ঢাকা ০৫:৪৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫

ধর্ষণ-নির্যাতনে বেড়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা

বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট সময় : ১২:৫৫:১৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫ ৩ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

অধিক মাত্রায় নারী নির্যাতন, ধর্ষণ-নিপীড়নের ঘটনায় সমাজে বেড়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। আকষ্মিক ভাবে ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সরকার তথা আইন শৃংখলা বাহিনীর ভিতরেও হয়েছে। এধরনের ন্যাক্কারজনক কাজ রোধ কল্পে সরকার হার্ড লাইনে রয়েছে।

জানা গেছে, সম্প্রতি মাগুরায় আট বছরের শিশু ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার ঘটনার পর শিক্ষার্থীসহ নাগরিক সমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারপরও বাড়ছে ধর্ষণ-নিপীড়নের ঘটনা। নির্যাতক ও ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ-সমাবেশ ও মানববন্ধন চলছে।

এদিকে গতকালও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধর্ষণ-নিপীড়নের বেশ কয়েকটি ঘটনা সম্পর্কে তথ্য জানা গেছে। এর মধ্যে রাজধানীর গুলশান, বারিধারা এলাকায় ১০ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত সজল হোসেন পলাশকে (৪০) স্থানীয়রা আটক করে গুলশান থানার পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে। ঢাকার বাইরেও গতকাল মাগুরা, কক্সবাজার, হবিগঞ্জ ও পঞ্চগড় জেলায় ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া যায়। পাশাপাশি গতকালও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ-নিপীড়নবিরোধী প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। ঢাকার বাইরে কুমিল্লায় ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সর্বোচ্চ ১৫ দিনের মধ্যে ধর্ষকের বিচারকাজ সম্পন্ন করার দাবিসহ তিন দফা দাবিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), শেরপুর, নাটোর, বাগেরহাট ও কুড়িগ্রামসহ আরও একাধিক জেলায় প্রতিবাদ-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এবিষয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেছেন, পরিস্থিতির উন্নতি বা সমাধানের অন্যতম পথ হচ্ছে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। তিনি বলেন, ধর্ষণ-নিপীড়ন আগেও ছিল, সবসময়ই ঘটেছে। তবে আকস্মিকভাবে বা মাঝেমধ্যে এই জাতীয় ঘটনা উদ্বেগজনকহারে বেড়ে যায়। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা এবং বিচারহীনতার কারনে এ সকল ঘটনা বেড়ে চলেছে। তিনি বলেন, সমাজে শাস্তির বিষয়টি দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা গেলে ধর্ষণ-নিপীড়নের ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে। তা ছাড়া ধর্ষণের ঘটনাগুলোর তদন্ত চাইলেই দ্রুত তদন্ত শেষ করা যায়। তেমনি বিচারও স্বল্প সময়ে শেষ করতে হবে। এ সবের জন্য প্রচুর রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গত জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ৩৯ জন নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার হন। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন তিনজন। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৬টি। এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ১৬টি। এর বাইরেও আরও অন্তত আটজন ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন। এদিকে যৌন হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১৯ জন। এর মধ্যে একজন আত্মহত্যা করেন। বাকি সবগুলো বখাটেদের দ্বারা যৌন হয়রানির ঘটনা।

এছাড়া ফেব্রুয়ারিতে ৩৬টি শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। যার মধ্যে কয়েকজন ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যাকা-ের শিকার। এই মাসে আরও ৪৬ শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এ ছাড়া নারী নির্যাতনের মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে পারিবারিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৫ জন নারী। এর মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ১৩ নারী। আসকের তথ্য মতে, গত বছরে তথা ২০২৪ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৪০১ জন নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার হন। এর মধ্যে ‘গ্যাং রেপ’ বা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ১০৫ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৪ জনকে। অপরদিকে গত জানুয়ারিতে পারিবারিক ও সামাজিক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ৪০ জন নারী, যার মধ্যে খুনের শিকার হন ২১ জন। গত জানুয়ারিতে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৪ জন।

