দলীয় সন্ত্রাসীদের রাজত্বমুক্ত হতে চায় ব্যবসায়িরা

- আপডেট সময় : ৮৪ বার পড়া হয়েছে
পুরান ঢাকায় নির্মমভাবে ব্যবসায়ী হত্যার পর চাঁদাবাজি কিংবা আধিপত্য বিস্তারের ভয় থেকে এখনও বের হতে পারেনি এলাকাবাসী এবং সাধারণ ব্যবসায়ীরা। এখনও ভয়ে আছেন তারা। তাদের শঙ্কা, এখন আপাতত চুপ থাকলেও বর্বরোচিত এই হত্যাকান্ড নিয়ে আলোচনা কমে এলেই আবার ফিরবে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা আর দলীয় সন্ত্রাসের রাজত্ব। আর এ সকল ঘটনা সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় গতকাল রোববার থেকে সারাদেশে চিরুনি অভিযান চালানোর ঘোষনা দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির ১১তম সভা শেষে এমনটা জানান তিনি। পাশাপাশি সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেসির ক্ষমতা আরও ২ মাস বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। রোববার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে পরবর্তী ৬০ দিন পর্যন্ত তারা সারাদেশে এ ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারবেন।
অপরদিকে অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এসব দখলবাজের মূলোৎপাটনে সরকার কার্যত ব্যবস্থা না নিলে মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরবে না। পাষাণ পাথরেরও কি দুঃখ হয়? আধিপত্যের পৈশাচিকতায় উন্মত্ত বর্বর খুনির হাত ঘুরে ঘুরে যে থেঁতলে দিলো একটা জীবন্ত মানুষের খুলি!
শতাব্দীর নিষ্ঠুর এক ভিডিও চিত্র, ছুরি, রডের উপর্যপুরি আঘাত, তার ওপর প্রায় বিবস্ত্র একটা নিথর দেহ। উন্মাদের মতো সেই দেহের পাজরে, কোমরের ওপর পাথর ছুড়ে মারা হচ্ছে। শেষবারের মত এপাশ যখন ফিরছিলো, তখনও হয়তো মৃতপ্রায় ব্যবসায়ীর সঙ্গে সংযোগ ছিলো পৃথিবীর। এর মধ্যে আবার পাথর ছুড়ে মারা হলো মাথায়।
ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জামে ব্যস্ত এ এলাকার দোকানগুলো। মিটফোর্ডের ৩ নম্বর গেটের সামনের এ ব্যস্ত সড়ক। সড়কের ওপর ফলমূল বিক্রির হকার। সবার সামনে সেদিন ঘটেছে নির্মমভাবে ব্যবসায়ীকে হত্যার ঘটনা। কিন্তু ঘটনার চার দিন পর যখন আবার তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় ঘটনা সম্পর্কে, তখনও তারা কথা বলতে দ্বিধান্বিত। মানুষ কতটা অসহায় দলীয় সন্ত্রাসিদের কাছে।
হত্যাকা-ের স্থান থেকে মাত্র ২ থেকে ৫ হাত দূরের এই ফার্মেসিগুলোতে কাজ করা কর্মীদের এখনও এ নিয়ে কথা বলতে না চাওয়ার কারণও ভয়। স্থানীয় দোকানদাররা বলেন, ‘লাশ দেখার কারণে ভয় লাগছে। আমরা সামনাসামনি দেখিনি। ভিডিওতেই দেখেছি। আবার অনেক দোকানদার জানাচ্ছেন, রাস্তায় মানুষের অনেক ভিড় ছিলো। ভিড়ের কারণে কিছু দেখা যায়নি। সবাই যার যার কাজে দোকানে ব্যস্ত ছিলেন তারা। এ সকল দলীয় সন্ত্রাসের রাজত্ব থেকে ব্যবসায়িরা নিস্কৃি তবা রেহাই চেয়েছে। শুধু তাই নয়, সোহাগ হত্যাকা- ঘিরে আতঙ্কে মিটফোড হাসপাতাল এবং আশপাশের বৃহৎ মেডিসিন ও কেমিক্যাল মার্কেট বন্ধ নয়েছে। আতঙ্কিত লোকজন জরুরী প্রয়োজন ছাড়া রাস্তায় বের হচ্ছেন না।
এ হত্যাকান্ডের এজাহারের বর্ণনা অনুযায়ী, গত বুধবার (৯ জুলাই) বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটের দিকে বায়তুল ফালাহ জামে মসজিদের পাশে রজনী বোস লেনের সোহানা মেটাল দোকান থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় নিহত ব্যবসায়ী সোহাগকে। এরপরের ঘটনা ঘটে মিটফোর্ড রোডের ৩ নম্বর গেট এলাকায়।
প্রতিদিন দেখা হওয়া এসব ব্যবসায়ীরাও ভয়ে। কেউ কেউ বলছেন, কোনও দিন কথা হয়নি। যদিও সিসিটিভিতে দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট, কখন, কীভাবে, কারা ঘটিয়েছে এই রোমহর্ষক ঘটনা। ওই এলাকার একজন দোকানদার বলেন, ‘চাঁদাবাজ এখনো আছে। আমার কাছেও চেয়েছে বিগত ৩ থেকে ৪ মাস আগে যুবদল নেতার পরিচয়ে। আমি তাদের ভয় পাইনা তাই আমি বলতে পারছি। এরকম অনেকের কাছেই চেয়েছে, তারা হয়তো বলতে পারছে না। সোহাগ হত্যার পর তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছে। দল থেকে বহিষ্কার করে বিজ্ঞপ্তি দিতে দেখা গেছে, এই হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত যুবদল ও ছাত্রদল নেতাকর্মীদের কয়েকজনকে।
অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, ভয় সৃষ্টি করতে চায় কারণ ভয় সৃষ্টি করতে পারলে তাদের লাভ আছে। একটি হলো, রাজনৈতিক পদ পদবি থেকে শুরু করে সেই লাভটি সে পায়। কিংবা ব্যবসা বাণিজ্য সম্পর্কে চাঁদাবাজি, মামলাবাজি বা দখল বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এই ভয় থেকে সে লাভবান হয়। গণঅভ্যুত্থানের পরে রাজনীতি কিংবা সমাজে কোন ধরনের ভয়, সংশয় বা দোদ্যলুমানতা থাকার কথা ছিলো না। কিন্তু নানাভাবে সেটা জড়িয়েছে। অপরাধ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, যেখানে জনসমক্ষে হত্যাকান্ড ঘটে, সেখানে ‘ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব’ বলেই দায় সারলে চলবে না। এ ধরনের অপরাধের পেছনে যদি রাজনৈতিক ছত্রছায়া বা প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা থাকে, তবে তা একটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাঠামোর বড় ধরনের ফাঁকফোকরকে তুলে ধরে। প্রশাসনের বিশ্বাসযোগ্যতা তখনই থাকে, যখন সে অপরাধীকে দল-মত নির্বিশেষে বিচারের আওতায় আনতে পারে। কিন্তু যদি ভিডিও প্রমাণ সত্ত্বেও মূল আসামিরা বাদ পড়ে, তাহলে প্রশ্ন উঠবেই পেছনে কে আছে? তারা আরো বলছেন, যে সংস্কৃতি মানুষকে প্রকাশ্যে হত্যা করতে সাহস দেয়, সেটি রাষ্ট্রের নৈতিক ও আইনি শাসনের পরাজয়। দীর্ঘদিনের বিচারহীনতা মানুষকে বার্তা দেয় অপরাধ করে পার পাওয়া যায়।
আইজিপি বাহারুল আলম স্বীকার করেছেন, আমারা ফোর্সটাকে শতভাগ কার্যকর করতে পারিনি। আমরা হয়তো ৫০ ভাগও সফল হইনি। অর্থাৎ সরকারবিরোধী আন্দোলনের পর পুলিশের মনোবল ও কার্যকারিতা এখনো পুনঃস্থাপিত হয়নি। এমন স্বীকারোক্তি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কাঠামোর ভয়াবহ দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অপরাধ বিশ্লেষক বলেন, পুরান ঢাকার মতো কেন্দ্রীয় এলাকায় দিনের আলোয় প্রকাশ্যে একজনকে হত্যা করে পালিয়ে যাওয়া শুধুই অপরাধীদের সাহস নয়, এটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি তাদের অবজ্ঞার প্রতিফলন। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে জাতিকে স্থিতিশীলতা দেওয়া, কিন্তু তারা রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার দুই ক্ষেত্রেই ব্যর্থ।
এ হত্যাকান্ডে চাঁদাবাজি হয়েছে কি না এ নিয়েই বরং বক্তব্যে ব্যস্ত দেখা যাচ্ছে পুলিশ কর্মকর্তাদের। এমন অবস্থায়, আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও ভীতি ছড়ানোর এসব ঘটনার কতটা বিচার হবে এবং গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী এসব সন্ত্রাসের কারণে জনসাধারণের মনে সঞ্চারিত ভীতি কতটা প্রশমিত হবে সে উত্তর যখন অনিশ্চিত, তখন পুলিশ সদর দপ্তরের হিসেব অনুসারে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৪ মাসেই রাজধানীতে খুনের শিকার হয়েছেন অন্তত ১৩৬ জন।
এ সকল ঘটনায় সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় গতকাল রোববার থেকে সারাদেশে চিরুনি অভিযান চালানোর ঘোষনা দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির ১১তম সভা শেষে এমনটা জানান তিনি। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, খুন, চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, সন্ত্রাস, অপহরণ, নারী নির্যাতন, মব সহিংসতা, মাদক চোরাচালানসহ সব ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা-ের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার যেকোনো সময় চিহ্নিত অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের ধরতে বিশেষ বা চিরুনি অভিযান পরিচালনা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণসহ সবার সহযোগিতা একান্তভাবে কাম্য। সরকার জনশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী যেকোনো কার্যক্রম কঠোর হস্তে দমন করবে জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের পরিস্থিতি অনুযায়ী বিশেষ বা চিরুনি অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটা এখন থেকেই শুরু।
এদিকে সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেসির ক্ষমতা আরও ২ মাস বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। রোববার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে পরবর্তী ৬০ দিন পর্যন্ত তারা সারাদেশে এ ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারবেন।