদতে ফায়দা লুটেছে কারা? টানা ১২ দিনের সংঘাতে ইসরায়েলজুড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কতটা ভয়াবহ তা তেমনভাবে সামনে আসেনি। কারণ, ইসরায়েল সরকার ক্ষয়ক্ষতির তথ্য প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছিল। তবে দখলদার দেশটিতে যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটি অনেকটাই অনুধাবন করা যায় সম্প্রতি সামনে আশা ইসরায়েলিদের ক্ষতিপূরণ চাওয়ার তথ্যের ভিত্তিতে।
এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংঘাত শুরুর পর থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর পর্যন্ত ১২ দিনে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির জন্য জনগণের কাছ থেকে ৩৯ হাজার ক্ষতিপূরণের আবেদন পেয়েছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের পত্রিকা ইয়েদিয়থ আহারোনোথের মতে, ১৩ জুন ইসরায়েল-ইরান সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলি কর কর্তৃপক্ষের প্রায় ৩৮ হাজার ৭০০টি ক্ষতিপূরণের দাবি পেয়েছে। এই দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ভবনের ক্ষতির জন্য ৩০ হাজার ৮০৯টি, যানবাহনের ক্ষতির জন্য ৩ হাজার ৭১৩টি এবং সরঞ্জাম ও অন্যান্য জিনিসপত্রের ক্ষতির জন্য ৪ হাজার ৮৫টি। অন্যদিকে, আঞ্চলিক শক্তি ইরানও এক অর্থে বড় ক্ষতির শিকার হয়েছে। দেশটির সামরিক স্থাপনা, ড্রোন ঘাঁটি, পারমাণবিক কর্মসূচির স্থাপনা লক্ষ্য করে ভয়াবহ হামলা, দেশের ভেতরেই বিস্ফোরণ, গুপ্তচরবৃত্তি, অভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ উসকে তোলার প্রচেষ্টা সব মিলে ইরানের অর্থনীতি ও অভ্যন্তরীণ স্থিতি চাপে পড়েছে।
ইসরায়েলের ক্ষেত্রেও ক্ষতি কম নয়। হাজারো রকেট হামলা, সীমান্ত অঞ্চলে অচলাবস্থা, বড় অঙ্কের সামরিক ব্যয় ও বৈশ্বিক জনমতের ক্ষতি- এগুলোই দেশটিকে চাপে রেখেছে। এছাড়া ইসরায়েল ইরানে আক্রমণের সময় কমপক্ষে ১৪ জন ইরানি বিজ্ঞানীকে লক্ষ্যবস্তু করে হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে। এদের মধ্যে রসায়নবিদ, পদার্থবিদ এবং প্রকৌশলীও ছিলেন। তবে সামগ্রিকভাবে বললে, মানবিক দিক থেকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিয়েছে গাজা ও লেবাননের সীমান্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ। বিশ্লেষকরা সবার আগে যে নামটি বলছেন, তা হলো ফিলিস্তিনি জনগণ। গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি হামলায় হাজারো বেসামরিক মানুষের মৃত্যু, লাখো মানুষের গৃহহীনতা, ধ্বংসস্তূপে পরিণত জনপদ-এটাই এই সংঘাতের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়।
