ঢাকা ০৪:৫৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ মার্চ ২০২৫

ক্ষতির মুখে পড়তে পারে রপ্তানি খাত

গণমুক্তি রিপোর্ট
  • আপডেট সময় : ১২:৩৭:২৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫ ৮ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

সম্প্রতি আমদানি পণ্যের কনটেইনারে বন্দরের ভাড়া বা স্টোর রেন্ট চারগুণ বাড়ানো হয়েছে। এই ডেমারেজ (মাশুল) শিল্পখাতের সংকটে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে বন্দরের কনটেইনারে চারগুণ মাশুল আরোপ পণ্যের আমদানি ব্যয় বাড়াবে, বাড়বে উৎপাদন ব্যয়ও

নানামুখী সংকটে ধুঁকছে তৈরি পোশাক রপ্তানিসহ শিল্পখাত। তার ওপর সম্প্রতি আমদানি পণ্যের কনটেইনারে বন্দরের ভাড়া বা স্টোর রেন্ট চারগুণ বাড়ানো হয়েছে। এই ডেমারেজ (মাশুল) শিল্পখাতের সংকটে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে বন্দরের কনটেইনারে চারগুণ মাশুল আরোপ পণ্যের আমদানি ব্যয় বাড়াবে, বাড়বে উৎপাদন ব্যয়ও। এতে ক্ষতির মুখে পড়বে কাঁচামাল আমদানিনির্ভর সব ধরনের রপ্তানি খাত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষেত্রবিশেষে আমদানিকারকদের একেকটি কনটেইনারে ৩৮৪ ডলার পর্যন্ত ডেমারেজ গুনতে হচ্ছে। এতে বাড়ছে পণ্যের আমদানি ব্যয়। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রপ্তানি শিল্পের ওপর। বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, জাহাজ থেকে খালাসের পর বন্দরে চার দিন কনটেইনার রাখার যে ফ্রি টাইম রয়েছে, সেই সময়ের মধ্যে অনেক আমদানিকারক কনটেইনার ডেলিভারি করতে পারছেন না। এতে কনটেইনারের যেমন জটলা তৈরি হচ্ছে, গচ্ছা যাচ্ছে শত শত ডলারও।
অথচ নির্ধারিত চার দিনের মধ্যে বন্দরের পণ্যবোঝাই কনটেইনার ডেলিভারি করা গেলে কোনো ভাড়া বা মাশুল দিতে হয় না। এতে বন্দরের কার্যক্রমও স্বাভাবিক থাকে। যদিও বিভিন্ন পণ্যের ছাড়পত্র অনুমোদনসহ নানান জটিলতায় আমদানিকারকদের পক্ষে অনেক সময়ই সেটি সম্ভব হয়ে ওঠে না।
শিল্পের উদ্যোক্তারা মনে করছেন, বিগত সরকারের পতনের পর বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে শ্রমিকদের আন্দোলনে গত সাত মাসে পোশাকশিল্পসহ সব ধরনের রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদনে ব্যাহত হয়েছে। রয়েছে গ্যাস সংকট। এ সময়ে কনটেইনারে চারগুণ মাশুল আরোপ সব মিলিয়ে কাঁচামাল আমদানিনির্ভর সব ধরনের রপ্তানি খাতকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।১০ মার্চ থেকে ফ্রি টাইমের পর ২০ বর্গফুট কনটেইনারের জন্য প্রথম ৭ দিন দৈনিক ২৪ ডলার, দ্বিতীয় ১৩ দিন দৈনিক ৯৬ ডলার, তৃতীয় ২১ দিন দৈনিক ১৯২ ডলার করে ভাড়া পরিশোধ করতে হচ্ছে।- চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র
জানা যায়, গত ফেব্রুয়ারিতে হঠাৎ করে বন্দরে কনটেইনার জটলা তৈরি হয়। একপর্যায়ে কনটেইনারের সংখ্যা ৪১ হাজার ছাড়িয়ে যায়। জটলা কমাতে গত ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম বন্দর ও ঢাকার কমলাপুর আইসিডিতে থাকা আমদানিকৃত এফসিএল কনটেইনারে চারগুণ হারে মাশুল আরোপ করে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। বন্দর পরিচালক (ট্রাফিক) এনামুল করিমের সই করা ওই বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম বন্দর ও ঢাকাস্থ কমলাপুর আইসিডি (পানগাঁও, আইসিটি ব্যতীত) থেকে কনটেইনার খালাসে অত্যন্ত ধীরগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। কোনো কোনো আমদানিকারক তাদের আমদানিকৃত কনটেইনার ২১ দিন বা তারও বেশি সময় ডেলিভারি না নিয়ে বন্দরের অভ্যন্তরে ও আইসিডিতে সংরক্ষণ করছেন। এতে চট্টগ্রাম বন্দর এবং কমলাপুর আইসিডির স্বাভাবিক অপারেশনাল কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটছে। বন্দরের ও আইসিডির স্বাভাবিক অপারেশনাল কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্ন রেখে দেশের সব আমদানি-রপ্তানিকারকদের দ্রুত বন্দর সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে অনতিবিলম্বে বন্দর অভ্যন্তরে/কমলাপুর আইসিডিতে থাকা আমদানিকৃত এফসিএল কনটেইনারগুলো ডেলিভারি/সরিয়ে নেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হবে। ওই সময়ের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে বা কমলাপুর আইসিডিতে থাকা কনটেইনার ডেলিভারি না নিলে ১০ মার্চ থেকে ‘রেগুলেশন্স ফর ওয়ার্কিং অব চিটাগং পোর্ট (কার্গো অ্যান্ড কনটেইনার), ২০০১-এর ১৬০ ধারা মোতাবেক এফসিএল কনটেইনার ভাড়া চারগুণ বেশি হারে আরোপে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হবে। এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর গত ১০ মার্চ থেকে স্টোর রেন্ট বা বন্দরের ভাড়া চারগুণ হারে আদায় শুরু করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এতে শিল্পখাতের উদ্যোক্তারা লোকসানের মুখে পড়ছে। এ নিয়ে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) চট্টগ্রামের সাবেক নেতারা বন্দর চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে চারগুণ মাশুল আদায়ের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানান।
বন্দর সূত্রে জানা যায়, আমদানিকৃত পণ্যবাহী কনটেইনার বন্দরে আসার পর চার দিন ফ্রি টাইম থাকে। এসময়ে পণ্য খালাস নিলে কোনো ভাড়া বা স্টোর রেন্ট দিতে হয় না। বন্দরের ঘোষিত নিয়ম অনুযায়ী, স্বাভাবিক সময়ে ফ্রি টাইমের পরে প্রথম ৭ দিনের মধ্যে খালাস নিতে প্রতিদিন ২০ বর্গফুট একক কনটেইনারের জন্য ৬ ডলার, ৪০ বর্গফুট কনটেইনারের জন্য ১২ ডলার, দ্বিতীয় ১৩ দিনের মধ্যে খালাস নিতে প্রতিদিন ২০ বর্গফুট কনটেইনারের জন্য একক প্রতি ২৪ ডলার, ৪০ বর্গফুট কনটেইনারের জন্য ৪৮ ডলার এবং তৃতীয় ধাপে ২১ দিনের মধ্যে খালাস নিতে প্রতিদিন ২০ বর্গফুট কনটেইনারের ৪৮ ডলার এবং ৪০ বর্গফুট কনটেইনারে ৯৬ ডলার করে ভাড়া দিতে হয়।
গত ১০ মার্চ থেকে এই ভাড়া চারগুণ হারে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে ফ্রি টাইমের পর ২০ বর্গফুট কনটেইনারের জন্য প্রথম ৭ দিন দৈনিক ২৪ ডলার, দ্বিতীয় ১৩ দিন দৈনিক ৯৬ ডলার, তৃতীয় ২১ দিন দৈনিক ১৯২ ডলার করে ভাড়া পরিশোধ করতে হচ্ছে। একইভাবে ৪০ বর্গফুট কনটেইনারের ক্ষেত্রে প্রথম ৭ দিন দৈনিক ৪৮ ডলার, দ্বিতীয় ১৩ দিন দৈনিক ১৯২ ডলার এবং তৃতীয় ২১ দিন থেকে দৈনিক ৩৮৪ ডলার করে ভাড়া আদায় করছে বন্দর।
বিজিএমইএ ফোরাম চট্টগ্রামের ট্রেজারার এবং চৌধুরী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিক চৌধুরী বাবলু বলেন, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সসহ নানান জটিলতার কারণে বন্দরে ১০-২০ দিন কনটেইনার রাখতে হয়। এখন চারগুণ হারে স্টোর রেন্ট নেওয়া হচ্ছে। এতে ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো কনটেইনারে ৪০০ ডলার পর্যন্ত ডেমারেজ দিতে হচ্ছে। এতে আরএমজি (রেডিমেড গার্মেন্টস) খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, দেশের জিডিপিতে আরএমজি খাতের অবদান ১০ শতাংশ। এখন নানান সংকটের কারণে এ শিল্প ধুঁকছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের অন্যতম বড় স্টেকহোল্ডার হচ্ছে আরএমজি। এ খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে বন্দরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ খাতে স্থবির এলে বন্দরও গতি হারাবে। আমরা মনে করি বন্দরের বর্তমান যে ফ্রি টাইম আছে, তা বাড়িয়ে ১৫ দিন করা উচিত। পাশাপাশি বর্ধিত চারগুণ স্টোর রেন্ট আদায়ের সিদ্ধান্ত দ্রুত পরিহার করা উচিত।
বিজিএমইএ নেতা রফিক চৌধুরী বাবলুর বক্তব্যের সত্যতা খুঁজে পাওয়া গেছে চট্টগ্রামের পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার চিত্রে। শিল্প পুলিশের সূত্রে বলছে, চট্টগ্রামে রপ্তানিকারক তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে ৫৮০টি। এরমধ্যে বর্তমানে চালু রয়েছে ৫২৮টি। বন্ধ হয়ে গেছে ৫০টির বেশি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় আর্থিক সংকটের মুখে কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যায়।
শুধু পোশাক খাত নয়, বন্দরের ভাড়া চারগুণ করায় সব ধরনের শিল্পই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বাড়বে আমদানি ব্যয়- এমনটিই মনে করছেন বাংলাদেশ নন-প্যাকার্স ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আমদানিকারক মাহবুব রানা। তিনি বলেন, শিল্প মালিকরা কাঁচামাল আমদানি করে বন্দরে রেখে দিতে চান না। এতে তাদেরই উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে। কিন্তু কিছু পণ্য খালাসে সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের সনদ ও ছাড়পত্র নিতে হয়। এতে সময়ক্ষেপণ হয়। এখন কনটেইনারে বন্দর কর্তৃপক্ষ স্টোর রেন্টে চারগুণ মাশুল আরোপ করায় রপ্তানিমুখী শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তিনি আরও বলেন, অনেক আমদানিকারক আছেন পণ্য আমদানি করে বন্দরকে গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করেন। এতে বন্দরের নিয়মিত কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে। কোন আমদানিকারক কোন পণ্য আমদানি করে বন্দরকে গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করেন সেই তথ্য বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে রয়েছে। তাদের ওপর ডেমারেজ আরোপ করা হলেও শিল্পোদ্যাক্তাদের এই ডেমারেজের বাইরে রাখা উচিত।
