ওরা এখন ডাকাত
- আপডেট সময় : ১১৭ বার পড়া হয়েছে
- ডাকাতি করছে চাকুরিচ্যুত পুলিশ আর্মি র্যাব ডিবি
- কিভাবে অবৈধ ভাবে আইন শৃংখলা বাহিনীর পোশাক কোথায় পেলো এবং হ্যান্ডক্যাপসহ সরঞ্জাম। এনিয়ে কারো কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছেনা। নির্ধারিত কিছু মার্কেট রয়েছে, সেগুলো অসাধু ব্যবসায়িরাই এ সকল পোশাক এবং সরঞ্জাম গোপনে বিক্রি করে
সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় নগদের কোটি টাকা ডাকাতির ঘটনায় জড়িত চাকুরিচ্যুত পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর সদস্য । শুধু উত্তরার ঘটনাই নয়, বিগত দিনে রাজধানীর মোহাম্মদপুর আইন শৃংখলা বাহিনীর পোশাকে ডাকাতি ছিনতাই টাকা লুটের ঘটনা ঘটছে। এ সকল ঘটনায় তাৎক্ষনিক প্রশাসনিক ভাবে টনক নড়ে। আর তখনই শুরু হয়ে যায় আইন শৃংখলা বাহিনীর দৌড় ঝাপ। কয়েকজন গ্রেফতার এবং কিছু টাকা উদ্ধারের পর এ ঘটনার তৎপরতা কমে যায়। কিন্তু কিভাবে অবৈধ ভাবে আইন শৃংখলা বাহিনীর পোশাক কোথায় পেলো এবং হ্যান্ডক্যাপসহ সরঞ্জাম। এনিয়ে কারো কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছেনা। নির্ধারিত কিছু মার্কেট রয়েছে, সেগুলো অসাধু ব্যবসায়িরাই এ সকল পোশাক এবং সরঞ্জাম গোপনে বিক্রি করে থাকে।
উত্তরায় নগদের কোটি টাকা ডাকাতির ঘটনার বিষয়ে উত্তরা জোনের পুলিশ কর্তা মুহিদুল ইসলাম বলেন, গ্রেফতারদের মধ্যে মূল পরিকল্পনাকারী গোলাম মোস্তফা বাংলাদেশ পুলিশের বহিষ্কৃত কনস্টেবল। গ্রেফতার শেখ মো. জালাল উদ্দিন ওরফে রবিউল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বহিষ্কৃত সার্জেন্ট। ডিবি ও থানা পুলিশ প্রযুক্তির সহায়তায় প্রথমে মাইক্রোবাসের চালক মো. হাসানকে খিলগাঁও থেকে গ্রেফতার করে। পরে তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গাড়িটি জব্দ করা হয় ও মূলহোতা চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্য শাহিনকে উত্তরা এলাকা থেকে গ্রেফতার করে তার কাছ থেকে ১৩ লাখ ৩৪ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে আরও তিন সদস্য- ইমদাদুল শরীফ (৮ লাখ ৪ হাজার টাকা সহ), সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট জালাল উদ্দিন (৬৩ হাজার টাকা সহ) এবং সাইফুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়।
মুহিদুল ইসলাম জানান, জালালের নিজের নামে ব্যাংকে জমা রাখা ১২ লাখ টাকা জব্দের আইনি প্রক্রিয়া চলছে। পুলিশ আরও জানায়, তাদের কাছ থেকে র্যাব ও পুলিশের নকল আইডি কার্ড, লাঠি, সিগন্যাল লাইট, সেনাবাহিনীর লোগোসহ মানিব্যাগ, বিভিন্ন ব্যাংকের চেকবই ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তাররা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বিভিন্ন সময়ে র্যাব ও পুলিশের পরিচয়ে দেশজুড়ে ডাকাতির কথা স্বীকার করেছেন।
এদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, সম্প্রতি মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকার একটি বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দুটি বাহিনীর পোশাক পরে ডাকাতির ঘটনা ঘটানো হয়। ওই সময়ে লুট করা হয় ৭৫ লাখ টাকা ও ৬০ ভরি স্বর্ণ। একইসঙ্গে ভবনটিতে থাকা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরা ও আলমারিও ভাঙচুর করা হয়। মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক পরে ডাকাতির ঘটনায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
