কঠোর নিরাপত্তায় ঢাবির প্রবেশমুখ

- আপডেট সময় : ২৭ বার পড়া হয়েছে
রাত পোহালেই ডাকসু নির্বাচন। ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ভোটের দিন পুরো ক্যাম্পাসে তিন স্তরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। নিরাপত্তাবলয়ে রয়েছে ক্যাম্পাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি প্রবেশমুখে সেনাবাহিনীর স্ট্রাইকিং ফোর্স মোতায়েন করা হচ্ছে বলে জানান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. গোলাম রাব্বানী। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট ভবনে প্রার্থীদের সঙ্গে এক আলোচনার পর তিনি এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, প্রথম স্তরে ২০০ এর বেশি বিএনসিসি সদস্য ও প্রক্টরিয়াল বডির শিক্ষকরা দায়িত্বে থাকবেন। দ্বিতীয় স্তরে প্রতিটি কেন্দ্রে পুলিশ মোতায়েন থাকবে। আর তৃতীয় স্তরে সেনা সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশমুখে অবস্থান করবেন। প্রয়োজনে ৫ মিনিটের মধ্যে তারা কেন্দ্রে প্রবেশ করবেন। ভোট শেষ হওয়ার পর ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত কেন্দ্রগুলো সেনা সদস্যদের বলয়ে নিরাপত্তায় থাকবে। এছাড়া বৈধ ভোটার ছাড়া ভোটের দিন ক্যাম্পাসে অন্য কারও অবস্থান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভোটের আগের দিন ও ভোটের দিন (৮ ও ৯ সেপ্টেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেট্রো স্টেশনও বন্ধ থাকছে।
অপরদিকে এই নির্বাচনকে ঘিরে শুরুর দিকে শিক্ষার্থীদের মাঝে উচ্ছ্বাস দেখা গেলেও বর্তমানে তা বিলিন হওয়ার পথে। কারণ, প্রচার-প্রচারণার প্রথম দিন থেকেই ঘটে চলছে একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। সেসব ঘটনার শিকার হচ্ছেন প্রার্থীরা। আবার কোনো কোনো ঘটনায় খোদ প্রার্থীদেরই জড়িত থাকার অভিযোগ উঠছে জোরেশোরে। এর ফলে সাধারণ শিক্ষার্থী অর্থাৎ ডাকসু নির্বাচনের ভোটারদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে শঙ্কা। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনটা হবে তো? এমন প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে তাদের মনে।
নির্বাচনি প্রচারণার প্রথম থেকেই ঢাবির চারুকলা অনুষদের ভেতরে শিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’-এর ফেস্টুন ভেঙে ফেলা হয়। পাশাপাশি ফেস্টুনে থাকা পুরুষ প্রার্থীদের ছবি ও হিজাব পরিহিত নারী প্রার্থীর ছবি বিকৃত করে দেয় দুষ্কৃতিকারীরা। এ ঘটনায় তিনজনকে চিহ্নিত করা হলেও এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি ঢাবি প্রশাসন। ফলে সামনে কী হতে চলেছে এই নির্বাচন ঘিরে, তা নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, একটি আলোচিত ছাত্র সংগঠনের প্যানেলের ফেস্টুন যদি দিনে-দুপুরে এভাবে ভেঙে ফেলা হয়, তবে অন্য সংগঠনগুলোর নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত হবে? এসব দেখেও যদি প্রশাসন এমন নির্বিকার থাকে, তবে তারা কীভাবে আমাদের একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেবে?
এদিকে নির্বাচনি প্রচারণা শুরুর কয়েকদিন পর কিছু প্রার্থীকে আচরণবিধি লঙ্ঘন করতে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বিভিন্ন জায়গায় তারা ব্যানার-ফেস্টুন টাঙান। এছাড়া নির্বাচনি প্রচারণা শুরুর আগেও অনেকে বিভিন্ন হলে প্রচারণা চালান, যা নির্বাচনি বিধিমালার স্পষ্ট লঙ্ঘন। এঘটনায়ও আশাহত শিক্ষার্থীরা। তাদের বক্তব্য, যারা এখনই নিয়ম মানছে না, নির্বাচিত হলে তারা কীভাবে নিয়ম মেনে আমাদের জন্য কাজ করবে?