কারা সবচেয়ে বেশি লাভবান: বিশ্লেষকদের বড় অংশ একমত, এই সংঘাতের সরাসরি সুবিধাভোগী মূলত আঞ্চলিক অস্ত্র ব্যবসায়ীরা এবং বৃহৎ সামরিক শিল্পের পৃষ্ঠপোষক দেশগুলো, বিশেষত দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। যুদ্ধবিরতির নামে মধ্যস্থতার কৃতিত্ব নিয়ে ট্রাম্প নিজের হারিয়ে যাওয়া ইমেজ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছেন। ইসরায়েলের কাছে আরও নতুন অস্ত্র সহায়তা ও প্রযুক্তি বিক্রির সুযোগ পেয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে নিজের অপরিহার্য অবস্থান আবারও জোরালোভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে। অন্যদিকে, ইরানের পাশে অবস্থান নিয়ে নিজেদের প্রভাব বলয়কে আরও পাকাপোক্ত করছে রাশিয়া ও চীন। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ভেঙ্গে বিকল্প বাজার ও সামরিক সহযোগিতা নিশ্চিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে এককভাবে শান্তির রক্ষাকর্তা হিসেবে দাঁড়াতে দিচ্ছে না।
এ সংঘাতের মূল খেসারত দিয়েছে সাধারণ মানুষ- বিশেষত গাজা ও সীমান্ত অঞ্চলের নিরপরাধ নারী-শিশুরা। আর বৈশ্বিক কূটনৈতিক মঞ্চে লাভবান হয়েছে বড় শক্তিধর সামরিক ক্ষমতাধর দেশগুলো এবং তাদের অস্ত্র নির্মাতা করপোরেশনগুলো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এই যুদ্ধবিরতি আর কতদিন টিকে থাকবে? এবং এ লড়াই শেষ পর্যন্ত কার কৌশলগত লাভ নিশ্চিত করবে? সময়ই সেই জবাব দেবে।
গাজা উপত্যকায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা মঙ্গলবার ৫৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। (২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির আগ পর্যন্ত)। এতে আহত হয়েছেন এক লাখ ৩০ হাজারের বেশি বাসিন্দা। গৃহহীন প্রায় ১২ লাখ মানুষ। গাজায়  ৭৫ শতাংশ ভবনই ধ্বংসপ্রাপ্ত। গাজা সংঘাতে ইসরায়েলের নিহত হয়েছে আনুমানিক দেড় হাজার মানুষ। রকেট হামলা, হামাসের আক্রমণ, পাল্টা হামলায় আঞ্চলিক অস্ত্র বাণিজ্য: ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪-২৫ সালে ইসরায়েলের অস্ত্র আমদানি প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন অস্ত্র রপ্তানি গত এক বছরে ১৪ শতাংশ বেড়েছে। গাজার স্কুলশিক্ষক থেকে আহমাদ সাইদ বলেন, আমার স্কুল আর নেই। আমাদের পুরো পাড়াটাই ধুলোয় মিশে গেছে। যুদ্ধবিরতি বলছে, কিন্তু আমরা এখনও আতঙ্কে বেঁচে আছি। ইসরায়েলের সীমান্ত শহর আশকেলনের বাসিন্দা লিয়োর বার-জোহর বলেন, ‘রকেট হামলা বন্ধ হয়নি পুরোপুরি। আমরা চাই স্থায়ী শান্তি, শুধু বোমা আর ক্ষেপণাস্ত্র নয়।
ইরানের বিশ্লেষক মাসুদ হাকিমি বলেন, ইরান সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে খরচ করেছে প্রচুর। কিন্তু আঞ্চলিক প্রভাব ধরে রাখতে এ ছাড়া উপায় ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা, ইরানের ভেতরকার অর্থনৈতিক ক্ষতি এবার চোখে পড়ার মতো।  মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. লিনা খালিদ বলেন, এই সংঘাত মূলত একটি দুঃসহ মানবিক ট্র্যাজেডি। বেনিফিশিয়ারি রাষ্ট্রগুলো সামরিক চুক্তি আর মধ্যস্থতার নামে রাজনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে- আর বেসামরিক মানুষের দুঃখ বেচে আসল ফায়দা লুটছে অস্ত্র উৎপাদকরা। ওয়াশিংটনের থিঙ্কট্যাংক ‘মিডল ইস্ট পলিসি ইনিশিয়েটিভ-এর গবেষক স্যাম পার্কার বলেন, ‘ট্রাম্প এই যুদ্ধবিরতিকে নিজের জয়ে রূপ দিতে চাইছেন। তবে ভেতরে ভেতরে মার্কিন প্রতিরক্ষা শিল্পের বিক্রি যে হারে বেড়েছে, সেটাই আসল ফায়দা।