ঢাকা ০৬:৩৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম ::
Logo জুলাই পুনর্জাগরণ উপলক্ষে মুক্তাগাছায় পরিচ্ছন্নতা অভিযান Logo স্ত্রীর ধোঁকায় যুবকের আত্মহনন Logo শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে মাসিক আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত Logo রাজবাড়ীতে যুবককে কুপিয়ে হত্যা মামলায় দুই আসামির যাবজ্জীবন Logo মাছরাঙা টেলিভিশনের বান্দরবানে ১৪তম বর্ষপূর্তি উদযাপন Logo ভাণ্ডারিয়ায় শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট বিতরণ Logo নগরকান্দা উপজেলায় আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভা অনুষ্ঠিত Logo কমিউনিটিভিত্তিক মডেলে মাঠ ও পার্ক ব্যবস্থাপনা করবে ডিএনসিসি Logo দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক ২ জেলা প্রশাসকসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান Logo শিবগঞ্জে নদীগর্ভে প্রায় ৮০টি বাড়ি, ঝুকিতে শতাধিক পরিবার

এনবিআর কর্মকর্তারা পেতে চান গণক্ষমা

স্টাফ রিপোর্টার
  • আপডেট সময় : ১১৬ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

আন্দোলন এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য। একসময় বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে যারা দর কষাকষি করতেন, এখন তারা দিন কাটাচ্ছেন বহিষ্কার আর দুদক আতঙ্কে। সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর এখন তাদের বোধোদয় হয়েছে- আন্দোলন করা ভুল ছিল। এরই মধ্যে কেউ কেউ ‘গণক্ষমা’ চাওয়ার বিষয়ও ভাবছেন। গত কয়েকদিনে এনবিআরের ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। একই সময়ে ৬ কর্মকর্তাকে বদলি এবং ৫ কর্মকর্তাকে সাময়িক বহিষ্কার ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে এনবিআর। এসব ঘটনায় আতঙ্ক বিরাজ করছে এনবিআরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে।
কেউ কেউ বলছেন, এনবিআর বিলুপ্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনে জড়িয়ে কঠিন শাস্তির মুখে পড়েছেন তারা। চাকরি বাঁচাতে এরই মধ্যে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন কয়েকজন। কেউ আবার যোগাযোগ করছেন চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে। অধিকাংশ কর্মকর্তাই আন্দোলনকে ভুল আখ্যা দিয়ে চেয়ারম্যানের কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এনবিআরের যৌক্তিক সংস্কার ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবিতে প্রথমে মে মাসে ও দ্বিতীয় দফায় জুনের শেষ সপ্তাহে আন্দোলন করেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। সারাদেশের কাস্টম অফিস, বন্দর বন্ধ রেখে গত ২৮ ও ২৯ জুন কমপ্লিট শাটডাউন ও মার্চ টু এনবিআর কর্মসূচি পালন করেন তারা। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে পালন করা হয় এসব কর্মসূচি। পরে ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতায় গত ২৯ জুন আন্দোলন স্থগিত করে এনবিআর ঐক্য পরিষদ।
এরপর যেন হঠাৎ করেই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। ২৯ জুন থেকে ৩ জুলাই (৫ দিনে) এনবিআরের ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই ১৬ জনের মধ্যে ১০ জন এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সদস্য। বাকিদেরও আন্দোলনে অংশ নিতে দেখা গেছে। ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও তিন মুখপাত্রকে দুদকের জালে আটকানোর বিষয়টি ভালো চোখে দেখছেন না এনবিআর কর্মকর্তারা। দুদক বলছে, যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কর ও শুল্ক আদায়ের ক্ষেত্রে মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে করদাতাদের কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব কর্মকর্তার কারণে প্রতিবছর সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে- এমন অভিযোগ আনা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা ঘুষ না পেয়ে কর ফাঁকি দেওয়ার মিথ্যা মামলা করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিককে হয়রানি করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে দুদকের কাছে। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার (৩ ও ৪ জুলাই) এনবিআর ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ কর্মকর্তা গণমাধ্যম এড়িয়ে চলছেন। কেউ কেউ ফোন বন্ধ রেখেছেন। এনবিআর কর্মকর্তাদের নিজস্ব গ্রুপ ও আন্দোলনের বিভিন্ন গ্রুপ থেকে লিভ নিয়েছেন অনেকেই। সবার মধ্যেই অজানা আতঙ্ক। বড় কর্তাদের (ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা) বিদায়ের খবরে অনেকেরই মন ভেঙেছে।
