ঢাকা ০১:২৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম ::

এইচএসসির খাতা মূল্যায়নে গোপনীয়তার চরম লঙ্ঘন

স্টাফ রিপোর্টার
  • আপডেট সময় : ৬৪ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে ভয়াবহ অনিয়মের চিত্র ধরা পড়েছে। খাতা যাচাইয়ের মতো গোপনীয় দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা পরীক্ষকরা খাতার ওএমআর অংশ বা ‘বৃত্ত’ পূরণের কাজ শিক্ষার্থীদের দিয়ে করিয়েছেন। বিষয়টি সামনে এসেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিও ও স্থিরচিত্রের মাধ্যমে। আবার এ নিয়ে প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে বেশ কয়েকজন পরীক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা। বোর্ড থেকে জানানো হয়েছে, ২০২৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র (বিষয় কোড-১০৮), উচ্চতর গণিত (বিষয় কোড-১২৬) এবং বাংলা দ্বিতীয় পত্রের (বিষয় কোড-১০২) খাতা মূল্যায়নে অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে।
এ নিয়ে অভিযুক্ত পরীক্ষকরা হলেন, রাজধানীর ডেমরার রোকেয়া আহসান কলেজের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক মুরছানা আক্তার, মোহাম্মদপুরের সেন্ট যোসেফস হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের উচ্চতর গণিতের শিক্ষক মহসীন আলামীন, যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ের পরীক্ষক মো. সাখাওয়াত হোসাইন আকন, রাজবাড়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পরীক্ষক সমীরময় মন্ডল, নবাবগঞ্জের মুন্সীনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিক এবং গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার আনসার ভিডিপি স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা বিষয়ের প্রভাষক মো. রাকিবুল হাসান। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে বোর্ড পরীক্ষার খাতা নিয়ে নিয়মবহির্ভূত যে ঘটনা ঘটছে তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মজা, বিদ্রুপ ও হাস্যরসের উপস্থাপন পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলছে। টিকটক, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম ঘাঁটলেই দেখা যাচ্ছে– খাতা কাটছেন শিক্ষার্থীরাই, কেউ আবার খাতা হাতে বসে খিচুড়ি, লুচি, পরোটা খাচ্ছেন। যেখানে একপাশে রাখা খাতা, আরেক পাশে চাটনি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা নিজেরাই খাতার ওএমআর অংশ (বৃত্ত) পূরণ করছেন। কোথাও কোথাও একাধিক শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে বসে খাতা পূরণ করতে দেখা গেছে। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ছবি শেয়ার করে এক শিক্ষার্থী ক্যাপশন দিয়েছেন– ‘বোর্ডের খাতা কাটছে টিকটকার’। আরেকজন লিখেছেন– ‘তোমাদের খাতা এখন আমাদের হাতে’। কেউ কেউ আবার ফল নিয়েও মজা করে লিখেছেন— ‘কে ভাই এইটা ৯২ পাইছে’। এসব পোস্ট এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যা নিয়ে বোর্ড পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে বিশ্বাসযোগ্যতা ও সার্বিক মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এ অবস্থায় উদ্বেগ, হতাশা আর অনিশ্চয়তায় ভুগছেন ২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষার খাতার গোপনীয়তা লঙ্ঘনের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর তারা প্রশ্ন তুলছেন কেন্দ্রীয় পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের যথাযথ পদ্ধতি ও বোর্ডের নজরদারি নিয়ে।
রাজধানীর একটি সরকারি কলেজের মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী সামিয়া আক্তার বলেন, যে পরিশ্রমটা করেছি, সেটা যদি সঠিকভাবে মূল্যায়নই না হয়, তাহলে তো সবই বৃথা। নিজের খাতার নম্বর কেউ এভাবে ভাইরাল করে দেবে, ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। এ ঘটনায় আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ঢাকা কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষার্থী তাহসিন ইসলাম বলেন, পরীক্ষার খাতা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, মনে হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ এখন টিকটকারদের হাতে। বোর্ডের উচিত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। নইলে যারা পরিশ্রম করে তারা প্রতারিত হবে।
