ঢাকা ১০:১৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম ::
Logo ড.ইউনুসের পদত্যাগের অভিপ্রায় দেশের জন্য অশনি সঙ্কেত Logo নিয়ন্ত্রনহীন স্বর্ণের বাজার, বেচাকেনা শূন্যের কোঠায় Logo হাটে পশু তুলতে প্রস্তুত ব্যাপারীরা Logo কোন পথে দেশ! Logo পাইকগাছায় সাবেক প্যানেল মেয়র জোনাকি সমিতির অর্থ আত্মসাৎকারী কবিতা রানী দাশের বিরুদ্ধে সাংবাদিক সম্মেলন Logo চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ৬ লেনে উন্নীত  করণের দাবিতে রামুতে মানববন্ধন ও সমাবেশ Logo গৌরীপুর উপজেলা ও পৌর বিএনপির নতুন কমিটি গঠন Logo কেশবপুরে প্রান্তিক জনগোষ্টির জীবনমান উন্নয়নে সেমিনার অনুষ্ঠিত Logo নওগাঁয় জমি আত্মসাতের চেষ্টার প্রতিবাদে প্রতিবন্ধী চাচার সংবাদ সম্মেলন Logo পলাশবাড়ীতে কাজী জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন

ড.ইউনুসের পদত্যাগের অভিপ্রায় দেশের জন্য অশনি সঙ্কেত

হালিম মোহাম্মদ
  • আপডেট সময় : ০৩:২১:৩৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫ ১০৮ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি
  • উপদেষ্টাদের পদত্যাগের কাদা ছোড়াছুড়ি

  • বিতর্কিত নির্বাচনে হবে ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন

ক্ষমতা ভাগাভাগির দরকষাকষিতে ভোটের আগে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান। শিগগিরই পর্দার অন্তরালে ঘটতে যাচ্ছে অনেক কিছু। দেশের রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে। ভোটের হিসেবের তৎপরতা ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করতে পারেন, এমন একটি গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। এখবরে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির দুই শীর্ষ নেতা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেছেন। বৈঠকে দুই উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর এবং এনসিপি- দুই তরফেই নিশ্চিত হয়েছে যে, এক ঘণ্টার এই বৈঠকে এনসিপি নেতারা ইউনূসকে পদত্যাগ না করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নাজুক। এ সময়ে প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করার অভিপ্রায় প্রকাশ করা মানে দেশবাসীর জন্য একটি অশনি সঙ্কেত বা কঠোর বার্তা। যা দেশবাসির জন্য সুখকর নয়।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করছেন, এমন খবরে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় যান এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তারা প্রায় এক ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করেন। কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, সেই প্রশ্নে সেই কর্মকর্তা বলেন, “মূলত প্রধান উপদেষ্টা যেন পদত্যাগ না করেন সেই অনুরোধই করতে এসেছিলেন।স্যারকে ওরা রিকুয়েস্ট করছে, স্যার যেন চলে টলে না যায়।
এবিষয়ে ড. ইউনস মনে করেন, বিতর্কিত নির্বাচন হলে তার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে। এর দায়ভার কে নেবে। তিনি দায় নিতে চান না। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিতর্কিত হলে নোবেলজয়ী হিসেবে ড. ইউনূসের সারাজীবনের অর্জিত ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে। এই দায় তিনি নিতে চান না প্রধান উপদেষ্টা।
গত বৃহস্পতিবার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের নির্ধারিত বৈঠকে ড. ইউনূসের পদত্যাগের প্রসঙ্গ উঠে আসলে তিনি এসব কথা বলেন। প্রথমে এক ঘণ্টা নিয়মিত উপদেষ্টা পরিষদের নির্ধারিত বৈঠক হয়। এরপর সচিবরা বেরিয়ে যান। উপদেষ্টাদের নিয়ে প্রায় চার ঘণ্টা অনির্ধারিত বৈঠক করেন ড. ইউনূস। রপর বিকেল থেকে এই আলোচনা ‘প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের গুঞ্জন’ হিসেবে ডালপালা মেলে। বৈঠকে উপস্থিত তিনজন উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার দুই কর্মকর্তা ও ছাত্রনেতারা সংবাদমাধ্যমকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
উপদেষ্টা পরিষদের নির্ধারিত বৈঠকে হতাশা ব্যক্ত করে ড. ইউনূস জানান, গণঅভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক দলের অনুরোধে তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন। দলগুলো সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কথা দিয়েছিল– আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন। কিন্তু এখন অস্থিরতা তৈরি করেছে। মানুষের আশা পূরণ করতে দিচ্ছে না। জনদুর্ভোগ তৈরি করছে। যে কোনো ইস্যুতেই রাস্তা অবরোধ করছে।
এসময় দু’জন উপদেষ্টা জানান, প্রধান উপদেষ্টা শুরুতে বলেছেন, রাজনৈতিক দলসহ কেউ সরকারকে প্রতিশ্রুত সহযোগিতা করছে না। এভাবে দায়িত্ব পালন সম্ভব হচ্ছে না। নির্বাচন নিয়ে চাপ তৈরি করা হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন হবে। এর দায় নিতে রাজি নন তিনি।
এদিকে নানামুখী আন্দোলনের কারণে রাজধানীতে কর্মদিবসে যে যানজট পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যাতে মানুষের বিরক্তি স্পষ্ট। সরকার কোনো কিছুর ব্যবস্থাপনায় মুন্সিয়ানা দেখাতে পারছে না, এমন অভিযোগ উঠছে। দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতিও ভালো না, সরকারি পরিসংখ্যানেই দেখা যাচ্ছে বেকারত্ব বেড়ে চলেছে। আবার সেনা সদরে কর্মকর্তাদের এক বৈঠকের খবর এসেছে সংবাদ মাধ্যমে, যেখানে বলা হয়েছে, ২০২৬ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে সেনাপ্রধান নির্বাচিত সরকার দেখতে চেয়েছেন। সেনাপ্রধানের এই বক্তব্য আসার পরদিন সামাজিক মাধ্যম এবং বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমেও লেখা হচ্ছে ইউনূস পদত্যাগের কথা ভাবছেন। কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাত অবশ্য দেওয়া হচ্ছে না।এর মধ্যে যমুনায় এই বৈঠকটি হলো।
অপরদিকে ভোটের সমীকরণই কী হবে? নির্বাচনি মাঠে নিজ নিজ সুবিধা নিশ্চিত করতে কে কাকে পাশে টানবে, কে কার সঙ্গে জোট বাঁধবে, এ নিয়ে রাজনীতির অন্দরে চলছে নানা মেরূকরণ। হিসাবনিকাশ ভিন্ন হলেও সবার লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। সবার উদ্দেশ্যই একই।
নির্বাচনি রোডম্যাপ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ আরও বাড়তে চলেছে। রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতা এবং বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নয়া মেরুকরণের পথে হাঁটছে দেশের রাজনীতি। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি- তিনটি দলই ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাদাভাবে ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে। তবে এ কার্যক্রমে দলগুলো আবার সচেতনভাবেই এড়িয়ে চলছে একে অপরকে। ফলে কে কার পক্ষে তা নিয়ে এক ধরনের প্রচ্ছন্ন লড়াই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে দলগুলোর ভিতরে।
তারা জানান, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে অবিশ্বাস করায় হতাশা প্রকাশ করে, নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এমন বিষয়কেও নির্বাচনী ইস্যু করে তোলা হচ্ছে জানিয়ে ড. ইউনূস বলেছেন,‌ ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে– এটা তিনি বারবার বলছেন। জুনের পর এক দিনও থাকবেন না। কিন্তু কোথাও যেন অবিশ্বাস রয়ে গেছে।
বিএনপি একাধিকবার ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়ে সুনির্দিষ্ট জবাব না পেয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, এই দাবি পূরণ না হলে ডিসেম্বরের পর তারা সরকারকে আর সহযোগিতা করবে না।
এনসিপির একজন নেতা জানান, প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ নিয়ে আজ বিকেল থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে, যা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলতে আজ সন্ধ্যায় যমুনায় যান দুই নেতা।
পরে বিকেল ৪টায় বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানায়, অন্যথায় সরকারকে সহযোগিতা করা কঠিন হবে বলে মত দেয়। এরপর বিকেল ৫টার দিকে জামায়াতে ইসলামী দলের নির্বাহী কমিটির সভা করে এবং সর্বদলীয় সভা ডাকার জন্য প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান জানায়।
এদিকে আদালতের রায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদ পাওয়া বিএনপির ইশরাক হোসেনের পক্ষে যায়। তার সমর্থকরা সপ্তাহখানেক ধরে মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে রাজপথ অবরোধ করে আন্দোলন করেছেন। গত মঙ্গলবার থেকে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার সামনে রাতদিন অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন তারা।
বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে খবর আসতে থাকে, প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করতে পারেন। বিকেল সোয়া ৪টার দিকে ইশরাক ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে আন্দোলনের ইতি টানেন। এর কিছু পর শাহবাগ মোড় অবরোধের কর্মসূচি শেষ করে ছাত্রদল।
সন্ধ্যায় এনসিপি নেতারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেন। গণমাধ্যমকে তারা জানান, প্রধান উপদেষ্টাকে তারা পদত্যাগ না করার জন্য অনুরোধ করেছেন। সরকারপ্রধানের পদত্যাগের ভাবনার কথা রাজনৈতিক অঙ্গনে ছড়ালে সন্ধ্যায় যমুনায় যান জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এবং মুখ্য সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। এক ঘণ্টা পর বেরিয়ে আসেন তারা।
উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছেন বলে জানা গেছে। তবে তারা ছাত্রনেতাদের সঙ্গে একই সময়ে গিয়েছেন, নাকি আলাদা গিয়েছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
অপরদিকে অর্থ, পরিকল্পনা ও আইন উপদেষ্টাকে একহাত নিলেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে শিক্ষা খাত ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য ওয়াহিদউদ্দিন ভাই কাজ করছেন, অর্থনৈতিক খাত ধ্বংসের জন্য সালেহউদ্দিন ভাই আর আইন মন্ত্রণালয় ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করছেন আসিফ নজরুল। আমরা বাধ্য করব এসব উপদেষ্টাকে পদত্যাগে।
এছাড়া নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন ও দ্রুত স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ সমাবেশে এসব কথা বলেন তিনি। নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, এ মাঠে কুসুম-কুসুম খেলা চলবে না। এবার কর্মসূচি দিয়ে তাঁদের পদত্যাগে বাধ্য করব।
উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে পাটওয়ারী বলেন, ‘ঘোষণাপত্র দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। একবার ছাত্র-জনতাকে মুলা দেখিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা রাখেননি। এটা বিশ্বাসঘাতকতা। এবার যদি কোনো হেরফের হয়, আসিফ নজরুল বাংলাদেশে থাকবেন কি না, তা বলা মুশকিল। জনগণের সঙ্গে অনেক বাটপারি হয়েছে, বেইমানি হয়েছে। আপনি (আসিফ নজরুল) এই বেইমানি নিয়ে সরকারি অফিসে আসতে পারেন না।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী জানান, ইসি পুনর্গঠন না হলে বর্তমান ইসির অধীনে নির্বাচনে যাবে না এনসিপি। অন্তর্বর্তী সরকারের তিন উপদেষ্টাকে বিএনপির মুখপাত্র বলে মন্তব্য করেন এই এনসিপি নেতা।এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক বলেন, ২০২২ সালের আইন অনুযায়ী বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হলেও সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা না বলে একটি দলের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করছে, যা দেশের জন্য লজ্জাজনক।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ড.ইউনুসের পদত্যাগের অভিপ্রায় দেশের জন্য অশনি সঙ্কেত

আপডেট সময় : ০৩:২১:৩৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫
  • উপদেষ্টাদের পদত্যাগের কাদা ছোড়াছুড়ি

  • বিতর্কিত নির্বাচনে হবে ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন

ক্ষমতা ভাগাভাগির দরকষাকষিতে ভোটের আগে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান। শিগগিরই পর্দার অন্তরালে ঘটতে যাচ্ছে অনেক কিছু। দেশের রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে। ভোটের হিসেবের তৎপরতা ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করতে পারেন, এমন একটি গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। এখবরে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির দুই শীর্ষ নেতা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেছেন। বৈঠকে দুই উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর এবং এনসিপি- দুই তরফেই নিশ্চিত হয়েছে যে, এক ঘণ্টার এই বৈঠকে এনসিপি নেতারা ইউনূসকে পদত্যাগ না করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নাজুক। এ সময়ে প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করার অভিপ্রায় প্রকাশ করা মানে দেশবাসীর জন্য একটি অশনি সঙ্কেত বা কঠোর বার্তা। যা দেশবাসির জন্য সুখকর নয়।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করছেন, এমন খবরে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় যান এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তারা প্রায় এক ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করেন। কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, সেই প্রশ্নে সেই কর্মকর্তা বলেন, “মূলত প্রধান উপদেষ্টা যেন পদত্যাগ না করেন সেই অনুরোধই করতে এসেছিলেন।স্যারকে ওরা রিকুয়েস্ট করছে, স্যার যেন চলে টলে না যায়।
এবিষয়ে ড. ইউনস মনে করেন, বিতর্কিত নির্বাচন হলে তার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে। এর দায়ভার কে নেবে। তিনি দায় নিতে চান না। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিতর্কিত হলে নোবেলজয়ী হিসেবে ড. ইউনূসের সারাজীবনের অর্জিত ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে। এই দায় তিনি নিতে চান না প্রধান উপদেষ্টা।
গত বৃহস্পতিবার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের নির্ধারিত বৈঠকে ড. ইউনূসের পদত্যাগের প্রসঙ্গ উঠে আসলে তিনি এসব কথা বলেন। প্রথমে এক ঘণ্টা নিয়মিত উপদেষ্টা পরিষদের নির্ধারিত বৈঠক হয়। এরপর সচিবরা বেরিয়ে যান। উপদেষ্টাদের নিয়ে প্রায় চার ঘণ্টা অনির্ধারিত বৈঠক করেন ড. ইউনূস। রপর বিকেল থেকে এই আলোচনা ‘প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের গুঞ্জন’ হিসেবে ডালপালা মেলে। বৈঠকে উপস্থিত তিনজন উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার দুই কর্মকর্তা ও ছাত্রনেতারা সংবাদমাধ্যমকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
উপদেষ্টা পরিষদের নির্ধারিত বৈঠকে হতাশা ব্যক্ত করে ড. ইউনূস জানান, গণঅভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক দলের অনুরোধে তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন। দলগুলো সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কথা দিয়েছিল– আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন। কিন্তু এখন অস্থিরতা তৈরি করেছে। মানুষের আশা পূরণ করতে দিচ্ছে না। জনদুর্ভোগ তৈরি করছে। যে কোনো ইস্যুতেই রাস্তা অবরোধ করছে।
এসময় দু’জন উপদেষ্টা জানান, প্রধান উপদেষ্টা শুরুতে বলেছেন, রাজনৈতিক দলসহ কেউ সরকারকে প্রতিশ্রুত সহযোগিতা করছে না। এভাবে দায়িত্ব পালন সম্ভব হচ্ছে না। নির্বাচন নিয়ে চাপ তৈরি করা হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন হবে। এর দায় নিতে রাজি নন তিনি।
এদিকে নানামুখী আন্দোলনের কারণে রাজধানীতে কর্মদিবসে যে যানজট পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যাতে মানুষের বিরক্তি স্পষ্ট। সরকার কোনো কিছুর ব্যবস্থাপনায় মুন্সিয়ানা দেখাতে পারছে না, এমন অভিযোগ উঠছে। দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতিও ভালো না, সরকারি পরিসংখ্যানেই দেখা যাচ্ছে বেকারত্ব বেড়ে চলেছে। আবার সেনা সদরে কর্মকর্তাদের এক বৈঠকের খবর এসেছে সংবাদ মাধ্যমে, যেখানে বলা হয়েছে, ২০২৬ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে সেনাপ্রধান নির্বাচিত সরকার দেখতে চেয়েছেন। সেনাপ্রধানের এই বক্তব্য আসার পরদিন সামাজিক মাধ্যম এবং বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমেও লেখা হচ্ছে ইউনূস পদত্যাগের কথা ভাবছেন। কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাত অবশ্য দেওয়া হচ্ছে না।এর মধ্যে যমুনায় এই বৈঠকটি হলো।
অপরদিকে ভোটের সমীকরণই কী হবে? নির্বাচনি মাঠে নিজ নিজ সুবিধা নিশ্চিত করতে কে কাকে পাশে টানবে, কে কার সঙ্গে জোট বাঁধবে, এ নিয়ে রাজনীতির অন্দরে চলছে নানা মেরূকরণ। হিসাবনিকাশ ভিন্ন হলেও সবার লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। সবার উদ্দেশ্যই একই।
নির্বাচনি রোডম্যাপ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ আরও বাড়তে চলেছে। রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতা এবং বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নয়া মেরুকরণের পথে হাঁটছে দেশের রাজনীতি। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি- তিনটি দলই ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাদাভাবে ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে। তবে এ কার্যক্রমে দলগুলো আবার সচেতনভাবেই এড়িয়ে চলছে একে অপরকে। ফলে কে কার পক্ষে তা নিয়ে এক ধরনের প্রচ্ছন্ন লড়াই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে দলগুলোর ভিতরে।
তারা জানান, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে অবিশ্বাস করায় হতাশা প্রকাশ করে, নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এমন বিষয়কেও নির্বাচনী ইস্যু করে তোলা হচ্ছে জানিয়ে ড. ইউনূস বলেছেন,‌ ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে– এটা তিনি বারবার বলছেন। জুনের পর এক দিনও থাকবেন না। কিন্তু কোথাও যেন অবিশ্বাস রয়ে গেছে।
বিএনপি একাধিকবার ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়ে সুনির্দিষ্ট জবাব না পেয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, এই দাবি পূরণ না হলে ডিসেম্বরের পর তারা সরকারকে আর সহযোগিতা করবে না।
এনসিপির একজন নেতা জানান, প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ নিয়ে আজ বিকেল থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে, যা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলতে আজ সন্ধ্যায় যমুনায় যান দুই নেতা।
পরে বিকেল ৪টায় বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানায়, অন্যথায় সরকারকে সহযোগিতা করা কঠিন হবে বলে মত দেয়। এরপর বিকেল ৫টার দিকে জামায়াতে ইসলামী দলের নির্বাহী কমিটির সভা করে এবং সর্বদলীয় সভা ডাকার জন্য প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান জানায়।
এদিকে আদালতের রায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদ পাওয়া বিএনপির ইশরাক হোসেনের পক্ষে যায়। তার সমর্থকরা সপ্তাহখানেক ধরে মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে রাজপথ অবরোধ করে আন্দোলন করেছেন। গত মঙ্গলবার থেকে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার সামনে রাতদিন অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন তারা।
বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে খবর আসতে থাকে, প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করতে পারেন। বিকেল সোয়া ৪টার দিকে ইশরাক ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে আন্দোলনের ইতি টানেন। এর কিছু পর শাহবাগ মোড় অবরোধের কর্মসূচি শেষ করে ছাত্রদল।
সন্ধ্যায় এনসিপি নেতারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেন। গণমাধ্যমকে তারা জানান, প্রধান উপদেষ্টাকে তারা পদত্যাগ না করার জন্য অনুরোধ করেছেন। সরকারপ্রধানের পদত্যাগের ভাবনার কথা রাজনৈতিক অঙ্গনে ছড়ালে সন্ধ্যায় যমুনায় যান জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এবং মুখ্য সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। এক ঘণ্টা পর বেরিয়ে আসেন তারা।
উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছেন বলে জানা গেছে। তবে তারা ছাত্রনেতাদের সঙ্গে একই সময়ে গিয়েছেন, নাকি আলাদা গিয়েছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
অপরদিকে অর্থ, পরিকল্পনা ও আইন উপদেষ্টাকে একহাত নিলেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে শিক্ষা খাত ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য ওয়াহিদউদ্দিন ভাই কাজ করছেন, অর্থনৈতিক খাত ধ্বংসের জন্য সালেহউদ্দিন ভাই আর আইন মন্ত্রণালয় ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করছেন আসিফ নজরুল। আমরা বাধ্য করব এসব উপদেষ্টাকে পদত্যাগে।
এছাড়া নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন ও দ্রুত স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ সমাবেশে এসব কথা বলেন তিনি। নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, এ মাঠে কুসুম-কুসুম খেলা চলবে না। এবার কর্মসূচি দিয়ে তাঁদের পদত্যাগে বাধ্য করব।
উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে পাটওয়ারী বলেন, ‘ঘোষণাপত্র দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। একবার ছাত্র-জনতাকে মুলা দেখিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা রাখেননি। এটা বিশ্বাসঘাতকতা। এবার যদি কোনো হেরফের হয়, আসিফ নজরুল বাংলাদেশে থাকবেন কি না, তা বলা মুশকিল। জনগণের সঙ্গে অনেক বাটপারি হয়েছে, বেইমানি হয়েছে। আপনি (আসিফ নজরুল) এই বেইমানি নিয়ে সরকারি অফিসে আসতে পারেন না।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী জানান, ইসি পুনর্গঠন না হলে বর্তমান ইসির অধীনে নির্বাচনে যাবে না এনসিপি। অন্তর্বর্তী সরকারের তিন উপদেষ্টাকে বিএনপির মুখপাত্র বলে মন্তব্য করেন এই এনসিপি নেতা।এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক বলেন, ২০২২ সালের আইন অনুযায়ী বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হলেও সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা না বলে একটি দলের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করছে, যা দেশের জন্য লজ্জাজনক।