ঢাকা ০৮:৩৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫

ছোট দলগুলোর জোট কৌশল

মহিউদ্দিন তুষার, সিনিয়র রিপোর্টার
  • আপডেট সময় : ৫৪ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনীতিতে ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা নতুন করে চোখে পড়ছে। সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে এসব দল এখন বড় রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে জোট গঠন, আসনভিত্তিক সমঝোতা কিংবা প্রয়োজনে নিজ দল বিলুপ্ত করে বড় দলে যোগ দেওয়ার কৌশল গ্রহণ করছে। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠছে নানা নতুন জোট-সমীকরণ ও রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রবণতা আপাতদৃষ্টিতে বাস্তববাদী মনে হলেও এর গভীরে রয়েছে সংসদে যাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। ছোট দলগুলোর একটি বড় অংশ বুঝতে পারছে, এককভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। ফলে বড় দলের প্রতীক ও জোটের ছায়াতেই তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ খুঁজছে তারা। তবে স্বল্পমেয়াদে এতে কিছু নেতার ব্যক্তিগত সাফল্য এলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি দলীয় আদর্শ, রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য উদ্বেগজনক বার্তা বহন করছে।

বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় একদিকে রয়েছে দীর্ঘদিনের মাঠের আন্দোলনে অভিজ্ঞ বিএনপিনির্ভর জোট, অন্যদিকে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন শক্তি সঞ্চয় করা জামায়াতকেন্দ্রিক জোট। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মাঠে অনুপস্থিতি এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কার্যত এই দুই বৃহৎ জোটের মধ্যকার শক্তি পরীক্ষার লড়াইয়ে রূপ দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ছোট দলগুলোর অবস্থান আরও জটিল হয়ে উঠেছে। কেউ বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সম্পর্ক ও আন্দোলনের স্মৃতি ধরে রাখতে চাইছে, আবার কেউ পরিবর্তিত বাস্তবতায় জামায়াতের সঙ্গে নতুন করে পথচলার হিসাব কষছে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই দুই জোটের টানাপোড়েনের মাঝেই ছোট দলগুলো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে নেমেছে। সংসদে প্রতিনিধিত্বের স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে তারা আদর্শের চেয়ে সমঝোতা ও সুবিধাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে যা আগামী দিনে দেশের রাজনীতিতে নতুন বাস্তবতা ও প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে।

এবারের নির্বাচনে একটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা হলো কিছু ছোট দল কার্যত নিজেদের দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগ দেওয়া। ঐসব দলের শীর্ষ নেতা সরাসরি বিএনপির সদস্যপদ গ্রহণ করেছেন এবং দলীয় প্রতীক ‘ধানের শীষে’ নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কয়েকটি আঞ্চলিক ও নামমাত্র নিবন্ধিত দলের চেয়ারম্যান ও সাধারণ সম্পাদকরা ইতোমধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত নেতৃত্বের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছেছেন। শর্ত একটাই নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে মনোনয়ন। এসব নেতার যুক্তি, নিজ দলের নাম থাকলেও বাস্তবে সংগঠন নেই, মাঠ নেই, ভোট নেই। ফলে বড় দলে যুক্ত হয়ে নির্বাচন করাই বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত।

অন্য একটি কৌশল হচ্ছে দল বিলুপ্ত না করে ব্যক্তিগতভাবে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করা। অর্থাৎ, নেতারা নিজ নিজ দলের পরিচয় রাখছেন, কিন্তু নির্বাচনে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করছেন বিএনপির প্রতীক। এতে ভবিষ্যতে দরকষাকষির সুযোগ থাকবে বলে তারা মনে করছেন। এটি মূলত ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির’ই প্রতিফলন। দল নয়, ব্যক্তি নিজেকে কেন্দ্র করে রাজনীতি পরিচালনা করছেন। এতে ছোট দলগুলো আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে, আর বড় দলগুলো সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হলেও আদর্শিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

বিএনপি ও জামায়াত এই দুই শক্তিকে কেন্দ্র করেই ছোট দলগুলোর বেশিরভাগ কৌশল আবর্তিত হচ্ছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছে নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বিজেপি, এনপিপি , জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (একাংশ)। এসব দলের নেতাদের এককভাবে নির্বাচনে গেলে সংসদে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই বড় দলের প্রতীক বা জোটের ছায়াতেই তাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে বেঁছে নিয়েছে।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোট গঠন করেছে কিছু ইসলামপন্থী ও সমমনা এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি, এলডিপি দল। জামায়াতের নেতারা বলছেন, আদর্শিক মিল থাকায় ছোট দলগুলো স্বাভাবিকভাবেই তাদের সঙ্গে যুক্ত হতে আগ্রহী হয়েছে।

শেষ মুহূর্তে এসে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে এনসিপির জোট গঠন দেশজুড়ে নানা প্রশ্ন ও ভাবনার জন্ম দিয়েছে। সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ মনে করেছিল, গণঅভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা ছাত্রনেতাদের হাত ধরেই গঠিত এই দলটি রাজনীতিতে নতুন ধারা ও ভিন্নমাত্রা নিয়ে আসবে। প্রত্যাশা ছিল, তারা প্রচলিত জোটনির্ভর ও সুবিধাবাদী রাজনীতির বাইরে গিয়ে একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পথ নির্মাণ করবে।

শুরু থেকেই এনসিপি ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে নিজেদের একটি বিকল্প শক্তি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিল। এই ঘোষণার মাধ্যমে দলটি জনগণের কাছে একটি আত্মবিশ্বাসী ও স্বাধীন রাজনৈতিক অবস্থানের বার্তা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের প্রাক্কালে এসে জামায়াতের সঙ্গে জোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সেই প্রত্যাশার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেই মনে করছেন অনেকে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই জোট গঠনের ফলে এনসিপির রাজনৈতিক অবস্থান ও ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যারা দলটিকে নতুন রাজনীতির প্রতীক হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন, তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। ফলে এনসিপির এই সিদ্ধান্ত আদর্শভিত্তিক রাজনীতির চেয়ে বাস্তব রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে—এমন ধারণা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।

লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রধান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, বীর বিক্রম। এলডিপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর জোট গঠন রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বড় চমক হিসেবেই দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে এসেছে। দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বহু বছর ধরেই ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে রাজনীতি করে আসছেন।

কিন্তু পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় এসে এলডিপি প্রত্যাশিত মূল্যায়ন না পাওয়ায় জোট রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বিএনপির পক্ষ থেকে এলডিপিকে পর্যাপ্ত গুরুত্ব না দেওয়ার সুযোগটি জামায়াতে ইসলামি কৌশলগতভাবে কাজে লাগিয়েছে। ফলে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সঙ্গী ছেড়ে এলডিপির এই নতুন জোটে যাওয়া নিছক তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং বর্তমান রাজনীতির বাস্তব হিসাব-নিকাশেরই প্রতিফলন।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, এই জোট পরিবর্তন শুধু এলডিপির নয়, বরং সামগ্রিক জোট রাজনীতিতেই একটি তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা দিচ্ছে যেখানে পারস্পরিক মূল্যায়ন ও আসন সমঝোতার প্রশ্নই ক্রমশ প্রধান নিয়ামক হয়ে উঠছে।

বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক মনে করেন, এই জোট কৌশল স্বল্পমেয়াদে কিছু নেতার ব্যক্তিগত লাভ নিশ্চিত করলেও দীর্ঘমেয়াদে রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর। এতে আদর্শভিত্তিক রাজনীতি দুর্বল হয়, সুযোগসন্ধানী রাজনীতির প্রসার ঘটে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট সৈয়দ ইফতেখার বলেন, ছোট দলগুলো সংসদে যেতে মরিয়া হয়ে নিজেদের অস্তিত্বই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আজ ধানের শীষ, কাল অন্য প্রতীক এই দোদুল্যমানতা জনগণের আস্থা নষ্ট করে।

রাজনীতিবিদরা বলছেন, তৃণমূল পর্যায়ের রাজনীতি বিদরাই বলছেন, ছোট দলগুলোর এই কৌশল নতুন কিছু নয়, তবে এবার তা আরও প্রকাশ্য ও নির্লজ্জ।

রাজনৈতিককর্মীরা মনে করছেন, নেতারা এমপি হতে চান, কিন্তু দল গড়ার দায় নিতে চান না। ভোটের সময় বড় দলে ভর করে সংসদে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। আরেকজন বলেন, এতে রাজনীতিতে কর্মীদের কোনো মূল্য থাকে না। সিদ্ধান্ত হয় শীর্ষ পর্যায়ে, মাঠের কর্মীরা শুধু দর্শক।

এমপি হওয়ার স্বপ্নে ছোট দলগুলোর জোট কৌশল দেশের রাজনীতিকে নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি করছে। বড় দলের ছায়ায় থেকে সংসদে যাওয়ার এই প্রবণতা ভবিষ্যতে রাজনীতিকে আরও ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও সুবিধাবাদী করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রশ্ন থেকেই যায় এই জোট রাজনীতি আদৌ কি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে, নাকি আদর্শহীন এক নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দেবে?

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ছোট দলগুলোর জোট কৌশল

আপডেট সময় :

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনীতিতে ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা নতুন করে চোখে পড়ছে। সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে এসব দল এখন বড় রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে জোট গঠন, আসনভিত্তিক সমঝোতা কিংবা প্রয়োজনে নিজ দল বিলুপ্ত করে বড় দলে যোগ দেওয়ার কৌশল গ্রহণ করছে। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠছে নানা নতুন জোট-সমীকরণ ও রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রবণতা আপাতদৃষ্টিতে বাস্তববাদী মনে হলেও এর গভীরে রয়েছে সংসদে যাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। ছোট দলগুলোর একটি বড় অংশ বুঝতে পারছে, এককভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। ফলে বড় দলের প্রতীক ও জোটের ছায়াতেই তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ খুঁজছে তারা। তবে স্বল্পমেয়াদে এতে কিছু নেতার ব্যক্তিগত সাফল্য এলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি দলীয় আদর্শ, রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য উদ্বেগজনক বার্তা বহন করছে।

বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় একদিকে রয়েছে দীর্ঘদিনের মাঠের আন্দোলনে অভিজ্ঞ বিএনপিনির্ভর জোট, অন্যদিকে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন শক্তি সঞ্চয় করা জামায়াতকেন্দ্রিক জোট। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মাঠে অনুপস্থিতি এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কার্যত এই দুই বৃহৎ জোটের মধ্যকার শক্তি পরীক্ষার লড়াইয়ে রূপ দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ছোট দলগুলোর অবস্থান আরও জটিল হয়ে উঠেছে। কেউ বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সম্পর্ক ও আন্দোলনের স্মৃতি ধরে রাখতে চাইছে, আবার কেউ পরিবর্তিত বাস্তবতায় জামায়াতের সঙ্গে নতুন করে পথচলার হিসাব কষছে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই দুই জোটের টানাপোড়েনের মাঝেই ছোট দলগুলো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে নেমেছে। সংসদে প্রতিনিধিত্বের স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে তারা আদর্শের চেয়ে সমঝোতা ও সুবিধাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে যা আগামী দিনে দেশের রাজনীতিতে নতুন বাস্তবতা ও প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে।

এবারের নির্বাচনে একটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা হলো কিছু ছোট দল কার্যত নিজেদের দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগ দেওয়া। ঐসব দলের শীর্ষ নেতা সরাসরি বিএনপির সদস্যপদ গ্রহণ করেছেন এবং দলীয় প্রতীক ‘ধানের শীষে’ নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কয়েকটি আঞ্চলিক ও নামমাত্র নিবন্ধিত দলের চেয়ারম্যান ও সাধারণ সম্পাদকরা ইতোমধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত নেতৃত্বের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছেছেন। শর্ত একটাই নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে মনোনয়ন। এসব নেতার যুক্তি, নিজ দলের নাম থাকলেও বাস্তবে সংগঠন নেই, মাঠ নেই, ভোট নেই। ফলে বড় দলে যুক্ত হয়ে নির্বাচন করাই বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত।

অন্য একটি কৌশল হচ্ছে দল বিলুপ্ত না করে ব্যক্তিগতভাবে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করা। অর্থাৎ, নেতারা নিজ নিজ দলের পরিচয় রাখছেন, কিন্তু নির্বাচনে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করছেন বিএনপির প্রতীক। এতে ভবিষ্যতে দরকষাকষির সুযোগ থাকবে বলে তারা মনে করছেন। এটি মূলত ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির’ই প্রতিফলন। দল নয়, ব্যক্তি নিজেকে কেন্দ্র করে রাজনীতি পরিচালনা করছেন। এতে ছোট দলগুলো আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে, আর বড় দলগুলো সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হলেও আদর্শিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

বিএনপি ও জামায়াত এই দুই শক্তিকে কেন্দ্র করেই ছোট দলগুলোর বেশিরভাগ কৌশল আবর্তিত হচ্ছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছে নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বিজেপি, এনপিপি , জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (একাংশ)। এসব দলের নেতাদের এককভাবে নির্বাচনে গেলে সংসদে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই বড় দলের প্রতীক বা জোটের ছায়াতেই তাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে বেঁছে নিয়েছে।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোট গঠন করেছে কিছু ইসলামপন্থী ও সমমনা এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি, এলডিপি দল। জামায়াতের নেতারা বলছেন, আদর্শিক মিল থাকায় ছোট দলগুলো স্বাভাবিকভাবেই তাদের সঙ্গে যুক্ত হতে আগ্রহী হয়েছে।