বিজিএমইএ চট্টগ্রামের সাবেক সহ-সভাপতি এবং এইচকেসি অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, বন্দরকে খালি করার জন্য স্টোর রেন্ট চারগুণ করেছিল। তখন হয়তো কনটেইনার ৪০ হাজার ছাড়িয়েছিল। এখনতো বন্দর খালি হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে ৫৩ হাজারের বেশি কনটেইনার রাখার সক্ষমতা রয়েছে। বর্তমানে ২৫ হাজারের মতো রয়েছে। তিনি বলেন, এমনিতে বহুমুখী সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে পোশাকশিল্প। এখন বন্দরের অতিরিক্ত স্টোর রেন্ট এ শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বর্ধিত স্টোর রেন্ট আদায়ের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়ে আমরা বন্দর চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট কনটেইনারগুলোর বিষয়ে তারা মৌনতা দেখিয়েছেন। এখন দেখি কোন সিদ্ধান্ত আসে।
বন্দরের তথ্য মতে, গত বৃহস্পতিবার আগের ২৪ ঘণ্টায় চার হাজার ৩৫ টিইইউস কনটেইনার বন্দর থেকে ডেলিভারি হয়েছে। এসময়ে চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে কনটেইনার ছিল ২৭ হাজার ৮২৬টি। এরমধ্যে ৯ হাজার ৪৬৯ টিইইউস কনটেইনার অকশন (নিলাম) ইউনিটের। একমাস আগে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার ছিল ৪১ হাজার ৫৫০ টিইইউস।
বন্দর সচিব মোহাম্মাদ ওমর ফারুক বলেন, নির্ধারিত সময়ে কনটেইনার খালাস নিলে বন্দর ব্যবহারকারীরাই সুফল পাবেন। বন্দরে কনটেইনার জট তৈরি হলে সমস্যাও তাদেরই। রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প বড় একটি খাত। কনটেইনার বন্দরে আসার পর ডেলিভারির জন্য চার দিন ফ্রি টাইম থাকে। এই সময়ে কোনো মাশুল দিতে হয় না। তিনি বলেন, বন্দর তো পণ্যের গোডাউন হতে পারে না। মূলত, বন্দরের গতিশীলতা অব্যাহত রাখতে স্টোর রেন্ট বাড়ানো হয়েছে। ফ্রি টাইমের সুযোগটা নিলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা হয়। সূত্র : জাগো নিউজ।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ক্ষতির মুখে পড়তে পারে রপ্তানি খাত

আপডেট সময় : ১২:৩৭:২৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫

সম্প্রতি আমদানি পণ্যের কনটেইনারে বন্দরের ভাড়া বা স্টোর রেন্ট চারগুণ বাড়ানো হয়েছে। এই ডেমারেজ (মাশুল) শিল্পখাতের সংকটে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে বন্দরের কনটেইনারে চারগুণ মাশুল আরোপ পণ্যের আমদানি ব্যয় বাড়াবে, বাড়বে উৎপাদন ব্যয়ও

নানামুখী সংকটে ধুঁকছে তৈরি পোশাক রপ্তানিসহ শিল্পখাত। তার ওপর সম্প্রতি আমদানি পণ্যের কনটেইনারে বন্দরের ভাড়া বা স্টোর রেন্ট চারগুণ বাড়ানো হয়েছে। এই ডেমারেজ (মাশুল) শিল্পখাতের সংকটে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে বন্দরের কনটেইনারে চারগুণ মাশুল আরোপ পণ্যের আমদানি ব্যয় বাড়াবে, বাড়বে উৎপাদন ব্যয়ও। এতে ক্ষতির মুখে পড়বে কাঁচামাল আমদানিনির্ভর সব ধরনের রপ্তানি খাত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষেত্রবিশেষে আমদানিকারকদের একেকটি কনটেইনারে ৩৮৪ ডলার পর্যন্ত ডেমারেজ গুনতে হচ্ছে। এতে বাড়ছে পণ্যের আমদানি ব্যয়। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রপ্তানি শিল্পের ওপর। বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, জাহাজ থেকে খালাসের পর বন্দরে চার দিন কনটেইনার রাখার যে ফ্রি টাইম রয়েছে, সেই সময়ের মধ্যে অনেক আমদানিকারক কনটেইনার ডেলিভারি করতে পারছেন না। এতে কনটেইনারের যেমন জটলা তৈরি হচ্ছে, গচ্ছা যাচ্ছে শত শত ডলারও।
অথচ নির্ধারিত চার দিনের মধ্যে বন্দরের পণ্যবোঝাই কনটেইনার ডেলিভারি করা গেলে কোনো ভাড়া বা মাশুল দিতে হয় না। এতে বন্দরের কার্যক্রমও স্বাভাবিক থাকে। যদিও বিভিন্ন পণ্যের ছাড়পত্র অনুমোদনসহ নানান জটিলতায় আমদানিকারকদের পক্ষে অনেক সময়ই সেটি সম্ভব হয়ে ওঠে না।
শিল্পের উদ্যোক্তারা মনে করছেন, বিগত সরকারের পতনের পর বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে শ্রমিকদের আন্দোলনে গত সাত মাসে পোশাকশিল্পসহ সব ধরনের রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদনে ব্যাহত হয়েছে। রয়েছে গ্যাস সংকট। এ সময়ে কনটেইনারে চারগুণ মাশুল আরোপ সব মিলিয়ে কাঁচামাল আমদানিনির্ভর সব ধরনের রপ্তানি খাতকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।১০ মার্চ থেকে ফ্রি টাইমের পর ২০ বর্গফুট কনটেইনারের জন্য প্রথম ৭ দিন দৈনিক ২৪ ডলার, দ্বিতীয় ১৩ দিন দৈনিক ৯৬ ডলার, তৃতীয় ২১ দিন দৈনিক ১৯২ ডলার করে ভাড়া পরিশোধ করতে হচ্ছে।- চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র
জানা যায়, গত ফেব্রুয়ারিতে হঠাৎ করে বন্দরে কনটেইনার জটলা তৈরি হয়। একপর্যায়ে কনটেইনারের সংখ্যা ৪১ হাজার ছাড়িয়ে যায়। জটলা কমাতে গত ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম বন্দর ও ঢাকার কমলাপুর আইসিডিতে থাকা আমদানিকৃত এফসিএল কনটেইনারে চারগুণ হারে মাশুল আরোপ করে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। বন্দর পরিচালক (ট্রাফিক) এনামুল করিমের সই করা ওই বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম বন্দর ও ঢাকাস্থ কমলাপুর আইসিডি (পানগাঁও, আইসিটি ব্যতীত) থেকে কনটেইনার খালাসে অত্যন্ত ধীরগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। কোনো কোনো আমদানিকারক তাদের আমদানিকৃত কনটেইনার ২১ দিন বা তারও বেশি সময় ডেলিভারি না নিয়ে বন্দরের অভ্যন্তরে ও আইসিডিতে সংরক্ষণ করছেন। এতে চট্টগ্রাম বন্দর এবং কমলাপুর আইসিডির স্বাভাবিক অপারেশনাল কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটছে। বন্দরের ও আইসিডির স্বাভাবিক অপারেশনাল কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্ন রেখে দেশের সব আমদানি-রপ্তানিকারকদের দ্রুত বন্দর সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে অনতিবিলম্বে বন্দর অভ্যন্তরে/কমলাপুর আইসিডিতে থাকা আমদানিকৃত এফসিএল কনটেইনারগুলো ডেলিভারি/সরিয়ে নেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হবে। ওই সময়ের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে বা কমলাপুর আইসিডিতে থাকা কনটেইনার ডেলিভারি না নিলে ১০ মার্চ থেকে ‘রেগুলেশন্স ফর ওয়ার্কিং অব চিটাগং পোর্ট (কার্গো অ্যান্ড কনটেইনার), ২০০১-এর ১৬০ ধারা মোতাবেক এফসিএল কনটেইনার ভাড়া চারগুণ বেশি হারে আরোপে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হবে। এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর গত ১০ মার্চ থেকে স্টোর রেন্ট বা বন্দরের ভাড়া চারগুণ হারে আদায় শুরু করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এতে শিল্পখাতের উদ্যোক্তারা লোকসানের মুখে পড়ছে। এ নিয়ে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) চট্টগ্রামের সাবেক নেতারা বন্দর চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে চারগুণ মাশুল আদায়ের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানান।
বন্দর সূত্রে জানা যায়, আমদানিকৃত পণ্যবাহী কনটেইনার বন্দরে আসার পর চার দিন ফ্রি টাইম থাকে। এসময়ে পণ্য খালাস নিলে কোনো ভাড়া বা স্টোর রেন্ট দিতে হয় না। বন্দরের ঘোষিত নিয়ম অনুযায়ী, স্বাভাবিক সময়ে ফ্রি টাইমের পরে প্রথম ৭ দিনের মধ্যে খালাস নিতে প্রতিদিন ২০ বর্গফুট একক কনটেইনারের জন্য ৬ ডলার, ৪০ বর্গফুট কনটেইনারের জন্য ১২ ডলার, দ্বিতীয় ১৩ দিনের মধ্যে খালাস নিতে প্রতিদিন ২০ বর্গফুট কনটেইনারের জন্য একক প্রতি ২৪ ডলার, ৪০ বর্গফুট কনটেইনারের জন্য ৪৮ ডলার এবং তৃতীয় ধাপে ২১ দিনের মধ্যে খালাস নিতে প্রতিদিন ২০ বর্গফুট কনটেইনারের ৪৮ ডলার এবং ৪০ বর্গফুট কনটেইনারে ৯৬ ডলার করে ভাড়া দিতে হয়।
গত ১০ মার্চ থেকে এই ভাড়া চারগুণ হারে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে ফ্রি টাইমের পর ২০ বর্গফুট কনটেইনারের জন্য প্রথম ৭ দিন দৈনিক ২৪ ডলার, দ্বিতীয় ১৩ দিন দৈনিক ৯৬ ডলার, তৃতীয় ২১ দিন দৈনিক ১৯২ ডলার করে ভাড়া পরিশোধ করতে হচ্ছে। একইভাবে ৪০ বর্গফুট কনটেইনারের ক্ষেত্রে প্রথম ৭ দিন দৈনিক ৪৮ ডলার, দ্বিতীয় ১৩ দিন দৈনিক ১৯২ ডলার এবং তৃতীয় ২১ দিন থেকে দৈনিক ৩৮৪ ডলার করে ভাড়া আদায় করছে বন্দর।
বিজিএমইএ ফোরাম চট্টগ্রামের ট্রেজারার এবং চৌধুরী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিক চৌধুরী বাবলু বলেন, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সসহ নানান জটিলতার কারণে বন্দরে ১০-২০ দিন কনটেইনার রাখতে হয়। এখন চারগুণ হারে স্টোর রেন্ট নেওয়া হচ্ছে। এতে ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো কনটেইনারে ৪০০ ডলার পর্যন্ত ডেমারেজ দিতে হচ্ছে। এতে আরএমজি (রেডিমেড গার্মেন্টস) খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, দেশের জিডিপিতে আরএমজি খাতের অবদান ১০ শতাংশ। এখন নানান সংকটের কারণে এ শিল্প ধুঁকছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের অন্যতম বড় স্টেকহোল্ডার হচ্ছে আরএমজি। এ খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে বন্দরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ খাতে স্থবির এলে বন্দরও গতি হারাবে। আমরা মনে করি বন্দরের বর্তমান যে ফ্রি টাইম আছে, তা বাড়িয়ে ১৫ দিন করা উচিত। পাশাপাশি বর্ধিত চারগুণ স্টোর রেন্ট আদায়ের সিদ্ধান্ত দ্রুত পরিহার করা উচিত।
বিজিএমইএ নেতা রফিক চৌধুরী বাবলুর বক্তব্যের সত্যতা খুঁজে পাওয়া গেছে চট্টগ্রামের পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার চিত্রে। শিল্প পুলিশের সূত্রে বলছে, চট্টগ্রামে রপ্তানিকারক তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে ৫৮০টি। এরমধ্যে বর্তমানে চালু রয়েছে ৫২৮টি। বন্ধ হয়ে গেছে ৫০টির বেশি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় আর্থিক সংকটের মুখে কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যায়।
শুধু পোশাক খাত নয়, বন্দরের ভাড়া চারগুণ করায় সব ধরনের শিল্পই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বাড়বে আমদানি ব্যয়- এমনটিই মনে করছেন বাংলাদেশ নন-প্যাকার্স ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আমদানিকারক মাহবুব রানা। তিনি বলেন, শিল্প মালিকরা কাঁচামাল আমদানি করে বন্দরে রেখে দিতে চান না। এতে তাদেরই উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে। কিন্তু কিছু পণ্য খালাসে সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের সনদ ও ছাড়পত্র নিতে হয়। এতে সময়ক্ষেপণ হয়। এখন কনটেইনারে বন্দর কর্তৃপক্ষ স্টোর রেন্টে চারগুণ মাশুল আরোপ করায় রপ্তানিমুখী শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তিনি আরও বলেন, অনেক আমদানিকারক আছেন পণ্য আমদানি করে বন্দরকে গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করেন। এতে বন্দরের নিয়মিত কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে। কোন আমদানিকারক কোন পণ্য আমদানি করে বন্দরকে গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করেন সেই তথ্য বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে রয়েছে। তাদের ওপর ডেমারেজ আরোপ করা হলেও শিল্পোদ্যাক্তাদের এই ডেমারেজের বাইরে রাখা উচিত।
বিজিএমইএ চট্টগ্রামের সাবেক সহ-সভাপতি এবং এইচকেসি অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, বন্দরকে খালি করার জন্য স্টোর রেন্ট চারগুণ করেছিল। তখন হয়তো কনটেইনার ৪০ হাজার ছাড়িয়েছিল। এখনতো বন্দর খালি হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে ৫৩ হাজারের বেশি কনটেইনার রাখার সক্ষমতা রয়েছে। বর্তমানে ২৫ হাজারের মতো রয়েছে। তিনি বলেন, এমনিতে বহুমুখী সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে পোশাকশিল্প। এখন বন্দরের অতিরিক্ত স্টোর রেন্ট এ শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বর্ধিত স্টোর রেন্ট আদায়ের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়ে আমরা বন্দর চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট কনটেইনারগুলোর বিষয়ে তারা মৌনতা দেখিয়েছেন। এখন দেখি কোন সিদ্ধান্ত আসে।
বন্দরের তথ্য মতে, গত বৃহস্পতিবার আগের ২৪ ঘণ্টায় চার হাজার ৩৫ টিইইউস কনটেইনার বন্দর থেকে ডেলিভারি হয়েছে। এসময়ে চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে কনটেইনার ছিল ২৭ হাজার ৮২৬টি। এরমধ্যে ৯ হাজার ৪৬৯ টিইইউস কনটেইনার অকশন (নিলাম) ইউনিটের। একমাস আগে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার ছিল ৪১ হাজার ৫৫০ টিইইউস।
বন্দর সচিব মোহাম্মাদ ওমর ফারুক বলেন, নির্ধারিত সময়ে কনটেইনার খালাস নিলে বন্দর ব্যবহারকারীরাই সুফল পাবেন। বন্দরে কনটেইনার জট তৈরি হলে সমস্যাও তাদেরই। রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প বড় একটি খাত। কনটেইনার বন্দরে আসার পর ডেলিভারির জন্য চার দিন ফ্রি টাইম থাকে। এই সময়ে কোনো মাশুল দিতে হয় না। তিনি বলেন, বন্দর তো পণ্যের গোডাউন হতে পারে না। মূলত, বন্দরের গতিশীলতা অব্যাহত রাখতে স্টোর রেন্ট বাড়ানো হয়েছে। ফ্রি টাইমের সুযোগটা নিলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা হয়। সূত্র : জাগো নিউজ।