জয়পুরহাটে ইউনিয়ন পরিষদের ‘‘ভিডব্লিউবির’’ সুবিধাভোগী স্বাবলম্বীরা
- আপডেট সময় : ৪৯ বার পড়া হয়েছে
জয়পুরহাটে ইউনিয়ন পরিষদের ‘‘ভিডব্লিউবির’’ সুবিধাভোগী লাখপতিরা। সুবিধাভোগী স্বপ্না খাতুনের ইটের বাড়ি, স্বামী চালান ইজিবাইক, গোয়ালে লাখ টাকারও বেশি দামের গরু আছে। মাঠে আছে জমিও , নিজের জমিতে চাষাবাদ করে ঘরের ভাত খান। এক কথায় সব মিলিয়ে স্বপ্না খাতুনের সংসার খুবি স্বচ্ছল। সংসারে কোন ধরনের অভাব অনটোন নেই, তবুও তিনি সরকারি চাল তোলেন মাসে মাসে। কারণ, তার নাম উঠেছে ভিডব্লিউবি (ভালনারেবল উইমেন বেনিফিট) সুবিধাভোগীর তালিকায়।
অপরদিকে, স্বপ্নার খাতুনের বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে থাকেন হালিমা খাতুন ভাঙাচোরা মাটির ঘরে । স্বামী জাহিদুল ইসলাম দিনমজুর। সহায়-সম্পদ বলতে তাদের কিছুই নেই। তিন বেলা খাবার জোগাতেই অনেক কষ্ট করতে হয় তাদের। অথচ তিনি এই সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
এই সুবিধাভোগী শুধু স্বপ্না খাতুন একাই নন, তার মতো অনেকে পরিবার-ই স্বচ্ছল হলেও ভিডব্লিউবি সুবিধাভোগীর তালিকায় রয়েছে তাদের নাম। আর তারা প্রতি মাসে বিনামূল্যে ৩০ কেজি করে চাল পাচ্ছেন। এখানে মজার বিষয় হলো, স্বচ্ছল পরিবারের যারাই সুবিধাভোগী তারাই ইউপি সদস্যের আত্মীয়-স্বজন।
এমন ঘটনাটাই ঘটেছে জেলার ক্ষেতলাল উপজেলার বড়তারা ইউনিয়ন পরিষদের (৫ নং ওর্য়াডের বড়তারা গ্রামে)। অভিযোগ আছে, বড়তারা ইউপির প্যানেল চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের সদস্যদের স্বজনপ্রীতির পাশাপাশি ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে স্বচ্ছল নারীদের সুবিধাভোগীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর এতে করে প্রকৃত দুস্থ ও অসহায় নারীরা বাদ পড়েছেন। উপজেলা প্রশাসন অবশ্য বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রকাশ্যে যাচাই-বাছাই করে ভিডব্লিউবির উপকারভোগী নির্বাচন করেছিল। কিন্তু এখন এ তালিকায় স্বচ্ছল ব্যক্তি ও ইউপি সদস্যের স্বজনদের নাম থাকায় প্রশাসনের প্রকাশ্যে যাচাই-বাছাই এর ব্যতিক্রমী এ উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় ও বড়তারা ইউপি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার বড়তারা ইউনিয়নে ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে ভিডব্লিউবির কর্মসূচির আওতায় ইউনিয়নের প্রায় ১০২৭ জন নারী আবেদন করেছিলেন। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখানে তিন কর্মকর্তাকে সুবিধাভোগী যাচাই-বাছাইয়ের জন্য নিয়োগ করা হয়। তারা ইউনিয়ন পরিষদে প্রকাশ্যে যাচাই-বাছাই শেষে ৪৪০ জন সুবিধাভোগীকে নির্বাচন করেন। এরমধ্যে ৫ নং ওয়ার্ডে ৫৩ জন নারী আছেন সুবিধাভোগীর তালিকায়। তারা প্রত্যেকেই প্রতিমাসেই বিনামূল্যের ৩০ কেজি করে চাল পাচ্ছেন । গত ২৯ সেপ্টেম্বর-২০২৫ সুবিধাভোগীদের চাল বিতরণ করা হয়। এরপর সুবিধাভোগীর তালিকায় স্বচ্ছল পরিবারের সদস্য ও ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলামের আত্বীয় স্বজনের নাম থাকার বিষয়টি নজরে আসে । এই ঘটনাটি মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার দপ্তর তদন্ত করে ইতিমধ্যেই ঘটনার সত্যতা পেয়েছে।
ওই ওয়ার্ডের সুবিধাভোগীর তালিকার ১৯১ নম্বরে নাম আছে রাজিয়া সুলতানা, ২০৬ নম্বরে হাবিবা খাতুন, ২০৯ নম্বরে আছে স্বপ্না খাতুন, ২১০ নম্বরে খোতেজা বিবি, ২১৬ নম্বরে আলেয়া বেগম, ২১৭ নম্বরে আমেনা বিবি, ২২৪ নম্বরে মোছা: ফারহানা আক্তার, ২৩০ নম্বরে মোছা: সেলিনা বেগমের খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫ নং ওয়ার্ডের সুবিধাভোগীদের বেশিরভাগ স্বচ্ছল পরিবার। তারা ওই ওয়ার্ডের মেম্বার শফিকুল ইসলামের আত্নীয় স্বজন ও প্রতিবেশী। আর রাজিয়া সুলতানা মেম্বার শফিকুল ইসলামের চাচাতো ভাই মোস্তাফিজুর রহমানের স্ত্রী। হাবিবা খাতুনের ফ্ল্যাট বাড়ি আছে। তার স্বামী রায়হান কবির মৎস্যচাষী, মোটরসাইকেল, ধান মাড়াইয়ের যন্ত্র, ভটভটি আছে। আছে জমাজমিও , স্বচ্ছল পরিবার। সর্ম্পকে ইউপি সদস্যের আত্নীয় হন। স্বপ্না খাতুনের ইটের বাড়ি আছে। তার স্বামী আব্দুল মতিন ইজিবাইক চালান। গোয়ালে আছে অনেক টাকা গরুও। স্বচ্ছল পরিবার ইউপি সদস্যের আত্নীয়, খোতেজা বিবির স্বামী হেলাল ইলেকট্রনিক্সের দোকান ও অটোভ্যানের ব্যবসা আছে। তিনিও ইউপি সদস্যের আত্নীয়। আলেয়া বেগমের ইটের বাড়ি আছে। তার স্বামী ইদ্রীস আলী কাঠমিস্ত্রি। ফসলি জমিও চাষাবাদ করে। তিনি ইউপি সদস্য শফিকুলের আপন চাচী। আমেনা বিবি, তার স্বামী নাসির উদ্দিন একজন কৃষক। নিজস্ব জমিজমা আছে। তিনি ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলামের চাচী। সেলিনা খাতুনের পাকা বাড়ি আছে। তারা স্বচ্ছল পরিবার। তিনিও ইউপি সদস্য শফিকুলের ভাইয়ের স্ত্রী।
ওই গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলাম তার আত্বীয় স্বজন ও স্বচ্ছল পরিবারের সদস্যদের সুবিধাভোগীর তালিকায় নাম দিয়েছেন। এছাড়া যারা টাকা দিতে পেরেছে তাদের নাম দিয়েছেন। আর এ কাজে প্যানেল চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম ও মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজোশ আছে। পুরো ইউনিয়নেই ভিডব্লিউবির সুবিধাভোগী নির্বাচনে টাকার খেলা হয়েছে। অথচ উপজেলা প্রশাসন লোক দেখানো প্রকাশ্যে যাচাই-বাছাইয়ের আয়োজন করেছিল।
বড়তারা মধ্যপাড়া গ্রামের বাসিন্দা হালিমা খাতুন বলেন, বড় লোকেরা ৩০ কেজি চাউলের কার্ড পাছে। মোর কিছু নাই, মোক কার্ড দ্যাইনি। লাইনিতো দাঁড়াওচিনু। মোক বাদ দিছে। সকিমা বিবি বলেন, গরীব মানুষের টাকাও নাই, কার্ডও নাই।
বড়তারা ইউপির ৫ নং ওয়ার্ডের সদস্য শফিকুল ইসলাম বলেন, এবার অনলাইনে আবেদন পড়েছিল। যাচাই-বাছাইয়ের জন্য একদিন সবাইকে ডাকা হয়েছিল। সেখানে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ের লোকজন, ট্যাগ অফিসাররা যাচাই-বাছাই করে তালিকা করেছে। তবে যাচাই-বাছাইয়ে কিছু ভুল থাকতে পারে। এখানে আমার কোন হাত নেই। আর টাকা-পয়সা লেনদেনের বিষয়টি আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ছড়ানো ছাড়া আর কিছুই নয়।
এ বিষয়ে জানতে বড়তারা ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা এক নম্বর প্যানেল চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে কল করলে তিনি তা রিসিভ করেননি।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা লায়লা নাসরিন জাহান বলেন, ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলাম মিথ্যা তথ্য দিয়ে তার কয়েকজন স্বাবলম্বী আত্মীয়র নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ইতিমধ্যে আমরা তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পেয়েছি। আর সেই নামগুলো উপজেলা কমিটিতে উপস্থাপন করা হবে। এ বিষয়ে উপজেলা কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে। আরও কয়েকটি ইউনিয়নেরও একই রকমের অভিযোগ লোকজন বিভিন্ন দপ্তরে দিয়েছে।
ক্ষেতলাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসিফ আল জিনাত বলেন, আমরা শতভাগ স্বচ্ছ করার চেষ্টা করেছি। তবে কিছু ভুল রয়েছে। এ বিষয়ে আমরা তদন্ত করে নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো।
উল্লেখিত অনিয়মের বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অত্র এলাকার বিভিন্ন শ্রেণী পেশার সচেতন ব্যক্তিবর্গরা বলেন,ইউনিয়ন পরিষদসহ সবখানে যে কোন ধরণের অপরাধ ও অনিয়ম যারা করে তারা ওই দপ্তরের উর্ধতন কর্মকর্তা ,কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসন যেটাই বলিনা কেন ? তাদেরকে ম্যানেজ করেই করে বলে আমরা মনে করি ।সুতারাং সঠিক তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের উপযুক্ত শাস্তি আমরা প্রত্যাশা করি।

