দুই দিনে এনবিআরের একজন মহাপরিচালক, কয়েকজন দ্বিতীয় সচিব, একজন সদস্যসহ একডজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ। সবাই একমত যে রাজস্ব প্রশাসনে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। কার কখন বদলি, বহিষ্কার কিংবা দুদকের অনুসন্ধানের খবর আসবে- এমন চিন্তা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব কর্মকর্তার কেউ কেউ স্বীকার করেছেন, অর্থবছরের শেষ সময়ে আন্দোলন করা ভুল ছিল। অর্থনীতির ব্লাড লাইন পোর্ট অচল করাও সঠিক হয়নি।
এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাড়ি থেকে বোনকে ঢাকায় এনেছি। তাকে সব বুঝিয়ে বলেছি। আমার চাকরি গেলে বা দুদকের অনুসন্ধান শুরু হলে যাতে বিচলিত না হয়। এটা বাবা-মাকে বুঝিয়ে বলতে বলেছি। শুনেছি ২৬ জনের তালিকা হয়েছে, সবাইকে বরখাস্ত করবে। এরপর আরও ৫০ জনকে শাস্তি দেওয়া হবে। একজন দ্বিতীয় সচিব বলেন, ‘বিপদে আছি। একবার শুনছি তালিকায় নাম আছে, আবার শুনছি কেউ একজন আমার নাম কাটিয়েছে। শাস্তি হিসেবে যাদের অবসরে পাঠানো হয়েছে তারা অত্যন্ত মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তা। কী করবো বুঝতেছি না। আমরা কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি চেয়ারম্যানের কাছে ক্ষমা চাইবো। ভুল তো সবাই করে। মহাপরিচালক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি আন্দোলনে ছিলাম না। আন্দোলনের গ্রুপে আমাকে কেউ যুক্ত করেছে। এখন খুবই টেনশন হচ্ছে। আরেক কর্মকর্তা বলেন, বদলির আদেশ আর দুদকের অনুসন্ধানের ভয়ের চেয়ে বহিষ্কার ভালো। পরে আপিল করে চাকরি ফেরত পাবো। দুদক ধরলে পরিবার সমাজে বিব্রত হবে। এখন সবকিছুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছি। ান্দোলন প্রত্যাহারের এক সপ্তাহ না যেতেই পাঁচ সিনিয়র কর্মকর্তাকে বরখাস্ত ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। দুদক এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছে আরও জ্যেষ্ঠ ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। গত ৩ জুলাই দুই কমিশনারসহ ৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। তারা হলেন- ঢাকা পূর্বের কমিশনার (কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট) কাজী মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, বেনাপোল স্থলবন্দরের কমিশনার মো. কামরুজ্জামান, উপ কর কমিশনার মো. মামুন মিয়া, অতিরিক্ত কর কমিশনার (আয়কর গোয়েন্দা ইউনিট) সেহেলা সিদ্দিকা ও কর অঞ্চল-২ এর কর পরিদর্শক লোকমান আহমেদ। সেহেলা সিদ্দিকা পরিষদের মুখপাত্র হিসেবে গণমাধ্যমে কথা বলেছেন। কর পরিদর্শক লোকমান আহমেদও ঐক্য পরিষদের সদস্য। এর আগে গত ১ জুলাই ৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে তারা হলেন- অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল রশীদ মিয়া, সদস্য লুতফুল আজীম, সিআইসির সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন, উপ কর কমিশনার মোহাম্মদ শিহাবুল ইসলাম ও যুগ্ম কমিশনার মো. তারেক হাছান। এদের মধ্যে শিহাবুল ইসলাম, মো. তারেক হাছান, আব্দুল রশীদ মিয়া এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সদস্য। এছাড়া গত ২৯ জুন এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতিসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে তারা হলেন- এনবিআরের সদস্য (আয়কর নীতি) এ কে এম বদিউল আলম, অতিরিক্ত কর কমিশনার ও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সিনিয়র সহ-সভাপতি মির্জা আশিক রানা, যুগ্ম কর কমিশনার ও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দীন খান, যুগ্ম কর কমিশনার ও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সহ-সভাপতি মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা, অতিরিক্ত কমিশনার ও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি হাছান তারেক রিকাবদার ও অতিরিক্ত কমিশনার ও সংস্কার ঐক্য পরিষদের সদস্য সাধন কুমার কুন্ডু। এদের মধ্যে পাঁচজনই এনবিআরের ‘শাটডাউন’ কর্মসূচির নেতৃত্বে ছিলেন। দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, এনবিআরের অনেক কর্মকর্তার বিষয়ে অনুসন্ধান করছে দুদক। চলমান অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে দুদক এই অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে সরকারের কোনো চাপ নেই। দুদকের অনুসন্ধানের সমালোচনা করে এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, এতদিন দুদকের অনুসন্ধান করার কথা মনে ছিল না। করুক অনুসন্ধান, কিছুই পাবে না। কিন্তু সমাজে আমাদের ইমেজ খারাপ হবে। দিন শেষে এনবিআরের ক্ষতি হবে। শুধু দুদকের তদন্ত নয়, গত কয়েক দিনে এনবিআরের এক কমিশনার ও চার সদস্যকে শাস্তির আওতায় এনেছে সরকার। এছাড়া ২৮ ও ২৯ জুন কারা কারা কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন তাদের তালিকা চাওয়া হয়েছে।
গত ১ জুলাই চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ‘সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে শুল্ক কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার’। পরদিন ২ জুলাই অবসরে পাঠানো হয় এনবিআরের চার সদস্য- ড. মো. আবদুর রউফ (মূসক নীতি), হোসেন আহমদ (শুল্ক নীতি ও আইসিটি), আলমগীর হোসেন (কর) এবং বরিশাল কর অঞ্চলের কমিশনার শাব্বির আহমেদকে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) থেকে পৃথক আদেশে বলা হয়েছে- সংশ্লিষ্টদের চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় ‘জনস্বার্থে’ তাদের ‘সরকারি চাকরি আইন ২০১৮’-এর ৪৫ ধারায় অবসরে পাঠানো হলো। তারা অবসরকালীন সব সুবিধা পাবেন। এর আগে ২১ ও ২২ জুন বদলি করা হয় ৬ কর্মকর্তাকে। তখন ঐক্য পরিষদ জানায়- আন্দোলনের জেরেই এসব কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। যদিও এসব ঘটনার জন্য এনবিআর চেয়ারম্যানকে দায়ী করছেন আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী অনেকে। তবে এসব বিষয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেননি এনবিআর চেয়ারম্যান। গত ৩ জুলাই ঢাকার কাস্টম হাউজ পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার কথা ছিল এনবিআর চেয়ারম্যানের। অনিবার্য কারণ দেখিয়ে ওই পরিদর্শনের আসেননি তিনি। আন্দোলন শেষ হওয়ার পর গত ৩০ জুন এনবিআর চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের বলেন, আন্দোলনের কারণে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম হোঁচট খেয়েছে। এখন সব ভুলে গিয়ে দেশের স্বার্থে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
এসব বিষয়ে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, এনবিআর চেয়ারম্যান ও অর্থ উপদেষ্টাকে চিঠি দিতে যাচ্ছি- পরিস্থিতি যেন আরও খারাপ না হয়। অসৎ কর্মকর্তাদের বাদ দিতে হবে, তবে আগে কাঠামোগত সংস্কার দরকার।
গত ১২ মে মধ্যরাতে এনবিআর বিলুপ্ত করে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এর বিরুদ্ধে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের কর্মসূচির ফলে সরকার গত ২৫ মে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে এনবিআর বিলুপ্ত না করার বিষয় জানায়। বরং এটিকে সরকারের একটি স্বতন্ত্র ও বিশেষায়িত বিভাগের মর্যাদায় আরও শক্তিশালী করা, রাজস্ব নীতি প্রণয়ণের লক্ষ্যে আলাদা একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গঠন এবং প্রয়োজনীয় সব সংশোধনের আগপর্যন্ত জারি করা অধ্যাদেশ কার্যকর করা হবে না বলে জানানো হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে ঐক্য পরিষদ তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর কাজে যোগ দিলেও আন্দোলনকারীরা এনবিআর চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবিতে অটল থাকেন এবং সংস্থার কার্যালয়ে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। পরে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নিরাপত্তায় অফিসে ফেরেন এনবিআর চেয়ারম্যান। পরে ২৯ জুন রাজস্ব সংস্কারে উপদেষ্টা কমিটি গঠনের পর আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

