এমন নজির নেই

- আপডেট সময় : ২১২ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে অন্তত ছয়টি পুরোনো এবং পরিত্যক্ত এয়ারস্ট্রিপ বা এয়ারফিল্ড রয়েছে, যেখানে নিয়মিত কোনো বাণিজ্যিক বা সামরিক কার্যক্রম নেই। অথচ অল্প মেরামতেই সেগুলো প্রশিক্ষণ উপযোগী করা যেত বলে মনে করেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতায় দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে এয়ারফিল্ডের কাজ।
এগুলোর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে ঈশ্বরদী এয়ারফিল্ড। পাবনা-নাটোর সীমান্তে অবস্থিত এই বিমানবন্দর থেকে একসময় বাণিজ্যিক বিমান চলাচল করত। তবে ২০১৪ সালে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে এটিকে সীমিতভাবে ব্যবহার করছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী। এর ৪ হাজার ৭০০ ফুটের রানওয়ে থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না।
১৯৪০ সালের ঠাকুরগাঁও এয়ারফিল্ডটি আজ থেকে ৪৫ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৮০ সালে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। এই এয়ারফিল্ডে রানওয়ে ছিল, গ্রাস স্ট্রিপ ও প্লেন চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত জায়গাও ছিল। তবে ১৯৭১ সালে এটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর আর সংস্কার করা হয়নি। এরপর থেকে এটি বন্ধ রয়েছে। এটিও সামরিক বাহিনীর যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণের জন্য উপযোগী করা যেতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রশিক্ষণের জন্য কুমিল্লা এয়ারস্ট্রিপও অন্যতম একটি জায়গা হতে পারে বলে মত তাদের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্মিত হয় এই এয়ারস্ট্রিপ। এর মাধ্যমে জাপানি বিমান পাহারা দেওয়ার জন্য আমেরিকার কিছু যুদ্ধবিমান ওঠানামা করত। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্লাইট চালু হলে কুমিল্লা বিমানবন্দর দিয়ে অনেক যাত্রী ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতেন। কিন্তু ১৯৮৬ সালের পর কুমিল্লা বিমানবন্দর থেকে সব ধরনের বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। বেশিরভাগ সময়ই এই এয়ারস্ট্রিপ শুধু ইতিহাসে এবং সংরক্ষিত তথ্য-উপাত্তে পাওয়া যায়।
পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা আরেক এয়ারফিল্ড লালমনিরহাট বিমানবন্দর। একসময় এটি এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমানঘাঁটি ছিল। বর্তমানে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ও বাংলাদেশ অ্যারোস্পেস অ্যান্ড অ্যাভিয়েশন ইউনিভার্সিটি এখানে সীমিতভাবে কার্যক্রম চালালেও ফাইটার বা প্রশিক্ষণ বিমান চালানো হয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি এই বিমানবন্দরটি ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার হতে পারে বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের এয়ারস্ট্রিপও। বর্তমানে এটি বিমানবাহিনী প্রশিক্ষণের জন্য সীমিতভাবে ব্যবহার করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন বাহিনীর বেজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল ফেনী এয়ারফিল্ড। এয়ারফিল্ডের ৪৮ একর জায়গার ওপর একটি রানওয়ে হওয়ার কথা থাকলেও সেখানে ২০০৬ সালে ফেনী গার্লস ক্যাডেট কলেজ স্থাপন করা হয়। বাকি অংশ এখন সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভূমি অধিগ্রহণ প্রস্তাব না থাকায় আটকে গেছে ছয় বিমান বন্দরের বা এয়ারফিল্ডের কাজ। এয়ারফিল্ডগুলো হচ্ছে, কুমিল্লা, ফেনী, বগুড়া, ঈশ্বরদী, লালমনিরহাট ও ঠাকুরগাঁওয়ে। এ সকল এয়ারফিল্ডগুলো সংস্কারের মাধ্যমে চালু না করায় পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে বছরের পর বছর। এ সকল বিমানবন্দরগুলো বাণিজ্যিকভাবে দ্রুত চালু করার জন্য উত্তরবঙ্গের কয়েক কোটি মানুষের প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বগুড়া বিমানবন্দর সম্প্রসারণ কাজ। ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে পাবনার ঈশ্বরদী বিমানবন্দরটি। লালমনিরহাট বিমানবন্দরটিও চালুর কোনো উদ্যোগ নেই। এ ছাড়া ঠাকুরগাঁও জেলা শহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে শিবগঞ্জ এলাকায় ৫৫০ একর জমির ওপর নির্মিত ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দরটিও নানান কারণে বন্ধ রয়েছে। এ চারটি বিমানবন্দর চালু হলে উত্তরাঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থা পাল্টে যাবে। আকাশপথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটবে। ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসারসহ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসবে উত্তরবঙ্গের ১৬টি জেলা। কুমিল্লা, ফেনী, বগুড়া, ঈশ্বরদী, লালমনিরহাট ও ঠাকুরগাঁওয়ে নির্মাণকৃত বিমানবন্দরগুলো বাণিজ্যিকভাবে দ্রুত চালু করার দাবি উত্তরবঙ্গের কয়েক কোটি মানুষের।