শেষ মুহূর্তে এসে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে এনসিপির জোট গঠন দেশজুড়ে নানা প্রশ্ন ও ভাবনার জন্ম দিয়েছে। সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ মনে করেছিল, গণঅভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা ছাত্রনেতাদের হাত ধরেই গঠিত এই দলটি রাজনীতিতে নতুন ধারা ও ভিন্নমাত্রা নিয়ে আসবে। প্রত্যাশা ছিল, তারা প্রচলিত জোটনির্ভর ও সুবিধাবাদী রাজনীতির বাইরে গিয়ে একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পথ নির্মাণ করবে।

শুরু থেকেই এনসিপি ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে নিজেদের একটি বিকল্প শক্তি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিল। এই ঘোষণার মাধ্যমে দলটি জনগণের কাছে একটি আত্মবিশ্বাসী ও স্বাধীন রাজনৈতিক অবস্থানের বার্তা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের প্রাক্কালে এসে জামায়াতের সঙ্গে জোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সেই প্রত্যাশার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেই মনে করছেন অনেকে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই জোট গঠনের ফলে এনসিপির রাজনৈতিক অবস্থান ও ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যারা দলটিকে নতুন রাজনীতির প্রতীক হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন, তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। ফলে এনসিপির এই সিদ্ধান্ত আদর্শভিত্তিক রাজনীতির চেয়ে বাস্তব রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে—এমন ধারণা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।

লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রধান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, বীর বিক্রম। এলডিপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর জোট গঠন রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বড় চমক হিসেবেই দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে এসেছে। দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বহু বছর ধরেই ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে রাজনীতি করে আসছেন।

কিন্তু পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় এসে এলডিপি প্রত্যাশিত মূল্যায়ন না পাওয়ায় জোট রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বিএনপির পক্ষ থেকে এলডিপিকে পর্যাপ্ত গুরুত্ব না দেওয়ার সুযোগটি জামায়াতে ইসলামি কৌশলগতভাবে কাজে লাগিয়েছে। ফলে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সঙ্গী ছেড়ে এলডিপির এই নতুন জোটে যাওয়া নিছক তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং বর্তমান রাজনীতির বাস্তব হিসাব-নিকাশেরই প্রতিফলন।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, এই জোট পরিবর্তন শুধু এলডিপির নয়, বরং সামগ্রিক জোট রাজনীতিতেই একটি তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা দিচ্ছে যেখানে পারস্পরিক মূল্যায়ন ও আসন সমঝোতার প্রশ্নই ক্রমশ প্রধান নিয়ামক হয়ে উঠছে।

বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক মনে করেন, এই জোট কৌশল স্বল্পমেয়াদে কিছু নেতার ব্যক্তিগত লাভ নিশ্চিত করলেও দীর্ঘমেয়াদে রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর। এতে আদর্শভিত্তিক রাজনীতি দুর্বল হয়, সুযোগসন্ধানী রাজনীতির প্রসার ঘটে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট সৈয়দ ইফতেখার বলেন, ছোট দলগুলো সংসদে যেতে মরিয়া হয়ে নিজেদের অস্তিত্বই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আজ ধানের শীষ, কাল অন্য প্রতীক এই দোদুল্যমানতা জনগণের আস্থা নষ্ট করে।

রাজনীতিবিদরা বলছেন, তৃণমূল পর্যায়ের রাজনীতি বিদরাই বলছেন, ছোট দলগুলোর এই কৌশল নতুন কিছু নয়, তবে এবার তা আরও প্রকাশ্য ও নির্লজ্জ।

রাজনৈতিককর্মীরা মনে করছেন, নেতারা এমপি হতে চান, কিন্তু দল গড়ার দায় নিতে চান না। ভোটের সময় বড় দলে ভর করে সংসদে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। আরেকজন বলেন, এতে রাজনীতিতে কর্মীদের কোনো মূল্য থাকে না। সিদ্ধান্ত হয় শীর্ষ পর্যায়ে, মাঠের কর্মীরা শুধু দর্শক।

এমপি হওয়ার স্বপ্নে ছোট দলগুলোর জোট কৌশল দেশের রাজনীতিকে নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি করছে। বড় দলের ছায়ায় থেকে সংসদে যাওয়ার এই প্রবণতা ভবিষ্যতে রাজনীতিকে আরও ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও সুবিধাবাদী করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রশ্ন থেকেই যায় এই জোট রাজনীতি আদৌ কি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে, নাকি আদর্শহীন এক নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দেবে?