ডাকাতির ঘটনায় জড়িত লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদমর্যাদার ওই কর্মকর্তা র্যাব সদর দপ্তরের একটি শাখার প্রধান ছিলেন। ২০১৯ সালে তাঁকে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অকালীন (বাধ্যতামূলক) অবসরে পাঠানো হয়। এ ছাড়া এই ডাকাতির ঘটনায় র্যাব ৪ কর্মরত শৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন সদস্যের (ননকমিশন্ড) নাম এসেছে। তাঁদের বিষয়ে র্যাব ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও ঘটনাটি তদন্ত করা হচ্ছে।
এদিকে পুলিশ ও গোয়েন্দা সদর দফতরের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, রাজধানীর পলওয়েল মার্কেট ও রজনীগন্ধা সুপারমার্কেটে অবাধে বিক্রি হয় র্যাব-পুলিশের পোশাক। পাওয়া যায় হাতকড়াসহ সব ধরনের সরঞ্জাম। পোশাক ও সরঞ্জাম বিক্রির ব্যাপারে নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। এই সুযোগ ভালোভাবে কাজে লাগাচ্ছে অপরাধীরা। তারা পুলিশ বা র্যাবের পোশাক পরে ছিনতাই, ডাকাতি, খুন ও অপহরণের ঘটনা ঘটাচ্ছে। এ কারণে ভাবমূর্তির সংকটে পড়ছেন পুলিশ ও র্যাবের আসল সদস্যরা। ওই মার্কেটে পুলিশ-র্যাবের কটি, হাতকড়া, লাইটিং ডিটেক্টর, ব্যাজ, বাঁশি, ক্যাপ, বেল্ট, জুতা, পিস্তল কাভারসহ সব সরঞ্জামই বাইরের লোকের কাছে বিক্রি করা হয়। অথচ পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নির্দেশনা দেওয়া আছে, পরিচয়পত্র ছাড়া কারো কাছে কোনো সরঞ্জাম বিক্রি করা যাবে না।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এক শ্রেণির প্রতারক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে সাধারণ লোকজনের সঙ্গে প্রতারণা করছে। কিছু প্রতারককে এরই মধ্যে ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, পুলিশের পোশাক ও সরঞ্জাম বাইরে বিক্রি হচ্ছে। এ অনৈতিক কাজে সহায়তা করছে দুর্নীতিবাজ কিছু পুলিশ সদস্য। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। পুলিশের পোশাক ও সরঞ্জাম বিক্রির জন্য নীতিমালা রয়েছে। কেউ অমান্য করলে তাকে শাস্তির আওতায় আনা হোক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চাকরিচ্যুত বা অবসরে যাওয়া কিছু পুলিশ সদস্য তাঁদের ব্যবহূত পোশাক জমা না দিয়ে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছে বিক্রি করে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পুলিশের পোশাক ও সরঞ্জাম ব্যবহারে কড়াকড়ি না থাকায় অপরাধীরা অপরাধ ঘটানোর সুযোগ পাচ্ছে। একসময় তালিকাভুক্ত দোকান ছাড়া অন্য কোথাও পুলিশি সরঞ্জাম বেচাকেনা করা যেত না। যে কেউ ইচ্ছা করলেই দোকান থেকে পুলিশি সরঞ্জাম কিনতে পারত না। পুলিশ সদস্যদেরও যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে পোশাক ও সরঞ্জাম কিনতে হতো। এখন যেকোনো ব্যবসায়ী পুলিশি সরঞ্জাম কেনাবেচা করতে পারেন, যে কেউ কিনতে পারেন। অনুমতির প্রয়োজন হয় না।
সূত্র আরো জানায়, খোলাবাজারে র্যাব-পুলিশের মনোগ্রামসহ ছাপানো আইডি কার্ডও বিক্রি হচ্ছে। তাতে যে কেউ নিজের নাম লিখে, ছবি বসিয়ে হয়ে যাচ্ছে পুলিশ বা র্যাবের বড় কর্তা। সেনাবাহিনী বা আনসার বাহিনীর আইডি কার্ডও কিনতে পাওয়া যায়।
পুরানা পল্টনের পলওয়েল মার্কেট ও কচুক্ষেতের রজনীগন্ধা সুপারমার্কেটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পোশাক ও সরঞ্জাম বিক্রি হয়। পুলিশ সদস্যরা ওই সব মার্কেট থেকে পোশাক ও সরঞ্জাম কিনে থাকেন। পুলিশের প্রবিধানে (পিআরবি) পুলিশি সরঞ্জাম খোলাবাজারে বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা নেই, তবে পোশাক বিক্রি বেআইনি।
২০১২ সালে এক কার্যনির্বাহী আদেশে পুলিশের পোশাক ব্যবহার সাধারণের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। এর পরও বিভিন্ন সিকিউরিটি কম্পানি, পাড়া-মহল্লার দারোয়ান ও নাইটগার্ডরা অহরহ র্যাব-পুলিশের মতো পোশাক ব্যবহার করছে। তারা পুলিশের মতো হাতকড়া, র্যাংক ব্যাজও ব্যবহার করছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে।
উত্তরার ডাকাতির ঘটনার পর পলওয়েল মার্কেটের বেশ কিছু দোকানে গিয়ে পুলিশের বিভিন্ন সরঞ্জাম কিনতে চাইলে ব্যবসায়ীরা অনায়াসে বিক্রি করতে রাজি হন। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর তাঁরা সতর্ক হন। বলেন, পুলিশের পরিচয়পত্র না দেখে বিক্রি করা যাবে না। ওই সময় ডিসেন্ট স্টোর, গাজীপুর পুলিশ স্টোর, বরিশাল মিলিটারি স্টোরসহ কয়েকটি দোকানে অবাধে এসব সরঞ্জাম বিক্রি করতে দেখা গেছে। ওই মার্কেটের একটি স্টোরের একজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করে জানান, নির্দেশনা থাকার পরও পোশাক ও সরঞ্জাম বিক্রি করেন তাঁরা। সব দোকানেই বিক্রি হয়। তিনি জানান, রজনীগন্ধা সুপারমার্কেটেও এসবের বেচাকেনা চলে।
পলওয়েল মার্কেটের ভেন্ডার (অনুমতিপ্রাপ্ত পুলিশি সরঞ্জাম বিক্রেতা) রুহুল আমিন, আবু হেনা ও রাসেল জানান, বুটজুতা এক হাজার ৩০০ থেকে দুই হাজার টাকা, নেমপ্লেট ৮০ থেকে ১০০ টাকা, র্যাংক ব্যাজ ৩০ থেকে ৭০ টাকা, ক্যাপ ৯০ থেকে ৩৫০ টাকা, পিস্তল কাভার ৩০০ থেকে দেড় হাজার টাকা, বেল্ট ৪৫০ থেকে এক হাজার টাকা, চীনা হাতকড়া ৭৫০ টাকা, থাই হাতকড়া এক হাজার ২০০ টাকা, কোরিয়ান হাতকড়া এক হাজার ৫০০ টাকা ও তাইওয়ানি হাতকড়া দুই হাজার টাকা, দেশি বাঁশি ৫০ টাকা এবং বিদেশি বাঁশি ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়। তাঁরা বলেন, পুলিশ সদর দপ্তর ও পলওয়েল মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির নির্দেশনা অনুযায়ী পোশাক ও সরঞ্জাম পরিচয়পত্র দেখে বিক্রি করা হয়। তবে জুতার কালি, ব্রাশ প্রভৃতি ছোটখাটো জিনিস বিক্রির বিষয়ে তেমন নির্দেশনা নেই।
পুলিশ সদরের এক কর্মকর্তা বলেন, পলওয়েল মার্কেটে কিছু দোকান নির্দিষ্ট করা আছে। ওই সব দোকান থেকে পুলিশ সদস্যরা পোশাক ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনতে পারেন। তবে খোলাবাজারে সহজলভ্য হওয়ায় এসবের অপব্যবহার হচ্ছে। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর মতো সাপ্লাই কোরের মাধ্যমে পুলিশের সরঞ্জাম বেচাকেনার ব্যবস্থা করলে প্রতারকরা সুযোগ পেত না। যারা প্রতারকদের কাছে সরঞ্জাম বিক্রি করছে তাদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান বলেন, এ রকম প্রতারকচক্র সারা দেশেই আছে। র্যাবের নাম ব্যবহার করে তারা অনেক ডাকাতি করেছে। অনেককে ধরা হয়েছে, অন্যদের ধরার চেষ্টা চলছে। র্যাবের পোশাক-সরঞ্জাম খোলাবাজারে পাওয়া যাওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের প্রতি সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।
























