এখনো সুরাহা হয়নি নির্বাচন পদ্বতি

- আপডেট সময় : ৫৪ বার পড়া হয়েছে
বিশ্বের ১৭০টি দেশের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশসহ ৯১টি দেশে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনীব্যবস্থা চালু রয়েছে
আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন পদ্বতিতে হবে এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলছে ব্যাপক আলোচনা। সংস্কারের আলাপে এই বিষয়টি নিয়ে রাজনীতির মাঠে গরম হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন থেকেই নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের দাবি উঠেছে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই দাবি আরও জোরালো হয়ে উঠে। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে এ পদ্ধতির পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা করছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রচলিত পদ্ধতিতেই নাকি সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি স্থান পাবে সেটি এখনো পরিষ্কার হয়নি।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই প্রচলিত পদ্ধতিতেই ভোট হয় এবং এটিই এখন পর্যন্ত তুলনামূলক জনপ্রিয় পদ্ধতি। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) অর্থাৎ এই সময়ের রাজনীতিতে বিএনপির বাইরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলগুলো এই প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে সংখ্যানুপাতিক বা প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন সংক্ষেপে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি তুলছে।
নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। তবে বড় একটি রাজনৈতিক দলের আপত্তিতে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা আদৌ সম্ভব হবে কি না সেটি নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। তবে সব দল রাজি হলে এরকম একটি ব্যবস্থার ব্যাপারে কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বিশ্বের যেসব দেশে এই পদ্ধতিতে ভোট হচ্ছে, তার উদাহরণ টেনে বিশ্লেষকরা বলছেন, শীঘ্রই চালু না হলেও ধীরে ধীরে আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোটের পথে হাঁটতে পারে বাংলাদেশ।
বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের ১৭০টি দেশের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশসহ ৯১টি দেশে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনীব্যবস্থা চালু রয়েছে। তবে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে হলে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে। এজন্য সংবিধান সংস্কার কমিশনকে উদ্যোগ নিতে হবে। এরপর সে অনুযায়ী নির্বাচনী আইন-কানুনেও পরিবর্তন আনতে হবে। তবে নির্বাচন পদ্ধতি বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন; তা না হলে সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন বিপাকে পড়বে।
আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা কী? আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থার এমন একটি পদ্ধতি যেখানে আসন বণ্টন হয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, যদি কোন দল মোট প্রদত্ত ভোটের শতকরা ১০ শতাংশ পায়, তাহলে সেই দল আনুপাতিক হারে সংসদের ১০ শতাংশ বা ৩০টি আসন পাবেন। পিআর বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে মুক্ত, গোপন ও মিশ্র তিনটি আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, কোনো দল নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পাবে, সংসদে তারা সেই আনুপাতে আসন পাবে, নির্বাচনের এই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি যদি চালু হয় তাহলে তা সুশাসন নিশ্চিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ পদ্ধতিতে একটি নির্বাচনে দেওয়া প্রত্যেকটি ভোট কাজে লাগে এবং প্রতিটি ভোট সংসদে সমানভাবে প্রতিনিধিত্ব করে।
বর্তমান দেশের সংসদীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় ৩০০টি আসনে আলাদা আলাদা প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে রাজনৈতিক দলগুলো। উদাহরণ হিসেবে- বর্তমান পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে একটি আসনে মোট চারজন প্রার্থী চারটি দল থেকে নির্বাচন করছে। এই নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৮৫ শতাংশ। এর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তিনজন প্রার্থীই ২০ শতাংশ হারে ভোট পেল। আর চতুর্থ প্রার্থী পেল ২৫ শতাংশ ভোট। বর্তমান পদ্ধতি অনুযায়ী চতুর্থ প্রার্থীই এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। আর তিনটি দলের ৬০ শতাংশ ভোট তেমন কোনো কাজে আসছে না।
একইভাবে সারাদেশের অন্তত ২৯০ আসনে যদি একই হারে ভোট পেয়ে চতুর্থ দলটির প্রার্থীরা জয়লাভ করে, তাহলে মাত্র ২৫ শতাংশ ভোট নিয়ে তারা সরকার গঠনসহ সংসদে একচ্ছত্র আধিপত্য করবে। অথচ বাকি তিন দল মিলে ৬০ শতাংশ ভোট পেলেও তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকছে না সংসদে। এতে সংসদে প্রতিনিধিত্বমূলক অংশগ্রহণ থাকে না।
নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলেন, এই পদ্ধতিতে ভোট হলে নিজস্ব ভোট ব্যাংকে কাজে লাগিয়ে বা স্থানীয় ইমেজ কাজে লাগিয়ে কেউ জিতে সরকার গঠন করতে পারে। সেক্ষেত্রে অনেক সময় মেজরিটি ভোটের মতের প্রতিফলন হয় না। আর আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি ভোটের আগে প্রতিটি দল ক্রম ভিত্তিতে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল তার প্রাপ্ত ভোটের হার অনুসারে আসন সংখ্যা পাবে।
একাধিক রাজনৈতিক ও নির্বাচন বিশ্লেষক তাদের মতামত তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হলে এই (আনুপাতিক) পদ্ধতিতে ভোট চালু করা যায়। সেক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতিতে কী কী লাভ হয়েছে সেটি বিশ্লেষণ করে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব। তবে এটা চালু করতে হলে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে। তবে সেটি খুব কঠিন কিছু নয়। এই পদ্ধতির কিছু ত্রুটিপূর্ণ দিক তুলে ধরে এই সংকটকে ভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করেছেন কিছু বিশ্লেষক। তাঁদের মতে, এই পিআর পদ্ধতিতে ভোটে যে সরকার গঠন হয়, সেটি স্থিতিশীল হয় না। কারণ এই পদ্ধতিতে ভোট হলে এ দেশে কোনো রাজনৈতিক দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবে না। যে কারণে আনুপাতিক নির্বাচন করতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যেই জোর দিচ্ছেন তারা।
রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি ও সম্মতি ঃ জনপরিসরে নতুন নির্বাচন পদ্ধতি চালু করার বিষয়ে আলোচনা শুরু হলেও অন্তর্বর্তী সরকার এখনো এ বিষয়ে তাদের চিন্তার কথা জানায়নি। সংবিধান সংস্কার কমিশন এবং নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সবে কাজ শুরু করেছে। তাদের প্রস্তাবে বিষয়টি আসবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
সম্প্রতি দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে রাজধানীতে একটি সেমিনার আয়োজন করা হয়। সেই সেমিনারে বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টিসহ দেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন বিশ্লেষকরা উপস্থিত ছিলেন। এই সেমিনারে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বড় অংশ বিদ্যমান পদ্ধতির পরিবর্তে আনুপাতিক পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে মত দেন।
ওই দলগুলোর মধ্যে অনেক দলই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সংলাপে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা চালুরও দাবি জানিয়ে আসছিল। এই পদ্ধতিতে মধ্য ও ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য থাকলেও এ নিয়ে আপত্তি আছে অন্যতম বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপির। দলটি শুরু থেকেই বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থাকে সমর্থন করে আসছে জাতীয় নির্বাচনে। আরেকটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে অবশ্য এসব সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
আগামী সংসদ নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে আসা প্রস্তাব সম্পর্কে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একটি অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, আজকে অনেকে বলেন, সংখ্যানুপাতিক অনুযায়ী নাকি সংসদে আসন থাকতে হবে! আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সংসদীয় আসন অনুযায়ী নির্বাচন হয়ে আসছে। এখানে কেউ চাইলে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চাপিয়ে দিতে পারবে না। এ বিষয়ে জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির (পিআর) নির্বাচন ব্যবস্থার দাবি জানিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেছেন, এ পদ্ধতি চালু হলে কোন দল এভাবে স্বৈরাচার হওয়ার সুযোগ পাবে না। বর্তমান রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন সিভিল সোসাইটিও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিও তুলেছেন।
সম্প্রতি ‘নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কেমন চাই’ শীর্ষক এক সেমিনারে বিএনপি সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির বিপক্ষে তাদের অবস্থা তুলে ধরলেও জামায়াতে ইসলামী, সিপিবি, জাতীয় পার্টি, এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন ও গণঅধিকার পরিষদের প্রতিনিধিরা পক্ষে বক্তব্য দেন। এ ছাড়া সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীও তাদের সংস্কার প্রস্তাবে সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থার কথা বলেছে।
এ বিষয়ে নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু বিএনপি না, অতীতে এই প্রস্তাব আসলেও বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো বড় দুটি দল না চাওয়াতে এই পদ্ধতি চালু হয়নি। এই ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করতে যদি বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল ও জনমতের চাপ থাকে তাহলে দু’একটি রাজনৈতিক দল না চাইলেও এই ব্যবস্থায় ভোট করা সম্ভব। তবে রাজনৈতিক মতৈক্য তৈরি করতে না পারলে এই পদ্ধতির প্রচলন করা কঠিন হতে পারে।