এনবিআর কর্মকর্তারা পেতে চান গণক্ষমা

আপডেট সময় :

আন্দোলন এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য। একসময় বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে যারা দর কষাকষি করতেন, এখন তারা দিন কাটাচ্ছেন বহিষ্কার আর দুদক আতঙ্কে। সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর এখন তাদের বোধোদয় হয়েছে- আন্দোলন করা ভুল ছিল। এরই মধ্যে কেউ কেউ ‘গণক্ষমা’ চাওয়ার বিষয়ও ভাবছেন। গত কয়েকদিনে এনবিআরের ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। একই সময়ে ৬ কর্মকর্তাকে বদলি এবং ৫ কর্মকর্তাকে সাময়িক বহিষ্কার ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে এনবিআর। এসব ঘটনায় আতঙ্ক বিরাজ করছে এনবিআরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে।
কেউ কেউ বলছেন, এনবিআর বিলুপ্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনে জড়িয়ে কঠিন শাস্তির মুখে পড়েছেন তারা। চাকরি বাঁচাতে এরই মধ্যে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন কয়েকজন। কেউ আবার যোগাযোগ করছেন চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে। অধিকাংশ কর্মকর্তাই আন্দোলনকে ভুল আখ্যা দিয়ে চেয়ারম্যানের কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এনবিআরের যৌক্তিক সংস্কার ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবিতে প্রথমে মে মাসে ও দ্বিতীয় দফায় জুনের শেষ সপ্তাহে আন্দোলন করেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। সারাদেশের কাস্টম অফিস, বন্দর বন্ধ রেখে গত ২৮ ও ২৯ জুন কমপ্লিট শাটডাউন ও মার্চ টু এনবিআর কর্মসূচি পালন করেন তারা। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে পালন করা হয় এসব কর্মসূচি। পরে ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতায় গত ২৯ জুন আন্দোলন স্থগিত করে এনবিআর ঐক্য পরিষদ।
এরপর যেন হঠাৎ করেই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। ২৯ জুন থেকে ৩ জুলাই (৫ দিনে) এনবিআরের ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই ১৬ জনের মধ্যে ১০ জন এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সদস্য। বাকিদেরও আন্দোলনে অংশ নিতে দেখা গেছে। ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও তিন মুখপাত্রকে দুদকের জালে আটকানোর বিষয়টি ভালো চোখে দেখছেন না এনবিআর কর্মকর্তারা। দুদক বলছে, যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কর ও শুল্ক আদায়ের ক্ষেত্রে মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে করদাতাদের কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব কর্মকর্তার কারণে প্রতিবছর সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে- এমন অভিযোগ আনা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা ঘুষ না পেয়ে কর ফাঁকি দেওয়ার মিথ্যা মামলা করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিককে হয়রানি করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে দুদকের কাছে। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার (৩ ও ৪ জুলাই) এনবিআর ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ কর্মকর্তা গণমাধ্যম এড়িয়ে চলছেন। কেউ কেউ ফোন বন্ধ রেখেছেন। এনবিআর কর্মকর্তাদের নিজস্ব গ্রুপ ও আন্দোলনের বিভিন্ন গ্রুপ থেকে লিভ নিয়েছেন অনেকেই। সবার মধ্যেই অজানা আতঙ্ক। বড় কর্তাদের (ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা) বিদায়ের খবরে অনেকেরই মন ভেঙেছে।
