ঢাকা ০২:১৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫

ডিজিটাল অর্থনীতির যুগে প্রবেশ বাংলাদেশের

স্টাফ রিপোর্টার
  • আপডেট সময় : ৬২ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে চীন। পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে উন্নয়নের পথে অগ্রসরমান দুই দেশ। আধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চীনা সহায়তায় ডিজিটাল অর্থনীতির যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে এগিয়ে যাওয়া দেশটির প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে ডিজিটাল অর্থনীতি। এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় এশিয়ার নেতৃত্বে থাকা দেশটি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক দেশ যুক্তরাষ্ট্রকেও পেছনে ফেলছে।
চীনের জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর এনডিবি প্রকাশিত ‘ডিজিটাল চায়না ডেভেলপমেন্ট’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে চীনের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ১০ শতাংশ ছিল ডিজিটাল অর্থনীতি।
বর্তমানে বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে চীন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ আমদানির উৎস। পোশাক শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তিপণ্য, বৈদ্যুতিক সামগ্রী ও ভোক্তাপণ্যসহ নানা খাতেই চীনের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা ব্যাপক। যদিও রপ্তানি খাত এখনো তুলনামূলক সীমিত। তারপরও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। বিশেষ করে কৃষিপণ্য, পাটজাত সামগ্রী ও ওষুধ খাতে।
২০২০ সালে বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা ঘোষণা করে চীন, যা বাণিজ্যে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। এই উদ্যোগের ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা চীনা বাজারে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছেন, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈচিত্র্য আনতে সহায়তা করছে। হুয়াওয়ে, শাওমি, অপো, ভিভোসহ চীনা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর উপস্থিতি বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতিকে গতিশীল করেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প বাস্তবায়নে চীনের প্রযুক্তিগত সহায়তা একটি বড় ভূমিকা রেখেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সব দিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক আজ একটি অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রতীক। চীনের প্রযুক্তি, বিনিয়োগ বাংলাদেশের শিল্পায়ন, জ্বালানি নিরাপত্তা ও ডিজিটাল রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
প্রযুক্তিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশে এখনো অনেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তিকে শুধু লেখালেখি, ছবি তৈরি বা চ্যাটবটের মধ্যেই সীমাবদ্ধভাবে কল্পনা করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই প্রযুক্তি শিল্প, কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জাতীয় নিরাপত্তায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। চীনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিপ্লব বাংলাদেশের জন্য একটি কার্যকর ও অনুসরণযোগ্য মডেল হতে পারে।
বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ গড়তে এখন থেকেই একটি সুসংগঠিত, গবেষণাভিত্তিক ও প্রয়োগমুখী এআই কাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণাধর্মী এআই ল্যাব স্থাপন, কৃষি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এআই প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে একটি জাতীয় এআই কাউন্সিল বা টাস্কফোর্স গঠন সময়োপযোগী হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে এআই স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তর করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডেটা সায়েন্স অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। স্কুলপর্যায় থেকেই প্রোগ্রামিং ও কোডিং শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে ওঠে। একইসঙ্গে দেশে একটি শক্তিশালী এআই ট্যালেন্টপুল গড়ে তুলতে হবে, যারা গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে নেতৃত্ব দেবে।
এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশেরও গেম শিল্পে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এই শিল্পের বিকাশ হলে বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। তাই বাংলাদেশের গেম শিল্প ও ডিজিটাল খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী চীনের অন্যতম বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান টেনসেন্ট।
টেনসেন্টের এপিএসি অঞ্চলের হেড অব পাবলিক অ্যাফেয়ার্স ইয়ে লার লাউ বলেন, গেম কেবল বিনোদন নয়, এটি একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক খাত, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং বৈশ্বিক সংযোগ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের তরুণ, প্রযুক্তি-সচেতন জনগোষ্ঠী ও দ্রুত উন্নয়নশীল ডিজিটাল অবকাঠামো গেম শিল্পের বিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে প্রস্তুত। বাংলাদেশের গেম ও ডিজিটাল খাতের উন্নয়নে টেনসেন্ট কাজ করতে আগ্রহী, যা দেশের অর্থনীতি ও সমাজের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে আমার বিশ্বাস। বাংলাদেশ ইন্টেলেকচ্যুয়াল প্রোপার্টি ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা এ বি এম হামিদুল মিসবাহ বলেন, বাংলাদেশের গেম শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় পার করছে। সঠিক নীতি, বিনিয়োগ ও সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা এর সম্পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারি। বাংলাদেশের ডিজিটাল অবকাঠামোর বড় অংশ এখন চীনা প্রযুক্তিনির্ভর। মোবাইল নেটওয়ার্কের যন্ত্রাংশ, ফাইবার অপটিক, সিসিটিভি ক্যামেরা, এমনকি সরকারি তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্পেও হুয়াওয়ে ও জেডটিইর ভূমিকা বিশাল।
বাংলাদেশের টেলিকম কোম্পানিগুলোর (গ্রামীণফোন বাদে) প্রায় সবগুলোই চীনা সরঞ্জাম ব্যবহার করে। এছাড়া সরকারি নিরাপত্তা অবকাঠামো, স্মার্ট সিটি প্রকল্প এবং ডেটা সেন্টারে চীনা কোম্পানির প্রযুক্তি রয়েছে। এখানে ভূ-রাজনৈতিক একটি বাস্তবতা আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো যেখানে ৫জি নেটওয়ার্কে হুয়াওয়ে বর্জন করছে, সেখানে বাংলাদেশ চীনা প্রযুক্তি গ্রহণে তুলনামূলক উন্মুক্ত।
বাংলাদেশের স্মার্টফোন বাজারেও চীনা ব্র্যান্ডের দাপট দিন দিন বাড়ছে। অপো, টেকনো, রিয়েলমি, ভিভো, শাওমি এখন দেশের মধ্যবিত্ত ও তরুণ প্রজন্মের পছন্দের তালিকার শীর্ষে। সাশ্রয়ীমূল্য, আকর্ষণীয় ডিজাইন, ভালো মানের ক্যামেরা ও দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারি- এই চার বৈশিষ্ট্য চীনা ব্র্যান্ডগুলো জনপ্রিয় করেছে।
বাংলাদেশে উৎপাদন কারখানা স্থাপনের মাধ্যমেও তারা তাদের প্রভাব আরও গভীর করেছে। স্থানীয়ভাবে স্মার্টফোন অ্যাসেম্বল করার ফলে পণ্যের মূল্য কমেছে, কর্মসংস্থান বেড়েছে এবং সরকার রাজস্ব আদায়েও লাভবান হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া দেশের প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করছে। চীনের ইলেকট্রিক গাড়ি খাত দ্রুত গতি পাচ্ছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালে বিশ্বের বৃহত্তম ইভি নির্মাতা শেনজেনভিত্তিক বিওয়াইডি বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করার পর। প্রথম মডেল বাজারে আনার পর প্রতিষ্ঠানটি দ্রুত দ্বিতীয় শোরুম চালু করেছে ঢাকায়। বিওয়াইডি সিলায়ন ৬ মডেলের গাড়িটি এক চার্জে ১ হাজার ৯২ কিলোমিটার পথ চলতে পারে। সুপার প্লাগ-ইন হাইব্রিড ইভি প্রযুক্তির গাড়িটি জ্বালানি সাশ্রয়ের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে বলে জানিয়েছে বিওয়াইডি।