এইচএসসি পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে এমন অনিয়ম নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন অভিভাবকরাও। এক পরীক্ষার্থীর মা মুসলিমা আক্তার বলেন, আমার ছেলেটা সারা বছর ভালো পড়েছে, মডেল টেস্টে ভালো করেছে। কিন্তু এখন শুনছি পরীক্ষার খাতার মূল্যায়নে অনিয়ম হচ্ছে, এটা খুব কষ্টের। ওদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এইচএসসির ফল। আর এবার এমনিতেই কড়াকড়িভাবে খাতা মূল্যায়নের কথা শুনেছি। সবমিলিয়ে অভিভাবক হিসেবে আমি খুব চিন্তায় আছি। উদ্বেগ জানিয়ে মিজানুর রহমান নামের আরেক অভিভাবক বলেন, আমরা সন্তানদের কষ্ট করে পড়াশোনা করাই, যাতে তারা ভালো ফল করে এগোতে পারে। কিন্তু বোর্ড যদি খাতা ঠিকভাবে মূল্যায়ন না করে, তাহলে সব পরিশ্রম বৃথা। সঠিক তদন্ত হোক, দোষীদের শাস্তি দেওয়া হোক। অভিভাবক হিসেবে আমাদের এটাই চাওয়া।
বিষয়টি নিয়ে নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর একটি সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক বলেন, বর্তমানে পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন নিয়ে যেসব অনিয়মের খবর আসছে তা শুধু হতাশাজনকই নয়, এগুলো শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা টালমাটাল করে দিচ্ছে।
অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, প্রত্যেক পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন অবশ্যই বোর্ডের নির্ধারিত নিয়ম মেনে দায়িত্বশীলতা ও সর্বোচ্চ সততার সঙ্গে সম্পন্ন হওয়া উচিত। একজন শিক্ষার্থী দীর্ঘ ১০-১২ বছর ধরে কঠোর পরিশ্রম করে একটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নেয়, যার ফল তার ভবিষ্যতের দিক নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সে কারণে তার উত্তরপত্র যেন যোগ্য ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক, যিনি নিজেই বোর্ড নির্ধারিত পরীক্ষক, তিনি সশরীরে মূল্যায়ন করেন, সেটিই প্রত্যাশিত। সেখানে সহকারী হিসেবে যদি সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা হয়, তবে তা গুরুতর নৈতিক লঙ্ঘন ও শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে।
অন্যদিকে শিক্ষা বোর্ড বলছে, শিক্ষার্থীদের দিয়ে উত্তরপত্র পূরণ করানো শুধু গোপনীয়তার লঙ্ঘনই নয়, বরং তা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেননা, পাবলিক পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নের নির্ধারিত প্রক্রিয়া রয়েছে। কেবল অনুমোদিত পরীক্ষকই খাতা খোলার ও মূল্যায়ন করার অধিকার রাখেন। প্রতিটি খাতা বোর্ড থেকে সিলগালা অবস্থায় নির্ধারিত কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া হয় এবং খোলা হয় নির্ধারিত নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে। এমসিকিউ অংশের বৃত্ত পূরণও পরীক্ষকের দায়িত্ব। সেখানে কোনো শিক্ষার্থী, এমনকি সহকারী শিক্ষকও যুক্ত হতে পারেন না। আবার নিয়ম অনুসারে, উত্তরপত্রের ওপর কোনোভাবেই শিক্ষার্থীর রোল নম্বর বা নাম থাকে না। এতে থাকে একটি নির্দিষ্ট কোড, যাতে পরিচয় গোপন থাকে এবং পক্ষপাতের সুযোগ না থাকে। খাতা মূল্যায়নের পর পরীক্ষক তা প্রধান পরীক্ষকের মাধ্যমে বোর্ডে ফেরত পাঠান। এই পুরো প্রক্রিয়া অত্যন্ত গোপনীয়, কেন্দ্রীয়ভাবে নির্ধারিত এবং নির্দিষ্ট নির্দেশিকা অনুযায়ী পরিচালিত হয়।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার বলেন, খাতা মূল্যায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরীক্ষকের বাইরে অন্য কেউ, বিশেষ করে শিক্ষার্থী বা পরিবারের সদস্য যদি বৃত্ত পূরণ করে তা গুরুতর শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এতে শিক্ষা বোর্ডের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং পরীক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে অভিযুক্ত তিন শিক্ষককে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত ছয়জনকে আমরা খুঁজে পেয়েছি। এমন ঘটনা কারা ঘটিয়েছে সেটির তদন্ত চলছে এবং খোঁজা হচ্ছে। এই ছয়জনকে নোটিশ দিয়ে এ বিষয়ে জবাব দিতে বলা হয়েছে। সেটি এলে (চিঠির জবাব) আমরা বোর্ডে মিটিংয়ে পাঠাব। সেখানে তাদের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

এইচএসসির খাতা মূল্যায়নে গোপনীয়তার চরম লঙ্ঘন

আপডেট সময় :

চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে ভয়াবহ অনিয়মের চিত্র ধরা পড়েছে। খাতা যাচাইয়ের মতো গোপনীয় দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা পরীক্ষকরা খাতার ওএমআর অংশ বা ‘বৃত্ত’ পূরণের কাজ শিক্ষার্থীদের দিয়ে করিয়েছেন। বিষয়টি সামনে এসেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিও ও স্থিরচিত্রের মাধ্যমে। আবার এ নিয়ে প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে বেশ কয়েকজন পরীক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা। বোর্ড থেকে জানানো হয়েছে, ২০২৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র (বিষয় কোড-১০৮), উচ্চতর গণিত (বিষয় কোড-১২৬) এবং বাংলা দ্বিতীয় পত্রের (বিষয় কোড-১০২) খাতা মূল্যায়নে অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে।
এ নিয়ে অভিযুক্ত পরীক্ষকরা হলেন, রাজধানীর ডেমরার রোকেয়া আহসান কলেজের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক মুরছানা আক্তার, মোহাম্মদপুরের সেন্ট যোসেফস হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের উচ্চতর গণিতের শিক্ষক মহসীন আলামীন, যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ের পরীক্ষক মো. সাখাওয়াত হোসাইন আকন, রাজবাড়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পরীক্ষক সমীরময় মন্ডল, নবাবগঞ্জের মুন্সীনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিক এবং গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার আনসার ভিডিপি স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা বিষয়ের প্রভাষক মো. রাকিবুল হাসান। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে বোর্ড পরীক্ষার খাতা নিয়ে নিয়মবহির্ভূত যে ঘটনা ঘটছে তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মজা, বিদ্রুপ ও হাস্যরসের উপস্থাপন পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলছে। টিকটক, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম ঘাঁটলেই দেখা যাচ্ছে– খাতা কাটছেন শিক্ষার্থীরাই, কেউ আবার খাতা হাতে বসে খিচুড়ি, লুচি, পরোটা খাচ্ছেন। যেখানে একপাশে রাখা খাতা, আরেক পাশে চাটনি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা নিজেরাই খাতার ওএমআর অংশ (বৃত্ত) পূরণ করছেন। কোথাও কোথাও একাধিক শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে বসে খাতা পূরণ করতে দেখা গেছে। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ছবি শেয়ার করে এক শিক্ষার্থী ক্যাপশন দিয়েছেন– ‘বোর্ডের খাতা কাটছে টিকটকার’। আরেকজন লিখেছেন– ‘তোমাদের খাতা এখন আমাদের হাতে’। কেউ কেউ আবার ফল নিয়েও মজা করে লিখেছেন— ‘কে ভাই এইটা ৯২ পাইছে’। এসব পোস্ট এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যা নিয়ে বোর্ড পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে বিশ্বাসযোগ্যতা ও সার্বিক মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এ অবস্থায় উদ্বেগ, হতাশা আর অনিশ্চয়তায় ভুগছেন ২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষার খাতার গোপনীয়তা লঙ্ঘনের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর তারা প্রশ্ন তুলছেন কেন্দ্রীয় পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের যথাযথ পদ্ধতি ও বোর্ডের নজরদারি নিয়ে।
রাজধানীর একটি সরকারি কলেজের মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী সামিয়া আক্তার বলেন, যে পরিশ্রমটা করেছি, সেটা যদি সঠিকভাবে মূল্যায়নই না হয়, তাহলে তো সবই বৃথা। নিজের খাতার নম্বর কেউ এভাবে ভাইরাল করে দেবে, ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। এ ঘটনায় আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ঢাকা কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষার্থী তাহসিন ইসলাম বলেন, পরীক্ষার খাতা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, মনে হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ এখন টিকটকারদের হাতে। বোর্ডের উচিত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। নইলে যারা পরিশ্রম করে তারা প্রতারিত হবে।
এইচএসসি পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে এমন অনিয়ম নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন অভিভাবকরাও। এক পরীক্ষার্থীর মা মুসলিমা আক্তার বলেন, আমার ছেলেটা সারা বছর ভালো পড়েছে, মডেল টেস্টে ভালো করেছে। কিন্তু এখন শুনছি পরীক্ষার খাতার মূল্যায়নে অনিয়ম হচ্ছে, এটা খুব কষ্টের। ওদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এইচএসসির ফল। আর এবার এমনিতেই কড়াকড়িভাবে খাতা মূল্যায়নের কথা শুনেছি। সবমিলিয়ে অভিভাবক হিসেবে আমি খুব চিন্তায় আছি। উদ্বেগ জানিয়ে মিজানুর রহমান নামের আরেক অভিভাবক বলেন, আমরা সন্তানদের কষ্ট করে পড়াশোনা করাই, যাতে তারা ভালো ফল করে এগোতে পারে। কিন্তু বোর্ড যদি খাতা ঠিকভাবে মূল্যায়ন না করে, তাহলে সব পরিশ্রম বৃথা। সঠিক তদন্ত হোক, দোষীদের শাস্তি দেওয়া হোক। অভিভাবক হিসেবে আমাদের এটাই চাওয়া।
বিষয়টি নিয়ে নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর একটি সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক বলেন, বর্তমানে পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন নিয়ে যেসব অনিয়মের খবর আসছে তা শুধু হতাশাজনকই নয়, এগুলো শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা টালমাটাল করে দিচ্ছে।
অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, প্রত্যেক পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন অবশ্যই বোর্ডের নির্ধারিত নিয়ম মেনে দায়িত্বশীলতা ও সর্বোচ্চ সততার সঙ্গে সম্পন্ন হওয়া উচিত। একজন শিক্ষার্থী দীর্ঘ ১০-১২ বছর ধরে কঠোর পরিশ্রম করে একটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নেয়, যার ফল তার ভবিষ্যতের দিক নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সে কারণে তার উত্তরপত্র যেন যোগ্য ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক, যিনি নিজেই বোর্ড নির্ধারিত পরীক্ষক, তিনি সশরীরে মূল্যায়ন করেন, সেটিই প্রত্যাশিত। সেখানে সহকারী হিসেবে যদি সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা হয়, তবে তা গুরুতর নৈতিক লঙ্ঘন ও শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে।
অন্যদিকে শিক্ষা বোর্ড বলছে, শিক্ষার্থীদের দিয়ে উত্তরপত্র পূরণ করানো শুধু গোপনীয়তার লঙ্ঘনই নয়, বরং তা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেননা, পাবলিক পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নের নির্ধারিত প্রক্রিয়া রয়েছে। কেবল অনুমোদিত পরীক্ষকই খাতা খোলার ও মূল্যায়ন করার অধিকার রাখেন। প্রতিটি খাতা বোর্ড থেকে সিলগালা অবস্থায় নির্ধারিত কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া হয় এবং খোলা হয় নির্ধারিত নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে। এমসিকিউ অংশের বৃত্ত পূরণও পরীক্ষকের দায়িত্ব। সেখানে কোনো শিক্ষার্থী, এমনকি সহকারী শিক্ষকও যুক্ত হতে পারেন না। আবার নিয়ম অনুসারে, উত্তরপত্রের ওপর কোনোভাবেই শিক্ষার্থীর রোল নম্বর বা নাম থাকে না। এতে থাকে একটি নির্দিষ্ট কোড, যাতে পরিচয় গোপন থাকে এবং পক্ষপাতের সুযোগ না থাকে। খাতা মূল্যায়নের পর পরীক্ষক তা প্রধান পরীক্ষকের মাধ্যমে বোর্ডে ফেরত পাঠান। এই পুরো প্রক্রিয়া অত্যন্ত গোপনীয়, কেন্দ্রীয়ভাবে নির্ধারিত এবং নির্দিষ্ট নির্দেশিকা অনুযায়ী পরিচালিত হয়।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার বলেন, খাতা মূল্যায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরীক্ষকের বাইরে অন্য কেউ, বিশেষ করে শিক্ষার্থী বা পরিবারের সদস্য যদি বৃত্ত পূরণ করে তা গুরুতর শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এতে শিক্ষা বোর্ডের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং পরীক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে অভিযুক্ত তিন শিক্ষককে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত ছয়জনকে আমরা খুঁজে পেয়েছি। এমন ঘটনা কারা ঘটিয়েছে সেটির তদন্ত চলছে এবং খোঁজা হচ্ছে। এই ছয়জনকে নোটিশ দিয়ে এ বিষয়ে জবাব দিতে বলা হয়েছে। সেটি এলে (চিঠির জবাব) আমরা বোর্ডে মিটিংয়ে পাঠাব। সেখানে তাদের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।