হোলি আর্টিজান =
জঙ্গি হত্যাযজ্ঞের ৯ বছর আজ

- আপডেট সময় : ১০:৫৭:০১ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫ ১৭ বার পড়া হয়েছে
ভয়াবহ এ হামলায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞ এবং প্রায় ১২ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস জিম্মি সংকটের ঘটনায় স্তম্ভিত করেছিল পুরো জাতিকে। ভয়াবহ এই জঙ্গি হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তা ও ১৭ জন বিদেশি নাগরিকসহ নিহত হন ২২ জন
আজ ১ জুলাই। যেদিনে দেশের ইতিহাসে ঘটেছিল ভয়াবহ এক জঙ্গি হামলা। গত ২০১৬ সালের এই দিনে গুলশান-২ এর লেক পাড়ের হলি আর্টিজান বেকারিতে ঘটে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলা। ওই দিন রাত ৮টা ৪০ মিনিট থেকে হলি আর্টিজান বেকারিতে নারকীয় এক হত্যাযজ্ঞ শুরু করে জঙ্গিরা। ভয়াবহ এ হামলায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞ এবং প্রায় ১২ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস জিম্মি সংকটের ঘটনায় স্তম্ভিত করেছিল পুরো জাতিকে। ভয়াবহ এই জঙ্গি হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তা ও ১৭ জন বিদেশি নাগরিকসহ নিহত হন ২২ জন। ওই দিন সারারাত চেষ্টা করেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা হলি আর্টিজানের হত্যাযজ্ঞ ও জিম্মিদশা বন্ধ করতে পারেনি। পরের দিন ২ জুলাই সকালে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো সদস্যদের পরিচালিত ‘অপারেশন থান্ডারবোল্টে’ অবসান হয় জিম্মিদশার, নিহত হয় হামলাকারী পাঁচ জঙ্গি।
৭ জঙ্গির আমৃত্যুদন্ডাদেশ ঃ এ নৃশংস হত্যাযজ্ঞ মামলার রাজধানীর গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে প্রায় ৯ বছর আগে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় করা মামলায় সাত জনকে আমৃত্যু কারাদন্ড ও অর্থদন্ড দিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। ২২৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি আজ মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। এ মামলায় বিচারিক আদালতের ছয় বছর আগে দেওয়া রায়ে সাত আসামিকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিল। ওই মামলার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদন্ডাদেশ অনুমোদন) এবং আসামিদের আপিল ও জেল আপিলের ওপর শুনানি শেষে ২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই রায় দেন। ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদন্ডাদেশ অনুমোদন) নামঞ্জুর করে আসামিদের আপিল ও জেল আপিল খারিজ করে এ রায় দেওয়া হয়। বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান বাংলায় রায়টি লিখেছেন, এর সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বিচারপতি সহিদুল করিম।
আমৃত্যু কারাদন্ডপ্রাপ্ত সাত আসামি হলেন রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান, মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, হাদিসুর রহমান, আবদুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজ, মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন ও শরিফুল ইসলাম খালেদ।
যে জঙ্গিরা হামলা করেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী একাধিক বাহিনী জানায়, হলি আর্টিজান হামলায় সরাসরি অংশ নেয় উচ্চ শিক্ষিত পাঁচ জঙ্গি। তারা জঙ্গি মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ ও পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। হামলায় অংশ নেয় মালয়েশিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির ছাত্র নিবরাস ইসলাম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, স্কলাসটিকার সাবেক ছাত্র মীর সামিহ মোবাশ্বের, বগুড়ার বিগিগ্রাম ডিইউ সেন্ট্রাল ফাজিল মাদ্রাসার সাবেক ছাত্র খায়রুল ইসলাম পায়েল, বগুড়ার সরকারি আযিযুল হক কলেজের ছাত্র শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল।
হলি আর্টিসানে যা ঘটেছে ঃ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও তদন্ত সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাত ৮টা ৪০ মিনিটে গুলশান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রিপন কুমার দাস ওয়্যারলেসে খবর পান হলি আর্টিজান বেকারিতে গোলাগুলি হচ্ছে। খবর পেয়ে তিনি একটি টিম নিয়ে রাত ৮টা ৫০ মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন প্রচ- গোলাগুলি হচ্ছে। কিন্তু পুলিশের আসার খবর পেয়ে রিপন কুমার দাসের টিমের ওপর গুলি ছোড়াসহ গ্রেনেড নিক্ষেপ করে জঙ্গিরা। এতে তার সঙ্গে থাকা কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় রিপন কুমার দাস তার ঊর্ধ্বতন অফিসারদের বিষয়টি ফোন করে জানান। পরে ডিএমপির তৎকালীন কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়াসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসে ঘটনাস্থলে হাজির হন। এসময়ের মধ্যে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার খবর। পরিস্থিতি বেসামাল দেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা হলি আর্টিজানসহ পুরো গুলশান এলাকা ঘিরে ফেলেন।
ডিএমপি কমিশনার ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে জঙ্গিরা রাত ১০টার দিকে হলি আর্টিজানের প্রধান গেটে আবারও গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতে অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। গ্রেনেড নিক্ষেপে আহত হয়ে ওই দিন রাত সাড়ে ১১টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় বনানী থানার তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. সালাহউদ্দিন খান ও ডিবির সহকারী কমিশনার (এসি) মো. রবিউল করিম মারা যান।
এর মধ্যে রাত সাড়ে ১১টায় ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হন তৎকালীন র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। তিনি এসময় সাংবাদিকদের জানান, হলি আর্টিজানের ভেতরে অন্তত ২০ জন বিদেশিসহ কয়েকজন বাংলাদেশিও আটকা পড়েছেন। ভেতরে যারা আছেন, তাদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য তারা বিপথগামীদের সঙ্গে কথা বলতে চান।
এরপর রাতভর চলতে থাকে জিম্মিদশা। হাজার চেষ্টা করেও জঙ্গিদের সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এর মধ্যে রাত দেড়টার দিকে সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী পাঁচ তরুণের ছবি প্রকাশ করে হামলার দায় স্বীকার করে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)।
২০ মিনিটের কিলিং অপারেশন ঃ হলি আর্টিজান হামলার মামলার তদন্ত সূত্রে জানা যায়, হামলা শুরুর প্রথম ২০ মিনিটে হলি আর্টিজানে কিলিং মিশন সম্পূর্ণ করে জঙ্গিরা। জঙ্গিরা দেশি-বিদেশিদের গুলি করে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গলাকেটে মৃত্যু নিশ্চিত করে। হত্যার পর ছবি তুলে অ্যাপের মাধ্যমে বাইরে অবস্থানরত নব্য জেএমবির নেতা তামিম চৌধুরী ও মারজানের কাছে পাঠায় তারা।
অপারেশন থান্ডারবোল্ট ঃ রাতভর চেষ্টা করেও সফল না হওয়ায় পর দিন ২ জুলাই সকালে শুরু হয় ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’। সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনা করে ১২ ঘণ্টার জিম্মিদশার অবসান ঘটায়। মাত্র ১২ থেকে ১৩ মিনিটের মধ্যেই সব সন্ত্রাসীকে নির্মূল করে ওই এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন। ‘অপারেশন থান্ডারবোল্টে’র পর জঙ্গিদের হাতে নিহত ২০ জনের মরদেহ বের করে নিয়ে আসা হয় হলি আর্টিজান থেকে। এদের মধ্যে ৯ জন ইতালির নাগরিক, ৭ জন জাপানের, একজন ভারতের ও ৩ জন বাংলাদেশি।
উগ্রবাদী শাসন ব্যবস্থায় হামলা ঃ হলি আর্টিজান জঙ্গি হামলার পর এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তদন্ত করে। তাদের তদন্ত উঠে আসে জঙ্গিরা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে হলি আর্টিজানে বিদেশি নাগরিকদের লক্ষ্য করে হামলা চালায়। আন্তর্জাতিক কোনো জঙ্গি সংগঠনের সহায়তা ছাড়াই দেশীয় জঙ্গিরা এই হামলা চালায়। ‘নব্য জেএমবি’ সদস্যরা দেশে উগ্রবাদী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ হামলা চালায়।
হলি আর্টিজান হামলার মামলার তদন্তকারী সংস্থা ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট জানায়, দেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করার পরিকল্পনা থেকে হলি আর্টিজানে হামলা করে নব্য জেএমবির সদস্যরা। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে গাইবান্ধার সাঘাটায় নব্য জেএমবির শুরাকমিটির এক বৈঠকে এই হামলার পরিকল্পনা হয়। পরিশেষে রাজধানীর গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে প্রায় ৯ বছর আগে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় করা মামলায় সাত জনকে আমৃত্যু কারাদন্ড ও অর্থদন্ড দিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। ২২৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি আজ মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। এ মামলায় বিচারিক আদালতের ছয় বছর আগে দেওয়া রায়ে সাত আসামিকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়া হয়েছিল।