ওদের ভাগ্যে নেই ভালো থাকা

- আপডেট সময় : ০১:৫১:৪২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫ ১০১ বার পড়া হয়েছে
-
মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছে পথশিশুরা
-
নিজের অজান্তেই মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে পথশিশুরা
-
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আইন শৃখলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান
ভালো খাবার খাওয়া, ভালো থাকা পথশিশুদের ভাগ্যে তা জোটে না। তাদের জীবন গড়ে উঠে অনাদর-অবহেলায় মৌলিক অধিকার বঞ্চিত মলিন আর জীর্ণ-শীর্ণ। যাদের রোজকার জীবনে নেই আহারের নিশ্চয়তা, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকার তো আরও দূরের বিষয়। এইসব শিশুদের কৌশলে মাদক কারবারে নিয়োজিত করছে একশ্রেনির সুযোগসন্ধানীরা। একসময় নিজের অজান্তেই মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে পথশিশুরা। এসব শিশুদের বেশিরভাগই ‘ড্যান্ডি’ নামে নতুন ও সহজলভ্য মাদকে আসক্ত।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতেই ড্যান্ডিতে আসক্ত পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ৭৫,০০০ জন। রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, ঝিগাতলা, মিরপুর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ বিভিন্ন স্থানে পথশিশুদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নেশায় আসক্ত পথশিশুরা অন্য পথশিশুদের জন্য হুমকি। তারা নেশার জন্য অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে।
চন্দ্রিমা উদ্যানে গেলে ফুল বিক্রেতা রাকিব নামে এক শিশুর সাথে দেখা হয়। সে বলে, মাঝে মাঝেই এই নেশাখোর ছেলেরা আসে। এইটা খেয়ে বলে এদের পেট ভরা থাকে, খিদা লাগে না। পথশিশু ইমন বলে, একবার ড্যান্ডির নেশা উঠলে এদের মাথা ঠিক থাকে না। এর জন্য এরা সব করতে পারে। সেইদিন এক লোকের মোবাইল ফোন নিয়ে দৌঁড় দিয়েছিল। পরে তাকে সবাই মিলে ধরে ফেলে। নেশার জন্য এরা যেকোন কিছু করতে পারে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ড্যান্ডি সেবনে ক্ষুধামান্দ্য তৈরি হয়। যারা সেবন করে তাদের কাছে মনে হয়, তারা সামাজিক বাস্তবতা ভুলে থাকছে। দেখা যায়, তারা যেখানে-সেখানে ঘুমিয়ে পড়ছে। এসব নেশায় জড়িয়ে পথশিশুরা অল্প বয়সেই কিংবা বড় হয়ে অপরাধকর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ার বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। তারা বলছেন, পথশিশুদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনাটাই হবে মূল সমাধান। কিন্তু সেটিই বড় চ্যালেঞ্জের কাজ। বেসরকারি ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে নিয়ে সরকারকে সেই কঠিন কাজটিতে হাত দিতে হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট (বিআইডিএস) ও ইউনিসেফের ২০০৫ সালের গবেষণা অনুযায়ী দেশে ৯ লাখ ৭৯ হাজার ৭২৮ জন পথশিশু রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরে রয়েছে ৭ লাখ পথশিশু। চলতি বছর শেষে দেশে এর সংখ্যা দাঁড়াবে ১১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৫৪ জনে। আর ২০২৪ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬ লাখ ১৫ হাজার ৩৩০ জনে। অন্য একটি হিসাব মতে, বাংলাদেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা এখন প্রায় ৭৯ লাখ। আর এ শিশুদের প্রায় ৪৫ লাখ ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত। এসব শিশু শ্রমিকের মধ্যে ৬৪ লাখ গ্রামাঞ্চলে এবং বাকি ১৫ লাখ শহরে বিভিন্ন পেশায় কাজ করে।
পিতা-মাতা, আত্মীয় কিংবা স্বজনহারা শিশুরা জীবন-সংগ্রামে নামে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই কোন না কোনভাবে মাদক সেবন করে। এর মধ্যে ১৯ শতাংশ হেরোইন, ৪৪ শতাংশ ধূমপান, ২৮ শতাংশ বিভিন্ন ট্যাবলেট এবং ৮ শতাংশ ইনজেকশনের মাধ্যমে নেশা করে থাকে। ঢাকা শহরে কমপক্ষে ২২৯টি স্পট রয়েছে, যেখানে ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা মাদক সেবন করে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ঢাকা বিভাগে মাদকাসক্ত শিশুর প্রায় ৩০ শতাংশ ছেলে এবং ১৭ শতাংশ মেয়ে। ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ছেলে ও মেয়েশিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন জানায়, মাদকাসক্ত ৮০ শতাংশ পথশিশু মাত্র সাত বছরের মধ্যে অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণা জরিপের মাধ্যমে জানা গেছে, মাদকাসক্ত শিশুদের ড্রাগ গ্রহণ ও বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত ৪৪ শতাংশ পথশিশু, পিকেটিংয়ে জড়িত ৩৫ শতাংশ, ছিনতাইয়ে ১২ শতাংশ, মানবপাচার সহায়তা কাজে ১১ শতাংশ, র্দুর্ধষ সন্ত্রাসীদের সহায়তাকারী হিসেবে ৫ শতাংশ ও অন্যান্য ভ্রাম্যমাণ অপরাধে জড়িত ২১ শতাংশ। এ ছাড়া বোমাবাজিসহ অন্যান্য সহিংস কর্মকান্ডে জড়িত ১৬ শতাংশ পথশিশু। একাধিক গবেষণায় জানা যায়, বড় অপরাধী বা সন্ত্রাসী চক্র পর্দার আড়ালে থেকে শিশু-কিশোরদের ব্যবহার করে। রাস্তায় বেড়ে ওঠা এবং বস্তিতে বসবাস করা শিশুদের মাদকপাচার, চুরি, ছিনতাই, পিকেটিং, রাজনৈতিক মিছিল, জোর করে ভিক্ষাবৃত্তি, অস্ত্র বহনসহ নানা কাজে শিশুদের ব্যবহার করা হয় বলে বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়। শিশু-কিশোররা ধরা পড়লেও সহজেই ছাড়া পেয়ে যায় বলে অপরাধমূলক কর্মকান্ড তাদের ব্যবহার করা হয় নিশ্চিন্তে। পথশিশুদের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় এসব অপরাধ কর্মকান্ডে এসব কাজে জড়িয়ে একপর্যায়ে এসব শিশু-কিশোর একসময় সমাজের শীর্ষ সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়।
এ বিষয়ে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের একজন উপ-পরিদর্শক (এসআই) নাম প্রকাশ না করারশর্তে বলেন, বর্তমানে পথশিশুদের মাঝে ড্যান্ডিসহ নানা ধরনের নেশা করতে দেখা যায়। ফুটপাত, পার্ক, বাসস্ট্যান্ড কিংবা ট্রেন স্টেশন, প্রায় সব পথে শিশুদের দেখা যায় পলিথিনে ভরে ড্যান্ডির নেশা করতে। এসব শিশু অবশ্যই অন্যান্য পথশিশুদের জন্য হুমকির কারণ। তাদের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কর্মকা-েরও অভিযোগ আসে। তবে শিশুদের অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদেরও কা
মনোরোগ ও মাদকাসক্তি চিকিৎসাবিদদের মতে, বস্তির শিশু, রাস্তার টোকাই এবং যারা মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাদের সন্তানেরা আগে মাদক নিত। এখন সমাজের অভিজাত শ্রেণির ছেলেমেয়েরাও মাদক নিয়ে থাকে। সাধারণত ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের মাদক গ্রহণের হার বেশি। শুরুতে তারা বলে, নেশা করব না, শুধু একটু খেয়ে দেখি। কিন্তু একপর্যায়ে তারা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে। স্বাভাবিক জীবন হারিয়ে ফেলে। মাদকসেবীরা অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। পথশিশুরা রাস্তায় বড় হয়। মাদকই তাদের একমাত্র বিনোদন। তবে নেশা করার জন্য টাকা না পেয়ে সন্তান মা-বাবাকে খুন করছে। স্বামী, স্ত্রীকে খুন করছে। মাদকের জন্য চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই সমাজে বেড়েই চলেছে। মাদকের টাকা জোগাড় করার জন্যে মাদকাসক্তরা যে কোনো খারাপ কাজ করতে কুণ্ঠাবোধ করছে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের ক্ষেত্রে এটি নিরাময়যোগ্য, তবে সময় সাপেক্ষ। সরকারি পর্যায়ে শিশুদের মাদকাশক্তি প্রতিরোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। মাত্র ৪টি সরকারি নিরাময় কেন্দ্র আছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তবে মাদকাসক্ত শিশুদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে চাইল্ড সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রোটেকশন অব বাংলাদেশ (সিএসপিবি) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় কিছু স্থানে ড্রপ ইন সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে মাদকাসক্ত শিশুদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। মাদক নির্মূলে সরকারের পাশাপাশি সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
সমাজ বিশ্লেষকদের মতে, সুযোগসন্ধানীদের হাত ধরে পথশিশুরা জড়াচ্ছে গ্যাং সংস্কৃতি ও মাদক কারবারে। এমন বাস্তবতায় শিশু অধিকার কর্মীদের দাবি, শিশুদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনের। তারা বলছেন, অপরাধী সংগঠনগুলোর টার্গেটের শিকার হচ্ছে পথশিশুরা। ব্যবহৃত হচ্ছে গ্যাং কালচার ও মাদক বহনের মত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। এই ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পেতে টেকসই প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়ার তাগিদ দেন তারা।
এক পথশিশু জানায়, নুডুলস তার প্রিয়, ছোটবেলায় মা নুডুলস খাওয়াতো। তারপর থেকে অন্য কারো হাতে নুডুলস খাই না। আমার অনেক মন চায় স্কুলে যেয়ে বাচ্ছাদের সাথে খেলতে। আরেক শিশু জানায়, ফুল বেইচ্চা টেহা দিয়া ভাত খাই। একইভাবে কথা বলেছেন হাসানুজ্জামান। শৈশবের গ্লানিময় বাস্তবতা নিয়ে পথেই বেড়ে উঠছে হাজারো শিশু। পাতে মেলে না পুষ্টিকর খাবার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৩-এর জরিপ বলছে, সারাদেশে পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ১০ লক্ষাধিক। যার প্রায় ৮২ শতাংশই ছেলে। যাদের ১৩ শতাংশ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন আর ৬ শতাংশ এতিম। তবে সমীক্ষার তথ্য আরও বলছে, প্রতি ৫ জনে একজন ছিন্নমূল শিশু ভাঙারি সংগ্রহ করে। ১৫ শতাংশ শিশু বিভিন্ন দোকানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আর ৯ শতাংশ পথেঘাটে ফেরি করে বেড়ায়। সার্ভে অন স্ট্রিট চিলড্রেনের তথ্য বলছে, খোলা আকাশের নিচে বসবাসকারী শিশুদের ৮২.৯ শতাংশ নির্যাতনের শিকার হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, রাষ্ট্র বা বেসরকারি উন্নয়র প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সঠিকভাবে পরিচালিত করতে বা বড় করতে না পারে এরাই সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলবে। কীভাবে নষ্ট করবে, তারা নানা ধরনের অপরাধের সাথে নিজেরা বেঁচে থাকার জন্য জড়িত হবে। সমাজের যারা স্বার্থান্বেষী জনগোষ্ঠী তাদের একত্র করে বিভিন্ন গ্যাং, দল বা উপদল তৈরি করে এদের নিয়ে নানা ধরনের অপরাধ করাবে। এর মাধ্যমে সমাজের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হবে।
শিশু অধিকারকর্মীরা বলছেন, অবহেলিত এই জনগোষ্ঠীকে পেছনে রেখে দেশের সার্বিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। প্রয়োজনে শিশুদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনেরও পরামর্শ তাদের। তবে শিশু অধিকার কর্মী জাহাঙ্গীর নাকির বলেন, সে যে খাবার খাচ্ছে সেটা কিন্তু অস্বাস্থ্যকর। এবং যখন তারা অসুস্থ হচ্ছে তখন তারা চিকিৎসা পাচ্ছে না। শিশুদের জন্য যে বাজেট হয় সেটা কিন্তু কাজে আসে না। বাসস্থান, নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সবধরনের সংকট আর আলোকের ঝর্ণাধারায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ফেরাতে কাজ করছে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা। শুধু প্রকল্পে আটকে না থেকে তা কার্যকরে গতি আনতে সবাইকে সমন্বিত উদ্যোগে গুরুত্ব দেন তারা।
সেভ দ্য চিলড্রেনের চাইল্ড প্রোটেকশন অ্যান্ড চাইল্ড রাইটস গভর্নেন্সের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, পরিকল্পনা থাকতে হবে, বাজেট থাকতে হবে, জবাবদিহিতা থাকতে হবে মনিটরিং থাকতে হবে। এখন প্রকল্প এটা করে না। সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, মেন্টাল ডেভেলপমেন্ট, শারিরীক, মানসিক বিকাশের পাশাপাশি সে যেন পরিবারে ফিরে যেতে পারে এবং কর্মসংস্থানে নিয়োজিত থাকতে পারে এজন্য তাদের আমরা বিনোদনমূলক কর্মসূচিতে যুক্ত করে থাকি। এজন্য ৪৩ কোটি টাকার বাজেট রাখা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে আমরা আশা করি এ বাজেট আরো বৃদ্ধি করা হবে।