কেমিক্যাল গোডাউন যেন মৃত্যুফাঁদ

- আপডেট সময় : ৫৫৯ বার পড়া হয়েছে
কারখানার মালিক পক্ষের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা আর গোঁর্য়াতমির কারণেই অগ্নিঝুঁকিতে মানুষের মৃত্যু বাড়ছে। মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই বসবাস রাজধানীবাসীর। একেকটি আগুন ট্র্যাজেডি কেড়ে নেয় মানুষের জানমাল সর্বস্ব। কিছুদিন পরপর কেমিক্যাল ও প্লাস্টিক কারখানায় লাগা আগুনে মৃত্যু হচ্ছে সাধারণ মানুষের। বাড়িতে বাড়িতে প্লাস্টিক, কেমিক্যাল গোডাউনগুলো যেন একেকটি মৃত্যুপুরী। সবশেষ গতকাল মঙ্গলবার মিরপুরের শিয়াল বাড়িতে কেমিক্যালের গোডাউন এবং পোশাক কারখানায় আগুনে ১০ জন নিহত হয়েছে। তবে দমকল বাহিনী ৯ জনের মৃত্যুর খবর স্বীকার করেছে।
নিমতলী থেকে চকবাজারের চুড়িহাট্টা, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড, টঙ্গী ও সবশেষ মিরপুরের শিয়ালবাড়ীর আবাসিক এলাকায় কেমিক্যালের গোডাউনগুলো যেন মৃত্যুফাঁদ। এবিষয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও বিভিন্ন সংস্থার হিসাব মতে, দুই দশকে বাংলাদেশে শিল্পকারখানায় বড় ধরনের ২৬টির বেশি দুর্ঘটনায় দুই হাজারের মতো শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আর গত ১১ বছরে শুধু পুরান ঢাকায় পৃথক ঘটনায় অন্তত দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। হতাহতের দিক থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ ১৫টি অগ্নিকান্ডের মধ্যে মাত্র ৩টি ঘটনার পর মামলা হয়েছে।
সূত্র বলছে, পুরান ঢাকাসহ আবাসিক এলাকার গুদামগুলোতে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য যেমন ড্রামভর্তি করে মজুদ করা হয় তেমনই অনেক গুদামে মজুদ থাকে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক, জুতার সোল তৈরির এডহেসিভ ও পেস্টিং সলিউশন- যার সবই দাহ্য পদার্থ। সার উৎপাদনেও আবার এই রাসায়নিক পদার্থটির ব্যবহার রয়েছে। সার কারখানাগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকলেও অধিকাংশ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুদ করে রাখা হয় কেবল পুরান ঢাকার বিভিন্ন গুদামে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, রাসায়নিকের এক একটি ড্রাম এক হাজার বোমার চেয়েও বেশি শক্তিশালী, যা থেকে আগুনের সূত্রপাত হলে পুরান ঢাকার অধিকাংশ জায়গাই পুড়ে যেতে পারে। কারণ, এসব গুদামের কোনোটাতেই অগ্নিকান্ড অগ্নিনির্বাপকের তেমন ব্যবস্থা নেই।
সম্প্রতি পুরান ঢাকার লালবাগে একটি প্লাস্টিক কারখানায় আগুন লাগে। প্রশ্ন উঠেছে, বার বার কেন এতো দুর্ঘটনা?কেন এত অগ্নিকান্ড পুরান ঢাকার বেশিরভাগ বাড়ির মালিক অধিক ভাড়ার লোভে বাসার নিচতলায় রাসায়নিক পদার্থ মজুদের জন্য ভাড়া দেন। এই কারখানা ও গুদামগুলোর বেশির ভাগেরই নেই পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বিস্ফোরক অধিদপ্তর কিংবা ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র। এসব প্লাস্টিক ও কেমিক্যাল কারখানা সরিয়ে কামরাঙ্গীচর ও কেরানীগঞ্জে নেয়ার কথা থাকলেও আজও এর হয়নি সুরাহা। পুরান ঢাকার বংশালের নিমতলী এলাকায় প্লাস্টিকের পাইপের কারখানায় আগুন লাগে। আগুনে নিহতের ঘটনা না থাকলেও কারখানার অনেক ক্ষয় ক্ষতি হয় বলে জানায় ফায়ান সার্ভিস। পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারে তাজমহল টাওয়ারের পাশে একটি ছয়তলা ভবনের চতুর্থ তলায় আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিস জানায়, ওই ভবনে বেশ কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ছিলো। পুরান ঢাকার মাহুতটুলীর ৪ তলা ভবনের নিচতলায় পলিথিনের কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিছু ব্যবসায়ী ও অতি মুনাফালোভী ভবন মালিকদের লোভের খেসারত দিচ্ছে পুরান ঢাকার মানুষ। তাই সরকারকে কঠোরভাবে সুপারিশ বাস্তবায়ন করে পুরান ঢাকার সব কেমিক্যাল কারখানা নির্ধারিত জায়গায় স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু করার তাগিদ দিয়েছেন তারা। অপরদিকে, সরকারি বিভিন্ন সংস্থাও রাসায়নিক আমদানির অনুমোদন দিয়ে সেটা কোথায় রাখা হচ্ছে, কীভাবে রাখা হচ্ছে এর খোঁজ রাখে না। অনুমোদন দিয়েই দায়িত্ব শেষ। কোনো সংস্থা আবার লাইসেন্স দেয়া বন্ধ রাখলেও অবৈধ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নেয়া হয় না কোনো পদক্ষেপ।
এবিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলেন, সরকার ও সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো তাদের দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বাসিন্দারা সচেতন নন। ফলে সরানো যাচ্ছে না কেমিক্যাল গোডাউন। অনেক সুপারিশ বাস্তবায়ন হলেও কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেয়ার সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি এখনো। এটা অবশ্যই করতে হবে।
২০১০ সালের জুন মাসে নিমতলীতে রাসায়নিক কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় গোটা দেশ নেমে আসে শোকের ছায়া। মর্মান্তিক ওই দুর্ঘটনায় ১২৪ জন নিহত হয়েছিলেন। এই শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতে ৯ বছরের মাথায় ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে ফের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ৭২ জন পুড়ে ছাই হয়ে যান। ওয়াহেদ ম্যানশনে কেমিক্যালের গোডাউন থাকায় অগ্নিকান্ডের পরপর নিমিষেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে আগুন। গত বছরের ৫ নভেম্বর পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাটে একটি জুতার কারখানায় আগুন লেগে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়।
নিমতলীতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকা থেকে প্রাণঘাতী রাসায়নিক পদার্থের কারখানা আর গুদামগুলো সরিয়ে নেয়ার দাবি উঠেছিলো। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেশকিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো, পরিকল্পিতভাবে রাসায়নিক শিল্পজোন গড়ে তুলে পুরান ঢাকার সব রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে নেয়া এবং দাহ্য রাসায়নিক দ্রব্য আনা-নেয়া বন্ধসহ সেখানে নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলা। এতো বছরেও এখনও সরেনি একটি কারখানাও। বিপরীতে সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার সুযোগে অবৈধ রাসায়নিকের ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা বাড়িয়েই চলেছেন দিনের পর দিন।
এছাড়া বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণায় উঠে এসেছে পুরান ঢাকাসহ আবাসিক এলাকায় রয়েছে ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে খোদ বাসা-বাড়িতে। মাত্র আড়াই হাজার গোডাউনকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। বাকি ২২ হাজারের মতো গোডাউন অবৈধ। এসব গোডাউনে ২০০ ধরনের ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের ব্যবসা চলছে। পুরান ঢাকার এসব গোডাউনে রয়েছে গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোস, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, মিথাইল-ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোইলসসহ আরো অনেক ধরনের রাসায়নিক।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে, পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউনের ৯৮ ভাগই অবৈধ। এবিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে পুরান ঢাকার রাসায়নিক কারখানা ও গুদামগুলো কামরাঙ্গীচর ও কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এগুলো সরিয়ে নেয়ার জন্য পৃথক দুই জায়গায় ১৭টি ভবন তৈরি করা হচ্ছে।
এবিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা বলেন, পুরান ঢাকার নিমতলী ও চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকান্ডের পর থেকে পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল এলাকাগুলোতে ট্রেড লাইসেন্স দেয়া বন্ধ আছে। নতুন করে কাউকে কোনো ট্রেড লাইনেন্স দেয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, যাদের আগে থেকেই দেয়া ছিলো তাদের লাইসেন্স নতুন করে নবায়ন করা হচ্ছে না। যারা এখনো ব্যবসা করে যাচ্ছেন তাদের বিষয়ে ক্যাবিনেট সিদ্বান্ত নেবে।
ভয়াবহ এসব অগ্নিকান্ডের ঘটনায় অনেক সময় মামলা হয় না। যেসব ঘটনায় মামলা হয় তদন্ত শেষে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেয়া হলেও বিচার কার্যক্রম এখনো শেষ হতে বছরের পর বছর গড়িয়ে যায়। এর মধ্যে চকবাজারের চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি ঘটনায় মামলা হলেও তদন্ত কার্যক্রম শেষ হয়নি। আবার এসব মামলার আসামিরা গ্রেপ্তার হলেও বেশিরবাগ আসামিরা জামিনে বের হয়ে আসেন। এবিষয়ে আইনজীবী আলমগীর হোসেন বলেন, অগ্নিকান্ডের মামলায় দোষীদের যথাযথ সাজা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে কারখানাগুলোয় আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। এবিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন্স) বলেন, আবাসিক এলাকা থেকে কারখানা সরানো না গেলে অগ্নিঝুঁকি থেকেই যাবে।