দুর্ভিক্ষের শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা

- আপডেট সময় : ০১:০৪:১৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ মে ২০২৫ ১২৬ বার পড়া হয়েছে
চারদিকে কি হচ্ছে মনে হয় তারা দেখতে পারছেন না। প্রতিনিয়ত আমাদের লে অফ হচ্ছে। কিছুদিন পরে মানুষ রাস্তায় নামবে। আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে। দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা হবে যদি আপনি শিল্পকে বাঁচাতে না পারেন – বিটিএমএ সভাপতি
শিল্পে গ্যাস সংকট চরমে। বন্ধ হচ্ছে একের পর এক কারখানা। সরকার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছেনা বলে অভিযোগ করেছেন বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, এভাবে চলতে থাকলে ঈদের বেতন-বোনাস পরিশোধ করা কঠিন হবে। কয়েক মাসের মধ্যে বন্ধ হতে পারে অর্ধেক টেক্সটাইল কারখানা।
গত রোববার জ্বালানি সংকট নিয়ে রাজধানীতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলা হয়। দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য কাপড় ও সুতার বড় অংশ জোগান দেয় স্থানীয় টেক্সটাইল কারখানাগুলো। বড় বিনিয়োগে গ্যাস নির্ভর এসব শিল্প এখন চরম সংকটে। জ্বালানির অভাবে বন্ধ থাকছে বেশিরভাগ সময়। নষ্ট হচ্ছে যন্ত্রপাতি। টানতে হচ্ছে চড়া সুদের ব্যাংক ঋণ। বিকল্প জ্বালানিতে খরচও বাড়ছে। দাম বাড়ানোর পরও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গ্যাস না পেয়ে ক্ষুব্ধ শিল্পমালিকরা। তাদের অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবেই ধ্বংস করা হচ্ছে শিল্পগুলো। সরকারের পরিকল্পনাহীনতার খেসারত দিচ্ছেন তারা।
টেক্সটাইল কারখানাগুলোর মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ’র সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, আমাদের উপদেষ্টা সাহেবরা মনে হয় উটপাখির মতো হয়ে গেছে। চারদিকে কি হচ্ছে মনে হয় তারা দেখতে পারছেন না। প্রতিনিয়ত আমাদের লে অফ হচ্ছে। কিছুদিন পরে মানুষ রাস্তায় নামবে। আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে। দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা হবে যদি আপনি শিল্পকে বাঁচাতে না পারেন।
ব্যবসায়ীরা বলেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ নিয়ে নীতি নির্ধারকরা কেবল আশ্বাস দিয়েই দায় সারছেন। অর্থনীতির নাজুক পরিস্থিতিতে ঈদে ১০ দিনের ছুটি দেওয়ারও সমালোচনা করেন তারা।
বিসিআই সভাপতি আনোয়ার উল আলম পারভেজ বলেন, ‘বেতন না দিতে পারলে সরকার থেকে আবার ধমক দেওয়া হচ্ছে যে এতো তারিখের মধ্যে আপনাদের সবাইকে ফ্যাক্টরির বেতনও দিতে হবে। অথচ ওনারা গ্যাসও দেবেন না, ব্যাংকের ইন্টারেস্ট রেটও বাড়াবেন আবার আমাকে গ্যাস বিলও দিতে হবে। গ্যাসের প্রেসার থাকতে ১ দশমিক ৫ বা জিরো, মিটার কিন্তু আমার ঘুরছে।’
ব্যবসায়ীরা বলেন, সিস্টেম লসের নামে ১২ ভাগ গ্যাস চুরি ও অপচয় হচ্ছে। শিল্পের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে ধাপে ধাপে বাসা বাড়িতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধের দাবি তাদের। স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেওয়ারও তাগিদ দেন ব্যবসায়ীরা।
একাধিক কারখানার মালিক বলেছেন, দেশের শিল্প খাতে গত কয়েক বছর ধরেই চলছে তীব্র গ্যাস সংকট। উচ্চ মূল্যে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহে সরকার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা সম্ভব হয়নি। গত কয়েক মাসে এই সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে শিল্প মালিকরা আর কোনোভাবেই লস দিয়ে কারখানা চালু রাখতে চাচ্ছেন না। এমন প্রেক্ষাপটে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে ৩ দফা দাবি জানিয়েছে পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট ৯টি বাণিজ্যিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা।
বিটিএমএ প্রেসিডেন্ট শওকত আজিজ রাসেল বলেন, গত এক থেকে দেড় মাস ধরে চলা প্রকট গ্যাস সংকটে দেশের রপ্তানি নির্ভর ও স্থানীয় টেক্সটাইল মিল এবং পোশাক খাতসহ অনেক খাতের কারখানার উৎপাদন আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাসের অভাবে ঠিক সময়ে উৎপাদন করতে না পারায় কার্যাদেশ অনুযায়ী সঠিক সময়ে পণ্য পৌঁছাতে বিমান ভাড়া করতে হচ্ছে। এতে ব্যয় বেড়ে কারখানাগুলোকে বিশাল অঙ্কের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
বিটিএমএ সভাপতি বলেন, গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের আশ্বাস দিয়ে গত কয়েক বছরে দফায় দফায় ৩০০ শতাংশ অধিক মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। একইসঙ্গে মিল মালিকদের সিকিউরিটি বাবদ অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে হয়। শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের সরবরাহের নামে মূল্য বৃদ্ধি করা হলেও বাস্তবে গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।
তিনি বলেন, বিগত ৩ বছরেরও বেশি সময় এই খাতটি জ্বালানি সংকটের জন্য স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। বিগত কয়েক মাসে তীব্র গ্যাস সংকটে কারখানাগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের বেশি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ফলে সুতা, কাপড় ও পোশাকের উৎপাদন ব্যপকভাবে হ্রাস পেয়ে উৎপাদন খরচ দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় সক্ষমতায় আমরা পিছিয়ে পড়ছি। টেক্সটাইল খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের স্থানীয় বাজারও বিদেশীদের হাতে চলে যাচ্ছে।
এমন প্রেক্ষাপটে কারখানাগুলো উৎপাদন সক্ষমতা ফিরে না পেলে আসন্ন ঈদ উৎসবে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস সময়মতো পরিশোধে সমস্যা তৈরি হবে। অপরদিকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সংকুচিত হওয়ায় অসহনীয় পরিস্থিতিতে শিল্প মালিকরা ব্যাংক ঋণ পরিশোধে সমস্যার সম্মুখীন হবেন বলেও তিনি সতর্ক করে দেন।
শওকত আজিজ রাসেল বলেন, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যে সমষ্যা দেখা যাচ্ছে এর অন্যতম প্রধান কারণ বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদন বাড়াতে শিল্প কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া। শুধু তিতাস নেটওয়ার্কেই শিল্প খাতে দৈনিক ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কমেছে বলে তিনি এসময় জানান।
গ্যাসের সরবরাহ পাওয়ার ক্ষেত্রে রপ্তানি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, রপ্তানি আয়ের মূল উৎসের প্রতিষ্ঠানগুলো গ্যাসের অভাবে স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। গ্যাসের এই অবস্থা চলতে থাকলে বিটিএমএ, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং বিটিটিএলএমইএর অধীনে টেক্সটাইল ও পোশাক খাতের প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। সংকট চলতে থাকলে উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হয়ে রপ্তানি কমে যাবে। ফলে রিজার্ভের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সামষ্টিক অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হলে আর্থিক সংকট ঘনিভূত হবে, ব্যাংক ঋণ এবং শ্রমিকদের বেতন পরিশোধে সংকট তৈরি হবে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ব্যাংকঋণের সুদের হার বেড়ে গেছে। গ্যাস-সংকটের কারণে ৬০ শতাংশের বেশি উৎপাদন হচ্ছে না কারখানায়। তিন মাস সুদ না দিলেই ঋণখেলাপি করছে ব্যাংক। আবার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বেতন পরিশোধের ধমক দিচ্ছে সরকার।