বিওয়াইডি বাংলাদেশের অফলাইন মার্কেটিং ও ক্যাটাগরি ডেভেলপমেন্ট প্রধান নাকিবুল ইসলাম খান এক অনুষ্ঠানে বলেন, গ্রাহকদের সাড়া অভাবনীয়। আমরা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ২৫০টির বেশি ইউনিট বিক্রি করেছি। বাংলাদেশের কার্বন নিঃসরণ কমানো ও পরিবেশবান্ধব পরিবহন নিশ্চিত করতে ইভি খাতকে জাতীয় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। বিওয়াইডি এই রূপান্তরের নেতৃত্ব দিচ্ছে বিওয়াইডি সিল আই অটো ৩-এর মতো মডেলের মাধ্যমে এবং দেশজুড়ে চার্জিং স্টেশন তৈরির মাধ্যমে। চীন শুধু বিনিয়োগই নয়, প্রযুক্তিগত সহায়তার ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশে চীনা কোম্পানিগুলো সরাসরি কাজ করছে—বিশেষ করে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক, স্মার্ট ডেটা সেন্টার ও ক্লাউড প্রযুক্তিতে। সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ উদ্যোগের সঙ্গে চীনা প্রযুক্তির মেলবন্ধ নতুন বাজার ও সেবা খাতের জন্ম দিচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ ই-কমার্স, মোবাইল পেমেন্ট, এআইনির্ভর সাপ্লাই চেইন এবং ডিজিটাল কৃষি বাজার দ্রুত প্রসার হচ্ছে। ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে চীনা বিনিয়োগ আগের বছরের তুলনায় তিনগুণ বেড়েছে। বর্তমানে প্রায় এক হাজার চীনা কোম্পানি দেশে কার্যক্রম চালাচ্ছে গার্মেন্টস, নির্মাণ, বিদ্যুৎ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে।
চট্টগ্রাম ইপিজেডে চীনা মালিকানাধীন ডিরেকশন টেকনোলজি (বাংলাদেশ) লিমিটেড ৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে হেডফোন ও ডেটা ক্যাবল উৎপাদন কারখানা স্থাপন করছে। এতে ৪৭৮ জন স্থানীয় কর্মী নতুন চাকরিতে যুক্ত হবে। চায়না লেসো গ্রুপও প্রায় ৩২ কোটি ৭৭ লাখ ডলার বিনিয়োগে নতুন কারখানা স্থাপন করছে, যেখানে সৌর প্যানেল, পিভিসি পাইপ, স্যানিটারি-সামগ্রী ও নির্মাণ উপকরণ উৎপাদন হবে এবং ৫০০-৬০০ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) তথ্য অনুযায়ী, শুধু চট্টগ্রামের আনোয়ারা এলাকার চায়না ইকোনমিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনে প্রায় ৩০টির বেশি চীনা কোম্পানি কার্যক্রম চালাচ্ছে। বেজা সম্প্রতি চীনের বহুজাতিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান চায়না লেসো গ্রুপের কাছে ১২ দশমিক ৫ একর জমি হস্তান্তর করেছে।
চীনের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) ২০২৪ সালের শেষে প্রায় ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। গার্মেন্টস, ইলেকট্রনিক্স, নির্মাণ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির মতো খাতে চীনা কোম্পানিগুলোর উপস্থিতি দ্রুত বাড়ছে।
বেজার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে চীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিনিয়োগকারী দেশ। চট্টগ্রাম ও মোংলা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় চীনা মালিকানাধীন বা যৌথভাবে পরিচালিত কারখানার সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত।
ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের শিল্পাঞ্চলেও চীনা বিনিয়োগে গড়ে উঠেছে টেক্সটাইল, প্লাস্টিক ও ইলেকট্রনিক্স কারখানা। অনেক চীনা উদ্যোক্তা বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার নতুন উৎপাদন হাব হিসেবে দেখছেন, কারণ এখানে শ্রমমূল্য তুলনামূলক কম।
চীনের সহায়তায় নারায়ণগঞ্জে গড়ে উঠছে ‘বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টার’, যা দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক আরও বাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চলতি বছরের মার্চ মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস চীনে সরকারি সফরে যান। আলোচনায় ছিল বাণিজ্য ভারসাম্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও ঋণ পুনর্গঠন। চীন বাংলাদেশকে সবুজ জ্বালানি ও শিল্পাঞ্চল উন্নয়নে সহযোগিতার আশ্বাস দেয়।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে চীন থেকে বাংলাদেশে আমদানি হয় প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এসবের মধ্যে রয়েছে মেশিনারি, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, তুলা, রাসায়নিক ও বিভিন্ন কাঁচামাল। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের জন্য চীন শুধু একটি রপ্তানি গন্তব্য নয়, বরং প্রযুক্তি, উৎপাদন ও উদ্ভাবনের এক বিশাল উৎস।
বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির ব্যবসা উন্নয়ন বিভাগের প্রধান নাহিয়ান রহমান রোচি মনে করেন, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ৫০ বছরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এখন আরও শক্ত ও কার্যকর পর্যায়ে পৌঁছেছে। দুই দেশের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা নতুন সুযোগের দরজা খুলে দিচ্ছে।
রোচি জানান, অবকাঠামো উন্নয়ন, তৈরি পোশাক, ওষুধ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) ও ইলেকট্রনিক্স খাতে চীনা বিনিয়োগ এখন আরও বাড়ছে। চীনা বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ দেখে আমরা আশাবাদী যে এসব খাতে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) সাবেক মহাসচিব আল মামুন মৃধা জানান, বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স শিল্পের বিকাশে চীনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিল্পে ব্যবহৃত বেশিরভাগ যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আসে চীন থেকে। সুলভমূল্যে এসব উপকরণ সরবরাহের কারণে আমরা শুধু নিজস্ব বাজারই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছি।
আধুনিক মোবাইল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সবশেষ কৌশল সম্পর্কে জানতে সম্প্রতি বাংলাদেশের একদল খ্যাতনামা ইউটিউবার, গণমাধ্যমকর্মী ও গবেষক চীনের গুয়াংজু প্রদেশ সফর করেন। সফরে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশি ইউটিউবার সাঈদ সজীব বলেন, এই অভিজ্ঞতা দর্শকদের জন্য প্রযুক্তিগতভাবে সমৃদ্ধ ও সঠিক রিভিউ তৈরি করতে সাহায্য করবে। এখন কেবল একটি পণ্যের বাহ্যিক দিক নয়, বরং প্রযুক্তির কার্যকারিতা ও কৌশল সম্পর্কেও সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য দিতে সক্ষম হবেন।
চীন থেকে ইলেকট্রনিক পণ্য দেশে আমদানি করেন সৈয়দ মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, ‘আমি পাঁচ বছর ধরে চীন থেকে বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানি করছি- যেমন মোবাইল অ্যাক্সেসরিজ, স্মার্টওয়াচ, পাওয়ার ব্যাংক, স্পিকার, এমনকি কিছু ছোট হোম অ্যাপ্লায়েন্সও। চীনের বাজারে পণ্যের বৈচিত্র্য অনেক, আর দামও তুলনামূলকভাবে কম। ফলে আমাদের দেশের ক্রেতাদের জন্য মানসম্মত পণ্য সুলভ দামে সরবরাহ করা সম্ভব হয়। ভবিষ্যতে আমরা নিজেদের ব্র্যান্ডও তৈরি করার পরিকল্পনা করছি, যাতে মেড ইন চায়না পণ্যের সঙ্গে আমাদের দেশীয় মানও যুক্ত হয়।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ডিজিটাল অর্থনীতির যুগে প্রবেশ বাংলাদেশের

আপডেট সময় :

বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে চীন। পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে উন্নয়নের পথে অগ্রসরমান দুই দেশ। আধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চীনা সহায়তায় ডিজিটাল অর্থনীতির যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে এগিয়ে যাওয়া দেশটির প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে ডিজিটাল অর্থনীতি। এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় এশিয়ার নেতৃত্বে থাকা দেশটি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক দেশ যুক্তরাষ্ট্রকেও পেছনে ফেলছে।
চীনের জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর এনডিবি প্রকাশিত ‘ডিজিটাল চায়না ডেভেলপমেন্ট’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে চীনের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ১০ শতাংশ ছিল ডিজিটাল অর্থনীতি।
বর্তমানে বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে চীন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ আমদানির উৎস। পোশাক শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তিপণ্য, বৈদ্যুতিক সামগ্রী ও ভোক্তাপণ্যসহ নানা খাতেই চীনের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা ব্যাপক। যদিও রপ্তানি খাত এখনো তুলনামূলক সীমিত। তারপরও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। বিশেষ করে কৃষিপণ্য, পাটজাত সামগ্রী ও ওষুধ খাতে।