অন্যদিকে এসব ঘটনার মাঝেই মধ্যরাতে স্বতন্ত্র প্যানেলের সহসভাপতি (ভিপি) পদপ্রার্থী জালাল আহমেদ ওরফে জ্বালাময়ী জালাল নিজের রুমমেটকে ছুরিকাঘাতে হত্যাচেষ্টা করেন। এরপরই তাকে হল থেকে বহিষ্কার এবং পুলিশে সোপর্দ করা হয়। বর্তমানে তিনি কারাগারে। অন্যদিকে আহত শিক্ষার্থীকে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা জালালের উপর এবং তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. সিরাজুল ইসলামের পদত্যাগ দাবি করেন। সবমিলিয়ে এখনো উত্তেজনাকর পরিস্থিতি ঢাবি ক্যাস্পাসজুড়ে। জালালের ওই ঘটনার পরে রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি আগেও হয়েছে। এতে ডাকসু নির্বাচনের উপর কোনো প্রভাব পড়বে না। নির্বাচন নির্ধারিত সময়ে সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হবে।
অন্যদিকে ডাকসুর ভোট নির্বিঘ্ন করতে ক্যাম্পাসের ভোট কেন্দ্রগুলোতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ বিষয়ে সবার মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। ডাকসুর সাবেক ভিপি, জিএস এবং বর্তমান বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীরাও বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। কিন্তু ডাকসু নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে গিয়ে এ পদক্ষেপ নিতে হয়েছে ।
এবিষয়ে ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুশতাক হোসেন এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব প্রশাসনের। অতীতে সেনাবাহিনী ছাড়াই ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। এবারও সেনা মোতায়েনের মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। সেনা উপস্থিতি বরং অস্থিরতা বাড়িয়ে দিতে পারে।
সাবেক ভিপি ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘সত্তর ও আশির দশকে সামরিক শাসনের মধ্যেও ডাকসু নির্বাচন হয়েছে, কিন্তু কখনো ক্যাম্পাসে সেনা মোতায়েনের ঘটনা ঘটেনি। এমনকি পুলিশের উপস্থিতিও সীমিত রাখা হতো। এখন কেন এমন সিদ্ধান্ত?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, প্রচারণা শুরু হওয়ার পর থেকেই এসব ঘটনা শিক্ষার্থীদের মধ্যে শঙ্কা সৃষ্টি করছে। এসব ঘটনার সূত্র ধরে অনেক রাজনৈতিক দল ডাকসু নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করতে পারে।
এবিষয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মেহেদী হাসান বলেন, ‘এসব ঘটনা ডাকসু নির্বাচন বানচাল করতে পারবে না। যদিও শিক্ষার্থীদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। যেই গোষ্ঠীগুলো ডাকসু নির্বাচন চায় না, তারা হয়তো এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভিসি-প্রক্টরের পদত্যাগ চাইবে। তিনি আরও বলেন, ‘ক্যাম্পাসের ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর বর্তমান অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়, তারা চায় ডাকসু নির্বাচন দ্রুত সম্পন্ন হোক। কোনো পক্ষের যদি নির্বাচন বানচালের অসৎ উদ্দেশ্য থাকে, তবে সংগঠনগুলো তা রুখে দেবে বলে আমি মনে করি।
এ ব্যাপারে চিফ রিটার্নিং অফিসার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন স্বাক্ষরিত নির্দেশনায় প্রচারণার জন্য কিছু নীতিমালা জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রার্থীরা কেবল সাদা-কালো পোস্টার, লিফলেট বা হ্যান্ডবিল ব্যবহার করতে পারবেন। নিজের ছবি ছাড়া অন্য কারো ছবি বা প্রতীক ব্যবহার করা যাবে না। ক্যাম্পাস ও হলের কোনো স্থাপনা, দেয়াল, গাছ, যানবাহন বা খুঁটিতে পোস্টার লাগানো যাবে না। প্রতিদ্বন্দ্বীর পোস্টার ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না এবং কালি, চুন বা কেমিক্যাল ব্যবহার করে দেয়াল লিখন বা প্রচারণা চালানোও নিষিদ্ধ।
২৬ আগস্ট থেকে ৭ সেপ্টেম্বর রাত ১১টা পর্যন্ত প্রার্থীরা প্রচারণা চালাতে পারবেন। তবে এ সময়ে কোনো সামাজিক, আর্থিক বা সেবামূলক কার্যক্রম, মজলিশ-মাহফিল আয়োজন কিংবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও প্রাঙ্গণে প্রচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে। রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. কাজী মারুফুল ইসলাম সতর্ক করে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধ ও শহিদদের অবমাননা করে কোনো ধরনের প্রচারণা চালানো যাবে না।
এরআগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্যাম্পাসের সার্বিক নিরাপত্তা ও ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানের সভাপতিত্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সভা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের চীফ রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন, রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানী, প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমদ, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী, সিটি এসবি’র ডিআইজি মীর আশরাফ আলী, ডিএমপির রমনা জোনের ডিসি মো. মাসুদ আলম ও শাহবাগ থানার ওসি মোহাম্মদ খালিদ মুনসুর।
সভায় ক্যাম্পাসে সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। নির্বাচন উপলক্ষে ক্যাম্পাসের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা, ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং শিক্ষার্থীদের নির্বিঘ্নে ভোট প্রদান ও সুষ্ঠুভাবে ভোট গণনা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন কর্মকৌশল ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বাচনী পরিবেশকে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, স্বচ্ছ ও নিরাপদ রাখতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণে বদ্ধপরিকর।