ঢাকা কী আন্দোলনের শহর!

- আপডেট সময় : ০৭:৩৪:৫৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫ ৩৫ বার পড়া হয়েছে
বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষ দিন। এই দিনে এমনিতেই ঢাকা শহরে যানবাহনের বাড়তি চাপ-যানজট ভোগান্তি থাকে। তারমধ্যেই ঢাকার দুটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কে যান চলাচল বন্ধ আন্দোলনকারীদের অবরোধের কারণে। কাকরাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অবস্থান। অন্যদিকে ইশরাককে মেয়র পদে বসানোর দাবিতে দ্বিতীয় দিনের মতো গুলিস্তানে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) কার্যালয়ের সামনের সড়ক বন্ধ করে আন্দোলন।
কাকরাইল সড়কে যান চলাচল বন্ধ গত বুধবার থেকেই। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সামনে বুধবার বিকেলে সড়ক অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার হলেও বৃহস্পতিবার আবার অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা। যে কারণে সকাল আটটা থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ছড়িয়ে পড়ে যানজট। সকাল ৯টা থেকে বেলা ৫ টা পর্যন্ত সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানী আগারগাঁও, মহাখালী, উড়োজাহাজ ক্রসিং, বিজয় সরণি, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, মগবাজার, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, মালিবাগ, কাকরাইল মোড়, গুলিস্তান, মতিঝিলজুড়ে কোথাও তীব্র যানজট কোথাও গাড়ির চাপ রয়েছে। অনেক স্থানের যাত্রীদেরকে বাস থেকে নেমে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হেঁটে যেতে দেখা যায়।
গতকাল বৃহস্পতিবার ট্রাফিক রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) শফিকুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার মানেই বাড়তি চাপ। এদিন এমনিতেই সড়কে তীব্র চাপ তৈরি হয়। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুটি স্থানে সড়কে যানচলাচল বন্ধ। যে কারণে সড়কে সকাল থেকেই চাপ। সে চাপ অধিকাংশ স্থানে যানজট তৈরি করেছে। গত বুধবার দুপুর আড়াইটার পর বৃষ্টি উপেক্ষা করে ডিপ্লোমা ইন নার্সিং ও মিডওয়াইফারি শিক্ষার্থীরা শাহবাগ অবরোধ করেন। এতে বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল, সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। ফলে দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ মানুষ। সন্ধ্যা সোয়া ৬টা পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের সেখানে অবস্থান করতে দেখা যায়।
ঢাকার সিদ্দিকবাজারে একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন মুস্তাফিজুর রহমান। ভোগান্তির কথা মাথায় রেখেই মোটরসাইকেল রেখে মেট্রোরেলে রওনা দেন অফিসের উদ্দেশে। সচিবালয় স্টেশনে নামার পর রিকশা নেন। সেখান থেকেই বিপত্তির শুরু। সামনে সড়ক বন্ধ। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) সামনে আন্দোলন-অবরোধে রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ। আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পর কূলকিনারা না পেয়ে হেঁটে গন্তব্যে রওনা দেন তিনি। তিনি বলেন, বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে ঢাকা শহর। এই শহরে থাকা আর ভোগান্তি যেন নামান্তর। সপ্তাহে ৩/৪ দিন ভুগতে হয় সড়কে।
সড়কে বাসে ভোগান্তিতে পড়া আতিকুর রহমান নামে এক যাত্রী বিজয় সরণি মোড়ে নেমে হেঁটে রাস্তা পার হন। এরপর সিএনজিতে ওঠেন। তিনি বলেন, চারদিকে খারাপ অবস্থা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে যাবো। তাই বাস ছেড়ে সিএনজিতে উঠতে বাধ্য হলাম। গুগল ম্যাপ বলছে নিউ মার্কেট সড়ক অনেকটা ক্লিয়ার। অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিসের ট্রেনিংয়ে অংশ নিতে মগবাজার থেকে গুলিস্তানের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে বিপাকে পড়েন বাসযাত্রী গণমাধ্যমকর্মী আলী তালুকদার। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, বাস চলছেই না। কাকরাইল সড়ক বন্ধ। বাধ্য হয়ে হেঁটে সেগুনবাগিচায় আসি। এরপর জাতীয় প্রেস ক্লাব মোড় থেকে রিকশা নিয়ে রওনা দিই গন্তব্যে। সিদ্দিকবাজার মোড়ে আসতেই দেখি গুলিস্তান সড়কও বন্ধ। বাধ্য হয়ে রিকশা ছেড়ে আরো হাঁটা পথ ধরতে হয়েছে।
তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, তিন দফা দাবিতে কাকরাইলে অবস্থান নিয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে গুলিস্তানেও সড়ক বন্ধ। এর চাপ পড়েছে তেজগাঁওয়ের বিভিন্ন সড়কে। সড়কে যানবাহনের বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। সড়কে যানবাহনের দীর্ঘ সারি সামলাতে বেগ পেতে হচ্ছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতন ঘটে। ৮ আগস্ট গঠন করা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হয় নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই শুরু হয় একের পর এক আন্দোলন। এতে এক রকম বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে বর্তমান সরকার। এসব আন্দোলনের মধ্যে ৭৬ শতাংশই হয়েছে বিভিন্ন পেশাজীবীর ব্যানারে। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট আন্দোলন আছে ৩২ ভাগ। এছাড়া শ্রমিক আন্দোলন আট ভাগ এবং অন্যান্য ব্যানারের আন্দোলন ১০ ভাগ। এর মধ্যেই বন্ধ হয়েছে ৯০ ভাগ আন্দোলন। সেই আন্দোলন এখনো চলমান।
জানা গেছে, গত আট মাসে আন্দোলনের হটস্পট হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে-জাতীয় প্রেস ক্লাব, বাংলাদেশ সবিচালয়, রেলভবন ও কমলাপুর রেলস্টেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ মোড় এবং জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণ এমনকি প্রধান উপদেষ্ট্রার বাসভবন যমুনার সামনেও। সবচেয়ে বেশি আন্দোলন হয়েছে জাতীয় প্রেস ক্লাবে। বেসরকারি শিক্ষকসহ একাধিক সংগঠন বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে করেছেন প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তায়। সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলনের প্রধান স্থান হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে সচিবালয়।
রেলওয়ে কর্মচারীদের আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হলো-রেলভবন ও কমালপুর রেলওয়ে স্টেশন। আর শিক্ষার্থীদর আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ মোড় ও জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণ। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গত আট মাসে যেসব দাবিতে আন্দোলন হয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ হলো- চাকরিচ্যুত ও পুনর্বহালের আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থানে হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচার, শহিদ পরিবারের পুনর্বাসন ও আহতদের উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত, সরকারি চাকরিজীবীদের বিভিন্ন দাবি, শ্রমিক স্বার্থ, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট আন্দোলন, সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোর আন্দোলন এবং পরিবহণ ও যানবাহনসংশ্লিষ্ট।
গত বছরের ১৩ থেকে ২৫ আগস্টের মধ্যে পালিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি কর্মসূচি। ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে আন্দোলনের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। একই মাসের ১০ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে আন্দোলন চালিয়েছে সরকারি চাকরিজীবী ও শিক্ষার্থীরা। অক্টোবর মাসে ফের আন্দোলনের চাপ বাড়ে। পুরো মাসব্যাপী আন্দোলন চালায় সরকারি কর্মচারী ও শিক্ষা খাতসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো। নভেম্বর মাসে আন্দোলন কিছুটা হ্রাস পেলেও ৭ থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত কিছু বড় কর্মসূচি ছিল।
গত ডিসেম্বরে তিতুমীর কলেজ ও শিক্ষক সংগঠনের আন্দোলনে উত্তাল ছিল রাজপথ। চলতি বছরের জানুয়ারিতে আবারও আন্দোলনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২৫ থেকে ৩০ জানুয়ারির মধ্যে অনেকগুলো কর্মসূচি চোখে পড়ে। ফেব্রুয়ারিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির মাধ্যমে সরকারকে বড় ধাক্কা দিতে চেয়েছিল একটি পরাজিত রাজনৈতিক শক্তি। এরপর নারী ও শিশু নির্যাতন-হয়রানি এবং ধর্ষণের বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে। এসবের প্রতিবাদের রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে আন্দোলন চলে। এছাড়া বনানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় পোশাক শ্রমিক নিহতের ঘটনায় সড়ক অবরোধে অচল হয়ে পড়ে পুরো রাজধানী।
চাকরি পুনর্বহালের আন্দোলনের মধ্যে আছে চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্য, সেনা সদস্য ও বিজিবি ৭৬তম ব্যাচ, ব্যাটালিয়ন আনসার ও সাধারণ আনসার, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও আইএফআইসি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী, গ্রামীণফোন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের আন্দোলন। সরকারি চাকরিজীবী আন্দোলনসংক্রান্ত দাবির মধ্যে আছে-চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর, ১১-২০ গ্রেডের সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৈষম্য নিরসন ও পদোন্নতি, উপসচিব পদে ক্যাডারদের সমান সুযোগের দাবি ও কর্মকর্তাদের বদলি নীতি সংস্কার। শ্রমিক আন্দোলনের দাবিগুলোর মধ্যে আছে-নির্মাণ শ্রমিকের নিরাপত্তা, বাসস্থান ও রেশনিং ব্যবস্থা চালু; রিকশা-ভান-ইজিবাইক শ্রমিকদের লাইসেন্স ও রুট পারমিট এবং সেবরকারি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট আন্দোলনের দাবিগুলোর মধ্যে আছে-মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য নিরসন ও চাকরি স্থায়ীকরণ, মেডিকেল টেকনোলজি ও ফার্মেসি শিক্ষার্থীদের বৈষম্য দূরীকরণ, ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিতে উত্তীর্ণদের লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি এবং শিক্ষার কারিকুলাম পরিবর্তন। সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় সংগঠনসংক্রান্ত আন্দোলনের দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন, হিন্দুধর্মীয় গুরু চিন্ময় দাসের মুক্তির দাবি বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ মঞ্চের এবং বৈষম্য দূরীকরণের দাবি ইসকন ও সনাতন ধর্মীয় সংগঠনগুলোর। পরিবহণ ও যানবাহনসংশ্লিষ্ট আন্দোলনগুলোর দাবির মধ্যে আছে-ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালু রাখা, হালকা মোটরযান চালকদের জন্য সাদা প্লেট সংযুক্ত গাড়ি ভাড়ায় চালানোর অনুমতির দাবি এবং সিএনজিচালকদের রেজিস্ট্রেশন ও পুলিশের হয়রানি বন্ধের দাবি।
সর্বশেষ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নেয় জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি’র নেতা-কর্মীরাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। এরপর শুরু হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অবস্থান। অন্যদিকে ইশরাককে মেয়র পদে বসানোর দাবিতে গুলিস্তানে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) কার্যালয়ের সামনের সড়ক বন্ধ করে আন্দোলন।