ঢাকা ০৩:১৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৬ মে ২০২৫

দ্বৈত নাগরিকরা কী টাকা পাচারের মেশিন…

মহিউদ্দিন তুষার
  • আপডেট সময় : ১১:২০:৪৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৫ মে ২০২৫ ১৫ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

দেশ থেকে টাকা পাচার ও বিদেশের সম্পদ গড়ার কাজটিও অবাধে চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশে অনেক শিল্পপতি ও ঋণখেলাপি বিদেশে নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। এমনকি সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও অনেকে এক বা একাধিক দেশের নাগরিক হয়েছেন

বাংলাদেশিরা দ্বৈত নাগরিক হয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোম্পানি নিবন্ধন করে বিনিয়োগ করেছেন। অথচ বাংলাদেশে তাঁদের সেই তথ্য জানানোর কোনো বাধ্যবাধকতাই নেই। দ্বৈত নাগরিক ছাড়াও, কেবল বাংলাদেশের নাগরিক যাঁরা, বিদেশে সম্পদ থাকলে আয়কর বিবরণীতে তাও জানানোর কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। বাংলাদেশে এই সুযোগ নিয়েই দেশ থেকে টাকা পাচার ও বিদেশের সম্পদ গড়ার কাজটিও অবাধে চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশে অনেক শিল্পপতি ও ঋণখেলাপি বিদেশে নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। এমনকি সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও অনেকে এক বা একাধিক দেশের নাগরিক হয়েছেন। বিশিষ্টজনরা মনে করেন, অর্থ পাচার ও বিদেশী নাগরিকত্ব গ্রহণের সঙ্গে দ্বৈত নাগরিকত্ব ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে কীভাবে কয়েকজন ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তি দ্রুত দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে কিছু ব্যবসায়ী কানাডা, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ার নাগরিকত্ব নিয়েছেন অথবা দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকার ফলে বিচার এড়ানোর উদ্দেশ্যে বাংলাদেশী নাগরিকত্ব ত্যাজ্য করেছে।
বাংলাদেশের নাগরিকদের ১০১টি দেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আইনেই এ সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও মন্ত্রী-এমপিরা এ সুযোগ না পেলেও তাঁদের অনেকেই আইন ভেঙে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে বড় কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের নাগরিকদের কতজন দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়েছেন এর সঠিক হিসাব সরকারের কাছে না থাকলেও বিভিন্ন সূত্র বলছে, এটি প্রায় আড়াই লাখ ছাড়িয়ে গেছে। তবে সরকারের কাছ থেকে সনদ নেওয়া এ রকম দ্বৈত নাগরিকের সংখ্যা ৩৪ হাজার ১৫৭ জন। সূত্র বলছে, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বৈধভাবে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে থাকেন। এতে আইনগতভাবে কোনো বাধা নেই। কিন্তু সরকারি চাকরি করে কেউ এ সুযোগ নিতে পারেন না।
বাংলাদেশ সরকারের (ইমিগ্রেশন) ডাটাবেজ অনুসারে দ্বৈত পাসপোর্ট ও নাগরিকত্বধারীদের মধ্যে বিদেশে নিয়মিত যাওয়া-আসা করা ব্যক্তির সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৩১ জন। তবে বিদেশে তাদের অর্থপাচার বা বাড়ি তৈরির বিষয়ে ইমিগ্রেশন বিভাগের কাছে কোনো তথ্য নেই।
তালিকা অনুসারে বাংলাদেশের ১০ হাজার ৭৭৪ জন নাগরিকের যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে। তালিকার দ্বিতীয় শীর্ষে আছে ভারত; ৬১৭ জন বাংলাদেশির একইসঙ্গে ভারতীয় নাগরিকত্ব আছে। এরপর ৫৬৮ জন বাংলাদেশির ব্রিটিশ, ৩৮৯ জন বাংলাদেশির কানাডিয়ান, ২৩৮ জনের জার্মান, ১৭৮ জনের অস্ট্রেলিয়ান, ১৭৭ জনের চীনা, ১১৭ জনের ইতালির নাগরিকত্ব আছে। এছাড়া ৬৬ জন বাংলাদেশি জাপানিজ, ৪১ জন দক্ষিণ কোরীয়, ৪০ জন ইন্দোনেশীয়, ৪০ জন ফিলিপিনো, ২১ জন ফরাসি, ২১ জন ফিনিশ, ২১ জন বেলজিয়ান, ১৫ জন হংকংয়ের, ১২ জন ডাচ, ১১ জন মিসরীয়, ১১ জন আইরিশ, নয়জন আফগান, সাতজন ইরানি, সাতজন ইরাকি, সাতজন অস্ট্রীয়, পাঁচজন ড্যানিশ, পাঁচজন অ্যান্টিগুয়ার, তিনজন ডমিনিকান, তিনজন গ্রিক ও তিনজন কেনীয় পাসপোর্ট বহন করছেন। এ ছাড়া দুইজন করে বাংলাদেশির সাইপ্রাস, কিরগিজিস্তান, কুয়েত, বাহরাইন, ব্রুনাই, ভুটান, কম্বোডিয়া, ব্রাজিল, আলজেরিয়া ও বাহামা দ্বীপপুঞ্জের; এবং একজন করে বাংলাদেশির বারবাডিয়ান, বলিভিয়ার, বসনিয়ার, বুলগেরিয়ার, চিলির, জিবুতির, পূর্ব তিমুরের, ফারো দ্বীপপুঞ্জের, জর্ডানের ও উত্তর কোরিয়ার পাসপোর্ট আছে।
এ ছাড়া অন্যান্য দেশের নাগরিকদের মধ্যে আছেন লাটভিয়া, লিবিয়া, লুক্সেমবার্গ, ফিলিস্তিন, পেরু, কাতার, গ্রানাডা, তিমুর, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, ওয়ালেস ও ফুটুনার একজন করে; লেবানন, মরিশাস, মলডোভা, ফিলিপাইন, উজবেকিস্তান, ভেনিজুয়েলা ও জিম্বাবুয়ের দুইজন করে; নাইজেরিয়া, নরওয়ে, রোমানিয়া ও ইয়েমেনের তিনজন করে; মালি, পোল্যান্ড, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস ও ইউক্রেনের চারজন করে; ভিয়েতনাম ও মঙ্গোলিয়ার পাচঁজন করে; তাইওয়ান, পর্তুগাল ও উগান্ডার ছয়জন করে; মিয়ানমার, তানজানিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের আটজন করে; সৌদি আরবের ১০ জন; স্পেনের ১১ জন; নিউজিল্যান্ডের ১২জন; মালদ্বীপ ও দক্ষিণ আফ্রিকার ১৩ জন; তুরস্কের ১৫ জন; সোমালিয়ার ১৬ জন; সিঙ্গাপুরের ১৭ জন; নেপালের ২২ জন; সুইজারল্যান্ডের ২৩ জন; থাইল্যান্ডের ২৬ জন; শ্রীলঙ্কার ৫৭ জন; সুইডেনের ৫৯ জন; রাশিয়ার ৬৫ জন; মালয়েশিয়ার ৭৬ জন এবং পাকিস্তানের ১১৯ জন ব্যক্তি দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে বাংলাদেশে বসবাস করছেন।
বাংলাদেশের সাবেক অন্তত ১৪ জন এমপি-মন্ত্রীর তথ্য জানা যায়, যাঁরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব রেখেও অন্য দেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়েছেন। কিন্তু এই অবৈধ নাগরিকত্ব নেওয়ার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে বড় কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানা যায়নি। অন্যদিকে বৈধভাবে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাসহ এমন অনেক দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়া লোক রয়েছেন, যাঁদের ব্যাপারে আইনগতভাবে কোনো বাধা না হওয়ার পরও তাঁরা সরকারের পক্ষ থেকে নানান বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। অনেকের বিদেশ গমনে আপত্তি দিয়ে রাখা হয়েছে। এমন বৈপরিত্যের মধ্যেও দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়ার প্রবণতা কমছে না।
জানা যায়, সরকারের সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের যাঁরা অবৈধভাবে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়েছেন, তাঁদের ধরতে অনুসন্ধান শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাঁদের খুঁজে বের করার জন্য দুদক সম্প্রতি চিঠি পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিদেশে থাকা বাংলাদেশি মিশনে এসব তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। এরই মধ্যে ২৪ জন মন্ত্রী-এমপির বিদেশি নাগরিকত্ব থাকার প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করলে বকু বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করলে তিনি সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী হতে পারেন না। কিন্তু এই আইন ভঙ্গ করে এ দেশের সাবেক অনেক মন্ত্রী-এমপি, সরকারি কর্মকর্তা অন্য দেশের নাগরিক হয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে। তাঁদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সাইপ্রাসের নাগরিকত্বের প্রমাণ পেয়েছে দুদুক। সাবেক তথ্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদ বেলজিয়ামের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, নসরুল হামিদ, জুনাইদ আহমেদ পলক, আব্দুস শহীদ, মানিকগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন মাহমুদ জাহিদ যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব নিয়েছেন তাজুল ইসলাম, আ হ ম মুস্তফা কামাল, সাইফুজ্জামান চৌধুরী, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও মো. মাহবুব আলী। কানাডার নাগরিক হয়েছেন সাবেক মন্ত্রী ও এমপি আবদুর রহমান, মাহবুবউল আলম হানিফ, আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী (নাসিম), শামীম ওসমান, শফিকুল ইসলাম (শিমুল) ও হাবিব হাসান। সুইজারল্যান্ডের নাগরিকত্ব নিয়েছেন সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। সাবেক রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম জাপানের, সাবেক এমপি তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনির জার্মানির ও ময়মনসিংহের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ ওয়াহেদের পাপুয়া নিউগিনির নাগরিকত্ব রয়েছে।
জানা গেছে, সালমান এফ রহমান টাকার জোরে গোপনে সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব নেন। একইভাবে বেলজিয়ামের নাগরিকত্ব নেন হাছান মাহমুদ। সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও জুনাইদ আহমেদ পলকের যুক্তরাষ্ট্রে ‘গ্রিন কার্ড’ রয়েছে। জানা গেছে, নাটোরের সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল কানাডায় ১৭ লাখের বেশি কানাডিয়ান ডলার খরচ করে বাড়ি কিনেছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, নাগরিকত্ব আইনে বলা হয়েছে, কোনো বাংলাদেশি যদি বিদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন, তাহলে তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চলমান রাখতে পারবেন। তিনি বলেন, আগে থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ৫৭টি দেশের নাগরিকত্ব নেওয়া যেত। ২০২৩ সালে আফ্রিকা মহাদেশের ১৯টি, আমেরিকা মহাদেশের ১২টি, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ১২টি এবং ওশেনিয়া মহাদেশের একটি দেশকে যুক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেশী ভারত, নেপাল ও আফগানিস্তানে অবশ্য দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়ে পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অর্থাৎ এসব দেশ তাদের নাগরিকদের অন্য দেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়ার কোনো সুযোগ রাখেনি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) এম হাফিজউদ্দিন খান এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, যাঁরা টাকা পাচার করেন, তাঁরা বেশ প্রভাবশালী। আইন তাঁদের স্পর্শ করতে পারে না। কানাডায় পাচার করা টাকায় ‘বেগমপাড়া’ হয়েছে। সেখানে তাঁদের স্ত্রী-সন্তানেরা বিলাসী জীবন যাপন করেন। অথচ কানাডায় তাঁদের কোনো আয় নেই। তাঁদের বিলাসী জীবনের টাকা কোথা থেকে আসে, এই প্রশ্নের উত্তর আমরা সবাই জানি। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। তাঁর মতে, বিদেশে থাকা সম্পদ ও আয় এ দেশে দেখানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। প্রয়োজনে আইন সংস্কার করা দরকার।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

