ঢাকা ০৪:৩৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ডাকসুতে আনছে নতুন বার্তা

মহিউদ্দিন তুষার
  • আপডেট সময় : ২৫ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

রাত পোহালেই ভোট

রাত পোহালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। বিগত সময়ের নির্বাচনগুলোর তুলনায় এবারের ভোট যেন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎসাহ, সচেতনতা এবং অংশগ্রহণ আগের চেয়ে অনেক বেশি। প্রজন্মের পরিবর্তন, প্রযুক্তিনির্ভর প্রচারণা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের জন্য আনা নতুন ব্যবস্থা ভোটারদের দৃষ্টিকোণ থেকে এই নির্বাচনকে ভিন্ন করেছে। ২০১৯ সালে দীর্ঘ ২৮ বছরের বিরতির পর ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা উৎসাহী হলেও নানা অনিয়ম ও অভিযোগের কারণে ভোট প্রক্রিয়ায় সমালোচনা ছিল। এবারের নির্বাচন মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত হওয়ায় ভোটাররা এক প্রজন্মের মধ্যে দু’বার ভোটের অভিজ্ঞতা পাচ্ছেন। বিশেষ করে প্রথমবার ভোট দিতে যাওয়া শিক্ষার্থীরা এই নির্বাচনকে ইতিহাসের অংশ মনে করছেন। তারা চাইছেন ভোট প্রক্রিয়া হবে শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও সুষ্ঠু।
ডাকসুর এবারের নির্বাচন শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যেই নয়, দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ভোটারই এটিকে বলছেন জাতীয় নির্বাচনের এসিড টেস্ট মনে করছেন। কারণ এটি দেশের ভোটার মানসিকতা, রাজনৈতিক পরিপক্কতা ও অংশগ্রহণকে মাপার এক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। যা বিগত ৫৪ বছরেও এমনটা দেখা যায়নি। যে কোন সময়ের চেয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগে শিক্ষার্থীরা আরও বেশি সচেতন। প্রজন্মের নতুন ঢেউ, বিশেষ করে প্রথমবার ভোট দেওয়া শিক্ষার্থীরা দেশের বৃহত্তম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শান্তিপূর্ণ ও স্বচ্ছ ভোট দিতে মুখিয়ে। তারা ভোট দিতে গেলে দলের প্রভাব বা সহিংসতার ভয়ে প্রভাবিত হন না এটি ভবিষ্যতের জাতীয় ভোটার আচরণের আগাম ইঙ্গিত।
আগের নির্বাচনে পোস্টার, দেয়াললিখন এবং মিছিলই প্রচারণার মূল হাতিয়ার ছিল। এবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে প্রচারণা বেশি চোখে পড়ছে। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক ও ইনস্টাগ্রামে প্রার্থীরা লাইভ সেশন, ভিডিও বার্তা ও রিলসের মাধ্যমে ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করছেন। ফলে ভোটাররা প্রার্থীর বক্তব্য, পরিকল্পনা ও নেতৃত্বগুণ সহজেই যাচাই করতে পারছেন। অতীত নির্বাচনে গেস্টরুম-গণরুমের চাপ, ভয়ভীতি এবং সহিংসতার অভিযোগ ছিল ব্যাপক। এবারের নির্বাচনে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, বুথ নিরাপত্তা এবং বাড়তি নজরদারি রাখা হয়েছে। ভোটাররা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোট দিতে পারছেন বলে জানাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
নারী প্রার্থীরা এবার সরাসরি নারী ভোটারদের কেন্দ্রভিত্তিক উপস্থিতির আহ্বান জানিয়েছেন। প্রার্থীরা চাইছেন নারী শিক্ষার্থীরা ভোট কেন্দ্রের বাইরে থেকে অংশ না নিন, বরং সক্রিয়ভাবে ভোট দিন। সামাজিক মাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণ ও দৃষ্টিভঙ্গি আগের যে কোনো নির্বাচনের তুলনায় বেশি আলোচিত হচ্ছে। আগের নির্বাচনে দলীয় প্রভাবই প্রার্থীদের নির্বাচনী দৌড়ে প্রাধান্য দিত। এবার অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আবাসন সংকট, গবেষণা সুবিধা, লাইব্রেরি এবং নিরাপত্তা বিষয়গুলোকে ইশতেহারে তুলে ধরছেন। শিক্ষার্থীরা এসব বাস্তব সমস্যা সমাধানের জন্য স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন করছেন।
অতীতের নির্বাচনে উৎসবমুখর শোভাযাত্রা, ব্যান্ড শো এবং মিছিল প্রাধান্য পেত। এবারে শিক্ষার্থীরা বলছেন, তারা শুধু উৎসব নয়, বরং কার্যকর ও দায়বদ্ধ নেতৃত্ব চাচ্ছেন। নিরাপত্তা, স্বচ্ছতা এবং শিক্ষার্থীর অধিকার রক্ষার দিকেই ভোটাররা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে ডাকসু নির্বাচন ২০২৫ শুধু একটি ভোট নয়, এটি শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, প্রজন্ম পরিবর্তন এবং নতুন প্রযুক্তিনির্ভর ও স্বচ্ছ নির্বাচনের প্রতিফলন। প্রার্থীরা যাতে শিক্ষার্থীর বাস্তব সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয়, সেই দিকেই শিক্ষার্থীদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। ১৯৫৩ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় ডাকসুর প্রথম নির্বাচন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ভাষা আন্দোলনের উত্তাল প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ নির্বাচন আয়োজন করে। তৎকালীন নির্বাচনে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন অংশ নেয়। প্রগতিশীল ছাত্র ইউনিয়নপন্থীরা জোরালো উপস্থিতি দেখায়। ভোটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের নেতৃত্ব বেছে নেয় এবং এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় ছাত্র রাজনীতির আনুষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক চর্চা।
প্রথম নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন মহিউদ্দিন আহমেদ। জেনারেল সেক্রেটারি (জিএস) পদে জয়লাভ করেন গাজী আরেফিন। সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) হন পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের ছাত্রনেতা হিসেবে খ্যাত আ স ম আব্দুর রব। ডাকসুর এই প্রথম নির্বাচন কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ ছিল না। এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে জাতীয় রাজনীতিতে। পরবর্তী সময়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবি, স্বাধিকার আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র নেতৃত্বের ভিত্তি তৈরি করে দেয় এই ডাকসু।ইতিহাসবিদদের মতে, ডাকসুর প্রথম নির্বাচন ছাত্রসমাজের গণতান্ত্রিক চর্চার একটি শক্ত ভিত তৈরি করেছিল, যা পরবর্তী সময়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ছাত্রদের ভূমিকা সুদৃঢ় করে। এরপর ধারাবাহিকভাবে ডাকসুর নির্বাচনে উঠে আসে এমন সব নাম, যারা পরে জাতীয় রাজনীতিরও নেতৃত্ব দেন। ষাটের দশকে মওদুদ আহমদ, আব্দুস সালাম খান, তোফায়েল আহমেদরা ডাকসুর নেতৃত্বে আসেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে ডাকসুর তৎকালীন ভিপি তোফায়েল আহমেদ ছিলেন অন্যতম নেতৃত্বশক্তি।
সত্তরের দশকে ডাকসুর সভাপতি হন আ স ম আব্দুর রব, যিনি মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করেছিলেন। স্বাধীনতার পর ডাকসুর ভিপি হিসেবে উঠে আসেন মহিউদ্দিন খান আলমগীর, নজরুল ইসলাম খানসহ আরও অনেকে। আশির দশকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ডাকসুর নেতৃত্ব দেন মাহবুবুল হক শাকিল, আমান উল্লাহ আমান প্রমুখ। ১৯৯০-এর গণতন্ত্র আন্দোলনেও ডাকসু ছিল অগ্রভাগে। ভিপি আমান উল্লাহ আমান ও জিএস বজলুর রশীদ ফিরোজ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ডাকসুর নির্বাচন বন্ধ ছিল। অবশেষে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন নুরুল হক নুর, জিএস হন গোলাম রাব্বানী। এই নির্বাচন নতুন প্রজন্মের ছাত্রদের আবারও ডাকসুর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। বিশ্লেষকদের মতে, ডাকসুর নেতৃত্ব শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ ছিল না। এখানে গড়ে ওঠা নেতারা জাতীয় রাজনীতিতেও রেখেছেন গভীর ছাপ। ১৯৫৩ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ডাকসুর ইতিহাস তাই এক অর্থে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেরই প্রতিচ্ছবি।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ডাকসুতে আনছে নতুন বার্তা

আপডেট সময় :

রাত পোহালেই ভোট

রাত পোহালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। বিগত সময়ের নির্বাচনগুলোর তুলনায় এবারের ভোট যেন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎসাহ, সচেতনতা এবং অংশগ্রহণ আগের চেয়ে অনেক বেশি। প্রজন্মের পরিবর্তন, প্রযুক্তিনির্ভর প্রচারণা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের জন্য আনা নতুন ব্যবস্থা ভোটারদের দৃষ্টিকোণ থেকে এই নির্বাচনকে ভিন্ন করেছে। ২০১৯ সালে দীর্ঘ ২৮ বছরের বিরতির পর ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা উৎসাহী হলেও নানা অনিয়ম ও অভিযোগের কারণে ভোট প্রক্রিয়ায় সমালোচনা ছিল। এবারের নির্বাচন মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত হওয়ায় ভোটাররা এক প্রজন্মের মধ্যে দু’বার ভোটের অভিজ্ঞতা পাচ্ছেন। বিশেষ করে প্রথমবার ভোট দিতে যাওয়া শিক্ষার্থীরা এই নির্বাচনকে ইতিহাসের অংশ মনে করছেন। তারা চাইছেন ভোট প্রক্রিয়া হবে শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও সুষ্ঠু।
ডাকসুর এবারের নির্বাচন শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যেই নয়, দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ভোটারই এটিকে বলছেন জাতীয় নির্বাচনের এসিড টেস্ট মনে করছেন। কারণ এটি দেশের ভোটার মানসিকতা, রাজনৈতিক পরিপক্কতা ও অংশগ্রহণকে মাপার এক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। যা বিগত ৫৪ বছরেও এমনটা দেখা যায়নি। যে কোন সময়ের চেয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগে শিক্ষার্থীরা আরও বেশি সচেতন। প্রজন্মের নতুন ঢেউ, বিশেষ করে প্রথমবার ভোট দেওয়া শিক্ষার্থীরা দেশের বৃহত্তম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শান্তিপূর্ণ ও স্বচ্ছ ভোট দিতে মুখিয়ে। তারা ভোট দিতে গেলে দলের প্রভাব বা সহিংসতার ভয়ে প্রভাবিত হন না এটি ভবিষ্যতের জাতীয় ভোটার আচরণের আগাম ইঙ্গিত।
আগের নির্বাচনে পোস্টার, দেয়াললিখন এবং মিছিলই প্রচারণার মূল হাতিয়ার ছিল। এবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে প্রচারণা বেশি চোখে পড়ছে। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক ও ইনস্টাগ্রামে প্রার্থীরা লাইভ সেশন, ভিডিও বার্তা ও রিলসের মাধ্যমে ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করছেন। ফলে ভোটাররা প্রার্থীর বক্তব্য, পরিকল্পনা ও নেতৃত্বগুণ সহজেই যাচাই করতে পারছেন। অতীত নির্বাচনে গেস্টরুম-গণরুমের চাপ, ভয়ভীতি এবং সহিংসতার অভিযোগ ছিল ব্যাপক। এবারের নির্বাচনে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, বুথ নিরাপত্তা এবং বাড়তি নজরদারি রাখা হয়েছে। ভোটাররা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোট দিতে পারছেন বলে জানাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
নারী প্রার্থীরা এবার সরাসরি নারী ভোটারদের কেন্দ্রভিত্তিক উপস্থিতির আহ্বান জানিয়েছেন। প্রার্থীরা চাইছেন নারী শিক্ষার্থীরা ভোট কেন্দ্রের বাইরে থেকে অংশ না নিন, বরং সক্রিয়ভাবে ভোট দিন। সামাজিক মাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণ ও দৃষ্টিভঙ্গি আগের যে কোনো নির্বাচনের তুলনায় বেশি আলোচিত হচ্ছে। আগের নির্বাচনে দলীয় প্রভাবই প্রার্থীদের নির্বাচনী দৌড়ে প্রাধান্য দিত। এবার অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আবাসন সংকট, গবেষণা সুবিধা, লাইব্রেরি এবং নিরাপত্তা বিষয়গুলোকে ইশতেহারে তুলে ধরছেন। শিক্ষার্থীরা এসব বাস্তব সমস্যা সমাধানের জন্য স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন করছেন।