চলতি মার্চ মাসের গতকাল পর্যন্ত ধর্ষণ-নিপীড়নের কোনো জরিপ বা পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। যদিও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, চলতি মাসের গত দশ দিনে বিগত মাসগুলোর তুলনায় অনেক বেশি ধর্ষণ, নারী নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মুনতাসীর মারুফ বলেছেন, যৌন হয়রানি, নিপীড়ন-ধর্ষণের ঘটনাগুলো নতুন নয়, তবে সাম্প্রতিক সময়ে অনেকটা বেড়ে গেছে। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ- আমাদের সমাজে শিশুকন্যাদের মানসিক বিকাশের সময় তাদেরকে পারিবারিকভাবেই প্রথমে হেয় বা ছোট করে দেখা হয়। যেমন- ‘মেয়েরা তো দুর্বল, মেয়েদের সব সহ্য করে থাকতে হয়, মেয়েদের দিয়ে তো কিছু হয় না, মেয়েদের বুদ্ধি কম’ ইত্যাদি কথা ও দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে আগেই খাটো করে দেখা হয়। এ ছাড়াও বর্তমানে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। এবিষয়ে সমাজ ও অপরাধবিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘মানুষ বিবেকের দংশনে বা সামাজিক দায়বদ্ধতায় এই জাতীয় ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। কারণ অধিকাংশ পরিবারেই শিশুকন্যা, তরুণী বা নারী আছে, তাই প্রায় প্রত্যেক সচেতন-বিবেকবান নাগরিকের মনেই ওই সব ঘটনা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

ড. তৌহিদুল হক আরও বলেন, ‘ধর্ষণ-নিপীড়ন কম-বেশি হয় মূলত আইনের শাসনের ওপর ভিত্তি করে। এর বাইরেও সামাজিক ও পারিবারিক শাসন-নৈতিকতার অবক্ষয়সহ নানা কারণে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন বা নিপীড়নের মতো অপরাধ বাড়তে থাকে। এ জন্য দৃশ্যমান কঠোর শাস্তি প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং বিচার বিভাগের এখানে বড় ভূমিকা রয়েছে। পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা, ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করা গেলে ধর্ষণ, নিপীড়ন-নির্যাতনের ঘটনা অনেকটা কমে আসবে। এদিকে জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের প্রতিবাদ র‌্যালিপূর্ব বিক্ষোভ সমাবেশে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই মাগুরায় শিশু ধর্ষণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি জানিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপরাধ দমনের পাশাপাশি নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে। নারী ও শিশু নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে বাংলাদেশ পুলিশ অঙ্গীকারবদ্ধ। গত ৫ মার্চ মাগুরায় আট বছর বয়সী শিশু ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার প্রতিবাদে সারা দেশে শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। গত শনিবার মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ধর্ষণবিরোধী মঞ্চ গঠন করে প্রতিবাদ শুরু হয়। এরপর রবিবার ঢাবি, বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি), কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি), কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যলয় (বাকৃবি), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ (শাবিপ্রবি) দেশের আরও একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজ ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ধর্ষণ-নির্যাতনবিরোধী প্রতিবাদ-আন্দোলন করা হয়।

অপরদিকে নারী নির্যাতন, নারীর প্রতি আক্রমণাত্মক ভঙ্গি, কটূক্তি, ইভটিজিং, হেনস্তা, যৌন হয়রানি বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স হটলাইন সেবা চালু করেছে। দেশের যেকোনো স্থানে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে ওই হটলাইন নম্বরে অভিযোগ দেওয়া যাবে। ওই হটলাইন নম্বরগুলো হলো: ০১৩২০০০২০০১, ০১৩২০০০২০০২, ০১৩২০০০২২২২। এই নম্বরগুলো ২৪ ঘণ্টা চালু থাকছে।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ধর্ষণ-নির্যাতনে বেড়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা

আপডেট সময় : ১২:৫৫:১৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫

অধিক মাত্রায় নারী নির্যাতন, ধর্ষণ-নিপীড়নের ঘটনায় সমাজে বেড়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। আকষ্মিক ভাবে ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সরকার তথা আইন শৃংখলা বাহিনীর ভিতরেও হয়েছে। এধরনের ন্যাক্কারজনক কাজ রোধ কল্পে সরকার হার্ড লাইনে রয়েছে।

জানা গেছে, সম্প্রতি মাগুরায় আট বছরের শিশু ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার ঘটনার পর শিক্ষার্থীসহ নাগরিক সমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারপরও বাড়ছে ধর্ষণ-নিপীড়নের ঘটনা। নির্যাতক ও ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ-সমাবেশ ও মানববন্ধন চলছে।

এদিকে গতকালও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধর্ষণ-নিপীড়নের বেশ কয়েকটি ঘটনা সম্পর্কে তথ্য জানা গেছে। এর মধ্যে রাজধানীর গুলশান, বারিধারা এলাকায় ১০ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত সজল হোসেন পলাশকে (৪০) স্থানীয়রা আটক করে গুলশান থানার পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে। ঢাকার বাইরেও গতকাল মাগুরা, কক্সবাজার, হবিগঞ্জ ও পঞ্চগড় জেলায় ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া যায়। পাশাপাশি গতকালও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ-নিপীড়নবিরোধী প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। ঢাকার বাইরে কুমিল্লায় ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সর্বোচ্চ ১৫ দিনের মধ্যে ধর্ষকের বিচারকাজ সম্পন্ন করার দাবিসহ তিন দফা দাবিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), শেরপুর, নাটোর, বাগেরহাট ও কুড়িগ্রামসহ আরও একাধিক জেলায় প্রতিবাদ-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এবিষয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেছেন, পরিস্থিতির উন্নতি বা সমাধানের অন্যতম পথ হচ্ছে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। তিনি বলেন, ধর্ষণ-নিপীড়ন আগেও ছিল, সবসময়ই ঘটেছে। তবে আকস্মিকভাবে বা মাঝেমধ্যে এই জাতীয় ঘটনা উদ্বেগজনকহারে বেড়ে যায়। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা এবং বিচারহীনতার কারনে এ সকল ঘটনা বেড়ে চলেছে। তিনি বলেন, সমাজে শাস্তির বিষয়টি দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা গেলে ধর্ষণ-নিপীড়নের ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে। তা ছাড়া ধর্ষণের ঘটনাগুলোর তদন্ত চাইলেই দ্রুত তদন্ত শেষ করা যায়। তেমনি বিচারও স্বল্প সময়ে শেষ করতে হবে। এ সবের জন্য প্রচুর রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গত জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ৩৯ জন নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার হন। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন তিনজন। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৬টি। এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ১৬টি। এর বাইরেও আরও অন্তত আটজন ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন। এদিকে যৌন হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১৯ জন। এর মধ্যে একজন আত্মহত্যা করেন। বাকি সবগুলো বখাটেদের দ্বারা যৌন হয়রানির ঘটনা।

এছাড়া ফেব্রুয়ারিতে ৩৬টি শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। যার মধ্যে কয়েকজন ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যাকা-ের শিকার। এই মাসে আরও ৪৬ শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এ ছাড়া নারী নির্যাতনের মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে পারিবারিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৫ জন নারী। এর মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ১৩ নারী। আসকের তথ্য মতে, গত বছরে তথা ২০২৪ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৪০১ জন নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার হন। এর মধ্যে ‘গ্যাং রেপ’ বা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ১০৫ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৪ জনকে। অপরদিকে গত জানুয়ারিতে পারিবারিক ও সামাজিক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ৪০ জন নারী, যার মধ্যে খুনের শিকার হন ২১ জন। গত জানুয়ারিতে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৪ জন।