২০২০ সালে বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা ঘোষণা করে চীন, যা বাণিজ্যে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। এই উদ্যোগের ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা চীনা বাজারে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছেন, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈচিত্র্য আনতে সহায়তা করছে। হুয়াওয়ে, শাওমি, অপো, ভিভোসহ চীনা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর উপস্থিতি বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতিকে গতিশীল করেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প বাস্তবায়নে চীনের প্রযুক্তিগত সহায়তা একটি বড় ভূমিকা রেখেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সব দিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক আজ একটি অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রতীক। চীনের প্রযুক্তি, বিনিয়োগ বাংলাদেশের শিল্পায়ন, জ্বালানি নিরাপত্তা ও ডিজিটাল রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
প্রযুক্তিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশে এখনো অনেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তিকে শুধু লেখালেখি, ছবি তৈরি বা চ্যাটবটের মধ্যেই সীমাবদ্ধভাবে কল্পনা করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই প্রযুক্তি শিল্প, কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জাতীয় নিরাপত্তায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। চীনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিপ্লব বাংলাদেশের জন্য একটি কার্যকর ও অনুসরণযোগ্য মডেল হতে পারে।
বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ গড়তে এখন থেকেই একটি সুসংগঠিত, গবেষণাভিত্তিক ও প্রয়োগমুখী এআই কাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণাধর্মী এআই ল্যাব স্থাপন, কৃষি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এআই প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে একটি জাতীয় এআই কাউন্সিল বা টাস্কফোর্স গঠন সময়োপযোগী হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে এআই স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তর করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডেটা সায়েন্স অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। স্কুলপর্যায় থেকেই প্রোগ্রামিং ও কোডিং শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে ওঠে। একইসঙ্গে দেশে একটি শক্তিশালী এআই ট্যালেন্টপুল গড়ে তুলতে হবে, যারা গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে নেতৃত্ব দেবে।
এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশেরও গেম শিল্পে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এই শিল্পের বিকাশ হলে বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। তাই বাংলাদেশের গেম শিল্প ও ডিজিটাল খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী চীনের অন্যতম বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান টেনসেন্ট।
টেনসেন্টের এপিএসি অঞ্চলের হেড অব পাবলিক অ্যাফেয়ার্স ইয়ে লার লাউ বলেন, গেম কেবল বিনোদন নয়, এটি একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক খাত, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং বৈশ্বিক সংযোগ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের তরুণ, প্রযুক্তি-সচেতন জনগোষ্ঠী ও দ্রুত উন্নয়নশীল ডিজিটাল অবকাঠামো গেম শিল্পের বিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে প্রস্তুত। বাংলাদেশের গেম ও ডিজিটাল খাতের উন্নয়নে টেনসেন্ট কাজ করতে আগ্রহী, যা দেশের অর্থনীতি ও সমাজের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে আমার বিশ্বাস। বাংলাদেশ ইন্টেলেকচ্যুয়াল প্রোপার্টি ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা এ বি এম হামিদুল মিসবাহ বলেন, বাংলাদেশের গেম শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় পার করছে। সঠিক নীতি, বিনিয়োগ ও সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা এর সম্পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারি। বাংলাদেশের ডিজিটাল অবকাঠামোর বড় অংশ এখন চীনা প্রযুক্তিনির্ভর। মোবাইল নেটওয়ার্কের যন্ত্রাংশ, ফাইবার অপটিক, সিসিটিভি ক্যামেরা, এমনকি সরকারি তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্পেও হুয়াওয়ে ও জেডটিইর ভূমিকা বিশাল।
বাংলাদেশের টেলিকম কোম্পানিগুলোর (গ্রামীণফোন বাদে) প্রায় সবগুলোই চীনা সরঞ্জাম ব্যবহার করে। এছাড়া সরকারি নিরাপত্তা অবকাঠামো, স্মার্ট সিটি প্রকল্প এবং ডেটা সেন্টারে চীনা কোম্পানির প্রযুক্তি রয়েছে। এখানে ভূ-রাজনৈতিক একটি বাস্তবতা আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো যেখানে ৫জি নেটওয়ার্কে হুয়াওয়ে বর্জন করছে, সেখানে বাংলাদেশ চীনা প্রযুক্তি গ্রহণে তুলনামূলক উন্মুক্ত।
বাংলাদেশের স্মার্টফোন বাজারেও চীনা ব্র্যান্ডের দাপট দিন দিন বাড়ছে। অপো, টেকনো, রিয়েলমি, ভিভো, শাওমি এখন দেশের মধ্যবিত্ত ও তরুণ প্রজন্মের পছন্দের তালিকার শীর্ষে। সাশ্রয়ীমূল্য, আকর্ষণীয় ডিজাইন, ভালো মানের ক্যামেরা ও দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারি- এই চার বৈশিষ্ট্য চীনা ব্র্যান্ডগুলো জনপ্রিয় করেছে।
বাংলাদেশে উৎপাদন কারখানা স্থাপনের মাধ্যমেও তারা তাদের প্রভাব আরও গভীর করেছে। স্থানীয়ভাবে স্মার্টফোন অ্যাসেম্বল করার ফলে পণ্যের মূল্য কমেছে, কর্মসংস্থান বেড়েছে এবং সরকার রাজস্ব আদায়েও লাভবান হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া দেশের প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করছে। চীনের ইলেকট্রিক গাড়ি খাত দ্রুত গতি পাচ্ছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালে বিশ্বের বৃহত্তম ইভি নির্মাতা শেনজেনভিত্তিক বিওয়াইডি বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করার পর। প্রথম মডেল বাজারে আনার পর প্রতিষ্ঠানটি দ্রুত দ্বিতীয় শোরুম চালু করেছে ঢাকায়। বিওয়াইডি সিলায়ন ৬ মডেলের গাড়িটি এক চার্জে ১ হাজার ৯২ কিলোমিটার পথ চলতে পারে। সুপার প্লাগ-ইন হাইব্রিড ইভি প্রযুক্তির গাড়িটি জ্বালানি সাশ্রয়ের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে বলে জানিয়েছে বিওয়াইডি।
বিওয়াইডি বাংলাদেশের অফলাইন মার্কেটিং ও ক্যাটাগরি ডেভেলপমেন্ট প্রধান নাকিবুল ইসলাম খান এক অনুষ্ঠানে বলেন, গ্রাহকদের সাড়া অভাবনীয়। আমরা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ২৫০টির বেশি ইউনিট বিক্রি করেছি। বাংলাদেশের কার্বন নিঃসরণ কমানো ও পরিবেশবান্ধব পরিবহন নিশ্চিত করতে ইভি খাতকে জাতীয় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। বিওয়াইডি এই রূপান্তরের নেতৃত্ব দিচ্ছে বিওয়াইডি সিল আই অটো ৩-এর মতো মডেলের মাধ্যমে এবং দেশজুড়ে চার্জিং স্টেশন তৈরির মাধ্যমে। চীন শুধু বিনিয়োগই নয়, প্রযুক্তিগত সহায়তার ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশে চীনা কোম্পানিগুলো সরাসরি কাজ করছে—বিশেষ করে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক, স্মার্ট ডেটা সেন্টার ও ক্লাউড প্রযুক্তিতে। সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ উদ্যোগের সঙ্গে চীনা প্রযুক্তির মেলবন্ধ নতুন বাজার ও সেবা খাতের জন্ম দিচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ ই-কমার্স, মোবাইল পেমেন্ট, এআইনির্ভর সাপ্লাই চেইন এবং ডিজিটাল কৃষি বাজার দ্রুত প্রসার হচ্ছে। ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে চীনা বিনিয়োগ আগের বছরের তুলনায় তিনগুণ বেড়েছে। বর্তমানে প্রায় এক হাজার চীনা কোম্পানি দেশে কার্যক্রম চালাচ্ছে গার্মেন্টস, নির্মাণ, বিদ্যুৎ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে।
চট্টগ্রাম ইপিজেডে চীনা মালিকানাধীন ডিরেকশন টেকনোলজি (বাংলাদেশ) লিমিটেড ৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে হেডফোন ও ডেটা ক্যাবল উৎপাদন কারখানা স্থাপন করছে। এতে ৪৭৮ জন স্থানীয় কর্মী নতুন চাকরিতে যুক্ত হবে। চায়না লেসো গ্রুপও প্রায় ৩২ কোটি ৭৭ লাখ ডলার বিনিয়োগে নতুন কারখানা স্থাপন করছে, যেখানে সৌর প্যানেল, পিভিসি পাইপ, স্যানিটারি-সামগ্রী ও নির্মাণ উপকরণ উৎপাদন হবে এবং ৫০০-৬০০ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) তথ্য অনুযায়ী, শুধু চট্টগ্রামের আনোয়ারা এলাকার চায়না ইকোনমিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনে প্রায় ৩০টির বেশি চীনা কোম্পানি কার্যক্রম চালাচ্ছে। বেজা সম্প্রতি চীনের বহুজাতিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান চায়না লেসো গ্রুপের কাছে ১২ দশমিক ৫ একর জমি হস্তান্তর করেছে।
চীনের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) ২০২৪ সালের শেষে প্রায় ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। গার্মেন্টস, ইলেকট্রনিক্স, নির্মাণ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির মতো খাতে চীনা কোম্পানিগুলোর উপস্থিতি দ্রুত বাড়ছে।