দ্বৈত নাগরিকরা কী টাকা পাচারের মেশিন…

আপডেট সময় : ১১:২০:৪৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৫ মে ২০২৫

দেশ থেকে টাকা পাচার ও বিদেশের সম্পদ গড়ার কাজটিও অবাধে চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশে অনেক শিল্পপতি ও ঋণখেলাপি বিদেশে নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। এমনকি সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও অনেকে এক বা একাধিক দেশের নাগরিক হয়েছেন

বাংলাদেশিরা দ্বৈত নাগরিক হয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোম্পানি নিবন্ধন করে বিনিয়োগ করেছেন। অথচ বাংলাদেশে তাঁদের সেই তথ্য জানানোর কোনো বাধ্যবাধকতাই নেই। দ্বৈত নাগরিক ছাড়াও, কেবল বাংলাদেশের নাগরিক যাঁরা, বিদেশে সম্পদ থাকলে আয়কর বিবরণীতে তাও জানানোর কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। বাংলাদেশে এই সুযোগ নিয়েই দেশ থেকে টাকা পাচার ও বিদেশের সম্পদ গড়ার কাজটিও অবাধে চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশে অনেক শিল্পপতি ও ঋণখেলাপি বিদেশে নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। এমনকি সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও অনেকে এক বা একাধিক দেশের নাগরিক হয়েছেন। বিশিষ্টজনরা মনে করেন, অর্থ পাচার ও বিদেশী নাগরিকত্ব গ্রহণের সঙ্গে দ্বৈত নাগরিকত্ব ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে কীভাবে কয়েকজন ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তি দ্রুত দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে কিছু ব্যবসায়ী কানাডা, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ার নাগরিকত্ব নিয়েছেন অথবা দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকার ফলে বিচার এড়ানোর উদ্দেশ্যে বাংলাদেশী নাগরিকত্ব ত্যাজ্য করেছে।
বাংলাদেশের নাগরিকদের ১০১টি দেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আইনেই এ সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও মন্ত্রী-এমপিরা এ সুযোগ না পেলেও তাঁদের অনেকেই আইন ভেঙে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে বড় কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের নাগরিকদের কতজন দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়েছেন এর সঠিক হিসাব সরকারের কাছে না থাকলেও বিভিন্ন সূত্র বলছে, এটি প্রায় আড়াই লাখ ছাড়িয়ে গেছে। তবে সরকারের কাছ থেকে সনদ নেওয়া এ রকম দ্বৈত নাগরিকের সংখ্যা ৩৪ হাজার ১৫৭ জন। সূত্র বলছে, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বৈধভাবে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে থাকেন। এতে আইনগতভাবে কোনো বাধা নেই। কিন্তু সরকারি চাকরি করে কেউ এ সুযোগ নিতে পারেন না।
বাংলাদেশ সরকারের (ইমিগ্রেশন) ডাটাবেজ অনুসারে দ্বৈত পাসপোর্ট ও নাগরিকত্বধারীদের মধ্যে বিদেশে নিয়মিত যাওয়া-আসা করা ব্যক্তির সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৩১ জন। তবে বিদেশে তাদের অর্থপাচার বা বাড়ি তৈরির বিষয়ে ইমিগ্রেশন বিভাগের কাছে কোনো তথ্য নেই।
