দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা

- আপডেট সময় : ৫৮ বার পড়া হয়েছে
হযরত শাহজালাল (রা,) আর্ন্তজাতিক বিমান বন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় সর্বস্ব পুড়ে ছাই হয়েছে। শুধু তাই নয়, কার্গো ভবনটি সম্পূর্ন ভষ্মিভুত এবং বিধ্বস্ত হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস বলেছে, কার্গো ভিলেজে থাকা সকল মালামাল ভষ্মিভুত হয়েছে। ভবনটি ভষ্মিভূত হওয়ায় বসবাসের অযোগ্য এবং ঝুঁকিপূর্ন হয়ে পড়েছে। বার বার শাহজালালে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় মানুষের মাঝে সন্দেহের দানা বেঁধেছে। এ সকল অগ্নিকান্ডের ঘটনা কি দুর্ঘটনা, নাকি স্যাবোটাজ জনমনে প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে। এর প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকান্ডর ঘটনায় বিবৃতি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এসব ঘটনায় নাশকতা বা অগ্নিসংযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়ার হুঁশিয়ারিও দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে গতকাল শনিবার এক বিবৃতিতে অন্তর্বর্তী সরকার জানায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি সংঘটিত একাধিক অগ্নিকান্ডের ঘটনায় জনমনে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার তা গভীরভাবে অবগত। আমরা সব নাগরিককে আশ্বস্ত করতে চাই- নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রতিটি ঘটনা গভীরভাবে তদন্ত করছে এবং মানুষের জীবন ও সম্পদ সুরক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, নাশকতা বা অগ্নিসংযোগের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে সরকার তাৎক্ষণিক ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে। কোনো অপরাধমূলক কর্মকান্ড বা উসকানির মাধ্যমে জনজীবন ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করার সুযোগ দেয়া হবে না। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই- যদি এসব অগ্নিকান্ড নাশকতা হিসেবে প্রমাণিত হয় এবং এর উদ্দেশ্য হয় জনমনে আতঙ্ক বা বিভাজন সৃষ্টি করা, তবে তারা সফল হবে কেবল তখনই, যখন আমরা ভয়কে আমাদের বিবেচনা ও দৃঢ়তার ওপর প্রাধান্য দিতে দেব।
এদিকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ বিমানবন্দরে বার বার আগুন লাগার নেপথ্যে কী? আগুন লাগার এমন ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে দেখছেন না অনেকেই। এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, আগুন লাগার ঘটনা দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তের অংশ। তদন্ত কমিটির ‘নাটক’ বাদ দিয়ে এর পেছনের কারণ খুঁজে বের করার আহ্বান জানান সারজিস আলম।
অপরদিকে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো সেকশনের অগ্নিকান্ড স্যাবোটাজ কিনা, তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করেন নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় তিনি গনমাধ্যমকর্মীদের এ কথা বলেন।
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি বলেন, বিমানবন্দরের কার্গো সেকশনের অগ্নিকান্ড স্যাবোটাজ কিনা, তা খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ কাস্টমসের অনেক জব্দ পণ্য এখানে থাকে। তবে এগুলো নানান সময়ে নানানভাবে বেরিয়ে যায়, অনেক চক্র এর সঙ্গে জড়িত। এগুলো ধামাচাপা দেয়ার জন্য অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটানো হয়েছে কিনা সেটাও তদন্ত করে দেখা দরকার। কারা করেছে এমন প্রশ্নে ফজলে শামীম এহসান বলেন, ভেতরের মানুষই করেছে। এখানে তো বাইরের কেউ ঢুকতে পারে না। এখান থেকে আমাদের অনেক পণ্য চুরি হয়ে যায়। ভেতরের লোকের সঙ্গে বাইরের লোকেরা মিলিয়েই এই কাজগুলো করে।
অগ্নিকা-ের এ ঘটনায় ব্যবসায়ীদের ক্ষয়ক্ষতি কতটুকু, কাটিয়ে ওঠা সম্ভব কিনা- এমন প্রশ্নে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি বলেন, বিষয়টা একটু অন্য রকম। ক্ষয়ক্ষতি কেমন, তা এখনও আমরা জানতে পারিনি। তবে খবরে যেটা দেখলাম, তাতে সেখানে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখানে আমাদের ২ রকমের সমস্যা হবে। আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হব বড় আকারের। এ ছাড়া, বায়ারদের কাছে বা সাপ্লায়ারদের কাছে ভয়াবহ ইমেজ সংকটের মুখে পড়ব। কারণ আমাদের যে ইনস্যুরেন্স সিস্টেম বা ক্ষতিপূরণটা কে দেবে বা কীভাবে দেবে, সেটা নিয়ে একটা বড় সমস্যা দেখা দেবে।
তিনি আরো বলেন, আমরা বিমানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানি করি। দেখা গেল, ৫ হাজার ডলারের হয়তো একটা বোতাম ছিল কিন্তু এর জন্য ৩ লাখ ডলারের একটা পণ্য হয়তো স্টক হয়ে যাবে। আমাদের ক্ষতিটা দুইভাবে নির্ণয় করতে হবে, পণ্যের পরিমাণ বা তার মূল্য এবং এর সঙ্গে সামগ্রিক ইফেক্ট। যেমন- বোতাম না লাগালে তো ওই পণ্য রফতানি করতে পারব না।
কার্গো সেকশনে অব্যবস্থাপনা নিয়ে ফজলে শামীম এহসান আরো বলেন, আমরা যখন বিমানে যাই, তখন দেখতে পাই কী পরিমাণ অব্যবস্থপনা রয়েছে। আগুন লাগার পর কীভাবে নেভাবে সেটা নেই। পানির পাইপ নষ্ট। বাংলাদেশের নম্বর ওয়ান কেপিআইয়ে ফায়ার ফাইটিং কাজ করে না– এর জন্য কে দায়ী? কাকে জেল দেবেন? কাকে শাস্তি দেবেন? আমরা আসলে হতভম্ব হয়ে গেছি। এত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কাজ করা সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যানসহ প্রত্যেককেই এখন জেলে নেয়া উচিত! তারা এভাবে কীভাবে কাজ করে! আমরা আসলে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি।
এদিকে গতকাল শনিবার ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর টিআইএম নুরুল কবির বলেন, রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো সেকশনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বড় ধরনের সংকট তৈরির আশঙ্কা করছেন। তিনি বলেন,বাংলাদেশে ইতিহাসে আজকের এই অগ্নিকান্ড একটি অপূরণীয় ক্ষতি। বড় ধরনের সংকটের দিকে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে এটি অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে, সাপ্লাই চেইনে অনেক বড় প্রভাব পড়বে।
এফআইসিসিআইর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর বলেন, বাংলাদেশের ফায়ার সেফটির অব্যবস্থাপনার চিত্র গোটা বিশ্বের কাছে আজ প্রচার হলো। ব্যবস্থাপনার ঘাটতি এবং এটির ইমপেক্ট দীর্ঘমেয়াদি। বিদেশে যেকোনো কেপিআই বা রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় অগ্নিনিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এর ঘাটতি লক্ষ্য করা যায় বলে তিনি মন্তব্য করেন। সরবারহ ব্যবস্থপনায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ জরুরি ভিত্তিতে নিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে।
আমদানি কার্গো ভবনের ২ নম্বর কুরিয়া গেট থেকে গত শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এক পর্যায়ে আগুনের ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ে। পুরো এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সবশেষ তথ্যানুযায়ী, আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট। এছাড়াও সিভিল অ্যাভিয়েশন, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর ইউনিটগুলোও আগুন নেভানোর চেষ্টায় যোগ দেয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত এক যুগে শাহজালালে বেশকিছু অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গত শনিবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো সেকশনে অগ্নিকান্ডটি ছিলো ভয়াবহ। বিমানবন্দরটির কার্গো সেকশনেই ২০১৩ সালেও একবার আগুন লাগে। কার্গো ভিলেজ ঘেঁষে বিপুল সংথ্যক খুপড়ি বস্তি ঘরে প্রবেশের রাস্তা সরু থাকায় এবার আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়েছে ফায়ার কর্মীদের।
জানা যায়, ২০১৩ সালের ৫ এপ্রিল বিমানবন্দরটির কার্গো সেকশনের কুরিয়ার সার্ভিস অংশে একটি গুদামে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রায় দুই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। অগ্নিকান্ডের ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটিও গঠন করা হয়।
এদিকে, ২০১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর সকালে ইমিগ্রেশন পুলিশের এক কর্মকর্তার দফতরে বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণে আগুন লাগে। যদিও এতে কোনো ক্ষতি হয়নি, কারণ আগুনটি সঙ্গে সঙ্গে নিভিয়ে ফেলা হয়েছিল। এ ছাড়া ২০১৭ সালের ১১ আগস্ট বিমানবন্দরটির মূল ভবনের ২ নং টার্মিনালের তৃতীয় তলায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এয়ার ইন্ডিয়ার একটি অফিস থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে জানিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস।
এরপর ২০১৮ সালের ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় বিমানবন্দরের ১নং টার্মিনালের ইমিগ্রেশন বিভাগের দোতলায় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। যদিও ওই অগ্নিকান্ডের তীব্রতা ছড়ায়নি। ২০২২ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিমানবন্দরের নির্মাণাধীন তৃতীয় টার্মিনালে দুটি তেলবাহী ট্যাংক লরি আগুনে পুড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ফোম ও অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করে ৪০ মিনিটের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন।