ঘুষ যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না
																
								
							
                                - আপডেট সময় : ৩৩৫ বার পড়া হয়েছে
 
- 
আকাশে যত তারা, পুলিশের তত ধারা
 - 
পুলিশে দুর্নীতির ৯ খাত : সংস্কার কমিশন
 - 
পুলিশের ঘুষ বাণিজ্য ও চাঁদাবাজি থেকে বেরিয়ে এসে জনকল্যাণে কাজ করতে হবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
 
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে টানা ১৭ বছরের দূর্দান্ত প্রতাপশালী সরকারের পতনের পর জনপ্রত্যাশা ছিলো পুলিশ আর ঘুষ, দুর্নীতিতে জড়াবে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নে অটল থাকবে পুলিশ। পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা এমন কথা অতীতে বলেছে এখনও বলছে। সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদও দুর্নীতিতে বিরুদ্ধে বলতেন অথচ তার বিরুদ্ধেই ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। রংপুরে উপপুলিশ কমিশনারের বিরুদ্ধে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ তাকে প্রত্যাহার করা হয়।
রংপুর মহানগর পুলিশের একজন উপকমিশনারের বিরুদ্ধে ১০ লাখ টাকার ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগে থানায় মামলা করতে গিয়ে মারধরের শিকার হয়েছেন এক ব্যবসায়ীর প্রতিনিধি। ওই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কর্তব্যরত কনস্টেবলের রাইফেল কেড়ে নিয়ে ওই ব্যক্তিকে বেধড়ক পিটুনির অভিযোগ উঠেছে। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে নগরের কোতোয়ালি থানায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় একটি অভ্যন্তরীণ সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। ঘটনার পর থানা-পুলিশ চাঁদাবাজির অভিযোগে ভুক্তভোগী ব্যক্তির একটি মামলা নিলেও আসামির তালিকায় ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে রাখা হয়নি। অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ শিবলী কায়সার নগর পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (অপরাধ) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তাঁকে অপরাধ থেকে প্রত্যাহার করে ক্রাইম অ্যান্ড অপসে সংযুক্ত করা হয়।
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের জাটিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের নৈশ প্রহরী মো. আরমান (২৪) হত্যা মামলা নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে অর্থ বাণিজ্যের অভিযোগ তুলেছে এলাকাবাসী। মামলায় উল্লেখিত আসামীদের না ধরে সাধারণ মানুষদের হত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করছেন। চার জনকে আটকের পর ৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে থানা থেকে মুক্তি দিয়েছে পুলিশ এমন অভিযোগ আটককৃত ও তার পরিবারের। জানা যায়, গত বছরের ১ অক্টোবর (মঙ্গলবার) ভোর রাতে জাটিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে কর্মরত অবস্থায় নৈশ প্রহরী আরমানকে হত্যা করা হয়। নিহত আরমান হোসেন স্থানীয় বাসিন্দা লোকমান হেকিমের ছেলে। ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর সে জাটিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে নৈশ প্রহরী হিসাবে যোগদান করে কর্মরত অবস্থায় নিহত হন। আরমান হত্যার বিষয়টি নিয়ে ঘটনার দিন রাতেই মা শামসুন্নাহার ঝর্ণা বাদি হয়ে ৬ জনকে আসামী করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই দিনেই আরমান হত্যার প্রধান আসামী মাসুদকে আটক করে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়। এলাকাবাসীর অভিযোগ আটকের কিছু দিন পরই আসামী মাসুদকে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জালাল উদ্দিনের সার্বিক সহযোগিতায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন আসেন। বাদীর অভিযোগ মাসুদ গ্রাম পুলিশ হওয়ায় জামিনে আসার পর ওসি ওবায়দুর রহমানের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে মামলাটি ভিন্নখাতে নিতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মামলা তুলে নেয়ার জন্য বাদীকে নানা হুমকী দিচ্ছেন বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
শুধু দুই একটি ঘটনাই নয় দেশের প্রায় থানায় পুলিশ সদস্যরা ঘুষের মত অপরাধের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিতে আসা এক সেবাপ্রার্থীর কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন নাটোর সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আমিনুল ইসলাম। এ কাজটি তিনি করেছেন থানার ভেতরে বসেই। পুলিশ কর্মকর্তার এ ঘুষ গ্রহণের একটি ভিডিও ইতোমধ্যে প্রকাশ্যে এসেছে। আশুলিয়া থানা পুলিশের ঘুষ বাণিজ্য একাধিক গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। পুলিশ সদস্যদের দুর্নীতি ও অবৈধ অর্থ উপার্জনের ৯টি খাত চিহ্নিত করেছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। পুলিশ সংস্কার কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা তথ্যে দেখা যায়, পুলিশে ২০০৯ সাল থেকে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ লাখ ৪৫ হাজার লঘুদণ্ড ও ২৩ হাজার ৫৫০টি গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে যে ৯টি খাতে দুর্নীতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, এর মধ্যে নিজস্ব প্রতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডভুক্ত দুর্নীতির ৫টি খাত রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘুষ গ্রহণ ও আর্থিক দুর্নীতি পুলিশের সবচেয়ে প্রচলিত ও দৃশ্যমান দুর্নীতির ধরন। সাধারণত থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) গ্রহণ থেকে শুরু করে মামলা দায়ের, গ্রেপ্তার–বাণিজ্য, অভিযোগপত্র দায়ের, মামলায় হাজিরা থেকে শুরু করে নিম্ন আদালতে বিচারিক মামলায় হাজিরাসহ মামলা নিষ্পত্তির বিভিন্ন পর্যায়ে পুলিশকে ঘুষ দিতে হয়। পুলিশের দুর্নীতির অন্যতম খাত হিসেবে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যে এবং রিমান্ডে আসামি নির্যাতন। ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতির কথাও উঠে আসে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ভুয়া বা গায়েবি মামলায় গ্রেপ্তার বা ফাঁসানোর ভয়ভীতি দেখিয়ে অবৈধভাবে অর্থ আদায়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে পুলিশ সদস্যরা।
নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির সর্বশেষ ও পঞ্চম খাত হিসেবে ট্রাফিক পুলিশের দুর্নীতির কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। পুলিশের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানবহির্ভূত দুর্নীতির চারটি খাত উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়ে থাকে, আকাশে যত তারা, পুলিশের তত ধারা অর্থাৎ পুলিশ এতই ক্ষমতাবান যে কাউকে ফাঁসাতে চাইলে বা বাগে আনতে চাইলে তার হাতে কৌশল বা অস্ত্রের অভাব নেই। প্রতিবেদনে পুলিশের চাঁদাবাজির কথা উল্লেখ করে বলা হয়, সড়ক-মহাসড়কে পুলিশের চাঁদাবাজি একটি দৃশ্যমান দুর্নীতি। পরিবহন খাতে এই চাঁদাবাজির টাকা ছাপানো স্লিপ বা কাগজ দিয়ে তোলা হয়। ফুটপাত ব্যবসা বা ইনফরমাল সেক্টরের দুর্নীতির বিষয়ে পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশেষত্ব ঢাকা-চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় ফুটপাত দখল করে অবৈধ অস্থায়ী দোকানপাট বসিয়ে ব্যবসা করা একটি অতিপরিচিত অর্থনৈতিক খাত। পুলিশ সেখানে দৈনিক দোকানপ্রতি ভাড়া আদায় করে। বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের মতে, বছরে এই চাঁদার পরিমাণ প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা।
ঘুষ ও চাঁদাবাজিকে দুর্নীতির মূল উৎস বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, ঘুষ ও চাঁদাবাজি হলো দুর্নীতির মূল উৎস। ঘুষ ও চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পুলিশের উদ্দেশে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, পুলিশের ঘুষ বাণিজ্য ও চাঁদাবাজি থেকে বেরিয়ে এসে জনকল্যাণে কাজ করতে হবে। নিজেদের পরিশুদ্ধ করতে হবে। পুলিশের আরেকটি বাণিজ্য রয়েছে, তা হলো নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য। সেটিও অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। কোনো পুলিশ অফিসার এসবের সঙ্গে জড়িত প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, অপরাধী যেই হোক না কেন, সে অপরাধী। আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অতীতের অনিয়ম, দুর্নীতির কারণে পুলিশ বাহিনীর প্রতি জনমনে যে ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে, সেটি প্রশমনের দায়িত্বও পুলিশের। ঘুষ ও চাঁদাবাজি বন্ধ করতে পারলে সমাজের অনেক অন্যায়-অনিয়ম দূরীভূত হবে। ঘুষ ও চাঁদাবাজি বন্ধ হলে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমবে, কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবে। ফলে নিত্যপণ্যের দাম কমবে ও সাধারণ মানুষ স্বস্তি পাবে।
																			