তালিকা অনুসারে বাংলাদেশের ১০ হাজার ৭৭৪ জন নাগরিকের যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে। তালিকার দ্বিতীয় শীর্ষে আছে ভারত; ৬১৭ জন বাংলাদেশির একইসঙ্গে ভারতীয় নাগরিকত্ব আছে। এরপর ৫৬৮ জন বাংলাদেশির ব্রিটিশ, ৩৮৯ জন বাংলাদেশির কানাডিয়ান, ২৩৮ জনের জার্মান, ১৭৮ জনের অস্ট্রেলিয়ান, ১৭৭ জনের চীনা, ১১৭ জনের ইতালির নাগরিকত্ব আছে। এছাড়া ৬৬ জন বাংলাদেশি জাপানিজ, ৪১ জন দক্ষিণ কোরীয়, ৪০ জন ইন্দোনেশীয়, ৪০ জন ফিলিপিনো, ২১ জন ফরাসি, ২১ জন ফিনিশ, ২১ জন বেলজিয়ান, ১৫ জন হংকংয়ের, ১২ জন ডাচ, ১১ জন মিসরীয়, ১১ জন আইরিশ, নয়জন আফগান, সাতজন ইরানি, সাতজন ইরাকি, সাতজন অস্ট্রীয়, পাঁচজন ড্যানিশ, পাঁচজন অ্যান্টিগুয়ার, তিনজন ডমিনিকান, তিনজন গ্রিক ও তিনজন কেনীয় পাসপোর্ট বহন করছেন। এ ছাড়া দুইজন করে বাংলাদেশির সাইপ্রাস, কিরগিজিস্তান, কুয়েত, বাহরাইন, ব্রুনাই, ভুটান, কম্বোডিয়া, ব্রাজিল, আলজেরিয়া ও বাহামা দ্বীপপুঞ্জের; এবং একজন করে বাংলাদেশির বারবাডিয়ান, বলিভিয়ার, বসনিয়ার, বুলগেরিয়ার, চিলির, জিবুতির, পূর্ব তিমুরের, ফারো দ্বীপপুঞ্জের, জর্ডানের ও উত্তর কোরিয়ার পাসপোর্ট আছে।
এ ছাড়া অন্যান্য দেশের নাগরিকদের মধ্যে আছেন লাটভিয়া, লিবিয়া, লুক্সেমবার্গ, ফিলিস্তিন, পেরু, কাতার, গ্রানাডা, তিমুর, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, ওয়ালেস ও ফুটুনার একজন করে; লেবানন, মরিশাস, মলডোভা, ফিলিপাইন, উজবেকিস্তান, ভেনিজুয়েলা ও জিম্বাবুয়ের দুইজন করে; নাইজেরিয়া, নরওয়ে, রোমানিয়া ও ইয়েমেনের তিনজন করে; মালি, পোল্যান্ড, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস ও ইউক্রেনের চারজন করে; ভিয়েতনাম ও মঙ্গোলিয়ার পাচঁজন করে; তাইওয়ান, পর্তুগাল ও উগান্ডার ছয়জন করে; মিয়ানমার, তানজানিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের আটজন করে; সৌদি আরবের ১০ জন; স্পেনের ১১ জন; নিউজিল্যান্ডের ১২জন; মালদ্বীপ ও দক্ষিণ আফ্রিকার ১৩ জন; তুরস্কের ১৫ জন; সোমালিয়ার ১৬ জন; সিঙ্গাপুরের ১৭ জন; নেপালের ২২ জন; সুইজারল্যান্ডের ২৩ জন; থাইল্যান্ডের ২৬ জন; শ্রীলঙ্কার ৫৭ জন; সুইডেনের ৫৯ জন; রাশিয়ার ৬৫ জন; মালয়েশিয়ার ৭৬ জন এবং পাকিস্তানের ১১৯ জন ব্যক্তি দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে বাংলাদেশে বসবাস করছেন।
বাংলাদেশের সাবেক অন্তত ১৪ জন এমপি-মন্ত্রীর তথ্য জানা যায়, যাঁরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব রেখেও অন্য দেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়েছেন। কিন্তু এই অবৈধ নাগরিকত্ব নেওয়ার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে বড় কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানা যায়নি। অন্যদিকে বৈধভাবে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাসহ এমন অনেক দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়া লোক রয়েছেন, যাঁদের ব্যাপারে আইনগতভাবে কোনো বাধা না হওয়ার পরও তাঁরা সরকারের পক্ষ থেকে নানান বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। অনেকের বিদেশ গমনে আপত্তি দিয়ে রাখা হয়েছে। এমন বৈপরিত্যের মধ্যেও দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়ার প্রবণতা কমছে না।
জানা যায়, সরকারের সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের যাঁরা অবৈধভাবে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়েছেন, তাঁদের ধরতে অনুসন্ধান শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাঁদের খুঁজে বের করার জন্য দুদক সম্প্রতি চিঠি পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিদেশে থাকা বাংলাদেশি মিশনে এসব তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। এরই মধ্যে ২৪ জন মন্ত্রী-এমপির বিদেশি নাগরিকত্ব থাকার প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করলে বকু বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করলে তিনি সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী হতে পারেন না। কিন্তু এই আইন ভঙ্গ করে এ দেশের সাবেক অনেক মন্ত্রী-এমপি, সরকারি কর্মকর্তা অন্য দেশের নাগরিক হয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে। তাঁদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সাইপ্রাসের নাগরিকত্বের প্রমাণ পেয়েছে দুদুক। সাবেক তথ্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদ বেলজিয়ামের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, নসরুল হামিদ, জুনাইদ আহমেদ পলক, আব্দুস শহীদ, মানিকগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন মাহমুদ জাহিদ যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব নিয়েছেন তাজুল ইসলাম, আ হ ম মুস্তফা কামাল, সাইফুজ্জামান চৌধুরী, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও মো. মাহবুব আলী। কানাডার নাগরিক হয়েছেন সাবেক মন্ত্রী ও এমপি আবদুর রহমান, মাহবুবউল আলম হানিফ, আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী (নাসিম), শামীম ওসমান, শফিকুল ইসলাম (শিমুল) ও হাবিব হাসান। সুইজারল্যান্ডের নাগরিকত্ব নিয়েছেন সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। সাবেক রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম জাপানের, সাবেক এমপি তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনির জার্মানির ও ময়মনসিংহের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ ওয়াহেদের পাপুয়া নিউগিনির নাগরিকত্ব রয়েছে।
জানা গেছে, সালমান এফ রহমান টাকার জোরে গোপনে সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব নেন। একইভাবে বেলজিয়ামের নাগরিকত্ব নেন হাছান মাহমুদ। সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও জুনাইদ আহমেদ পলকের যুক্তরাষ্ট্রে ‘গ্রিন কার্ড’ রয়েছে। জানা গেছে, নাটোরের সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল কানাডায় ১৭ লাখের বেশি কানাডিয়ান ডলার খরচ করে বাড়ি কিনেছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, নাগরিকত্ব আইনে বলা হয়েছে, কোনো বাংলাদেশি যদি বিদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন, তাহলে তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চলমান রাখতে পারবেন। তিনি বলেন, আগে থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ৫৭টি দেশের নাগরিকত্ব নেওয়া যেত। ২০২৩ সালে আফ্রিকা মহাদেশের ১৯টি, আমেরিকা মহাদেশের ১২টি, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ১২টি এবং ওশেনিয়া মহাদেশের একটি দেশকে যুক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেশী ভারত, নেপাল ও আফগানিস্তানে অবশ্য দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়ে পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অর্থাৎ এসব দেশ তাদের নাগরিকদের অন্য দেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়ার কোনো সুযোগ রাখেনি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) এম হাফিজউদ্দিন খান এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, যাঁরা টাকা পাচার করেন, তাঁরা বেশ প্রভাবশালী। আইন তাঁদের স্পর্শ করতে পারে না। কানাডায় পাচার করা টাকায় ‘বেগমপাড়া’ হয়েছে। সেখানে তাঁদের স্ত্রী-সন্তানেরা বিলাসী জীবন যাপন করেন। অথচ কানাডায় তাঁদের কোনো আয় নেই। তাঁদের বিলাসী জীবনের টাকা কোথা থেকে আসে, এই প্রশ্নের উত্তর আমরা সবাই জানি। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। তাঁর মতে, বিদেশে থাকা সম্পদ ও আয় এ দেশে দেখানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। প্রয়োজনে আইন সংস্কার করা দরকার।