দুই দিনে এনবিআরের একজন মহাপরিচালক, কয়েকজন দ্বিতীয় সচিব, একজন সদস্যসহ একডজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ। সবাই একমত যে রাজস্ব প্রশাসনে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। কার কখন বদলি, বহিষ্কার কিংবা দুদকের অনুসন্ধানের খবর আসবে- এমন চিন্তা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব কর্মকর্তার কেউ কেউ স্বীকার করেছেন, অর্থবছরের শেষ সময়ে আন্দোলন করা ভুল ছিল। অর্থনীতির ব্লাড লাইন পোর্ট অচল করাও সঠিক হয়নি।
এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাড়ি থেকে বোনকে ঢাকায় এনেছি। তাকে সব বুঝিয়ে বলেছি। আমার চাকরি গেলে বা দুদকের অনুসন্ধান শুরু হলে যাতে বিচলিত না হয়। এটা বাবা-মাকে বুঝিয়ে বলতে বলেছি। শুনেছি ২৬ জনের তালিকা হয়েছে, সবাইকে বরখাস্ত করবে। এরপর আরও ৫০ জনকে শাস্তি দেওয়া হবে। একজন দ্বিতীয় সচিব বলেন, ‘বিপদে আছি। একবার শুনছি তালিকায় নাম আছে, আবার শুনছি কেউ একজন আমার নাম কাটিয়েছে। শাস্তি হিসেবে যাদের অবসরে পাঠানো হয়েছে তারা অত্যন্ত মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তা। কী করবো বুঝতেছি না। আমরা কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি চেয়ারম্যানের কাছে ক্ষমা চাইবো। ভুল তো সবাই করে। মহাপরিচালক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি আন্দোলনে ছিলাম না। আন্দোলনের গ্রুপে আমাকে কেউ যুক্ত করেছে। এখন খুবই টেনশন হচ্ছে। আরেক কর্মকর্তা বলেন, বদলির আদেশ আর দুদকের অনুসন্ধানের ভয়ের চেয়ে বহিষ্কার ভালো। পরে আপিল করে চাকরি ফেরত পাবো। দুদক ধরলে পরিবার সমাজে বিব্রত হবে। এখন সবকিছুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছি। ান্দোলন প্রত্যাহারের এক সপ্তাহ না যেতেই পাঁচ সিনিয়র কর্মকর্তাকে বরখাস্ত ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। দুদক এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছে আরও জ্যেষ্ঠ ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। গত ৩ জুলাই দুই কমিশনারসহ ৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। তারা হলেন- ঢাকা পূর্বের কমিশনার (কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট) কাজী মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, বেনাপোল স্থলবন্দরের কমিশনার মো. কামরুজ্জামান, উপ কর কমিশনার মো. মামুন মিয়া, অতিরিক্ত কর কমিশনার (আয়কর গোয়েন্দা ইউনিট) সেহেলা সিদ্দিকা ও কর অঞ্চল-২ এর কর পরিদর্শক লোকমান আহমেদ। সেহেলা সিদ্দিকা পরিষদের মুখপাত্র হিসেবে গণমাধ্যমে কথা বলেছেন। কর পরিদর্শক লোকমান আহমেদও ঐক্য পরিষদের সদস্য। এর আগে গত ১ জুলাই ৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে তারা হলেন- অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল রশীদ মিয়া, সদস্য লুতফুল আজীম, সিআইসির সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন, উপ কর কমিশনার মোহাম্মদ শিহাবুল ইসলাম ও যুগ্ম কমিশনার মো. তারেক হাছান। এদের মধ্যে শিহাবুল ইসলাম, মো. তারেক হাছান, আব্দুল রশীদ মিয়া এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সদস্য। এছাড়া গত ২৯ জুন এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতিসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে তারা হলেন- এনবিআরের সদস্য (আয়কর নীতি) এ কে এম বদিউল আলম, অতিরিক্ত কর কমিশনার ও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সিনিয়র সহ-সভাপতি মির্জা আশিক রানা, যুগ্ম কর কমিশনার ও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দীন খান, যুগ্ম কর কমিশনার ও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সহ-সভাপতি মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা, অতিরিক্ত কমিশনার ও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি হাছান তারেক রিকাবদার ও অতিরিক্ত কমিশনার ও সংস্কার ঐক্য পরিষদের সদস্য সাধন কুমার কুন্ডু। এদের মধ্যে পাঁচজনই এনবিআরের ‘শাটডাউন’ কর্মসূচির নেতৃত্বে ছিলেন। দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, এনবিআরের অনেক কর্মকর্তার বিষয়ে অনুসন্ধান করছে দুদক। চলমান অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে দুদক এই অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে সরকারের কোনো চাপ নেই। দুদকের অনুসন্ধানের সমালোচনা করে এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, এতদিন দুদকের অনুসন্ধান করার কথা মনে ছিল না। করুক অনুসন্ধান, কিছুই পাবে না। কিন্তু সমাজে আমাদের ইমেজ খারাপ হবে। দিন শেষে এনবিআরের ক্ষতি হবে। শুধু দুদকের তদন্ত নয়, গত কয়েক দিনে এনবিআরের এক কমিশনার ও চার সদস্যকে শাস্তির আওতায় এনেছে সরকার। এছাড়া ২৮ ও ২৯ জুন কারা কারা কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন তাদের তালিকা চাওয়া হয়েছে।
গত ১ জুলাই চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ‘সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে শুল্ক কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার’। পরদিন ২ জুলাই অবসরে পাঠানো হয় এনবিআরের চার সদস্য- ড. মো. আবদুর রউফ (মূসক নীতি), হোসেন আহমদ (শুল্ক নীতি ও আইসিটি), আলমগীর হোসেন (কর) এবং বরিশাল কর অঞ্চলের কমিশনার শাব্বির আহমেদকে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) থেকে পৃথক আদেশে বলা হয়েছে- সংশ্লিষ্টদের চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় ‘জনস্বার্থে’ তাদের ‘সরকারি চাকরি আইন ২০১৮’-এর ৪৫ ধারায় অবসরে পাঠানো হলো। তারা অবসরকালীন সব সুবিধা পাবেন। এর আগে ২১ ও ২২ জুন বদলি করা হয় ৬ কর্মকর্তাকে। তখন ঐক্য পরিষদ জানায়- আন্দোলনের জেরেই এসব কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। যদিও এসব ঘটনার জন্য এনবিআর চেয়ারম্যানকে দায়ী করছেন আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী অনেকে। তবে এসব বিষয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেননি এনবিআর চেয়ারম্যান। গত ৩ জুলাই ঢাকার কাস্টম হাউজ পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার কথা ছিল এনবিআর চেয়ারম্যানের। অনিবার্য কারণ দেখিয়ে ওই পরিদর্শনের আসেননি তিনি। আন্দোলন শেষ হওয়ার পর গত ৩০ জুন এনবিআর চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের বলেন, আন্দোলনের কারণে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম হোঁচট খেয়েছে। এখন সব ভুলে গিয়ে দেশের স্বার্থে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
এসব বিষয়ে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, এনবিআর চেয়ারম্যান ও অর্থ উপদেষ্টাকে চিঠি দিতে যাচ্ছি- পরিস্থিতি যেন আরও খারাপ না হয়। অসৎ কর্মকর্তাদের বাদ দিতে হবে, তবে আগে কাঠামোগত সংস্কার দরকার।
গত ১২ মে মধ্যরাতে এনবিআর বিলুপ্ত করে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এর বিরুদ্ধে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের কর্মসূচির ফলে সরকার গত ২৫ মে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে এনবিআর বিলুপ্ত না করার বিষয় জানায়। বরং এটিকে সরকারের একটি স্বতন্ত্র ও বিশেষায়িত বিভাগের মর্যাদায় আরও শক্তিশালী করা, রাজস্ব নীতি প্রণয়ণের লক্ষ্যে আলাদা একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গঠন এবং প্রয়োজনীয় সব সংশোধনের আগপর্যন্ত জারি করা অধ্যাদেশ কার্যকর করা হবে না বলে জানানো হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে ঐক্য পরিষদ তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর কাজে যোগ দিলেও আন্দোলনকারীরা এনবিআর চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবিতে অটল থাকেন এবং সংস্থার কার্যালয়ে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। পরে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নিরাপত্তায় অফিসে ফেরেন এনবিআর চেয়ারম্যান। পরে ২৯ জুন রাজস্ব সংস্কারে উপদেষ্টা কমিটি গঠনের পর আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ।