ঢাকা ০৮:১৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

জেলে পরিবারগুলোতে শোক আর হাহাকার

হালিম মোহাম্মদ
  • আপডেট সময় : ২৫৯ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারে গিয়ে প্রতিবছরই ডুবে যাচ্ছে অসংখ্য ট্রলার, হারিয়ে যাচ্ছেন শত শত জেলে। কারও লাশ ভেসে আসে, আবার অনেকের কোনো খোঁজও মেলে না। এতে কর্মক্ষম স্বজন হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ছে পরিবারগুলো। কারও সংসার চলছে ধার-কর্জে, কেউবা প্রতিবেশীর সাহায্যে। অথচ সমুদ্রে নিখোঁজ জেলেদের কোনো সঠিক পরিসংখ্যানই নেই সংশ্লিষ্ট দফতরের কাছে।
জেলে পরিবারের অভিযোগ, প্রতি বছর হাজারো জেলে সমুদ্রে হারিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু এখনো কার্যকর উদ্ধার অভিযান, রেসকিউ সেন্টার কিংবা আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। বছরের পর বছর বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা মেটাচ্ছেন জেলেরা। কিন্তু অনেকেই আর ঘরে ফেরেন না। উপকূলে বসে বিলাপ করে আশায় বুক বাঁধে ফিরে আসার অপেক্ষা। রয়েছে শোক আর হাহাকার।
৬২ বছর বয়সী নজরুল ইসলাম ছিলেন পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লালুয়ার একজন অভিজ্ঞ জেলে। দীর্ঘদিন ধরে সমুদ্রে মাছ শিকার করতেন তিনি। গত ২৫ জুলাই রাতে গভীর সমুদ্রে ঝড়ে পড়ে ডুবে যায় তার ট্রলার। নিখোঁজ হন ১৫ জন জেলে। এক সপ্তাহ পর গত পহেলা আগস্ট কুয়াকাটা সৈকতে ভেসে ওঠে নজরুলের নিথর দেহ। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে এখন দিশেহারা তার স্ত্রী ও সন্তানরা। নজরুলের স্ত্রী বলেন, আমাদের তো আর কেউ রইল না। সংসার চলে প্রতিবেশীর দেয়া চাল-ডালে। মালিক কোনো টাকা দেয়নি, সরকার থেকেও এখনো কিছু পাইনি। বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকালে বুকটা ফেটে যায়।
শুধু নজরুলের পরিবার নয়, পটুয়াখালী, ভোলা ও বরগুনার উপকূলে এমন হাজারো পরিবারের আর্তনাদ শোনা যায়। প্রতি বছরই সমুদ্রে ঝড়-ঝঞ্ঝায় প্রাণ হারান অসংখ্য জেলে। কেউ কেউ বছরের পর বছর নিখোঁজ থাকেন, যাদের লাশও আর ঘরে ফেরে না। শুধু ট্রলার ডুবিই নয়, দিকভ্রান্ত হয়ে ভারতীয় জলসীমায় ঢুকে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাও ঘটে। রেখে যান শোক, অনিশ্চয়তা আর দারিদ্র্যের তীব্র কষাঘাত।
সমুদ্রগামী জেলে কালাম মাঝি বলেন, পেটের দায়ে তো সমুদ্রে নামতেই হয়। জানি ঝুঁকি আছে। ঢেউ উঠলে ভয় লাগে, কিন্তু ঘরে খাবার না থাকলে ভয় ভুলে যাই। অনেকে আর ফেরত আসে না, তখন তাদের পরিবার না খেয়ে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক জেলে জোড়াতালির ইঞ্জিনচালিত ট্রলার নিয়ে গভীর সমুদ্রে যান। এসব নৌযানে নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম। দক্ষিণ উপকূলের জেলেরা বলছেন, সাধারণত বর্ষা মৌসুমে সাগরে লঘুচাপ বা নিম্নচাপ হলেও বড় ধরনের ঝড় কিংবা এসব ঝড়ে ট্রলারডুবি ও জেলেদের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে না। কিন্তু এবার কোনো রকম ঘূর্ণিঝড় ছাড়াই নিম্নচাপের প্রভাবে সৃষ্ট ঝড়ের তা-ব দেখেছেন উপকূলের জেলেরা।
জেলেদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান লয়েডস রেজিস্টার ফাউন্ডেশনের ‘ফিশসেফ’ ২০২৫ প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ হাজার ৩৫০ জনেরও বেশি জেলে শুধু নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাবে সাগরে মারা যান। ‘ফিশসেফ’ ২০২৫ প্রকল্পের তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায় বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী জেলার সমুদ্রগামী অন্তত ২০ জন জেলের সঙ্গে কথা বলে। এসব এলাকার জেলেরা বলেন, সমুদ্রগামী ট্রলারে জেলেদের নিরাপত্তা সরঞ্জাম বলতে চার থেকে পাঁচটি বয়া ছাড়া আর কিছুই থাকে না। লাইফ জ্যাকেট দেওয়ার ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের রয়েছে অনাগ্রহ। একই সঙ্গে ট্রলারগুলোয় দিক নির্ণয়ের জন্য কোনো যন্ত্রও নেই। ঝড়ের কবলে পড়লে জেলে ও মাঝিরা দিকহারা হয়ে ভেসে যান দেশের সমুদ্রসীমা ডিঙিয়ে ভিনদেশে। আটক হয়ে মাসের পর মাস সেখানে থাকতে হয়। মুক্তি পেতে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। এ ছাড়া সাগরে অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য কোনো ফাষ্টএইড বক্স নেই কোনো ট্রলারে।
মালিকপক্ষ কেন ট্রলারে জেলেদের নিরাপত্তায় লাইফ জ্যাকেট দিতে আগ্রহী নয়,এমন প্রশ্ন করা হলে অন্তত ১০ জন জেলে পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, মূলত মালিকেরা মনে করেন, জেলেদের লাইফ জ্যাকেট দেওয়া হলে ঝড়ের সময় জেলেরা ট্রলার ফেলে লাইফ জ্যাকেট নিয়ে জীবন বাঁচাতে সাগরে ঝাঁপ দেবেন। এতে তাঁদের ট্রলার ও সম্পদ অরক্ষিত হবে।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মালিকপক্ষ নিজেদের সম্পদ রক্ষায় জেলেদের জীবন রক্ষার সামগ্রী না দেওয়ার এই রেওয়াজকে অমানবিক বলে উল্লেখ করেছেন। এটা তাঁদের জলদাসে পরিণত করার অপকৌশল ছাড়া আর কিছু নয়।
ইউএসএআইডির অর্থায়নে পরিচালিত আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ডফিশের ইকোফিশ-২ অ্যাক্টিভিটি বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, উপকূলীয় এলাকার ৫০ লাখের বেশি মানুষের আয়ের প্রধান উৎস সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ। সমুদ্রে মাছ ধরার সঙ্গে জড়িত ২০০টিরও বেশি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার এবং ৬৭ হাজারের বেশি দেশি ইঞ্জিনচালিত নৌকা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির গবেষকেরা বলছেন, মৎস্যজীবীরা এখনো প্রচলিত পদ্ধতি ব্যবহার করে বঙ্গোপসাগরের মৎস্য সম্পদের প্রায় ৮৩ শতাংশ আহরণ করেন। সমুদ্রে মাছ ধরার কাজে যুক্ত এসব নৌযানে আধুনিক জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম ও নেভিগেশন সিস্টেমের যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
চট্টগ্রাম মেরিন ফিশারিজের পরিচালক বলেন,সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতির যুগে এটা অবশ্যই এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। লাইফ জ্যাকেটের ব্যাপারে মালিকদের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি আমিও জানি। এটা খুবই দুঃখজনক।
অপরদিকে পাথরঘাটা লাঠিমারার এলাকার ট্রলারমালিক আবুল হোসেন এবং একই উপজেলার মঠেরখাল এলাকার আরেক মালিক জাফর হাওলাদার বলেন, লাইফ জ্যাকেট ও বয়া থাকে না এটা নয়। কমবেশি সব ট্রলারেই কিছু আছে।
জেলেদের ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত সরকারের নীতি অনুযায়ী, মৎস্য অধিদপ্তরে নিবন্ধিত একজন জেলে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বজ্রপাত এবং জলদস্যু, বাঘ, কুমির বা বন্য প্রাণীর আক্রমণে মাছ ধরার সময় মারা গেলে বা নিখোঁজ হলে তাঁর পরিবার সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। এ ছাড়া স্থায়ীভাবে পঙ্গু ব্যক্তিদের জন্য সর্বোচ্চ এককালীন আর্থিক সহায়তা হিসেবে ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান আছে। সরকারি বিধি-বিধানের আওতায় না থাকায় অধিকাংশ জেলেই এই সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছেন।