অতীতের নির্বাচনে উৎসবমুখর শোভাযাত্রা, ব্যান্ড শো এবং মিছিল প্রাধান্য পেত। এবারে শিক্ষার্থীরা বলছেন, তারা শুধু উৎসব নয়, বরং কার্যকর ও দায়বদ্ধ নেতৃত্ব চাচ্ছেন। নিরাপত্তা, স্বচ্ছতা এবং শিক্ষার্থীর অধিকার রক্ষার দিকেই ভোটাররা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে ডাকসু নির্বাচন ২০২৫ শুধু একটি ভোট নয়, এটি শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, প্রজন্ম পরিবর্তন এবং নতুন প্রযুক্তিনির্ভর ও স্বচ্ছ নির্বাচনের প্রতিফলন। প্রার্থীরা যাতে শিক্ষার্থীর বাস্তব সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয়, সেই দিকেই শিক্ষার্থীদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। ১৯৫৩ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় ডাকসুর প্রথম নির্বাচন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ভাষা আন্দোলনের উত্তাল প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ নির্বাচন আয়োজন করে। তৎকালীন নির্বাচনে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন অংশ নেয়। প্রগতিশীল ছাত্র ইউনিয়নপন্থীরা জোরালো উপস্থিতি দেখায়। ভোটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের নেতৃত্ব বেছে নেয় এবং এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় ছাত্র রাজনীতির আনুষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক চর্চা।
প্রথম নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন মহিউদ্দিন আহমেদ। জেনারেল সেক্রেটারি (জিএস) পদে জয়লাভ করেন গাজী আরেফিন। সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) হন পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের ছাত্রনেতা হিসেবে খ্যাত আ স ম আব্দুর রব। ডাকসুর এই প্রথম নির্বাচন কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ ছিল না। এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে জাতীয় রাজনীতিতে। পরবর্তী সময়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবি, স্বাধিকার আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র নেতৃত্বের ভিত্তি তৈরি করে দেয় এই ডাকসু।ইতিহাসবিদদের মতে, ডাকসুর প্রথম নির্বাচন ছাত্রসমাজের গণতান্ত্রিক চর্চার একটি শক্ত ভিত তৈরি করেছিল, যা পরবর্তী সময়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ছাত্রদের ভূমিকা সুদৃঢ় করে। এরপর ধারাবাহিকভাবে ডাকসুর নির্বাচনে উঠে আসে এমন সব নাম, যারা পরে জাতীয় রাজনীতিরও নেতৃত্ব দেন। ষাটের দশকে মওদুদ আহমদ, আব্দুস সালাম খান, তোফায়েল আহমেদরা ডাকসুর নেতৃত্বে আসেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে ডাকসুর তৎকালীন ভিপি তোফায়েল আহমেদ ছিলেন অন্যতম নেতৃত্বশক্তি।
সত্তরের দশকে ডাকসুর সভাপতি হন আ স ম আব্দুর রব, যিনি মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করেছিলেন। স্বাধীনতার পর ডাকসুর ভিপি হিসেবে উঠে আসেন মহিউদ্দিন খান আলমগীর, নজরুল ইসলাম খানসহ আরও অনেকে। আশির দশকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ডাকসুর নেতৃত্ব দেন মাহবুবুল হক শাকিল, আমান উল্লাহ আমান প্রমুখ। ১৯৯০-এর গণতন্ত্র আন্দোলনেও ডাকসু ছিল অগ্রভাগে। ভিপি আমান উল্লাহ আমান ও জিএস বজলুর রশীদ ফিরোজ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ডাকসুর নির্বাচন বন্ধ ছিল। অবশেষে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন নুরুল হক নুর, জিএস হন গোলাম রাব্বানী। এই নির্বাচন নতুন প্রজন্মের ছাত্রদের আবারও ডাকসুর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। বিশ্লেষকদের মতে, ডাকসুর নেতৃত্ব শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ ছিল না। এখানে গড়ে ওঠা নেতারা জাতীয় রাজনীতিতেও রেখেছেন গভীর ছাপ। ১৯৫৩ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ডাকসুর ইতিহাস তাই এক অর্থে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেরই প্রতিচ্ছবি।