চলতি মার্চ মাসের গতকাল পর্যন্ত ধর্ষণ-নিপীড়নের কোনো জরিপ বা পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। যদিও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, চলতি মাসের গত দশ দিনে বিগত মাসগুলোর তুলনায় অনেক বেশি ধর্ষণ, নারী নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মুনতাসীর মারুফ বলেছেন, যৌন হয়রানি, নিপীড়ন-ধর্ষণের ঘটনাগুলো নতুন নয়, তবে সাম্প্রতিক সময়ে অনেকটা বেড়ে গেছে। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ- আমাদের সমাজে শিশুকন্যাদের মানসিক বিকাশের সময় তাদেরকে পারিবারিকভাবেই প্রথমে হেয় বা ছোট করে দেখা হয়। যেমন- ‘মেয়েরা তো দুর্বল, মেয়েদের সব সহ্য করে থাকতে হয়, মেয়েদের দিয়ে তো কিছু হয় না, মেয়েদের বুদ্ধি কম’ ইত্যাদি কথা ও দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে আগেই খাটো করে দেখা হয়। এ ছাড়াও বর্তমানে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। এবিষয়ে সমাজ ও অপরাধবিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘মানুষ বিবেকের দংশনে বা সামাজিক দায়বদ্ধতায় এই জাতীয় ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। কারণ অধিকাংশ পরিবারেই শিশুকন্যা, তরুণী বা নারী আছে, তাই প্রায় প্রত্যেক সচেতন-বিবেকবান নাগরিকের মনেই ওই সব ঘটনা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

ড. তৌহিদুল হক আরও বলেন, ‘ধর্ষণ-নিপীড়ন কম-বেশি হয় মূলত আইনের শাসনের ওপর ভিত্তি করে। এর বাইরেও সামাজিক ও পারিবারিক শাসন-নৈতিকতার অবক্ষয়সহ নানা কারণে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন বা নিপীড়নের মতো অপরাধ বাড়তে থাকে। এ জন্য দৃশ্যমান কঠোর শাস্তি প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং বিচার বিভাগের এখানে বড় ভূমিকা রয়েছে। পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা, ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করা গেলে ধর্ষণ, নিপীড়ন-নির্যাতনের ঘটনা অনেকটা কমে আসবে। এদিকে জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের প্রতিবাদ র‌্যালিপূর্ব বিক্ষোভ সমাবেশে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই মাগুরায় শিশু ধর্ষণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি জানিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপরাধ দমনের পাশাপাশি নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে। নারী ও শিশু নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে বাংলাদেশ পুলিশ অঙ্গীকারবদ্ধ। গত ৫ মার্চ মাগুরায় আট বছর বয়সী শিশু ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার প্রতিবাদে সারা দেশে শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। গত শনিবার মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ধর্ষণবিরোধী মঞ্চ গঠন করে প্রতিবাদ শুরু হয়। এরপর রবিবার ঢাবি, বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি), কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি), কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যলয় (বাকৃবি), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ (শাবিপ্রবি) দেশের আরও একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজ ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ধর্ষণ-নির্যাতনবিরোধী প্রতিবাদ-আন্দোলন করা হয়।

অপরদিকে নারী নির্যাতন, নারীর প্রতি আক্রমণাত্মক ভঙ্গি, কটূক্তি, ইভটিজিং, হেনস্তা, যৌন হয়রানি বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স হটলাইন সেবা চালু করেছে। দেশের যেকোনো স্থানে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে ওই হটলাইন নম্বরে অভিযোগ দেওয়া যাবে। ওই হটলাইন নম্বরগুলো হলো: ০১৩২০০০২০০১, ০১৩২০০০২০০২, ০১৩২০০০২২২২। এই নম্বরগুলো ২৪ ঘণ্টা চালু থাকছে।