বেজার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে চীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিনিয়োগকারী দেশ। চট্টগ্রাম ও মোংলা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় চীনা মালিকানাধীন বা যৌথভাবে পরিচালিত কারখানার সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত।
ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের শিল্পাঞ্চলেও চীনা বিনিয়োগে গড়ে উঠেছে টেক্সটাইল, প্লাস্টিক ও ইলেকট্রনিক্স কারখানা। অনেক চীনা উদ্যোক্তা বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার নতুন উৎপাদন হাব হিসেবে দেখছেন, কারণ এখানে শ্রমমূল্য তুলনামূলক কম।
চীনের সহায়তায় নারায়ণগঞ্জে গড়ে উঠছে ‘বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টার’, যা দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক আরও বাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চলতি বছরের মার্চ মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস চীনে সরকারি সফরে যান। আলোচনায় ছিল বাণিজ্য ভারসাম্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও ঋণ পুনর্গঠন। চীন বাংলাদেশকে সবুজ জ্বালানি ও শিল্পাঞ্চল উন্নয়নে সহযোগিতার আশ্বাস দেয়।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে চীন থেকে বাংলাদেশে আমদানি হয় প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এসবের মধ্যে রয়েছে মেশিনারি, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, তুলা, রাসায়নিক ও বিভিন্ন কাঁচামাল। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের জন্য চীন শুধু একটি রপ্তানি গন্তব্য নয়, বরং প্রযুক্তি, উৎপাদন ও উদ্ভাবনের এক বিশাল উৎস।
বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির ব্যবসা উন্নয়ন বিভাগের প্রধান নাহিয়ান রহমান রোচি মনে করেন, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ৫০ বছরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এখন আরও শক্ত ও কার্যকর পর্যায়ে পৌঁছেছে। দুই দেশের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা নতুন সুযোগের দরজা খুলে দিচ্ছে।
রোচি জানান, অবকাঠামো উন্নয়ন, তৈরি পোশাক, ওষুধ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) ও ইলেকট্রনিক্স খাতে চীনা বিনিয়োগ এখন আরও বাড়ছে। চীনা বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ দেখে আমরা আশাবাদী যে এসব খাতে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) সাবেক মহাসচিব আল মামুন মৃধা জানান, বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স শিল্পের বিকাশে চীনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিল্পে ব্যবহৃত বেশিরভাগ যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আসে চীন থেকে। সুলভমূল্যে এসব উপকরণ সরবরাহের কারণে আমরা শুধু নিজস্ব বাজারই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছি।
আধুনিক মোবাইল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সবশেষ কৌশল সম্পর্কে জানতে সম্প্রতি বাংলাদেশের একদল খ্যাতনামা ইউটিউবার, গণমাধ্যমকর্মী ও গবেষক চীনের গুয়াংজু প্রদেশ সফর করেন। সফরে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশি ইউটিউবার সাঈদ সজীব বলেন, এই অভিজ্ঞতা দর্শকদের জন্য প্রযুক্তিগতভাবে সমৃদ্ধ ও সঠিক রিভিউ তৈরি করতে সাহায্য করবে। এখন কেবল একটি পণ্যের বাহ্যিক দিক নয়, বরং প্রযুক্তির কার্যকারিতা ও কৌশল সম্পর্কেও সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য দিতে সক্ষম হবেন।
চীন থেকে ইলেকট্রনিক পণ্য দেশে আমদানি করেন সৈয়দ মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, ‘আমি পাঁচ বছর ধরে চীন থেকে বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানি করছি- যেমন মোবাইল অ্যাক্সেসরিজ, স্মার্টওয়াচ, পাওয়ার ব্যাংক, স্পিকার, এমনকি কিছু ছোট হোম অ্যাপ্লায়েন্সও। চীনের বাজারে পণ্যের বৈচিত্র্য অনেক, আর দামও তুলনামূলকভাবে কম। ফলে আমাদের দেশের ক্রেতাদের জন্য মানসম্মত পণ্য সুলভ দামে সরবরাহ করা সম্ভব হয়। ভবিষ্যতে আমরা নিজেদের ব্র্যান্ডও তৈরি করার পরিকল্পনা করছি, যাতে মেড ইন চায়না পণ্যের সঙ্গে আমাদের দেশীয় মানও যুক্ত হয়।