ইকোফিশ-২ অ্যাক্টিভিটির হয়ে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং দায়িত্বশীলভাবে মাছ ধরতে জেলেদের প্রশিক্ষণ বিষয়ে কাজ করেন বিজ্ঞানী হেদায়েত উল্লাহ। তিনি বলেন, সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ এখন দেশের অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই এই বিয়ষটিকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। জেলেদের নিরাপত্তা, মাছ ধরায় আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজনসহ নানা বিষয়ে এ খাতে অনেক কিছু করার রয়েছে। আধুনিকায়ন না করা গেলে এই খাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো অসম্ভব।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের কর্মকর্তা বলেন, আমাদের জেলেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রে যান। অধিকাংশ ট্রলারেই যথেষ্ট লাইফ জ্যাকেট বা লাইফ বয়া থাকে না। দুর্ঘটনার সময় আত্মরক্ষার সুযোগ পান না তারা। তাই সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে জেলেদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতে হবে, নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে এবং আবহাওয়ার সতর্কতা ব্যবস্থা আরও কার্যকর করতে হবে।
মৎস্য অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ। অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, নিবন্ধিত জেলে সমুদ্রে দুর্ঘটনায় নিখোঁজ বা মৃত্যুবরণ করলে তাদের পরিবারকে এককালীন ৫০ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয়। তবে সঠিক তথ্য না মেলার কারণে অনেক পরিবারই এ সহায়তা থেকে বঞ্চিত হন। এজন্য নিবন্ধন কার্যক্রম আরও জোরদার করা হচ্ছে।
তবে বাস্তবে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। অগণিত পরিবার কোনো সহায়তাই পায় না। নিবন্ধন অসম্পূর্ণ থাকা বা দুর্ঘটনার প্রমাণ না পাওয়ায় তাদের কষ্ট আরও বেড়ে যায়। স্থানীয় জেলে সংগঠনের নেতারা বলছেন, সরকার ও ট্রলার মালিকপক্ষের সমন্বিত সহায়তার অভাবে পরিবারগুলো নিঃস্ব হয়ে পড়ে। জেলে নেতা নাসির মৃধা বলেন, প্রতিটি ট্রলারে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম থাকতে হবে। আর কোনো পরিবারকে যেন স্বজন হারিয়ে অনাহারে দিন কাটাতে না হয়, সে জন্য একটি বিশেষ তহবিল গঠন জরুরি বলে তিনি মনে করেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

জেলে পরিবারগুলোতে শোক আর হাহাকার

আপডেট সময় :

বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারে গিয়ে প্রতিবছরই ডুবে যাচ্ছে অসংখ্য ট্রলার, হারিয়ে যাচ্ছেন শত শত জেলে। কারও লাশ ভেসে আসে, আবার অনেকের কোনো খোঁজও মেলে না। এতে কর্মক্ষম স্বজন হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ছে পরিবারগুলো। কারও সংসার চলছে ধার-কর্জে, কেউবা প্রতিবেশীর সাহায্যে। অথচ সমুদ্রে নিখোঁজ জেলেদের কোনো সঠিক পরিসংখ্যানই নেই সংশ্লিষ্ট দফতরের কাছে।
জেলে পরিবারের অভিযোগ, প্রতি বছর হাজারো জেলে সমুদ্রে হারিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু এখনো কার্যকর উদ্ধার অভিযান, রেসকিউ সেন্টার কিংবা আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। বছরের পর বছর বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা মেটাচ্ছেন জেলেরা। কিন্তু অনেকেই আর ঘরে ফেরেন না। উপকূলে বসে বিলাপ করে আশায় বুক বাঁধে ফিরে আসার অপেক্ষা। রয়েছে শোক আর হাহাকার।
৬২ বছর বয়সী নজরুল ইসলাম ছিলেন পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লালুয়ার একজন অভিজ্ঞ জেলে। দীর্ঘদিন ধরে সমুদ্রে মাছ শিকার করতেন তিনি। গত ২৫ জুলাই রাতে গভীর সমুদ্রে ঝড়ে পড়ে ডুবে যায় তার ট্রলার। নিখোঁজ হন ১৫ জন জেলে। এক সপ্তাহ পর গত পহেলা আগস্ট কুয়াকাটা সৈকতে ভেসে ওঠে নজরুলের নিথর দেহ। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে এখন দিশেহারা তার স্ত্রী ও সন্তানরা। নজরুলের স্ত্রী বলেন, আমাদের তো আর কেউ রইল না। সংসার চলে প্রতিবেশীর দেয়া চাল-ডালে। মালিক কোনো টাকা দেয়নি, সরকার থেকেও এখনো কিছু পাইনি। বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকালে বুকটা ফেটে যায়।
শুধু নজরুলের পরিবার নয়, পটুয়াখালী, ভোলা ও বরগুনার উপকূলে এমন হাজারো পরিবারের আর্তনাদ শোনা যায়। প্রতি বছরই সমুদ্রে ঝড়-ঝঞ্ঝায় প্রাণ হারান অসংখ্য জেলে। কেউ কেউ বছরের পর বছর নিখোঁজ থাকেন, যাদের লাশও আর ঘরে ফেরে না। শুধু ট্রলার ডুবিই নয়, দিকভ্রান্ত হয়ে ভারতীয় জলসীমায় ঢুকে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাও ঘটে। রেখে যান শোক, অনিশ্চয়তা আর দারিদ্র্যের তীব্র কষাঘাত।
সমুদ্রগামী জেলে কালাম মাঝি বলেন, পেটের দায়ে তো সমুদ্রে নামতেই হয়। জানি ঝুঁকি আছে। ঢেউ উঠলে ভয় লাগে, কিন্তু ঘরে খাবার না থাকলে ভয় ভুলে যাই। অনেকে আর ফেরত আসে না, তখন তাদের পরিবার না খেয়ে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক জেলে জোড়াতালির ইঞ্জিনচালিত ট্রলার নিয়ে গভীর সমুদ্রে যান। এসব নৌযানে নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম। দক্ষিণ উপকূলের জেলেরা বলছেন, সাধারণত বর্ষা মৌসুমে সাগরে লঘুচাপ বা নিম্নচাপ হলেও বড় ধরনের ঝড় কিংবা এসব ঝড়ে ট্রলারডুবি ও জেলেদের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে না। কিন্তু এবার কোনো রকম ঘূর্ণিঝড় ছাড়াই নিম্নচাপের প্রভাবে সৃষ্ট ঝড়ের তা-ব দেখেছেন উপকূলের জেলেরা।
জেলেদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান লয়েডস রেজিস্টার ফাউন্ডেশনের ‘ফিশসেফ’ ২০২৫ প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ হাজার ৩৫০ জনেরও বেশি জেলে শুধু নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাবে সাগরে মারা যান। ‘ফিশসেফ’ ২০২৫ প্রকল্পের তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায় বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী জেলার সমুদ্রগামী অন্তত ২০ জন জেলের সঙ্গে কথা বলে। এসব এলাকার জেলেরা বলেন, সমুদ্রগামী ট্রলারে জেলেদের নিরাপত্তা সরঞ্জাম বলতে চার থেকে পাঁচটি বয়া ছাড়া আর কিছুই থাকে না। লাইফ জ্যাকেট দেওয়ার ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের রয়েছে অনাগ্রহ। একই সঙ্গে ট্রলারগুলোয় দিক নির্ণয়ের জন্য কোনো যন্ত্রও নেই। ঝড়ের কবলে পড়লে জেলে ও মাঝিরা দিকহারা হয়ে ভেসে যান দেশের সমুদ্রসীমা ডিঙিয়ে ভিনদেশে। আটক হয়ে মাসের পর মাস সেখানে থাকতে হয়। মুক্তি পেতে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। এ ছাড়া সাগরে অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য কোনো ফাষ্টএইড বক্স নেই কোনো ট্রলারে।
মালিকপক্ষ কেন ট্রলারে জেলেদের নিরাপত্তায় লাইফ জ্যাকেট দিতে আগ্রহী নয়,এমন প্রশ্ন করা হলে অন্তত ১০ জন জেলে পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, মূলত মালিকেরা মনে করেন, জেলেদের লাইফ জ্যাকেট দেওয়া হলে ঝড়ের সময় জেলেরা ট্রলার ফেলে লাইফ জ্যাকেট নিয়ে জীবন বাঁচাতে সাগরে ঝাঁপ দেবেন। এতে তাঁদের ট্রলার ও সম্পদ অরক্ষিত হবে।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মালিকপক্ষ নিজেদের সম্পদ রক্ষায় জেলেদের জীবন রক্ষার সামগ্রী না দেওয়ার এই রেওয়াজকে অমানবিক বলে উল্লেখ করেছেন। এটা তাঁদের জলদাসে পরিণত করার অপকৌশল ছাড়া আর কিছু নয়।
ইউএসএআইডির অর্থায়নে পরিচালিত আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ডফিশের ইকোফিশ-২ অ্যাক্টিভিটি বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, উপকূলীয় এলাকার ৫০ লাখের বেশি মানুষের আয়ের প্রধান উৎস সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ। সমুদ্রে মাছ ধরার সঙ্গে জড়িত ২০০টিরও বেশি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার এবং ৬৭ হাজারের বেশি দেশি ইঞ্জিনচালিত নৌকা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির গবেষকেরা বলছেন, মৎস্যজীবীরা এখনো প্রচলিত পদ্ধতি ব্যবহার করে বঙ্গোপসাগরের মৎস্য সম্পদের প্রায় ৮৩ শতাংশ আহরণ করেন। সমুদ্রে মাছ ধরার কাজে যুক্ত এসব নৌযানে আধুনিক জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম ও নেভিগেশন সিস্টেমের যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
চট্টগ্রাম মেরিন ফিশারিজের পরিচালক বলেন,সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতির যুগে এটা অবশ্যই এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। লাইফ জ্যাকেটের ব্যাপারে মালিকদের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি আমিও জানি। এটা খুবই দুঃখজনক।
অপরদিকে পাথরঘাটা লাঠিমারার এলাকার ট্রলারমালিক আবুল হোসেন এবং একই উপজেলার মঠেরখাল এলাকার আরেক মালিক জাফর হাওলাদার বলেন, লাইফ জ্যাকেট ও বয়া থাকে না এটা নয়। কমবেশি সব ট্রলারেই কিছু আছে।
জেলেদের ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত সরকারের নীতি অনুযায়ী, মৎস্য অধিদপ্তরে নিবন্ধিত একজন জেলে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বজ্রপাত এবং জলদস্যু, বাঘ, কুমির বা বন্য প্রাণীর আক্রমণে মাছ ধরার সময় মারা গেলে বা নিখোঁজ হলে তাঁর পরিবার সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। এ ছাড়া স্থায়ীভাবে পঙ্গু ব্যক্তিদের জন্য সর্বোচ্চ এককালীন আর্থিক সহায়তা হিসেবে ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান আছে। সরকারি বিধি-বিধানের আওতায় না থাকায় অধিকাংশ জেলেই এই সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছেন।
ইকোফিশ-২ অ্যাক্টিভিটির হয়ে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং দায়িত্বশীলভাবে মাছ ধরতে জেলেদের প্রশিক্ষণ বিষয়ে কাজ করেন বিজ্ঞানী হেদায়েত উল্লাহ। তিনি বলেন, সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ এখন দেশের অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই এই বিয়ষটিকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। জেলেদের নিরাপত্তা, মাছ ধরায় আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজনসহ নানা বিষয়ে এ খাতে অনেক কিছু করার রয়েছে। আধুনিকায়ন না করা গেলে এই খাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো অসম্ভব।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের কর্মকর্তা বলেন, আমাদের জেলেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রে যান। অধিকাংশ ট্রলারেই যথেষ্ট লাইফ জ্যাকেট বা লাইফ বয়া থাকে না। দুর্ঘটনার সময় আত্মরক্ষার সুযোগ পান না তারা। তাই সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে জেলেদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতে হবে, নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে এবং আবহাওয়ার সতর্কতা ব্যবস্থা আরও কার্যকর করতে হবে।
মৎস্য অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ। অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, নিবন্ধিত জেলে সমুদ্রে দুর্ঘটনায় নিখোঁজ বা মৃত্যুবরণ করলে তাদের পরিবারকে এককালীন ৫০ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয়। তবে সঠিক তথ্য না মেলার কারণে অনেক পরিবারই এ সহায়তা থেকে বঞ্চিত হন। এজন্য নিবন্ধন কার্যক্রম আরও জোরদার করা হচ্ছে।
তবে বাস্তবে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। অগণিত পরিবার কোনো সহায়তাই পায় না। নিবন্ধন অসম্পূর্ণ থাকা বা দুর্ঘটনার প্রমাণ না পাওয়ায় তাদের কষ্ট আরও বেড়ে যায়। স্থানীয় জেলে সংগঠনের নেতারা বলছেন, সরকার ও ট্রলার মালিকপক্ষের সমন্বিত সহায়তার অভাবে পরিবারগুলো নিঃস্ব হয়ে পড়ে। জেলে নেতা নাসির মৃধা বলেন, প্রতিটি ট্রলারে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম থাকতে হবে। আর কোনো পরিবারকে যেন স্বজন হারিয়ে অনাহারে দিন কাটাতে না হয়, সে জন্য একটি বিশেষ তহবিল গঠন জরুরি বলে তিনি মনে করেন।