জানা যায়, ১৬ বছর পর আগামী জুলাইয়ে বগুড়ার আকাশে বিমান উড়ার কথা থাকলেও ভূমি অধিগ্রহণ প্রস্তাব না থাকায় আটকে গেছে বগুড়া বিমানবন্দর সম্প্রসারণ কাজ। প্রায় দুই যুগ পর বগুড়ায় বিমানবন্দর চালুর উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এজন্য ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে বগুড়া বিমানবন্দরের বিদ্যমান রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে, ডাম্বল এবং এপ্রোন সারফেস এরিয়ায় সারফেসের কার্যক্রম চলছে। কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ প্রস্তাব না থাকায় বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ কাজ আটকে গেছে।
বগুড়ায় বিমানবন্দর স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯৮৭ সালে। কিন্তু নানান জটিলতায় সেই উদ্যোগে ভাটা পড়ে। এরপর ১৯৯১-৯৬ মেয়াদে বিএনপি সরকারের শেষদিকে এখানে বিমানবন্দর স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এজন্য সরকার ২২ কোটি টাকার একটি প্রকল্পও অনুমোদন দেয়। ১৯৯৫ সালে সদর উপজেলার এরুলিয়া এলাকায় বগুড়া-নওগাঁ মহাসড়কের পাশে ১১০ একর জমি অধিগ্রহণ করে সরকার। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ সালে প্রকল্পের আওতায় রানওয়ে, কার্যালয় ভবন ও কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণ, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ, রাস্তাঘাট নির্মাণসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ শুরু হয়। প্রকল্পের কাজ শেষ হয় ২০০০ সালে। কিন্তু এরপর ২৪ বছরেও বগুড়া থেকে বিমান আর ওড়েনি আকাশে। সম্প্রতি বগুড়া বিমানবন্দর বাণিজ্যিকভাবে চালু করতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে চার সদস্যের কমিটি গঠন করে বেবিচক। কমিটির সদস্যরা বিমানবন্দর এলাকা পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদনও দাখিল করেন। এরপর বিমানবন্দরের বিদ্যমান রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে, ডাম্বল এবং এপ্রোন সারফেস এরিয়ায় সারফেসের কার্যক্রম শুরু হয়।
এদিকে উত্তরায় মাইলষ্টোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুদ্ধ বিমান বিধ্বস্তের পরই প্রশাসনের টনক নড়েছে। এবিষয়ে নৌপরিবহন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বিমান প্রশিক্ষণ কোথায় হবে তা নতুন করে ভাবা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য সব সংস্থা এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে বলব– এ ধরনের ট্রেনিং কোথায়, কী করলে, কোন চ্যানেলে করতে হবে সেটা নতুন করে দেখা প্রয়োজন। ঢাকা শহর ঘনবসতিপূর্ণ। যেকোনো কিছুতে একটা ট্র্যাজেডি ঘটতে পারে।
এম সাখাওয়াত হোসেন আরও বলেন, বিমান নানা কারণে বিধ্বস্ত হতে পারে। এর মধ্যে প্রধান কারণ– টেকনিক্যাল এরর ও পাইলট এরর। যদিও উড়োজাহাজগুলো পুরোনো। এগুলো ট্রেনিং জেট। আমার জানামতে এগুলো পুরোনো হলেও ভেতরের অ্যাম্বিয়েন্ট ও কম্পোনেন্ট আপডেট করা হয়। এখন এটার ব্ল্যাকবক্স অ্যানালাইসিস না করা পর্যন্ত বোঝা যাবে না এটা কি টেকনিক্যাল এরর নাকি পাইলট এরর।
এ পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞ ওয়াহীদুল আলম বলেন, স্বাধীনতার পর গত ৫৪-৫৫ বছরে আমাদের দেশে কোনো নতুন বিমানবন্দর হয়নি। যেগুলো ছিল সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। সেগুলো থাকলেও প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করা যেত।
বাংলাদেশে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকে সামরিক বাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলো প্রশিক্ষণের জন্য উড্ডয়ন ও অবতরণ করে। একই রানওয়ে থেকে যাত্রীবাহী ও বাণিজ্যিক প্লেন ওঠানামা করে। পৃথিবীর কোনো দেশে এমন নজির নেই। সব দেশেই যাত্রীবাহী ও সামরিক বিমান উড্ডয়নের জন্য পৃথক রানওয়ে বা বিমানবন্দর থাকে।
আইকাওয়ের অ্যানেক্স-১৪ এর নির্দেশনায় বলা হয়েছে, প্রশিক্ষণ ফ্লাইটের জন্য এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে যেটি হবে জনবসতি থেকে দূরে। যেখানে শব্দদূষণ কম হবে এবং ঝুঁকি কম থাকবে। বেবিচকের নীতিমালায়ও একই কথা বলা হয়েছে। তবে এসব বিধান অনুযায়ী প্রশিক্ষণ পরিচালনা না করে বিপদে রাখা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
বিশিষ্ট এভিয়েশন ও বিমান নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, বাংলাদেশে এত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এয়ারপোর্টই থাকার কথা না। তবে আমাদের দেশে বাণিজ্যিক আর সামরিক বিমান উড্ডয়নের জন্য একটা রানওয়েই ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরা আইনের ধার ধারছি না। আমাদের এখানে সব উঁচু উঁচু মাল্টিস্টোরিজ বিল্ডিং। চারদিকেই ঘনবসতি। এটা ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।