ঢাকা ০৯:৩১ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪
সংবাদ শিরোনাম ::
Logo ১৫ বছরে অন্যায় কাজের জন্য পুলিশ দুঃখিত ও লজ্জিত: আইজিপি Logo রাজশাহীতে সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের ৩ জনের Logo সমমনা দলের সঙ্গে বিএনপি মহাসচিবের বৈঠক Logo জাতীয় ইমাম পরিষদের পৌর শাখার সভাপতি আশরাফুল-সেক্রেটারি কাদির Logo শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে ভারতীয় মদ সহ গ্রেফতার-১ Logo আওয়ামী স্বৈরশাসনের সময় দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে :  ড্যাব মহাসচিব Logo বিনিয়োগকারী নয়, পুঁজিবাজারে অস্থিরতার নেপথ্যে প্লেয়ার ও রেগুলেটররা : অর্থ উপদেষ্টা Logo ঢাকায় বসে কোনো পরিকল্পনা করবে না: ফাওজুল কবির Logo মেঘনায় অবৈধ বালু উত্তোলন, বাল্কহেডসহ আটক ৯ Logo বান্দরবানে মাশরুম চাষ সম্প্রসারণ ও উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে কর্মশালা

ডেমরায় শিক্ষার্থীদের তান্ডব

মহিউদ্দিন তুষার
  • আপডেট সময় : ১১:০০:৩১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ৫৩ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

– রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে আহত শতাধিক, হাসপাতালে ভর্তি ৬৩

  • আগের দিন মেগা মানডে ঘোষণা দিয়ে মোল্লা কলেজে হামলা

  • যাত্রাবাড়ী-ডেমরা এলাকায় ৬ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন

  • আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অ্যাকশনে গেলে রক্তপাত হতো : আসিফ মাহমুদ

  • শিক্ষার্থীদের প্রতি শান্ত থাকার আহ্বান সরকারের

  • ছাত্রদের বেশে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ছিলো : ওয়ারীর ডিসি

সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজ ভাঙচুরের প্রতিবাদে সোমবারকে ‘মেগা মানডে’ ঘোষণা করেন এ দুটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল সোমবার দুপুর থেকে ডেমরায় ড.মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে মাইকিং করে ভাঙচুর চালায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। ঘোষণার পর থেকে পুলিশ সতর্ক অবস্থানে থাকলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের পর ছয় প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। গতকাল সোমবার বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদর দফতর থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-ডেমরা এলাকায় ছয় প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

জানা যায়, পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেলে মাহাবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিতের মৃত্যুর ঘটনায় গত রোববার ঘেরাও কর্মসূচি দেয়া হয়েছিল। পূর্বঘোষিত সেই ‘সুপার সানডে’ কর্মসূচির মধ্যে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল ও পাশের সোহরাওয়ার্দী কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় মোল্লা কলেজসহ কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা। ওই সময় সোহরাওয়ার্দী কলেজ কেন্দ্রে অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিচ্ছিলেন নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। নিরাপত্তার কারণে মাঝপথে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। ওই হামলা ও লুটপাটের প্রতিবাদে সোমবার ‘মেগা মানডে’ কর্মসূচির ডাক দেন সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা।

এদিকে গতকাল সোমবার সকাল ১০টা থেকে কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে লাঠিসোঁটা নিয়ে জড়ো হতে থাকেন। পরে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রায়সাহেব বাজারের দিকে অগ্রসর হয়ে সাত কলেজের অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জড়ো হতে থাকে। পরে তারা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে দুপুর ১২টার দিকে ডেমরা সড়ক সংলগ্ন মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা চালায়। এ সময় মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। মুহূর্তেই যাত্রাবাড়ী-ডেমরা সড়ক রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। দুপক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে বেধড়ক মারধর করা হলে তারা সড়কে লুটিয়ে পড়েন। আর মোল্লা কলেজের সামনের কাঁচসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ডা. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলার ঘটনায় শতাধিক শিক্ষার্থী এবং বেশ কয়েকজন শিক্ষক আহত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি ৭০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে বলেও দাবি করেন অধ্যক্ষ ওবায়দুল্লাহ নয়ন। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের হামলায় আমাদের ১২তলা ভবনের কোনো কাঁচ আর অক্ষত নেই। ৫টি লিফট, কম্পিউটার ও সায়েন্সল্যাব ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হামলাকারী শিক্ষার্থীরা নগদ টাকা, শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট, সার্টিফিকেট, ৩ শতাধিক ফ্যান, প্রায় ৩০টির মতো ল্যাপটপ, অসংখ্য কম্পিউটারসহ মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিস লুট করেছে। এতে করে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ কোটির মতো ক্ষতি হয়েছে।

জানা যায়, শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে অনেক শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩৩ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে এবং ৩০ জন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। আহতদের মধ্যে ৩৩ জন দুপুর দেড়টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ঢামেকে চিকিৎসার জন্য এসেছেন। ঢামেক পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ (পরিদর্শক) মোহাম্মদ ফারুক বলেন, সংঘর্ষে আহত হয়ে এ পর্যন্ত ৩৩ জন শিক্ষার্থী ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি বিভাগে এসেছেন। তাদেরকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

এদিকে সংঘর্ষে আহত হয়ে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন ৩০ জন। তারা সবাই কবি নজরুল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থী বলে জানা গেছে। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ড. মাহমুদ বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের হাসপাতালে আহত প্রায় ৩০ জন শিক্ষার্থী এসেছেন। তাদের মধ্যে ১০ জনের অবস্থা গুরুতর।

মোল্লা কলেজে সংঘর্ষের ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যাত্রাবাড়ী-ডেমরা এলাকায় ৬ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-ডেমরা এলাকায় ৬ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

রাজধানীতে কলেজের শিক্ষার্থীদের হামলা-পাল্টা হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অ্যাকশনে গেলে আরও রক্তপাত হতো বলে মনে করেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি বলেন, শত চেষ্টা ও বসে সমাধান করার আহ্বান জানানোর পরও শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে জড়ানো থেকে আটকানো গেল না। শিক্ষার্থীদের অ্যাগ্রেসিভনেস ও প্রস্তুতি দেখে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও স্ট্রিক্ট অ্যাকশনে যায়নি। কোনও প্রকার অ্যাকশনে গেলেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ ও রক্তপাত হতো। সব পক্ষকে ধৈর্য্য ধরার আহ্বান জানাচ্ছি। একত্রে দেশ গড়ার সময়ে সংঘর্ষের মতো নিন্দনীয় কাজে জড়ানো দুঃখজনক। এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের সংঘর্ষে না জড়িয়ে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ধরনের সংঘাতের পেছনে কোনো ধরনের ইন্ধন থাকলে তা কঠোর হাতে দমন করা হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম এ কথা বলেন। তিনি বলেন, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে সংঘাত-সংঘর্ষ হয়েছে, সরকার তার প্রতি নজর রাখছে। আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো ধরনের সংঘর্ষে না জড়িয়ে শান্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। এ ধরনের সংঘাতের পেছনে কোনো ইন্ধন আছে কি-না- আমরা খতিয়ে দেখছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দেশের অন্য যে কোনো অঙ্গনে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির যে কোনো চেষ্টা কঠোর হাতে দমন করা হবে বলে জানান তিনি।

বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে মাহবুবুর রহমান কলেজ পরিদর্শনে যান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. ছালেহ উদ্দিন। সেখানে তিনি বলেন, আমাদের ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে খবর পাওয়া তথ্যে মনে হচ্ছে, কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ছাত্রদের বেশে এখানে এসেছে। এবং তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর করেছে, হামলা করেছে। কলেজটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যেটি খুবই দুঃখজনক।

তিনি আরও বলেন, এ ঘটনায় পুলিশ, র‌্যাব, আর্মি এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্মিলিতভাবে কাজ করেছে। আমরা অচিরেই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব এবং এই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত সেসব চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হব। কোনো হতাহতের খবর আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু আহতের সংবাদ আমাদের কাছে এসেছে। কিন্তু কেউ নিহত হয়েছেন বলে এমন সংবাদ আমরা এখনও পাইনি। আমরা এটি তদন্ত করছি। আমাদের তদন্ত অব্যাহত আছে।

পুলিশ কি বিক্ষোভকারীদের ভয় পাই কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পরবর্তী প্রেক্ষাপট আপনারা সবাই জানেন। সেখান থেকে আমরা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছি। আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। ৫ আগস্ট এবং পরবর্তী ঘটনায় যাত্রাবাড়ীসহ অন্যান্য এলাকায় আমাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমাদের এখন প্রতিদিন দায়িত্ব পালন করার জন্য লেগ গার্ড, হেলমেট, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট, গাড়ি থেকে শুরু করে অনেক কিছুই সীমিত। অনেক কিছু ধ্বংস হয়েছে। এখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি আমরা। সবার সহযোগিতা পেলে আশা করি, এই নগরবাসীকে আমরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হব।

ছালেহ উদ্দিন বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় অনেক ঘটনা ঘটছে। সব জায়গায় ফোর্স নিয়োজিত থাকে। কিন্তু এক জায়গায় যদি সব ফোর্স নিয়োজিত থাকে তাহলে অন্য জায়গাগুলো অনিয়ন্ত্রিত থাকে। এজন্য একটি সার্বিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এই পরিকল্পনায় যতটুকু ফোর্স আমাদের থাকা দরকার সেখানে সর্বোচ্চ ফোর্স নিয়োজিত ছিল। পরবর্তীতে আরও ফোর্স পেয়েছি আমরা। আমাদের সঙ্গে র‌্যাব, আর্মিসহ অন্যান্য সংস্থার সদস্যরা এসেছেন। আমরা সম্মিলিতভাবে ঘটনাস্থলে প্রবেশ করেছি। ঘটনাস্থলে যে ধ্বংসাবশেষ রয়েছে সেগুলো আমরা দেখেছি। আমরা পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা মামলা, সিজার লিস্ট করা এবং এজাহারনামীয় আসামিদের গ্রেফতার করা এই অভিযানগুলো অব্যাহত থাকবে।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ডেমরায় শিক্ষার্থীদের তান্ডব

আপডেট সময় : ১১:০০:৩১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪

– রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে আহত শতাধিক, হাসপাতালে ভর্তি ৬৩

  • আগের দিন মেগা মানডে ঘোষণা দিয়ে মোল্লা কলেজে হামলা

  • যাত্রাবাড়ী-ডেমরা এলাকায় ৬ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন

  • আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অ্যাকশনে গেলে রক্তপাত হতো : আসিফ মাহমুদ

  • শিক্ষার্থীদের প্রতি শান্ত থাকার আহ্বান সরকারের

  • ছাত্রদের বেশে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ছিলো : ওয়ারীর ডিসি

সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজ ভাঙচুরের প্রতিবাদে সোমবারকে ‘মেগা মানডে’ ঘোষণা করেন এ দুটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল সোমবার দুপুর থেকে ডেমরায় ড.মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে মাইকিং করে ভাঙচুর চালায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। ঘোষণার পর থেকে পুলিশ সতর্ক অবস্থানে থাকলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের পর ছয় প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। গতকাল সোমবার বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদর দফতর থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-ডেমরা এলাকায় ছয় প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

জানা যায়, পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেলে মাহাবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিতের মৃত্যুর ঘটনায় গত রোববার ঘেরাও কর্মসূচি দেয়া হয়েছিল। পূর্বঘোষিত সেই ‘সুপার সানডে’ কর্মসূচির মধ্যে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল ও পাশের সোহরাওয়ার্দী কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় মোল্লা কলেজসহ কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা। ওই সময় সোহরাওয়ার্দী কলেজ কেন্দ্রে অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিচ্ছিলেন নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। নিরাপত্তার কারণে মাঝপথে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। ওই হামলা ও লুটপাটের প্রতিবাদে সোমবার ‘মেগা মানডে’ কর্মসূচির ডাক দেন সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা।

এদিকে গতকাল সোমবার সকাল ১০টা থেকে কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে লাঠিসোঁটা নিয়ে জড়ো হতে থাকেন। পরে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রায়সাহেব বাজারের দিকে অগ্রসর হয়ে সাত কলেজের অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জড়ো হতে থাকে। পরে তারা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে দুপুর ১২টার দিকে ডেমরা সড়ক সংলগ্ন মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা চালায়। এ সময় মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। মুহূর্তেই যাত্রাবাড়ী-ডেমরা সড়ক রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। দুপক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে বেধড়ক মারধর করা হলে তারা সড়কে লুটিয়ে পড়েন। আর মোল্লা কলেজের সামনের কাঁচসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ডা. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলার ঘটনায় শতাধিক শিক্ষার্থী এবং বেশ কয়েকজন শিক্ষক আহত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি ৭০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে বলেও দাবি করেন অধ্যক্ষ ওবায়দুল্লাহ নয়ন। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের হামলায় আমাদের ১২তলা ভবনের কোনো কাঁচ আর অক্ষত নেই। ৫টি লিফট, কম্পিউটার ও সায়েন্সল্যাব ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হামলাকারী শিক্ষার্থীরা নগদ টাকা, শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট, সার্টিফিকেট, ৩ শতাধিক ফ্যান, প্রায় ৩০টির মতো ল্যাপটপ, অসংখ্য কম্পিউটারসহ মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিস লুট করেছে। এতে করে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ কোটির মতো ক্ষতি হয়েছে।

জানা যায়, শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে অনেক শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩৩ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে এবং ৩০ জন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। আহতদের মধ্যে ৩৩ জন দুপুর দেড়টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ঢামেকে চিকিৎসার জন্য এসেছেন। ঢামেক পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ (পরিদর্শক) মোহাম্মদ ফারুক বলেন, সংঘর্ষে আহত হয়ে এ পর্যন্ত ৩৩ জন শিক্ষার্থী ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি বিভাগে এসেছেন। তাদেরকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

এদিকে সংঘর্ষে আহত হয়ে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন ৩০ জন। তারা সবাই কবি নজরুল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থী বলে জানা গেছে। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ড. মাহমুদ বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের হাসপাতালে আহত প্রায় ৩০ জন শিক্ষার্থী এসেছেন। তাদের মধ্যে ১০ জনের অবস্থা গুরুতর।

মোল্লা কলেজে সংঘর্ষের ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যাত্রাবাড়ী-ডেমরা এলাকায় ৬ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-ডেমরা এলাকায় ৬ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

রাজধানীতে কলেজের শিক্ষার্থীদের হামলা-পাল্টা হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অ্যাকশনে গেলে আরও রক্তপাত হতো বলে মনে করেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি বলেন, শত চেষ্টা ও বসে সমাধান করার আহ্বান জানানোর পরও শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে জড়ানো থেকে আটকানো গেল না। শিক্ষার্থীদের অ্যাগ্রেসিভনেস ও প্রস্তুতি দেখে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও স্ট্রিক্ট অ্যাকশনে যায়নি। কোনও প্রকার অ্যাকশনে গেলেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ ও রক্তপাত হতো। সব পক্ষকে ধৈর্য্য ধরার আহ্বান জানাচ্ছি। একত্রে দেশ গড়ার সময়ে সংঘর্ষের মতো নিন্দনীয় কাজে জড়ানো দুঃখজনক। এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের সংঘর্ষে না জড়িয়ে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ধরনের সংঘাতের পেছনে কোনো ধরনের ইন্ধন থাকলে তা কঠোর হাতে দমন করা হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম এ কথা বলেন। তিনি বলেন, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে সংঘাত-সংঘর্ষ হয়েছে, সরকার তার প্রতি নজর রাখছে। আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো ধরনের সংঘর্ষে না জড়িয়ে শান্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। এ ধরনের সংঘাতের পেছনে কোনো ইন্ধন আছে কি-না- আমরা খতিয়ে দেখছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দেশের অন্য যে কোনো অঙ্গনে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির যে কোনো চেষ্টা কঠোর হাতে দমন করা হবে বলে জানান তিনি।

বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে মাহবুবুর রহমান কলেজ পরিদর্শনে যান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. ছালেহ উদ্দিন। সেখানে তিনি বলেন, আমাদের ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে খবর পাওয়া তথ্যে মনে হচ্ছে, কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ছাত্রদের বেশে এখানে এসেছে। এবং তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর করেছে, হামলা করেছে। কলেজটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যেটি খুবই দুঃখজনক।

তিনি আরও বলেন, এ ঘটনায় পুলিশ, র‌্যাব, আর্মি এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্মিলিতভাবে কাজ করেছে। আমরা অচিরেই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব এবং এই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত সেসব চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হব। কোনো হতাহতের খবর আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু আহতের সংবাদ আমাদের কাছে এসেছে। কিন্তু কেউ নিহত হয়েছেন বলে এমন সংবাদ আমরা এখনও পাইনি। আমরা এটি তদন্ত করছি। আমাদের তদন্ত অব্যাহত আছে।

পুলিশ কি বিক্ষোভকারীদের ভয় পাই কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পরবর্তী প্রেক্ষাপট আপনারা সবাই জানেন। সেখান থেকে আমরা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছি। আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। ৫ আগস্ট এবং পরবর্তী ঘটনায় যাত্রাবাড়ীসহ অন্যান্য এলাকায় আমাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমাদের এখন প্রতিদিন দায়িত্ব পালন করার জন্য লেগ গার্ড, হেলমেট, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট, গাড়ি থেকে শুরু করে অনেক কিছুই সীমিত। অনেক কিছু ধ্বংস হয়েছে। এখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি আমরা। সবার সহযোগিতা পেলে আশা করি, এই নগরবাসীকে আমরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হব।

ছালেহ উদ্দিন বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় অনেক ঘটনা ঘটছে। সব জায়গায় ফোর্স নিয়োজিত থাকে। কিন্তু এক জায়গায় যদি সব ফোর্স নিয়োজিত থাকে তাহলে অন্য জায়গাগুলো অনিয়ন্ত্রিত থাকে। এজন্য একটি সার্বিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এই পরিকল্পনায় যতটুকু ফোর্স আমাদের থাকা দরকার সেখানে সর্বোচ্চ ফোর্স নিয়োজিত ছিল। পরবর্তীতে আরও ফোর্স পেয়েছি আমরা। আমাদের সঙ্গে র‌্যাব, আর্মিসহ অন্যান্য সংস্থার সদস্যরা এসেছেন। আমরা সম্মিলিতভাবে ঘটনাস্থলে প্রবেশ করেছি। ঘটনাস্থলে যে ধ্বংসাবশেষ রয়েছে সেগুলো আমরা দেখেছি। আমরা পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা মামলা, সিজার লিস্ট করা এবং এজাহারনামীয় আসামিদের গ্রেফতার করা এই অভিযানগুলো অব্যাহত থাকবে।